রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নামে সুন্দরবন ধ্বংসের আয়োজন বন্ধের দাবিতে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার উদ্যোগে ১৬ – ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ‘ঢাকা – সুন্দরবন রোডমার্চ’ কর্মসূচি সম্পন্ন হয়েছে। ১৬ অক্টোবর ঢাকা শহরে উদ্বোধনী সমাবেশ ও মিছিল-এর মাধ্যমে শুরু করে গত ৩ দিনে রোডমার্চ প্রায় ৫০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। ৫ শতাধিক অংশগ্রহণকারীর সমন্বয়ে এই রোডমার্চ যাত্রাপথে মানিকগঞ্জ, গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী), মাগুরা, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা জেলায় জনসভা-মিছিল-গণসংযোগ করে আজ ১৮ অক্টোবর বিকাল সাড়ে ৫টায় সুন্দরবনের নিকটবর্তী বাগেরহাট জেলার কাটাখালি মোড়ে সমাবেশে মিলিত হয়েছে।
রোডমার্চে ফ্যাসিষ্ট মহাজোট সরকারের নির্দেশে তার আজ্ঞাবহ পুলিশ পথে পথে বাধাঁ দিয়েছে, নেতা-কর্মীদের হামলা করেছে। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে যাত্রা শুরুর প্রথম দিন মানিকগঞ্জে পৌঁছেই প্রথম দফা হামলার শিকার হয়। পুলিশ লাঠিপেটা করে, ব্যানার কেড়ে নিয়ে জনসভা করতে বাধা প্রদান করে। হামলায় আহত হন গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু সহ ২০-২৫ জন নেতা-কর্মী। গোয়ালন্দে পুলিশ গাড়ি থেকে নামতেই দেয়নি। মাগুরায় এসে নামার চেষ্টা করলে পুলিশ নির্বিচারে লাঠিচার্জ করে ব্যানার মাইক কেড়ে নেয়। এখানে আহত হয়ে হাসপাতালে যান বাম মোর্চার সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়র্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। ঝিনাইদহে প্রবেশমুখেই বাধা প্রদান করে । জোর করে গাড়ীবহর বাইপাস দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যশোরে নামতেই দেওয়া হয়নি। পুলিশী প্রহরায় খুলনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এমনকি পঞ্চাশজন নারী সহ পাঁচ শতাধিক রোডমার্চকারীদের নির্ধারিত স্থানে খাবার গ্রহণ, টয়লেট-বাথরুমে পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয়নি। রোডমার্চের গাড়ীবহরের সামনে পিছনে পুলিশী গাড়ীবহরের অবরোধ পুরো পথেই ছিল। এমনি এক অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। এই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঘটনা প্রমাণ করছে জনপ্রতিনিধিত্বহীন মহাজোট সরকারের ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। জনস্বার্থ ধ্বংসকারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করার এ আক্রমন সরকারের অগণতান্ত্রিক চরিত্র চূড়ান্তভাবে উন্মোচিত করল।
এই সমাপনী সমাবেশে প্রদত্ত ঘোষণায় গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য ও ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ সুন্দরবনের পাশে পরিবেশ দূষণকারী রামপাল ও ওরিয়ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প অবিলম্বে বাতিলের জন্য মহাজোট সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে, অন্যথায় দেশের জন্য আত্মঘাতী এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয় ঘোষণা করছে।
দেশের জনগণের মতামত ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগকে উপেক্ষা করে ভারতকে খুশী রাখতে প্রধানমন্ত্রী সুন্দরবন বিপন্নকারী রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়ে চলেছেন। তিনি একহাতে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরষ্কার নিচ্ছেন, অন্য হাতে সুন্দরবন তথা দক্ষিণাঞ্চলের প্রাণ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য বিপজ্জনক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। বিতর্কিত ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে একই ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি নতুন প্রকল্পের জন্য আরো জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব সম্প্রতি একনেক পাশ করেছে। শুধু তাই নয়, অদূরেই ওরিয়ন কোম্পানিকে ৬০০ মেগাওয়াটের আরেকটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য জমি দেয়া হয়েছে। সুন্দরবন থেকে সরকারি হিসাবে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা পোড়ানো হবে তা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, ছাই, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি আশেপাশের বায়ু, পানি, মাটিকে দূষিত করবে। এই দূষণ পানি ও বাতাসের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে সুন্দরবনকে বিপন্ন করবে। বিপুল পরিমাণ কয়লা বহনকারী জাহাজ আসা-যাওয়া করবে বনের ভেতর দিয়ে। গতবছর শ্যালা নদীতে একটি তেলবাহী জাহাজডুবিতে সুন্দরবনের বিপন্ন দশা আমরা দেখেছি। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন ও ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ সুন্দরবনের কয়লা দূষণে মৃত্যু হলে সারা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় দক্ষিণাঞ্চল তো বটেই, বাংলাদেশের বিরাট অংশ অরক্ষিত হয়ে পড়বে। আপনারা অবগত আছেন যে সিডর, আইলা, লবনাক্ততাসহ নানা কারনে দক্ষিণাঞ্চল বিপর্যস্ত। তার ওপর সুন্দরবনের অদূরে এসব বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হলে সুন্দরবনসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। ভারতীয় এনটিপিসি কোম্পানির সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তগুলোও অসম এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী, উৎপাদিত বিদ্যুতের দামও পড়বে বেশি।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র অপরিহার্য বলে দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু, বিদ্যুৎ উৎপাদনের বহু বিকল্প আছে, সুন্দরবনের কোন বিকল্প নেই। প্রকৃতপক্ষে, বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের নামে স্থাপিত ব্যয়বহুল রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্থলভাগ ও বঙ্গোপসাগরের গ্যাসব্লক অসম শর্তে বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দান, ফুলবাড়ি-বড়পুকুরিয়ার উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত অব্যাহত রাখা, কিংবা ভারতীয় বিনিয়োগে সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি সবকিছুই জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে মুনাফা ও লুটপাটের আয়োজনের অংশ। একই কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমা সত্ত্বেও দেশে দাম কমানো হচ্ছে না, বরং দফায় দফায় গ্যাস-বিদ্যুতের মল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। সরকারী বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহ মেরামত-সংস্কার করা ও সরকারী উদ্যোগে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন না করে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি, ভারতীয় কোম্পানি আদানি ও রিলায়েন্সের সাথে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করা হচ্ছে যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ও অন্যান্য বামপন্থী দল, দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গ-সংগঠনসমূহ রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। বহুল সমালোচিত এই প্রকল্প নিয়ে ইতিমধ্যে শুধু দেশে নয়, ইউনেস্কো-রামসারসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাও প্রশ্ন তুলেছে। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় কয়েকটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী ব্যাংক ইতিমধ্যে এতে অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। অথচ, সকল মহলের প্রতিবাদ সত্ত্বেও অনির্বাচিত মহাজোট সরকার স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় এই প্রকল্প অগ্রসর করছে। জনসাধারণের সংগঠিত আন্দোলনের চাপেই কেবলমাত্র সরকারকে তার অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য করা সম্ভব। সেই লক্ষ্যে আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা ১৬-১৮ অক্টোবর ঢাকা থেকে সুন্দরবন রোডমার্চের ডাক দিয়েছিল।
দেশ ও দেশের সম্পদ নিয়ে যা খুশি তাই করবার অধিকার কারো নেই। মুষ্টিমেয় লুটেরা গোষ্ঠির স্বেচ্ছাচারিতায় তাদের মুনাফার স্বার্থে বিশ্ব প্রাকৃতিক ঐতিহ্য সুন্দরবন যা মায়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কোটি কোটি মানুষকে আগলিয়ে রেখেছে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন ও অর্থনীতিকে সচল রেখেছে তাকে কোনোভাবেই বাম মোর্চা নষ্ট হতে দিতে পারে না। দক্ষিণাঞ্চলের প্রকৃতি পরিবেশ ও জীবন বিরোধী এই সর্বনাশা তৎপরতাকে দেশের মানুষ কোনোভাবেই বরদাস্ত করবে না। গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার পক্ষ থেকে আত্মঘাতি এবং বিপদজনক রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধে প্রতিরোধ জোরদার করতে দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়েছে।
কর্মসূচি:
২০ অক্টোবর: সরকারের নির্দেশে রোডমার্চ কর্মসূচীতে হামলা, লাঠিচার্জ ও বাধা প্রদানের প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ।
৫ নভেম্বর: দেশব্যাপী ‘সুন্দরবন সংহতি দিবস’ কর্মসূচি পালন।