সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বামপন্থীদের নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে তুলুন
ঢাকা সহ সারাদেশের জেলা উপজেলায় জনসভা, সমাবেশ, আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে পালিত হল বাসদ-এর ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ৯৬তম বার্ষিকী। জোট মহাজোটের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির বিপরীতে গণআন্দোলনের ধারায় বাম-বিকল্প গড়ে তোলার আহ্বান নিয়ে পালিত হল দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে গত ৮ নভেম্বর ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনা সভা ও শোভাযাত্রা, ১৪ নভেম্বর নোয়াখালী টাউনহলে আলোচনা সভা ও মিছিল, গাইবান্ধায় মিছিল ও শহীদ মিনারে জনসভা, ১৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম শহীদ মিনারে জনসভা ও মিছিল, নওগাঁ ব্রিজের মোড়ে সমাবেশ এবং রংপুর শহরের পায়রা চত্বরে জনসভা, ১৬ নভেম্বর ফেনী শহীদ মিনারে আলোচনা সভা ও মিছিল, খাগড়াছড়িতে মিছিল ও জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা : জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়কারী সাইফুল হক, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি জহিরুল ইসলাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি সাইফুজ্জামান সাকন, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক মর্জিনা খাতুন, বাসদ নেতা ফখরুদ্দিন কবির আতিক।
সভাপতির বক্তব্যে বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী বলেন, “দেশের মানুষকে জিম্মি করে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দল আজ সংঘাতে লিপ্ত। এতে মরছে সাধারণ মানুষ, ভুগছে সাধারণ মানুষ, কিন্তু এ সংঘাতে সাধারণ মানুষের কোনো স্বার্থ নেই – কে ক্ষমতায় যাবে, লুটপাট করবে তাই নিয়ে সংঘাত। আওয়ামী লীগ চাইছে তাদের অধীনে ও কর্তৃত্বে একতরফা নির্বাচন করে পুনর্বার ক্ষমতায় আসতে। কিন্তু এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে কোনোভাবেই একতরফা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না, দেশবাসী মেনে নেবে না। এ ধরনের নির্বাচন ন্যূনতম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেশকে ফ্যাসিবাদী শাসনের দিকে নিয়ে যাবে।”
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী বলেন, “বুর্জোয়া রাজনীতির এবং বুর্জোয়া ব্যবস্থার দেউলিয়াত্ব নগ্নভাবে উন্মোচিত। বুর্জোয়া দলগুলো কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না, জনগণও এদের কাউকে বিশ্বাস করে না। এরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের আয়োজন করতেও অক্ষম। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বুর্জোয়ারা সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদকে উসকে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ, দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।” তিনি বলেন, “বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচন কি অবাধ হয়? নিরপেক্ষ হয়? নির্বাচনে তো টাকার খেলা হয়। বুর্জোয়া শক্তিগুলো যেভাবে কালোটাকা, পেশীশক্তি, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করে, প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করে, তাতে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ অবাধ নির্বাচন হতে পারে না।” তিনি নির্বাচনে কালোটাকা-পেশীশক্তি-সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার বন্ধের দাবি জানান। তিনি বলেন, “এ অবস্থার পরিত্রাণের লক্ষ্যে বামপন্থীদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের শক্তি গড়ে তোলা আজ সময়ের দাবি। মহান সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আমাদের সামনে এ শিক্ষাই রেখে গেছে যে গণআন্দোলনের শক্তি গড়ে তোলা ছাড়া জনগণের, শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা এবং বুর্জোয়াদের মোকাবেলা করার শক্তি কিছুতেই গড়ে উঠতে পারে না।”
তিনি বলেন, “আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষা ছিল শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তা হয়নি। স্বাধীনতার পর থেকেই এদেশের শ্রমিক-কৃষক শ্রমজীবী মেহনতি জনগণ শোষণমুক্ত সমাজ কায়েম এবং মর্যাদাময় জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। মহান নভেম্বর বিপ্লবের চেতনাকে ধারণ করে, মুক্তিযুদ্ধের শোষণমুক্তির চেতনাকে ধারণ করে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং এ যুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার আলোকে ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর আমাদের দল গড়ে ওঠেছিল।”
আলোচনা সভার শুরুতে একটি মিছিল জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে দোয়েল চত্বর, পল্টন মোড়, গোলাপশাহ মাজার, গুলিস্তান হয়ে পুনরায় প্রেসক্লাবে এসে মিলিত হয়। অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। সমবেত কণ্ঠে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গাওয়ার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে।
চট্টগ্রাম : বাসদ চট্টগ্রাম জেলা শাখার উদ্যোগে ১৫ নভেম্বর বিকাল ৩টায় চট্টগ্রাম শহীদ মিনারে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। দলের চট্টগ্রাম জেলা শাখার আহ্বায়ক মানস নন্দীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য উজ্জ্বল রায়, চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সদস্য সচিব অপু দাশ গুপ্ত ও সিটি কর্পোরেশন কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস পপি। কমরেড মুবিনুল হায়দার বলেন, ‘সংকটের চোরাবালিতে নিমজ্জিত বুর্জোয়া গণতন্ত্রের যত সংস্কার সাধনের চেষ্টা করা হোক না কেন তা লোক দেখানো সাধু কথার ফুলঝুরিতে পর্যবসিত হতে বাধ্য। নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা ও গণতান্ত্রিক শক্তির বিকাশ বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। সামরিক শাসন, একদলীয় শাসন বা বহুদলীয় সংসদীয় শাসন Ñ যাই খাড়া হোক না কেন তা বাস্তবে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের হাতিয়ারে রূপ নিয়েছে। এবারো তার ব্যতিক্রম হবার কোনো লক্ষণ নেই।’ নেতৃবৃন্দ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানান ও অবিলম্বে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। সমাবেশের শুরুতে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গণসংগীত পরিবেশন করে। সমাবেশ শেষে শহীদ মিনার থেকে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি শুরু হয়ে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে নিউমার্কেটে এসে শেষ হয়।
নোয়াখালী : জেলা বাসদের উদ্যোগে ১৪ নভেম্বর সকালে নোয়াখালী জেলার টাউন হলে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং আলোচনা সভা শেষে শহরের রাজপথে বর্ণাঢ্য র্যালি প্রদক্ষিণ করে। পার্টির জেলা সদস্য সচিব দলিলুর রহমান দুলালের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন জেলা আহ্বায়ক অধ্যাপক মতিন উদ্দিন আহমেদ। বক্তব্য রাখেন বাসদ নোয়াখালী , তেল-গ্যাস জাতীয় কমিটির জেলা শাখার সভাপতি আ.ন.ম. জাহের উদ্দিন, তারকেশ¡র দেবনাথ নান্টু, ছাত্রনেতা বিটুল তালুকদার।
ফেনী : ১৬ নভেম্বর বিকেলে ফেনী শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন জসীম উদ্দিন। এতে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম জেলা বাসদ সমন্বয়ক কমরেড মানস নন্দী, ফখরুদ্দিন কবির আতিক, কৃষক ফ্রন্ট নেতা আব্দুস সালাম, অনুপম পাল।
রংপুর : ১৬ নভেম্বর বিকেল ৩টায় বাসদ রংপুর জেলা শাখার উদ্যোগে পায়রা চত্বরে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জেলা বাসদ সমন্বয়ক আনোয়ার হোসেন বাবলু’র সভাপতিত্বে জনসভায় প্রধান বক্তা ছিলেন কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী। আরো বক্তব্য রাখেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য আহসানুল হাবিব সাঈদ, মনজুর আলম মিঠু, পরিচালনা করেন পলাশ কান্তি নাগ।
কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী বলেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামাতসহ বুর্জোয়া দলগুলো গত ৪২ বছরে একদিকে দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত লুটপাটের ব্যবস্থা কায়েম করেছে। অন্যদিকে লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্রমাগত সংকুচিত করছে। তিনি বলেন, শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তদের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো ধারাবাহিকভাবে গণআন্দোলনের পরিপূরক সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার পথেই একে মোকাবেলা করতে হবে। বামপন্থিদের নেতৃত্বে দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনের পথেই জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির বিকশিত হবে, যা গণবিরোধী লুটেরা বুর্জোয়া দ্বি-দলীয় রাজনীতির বৃত্ত ভেঙ্গে দেশের অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটাবে। এই পথে শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের মধ্যে শক্ত অবস্থান গড়ে তোলা ছাড়া নির্বাচনেও বিকল্প হওয়া সম্ভব নয়। জনসভা শুরুর আগে একটি মিছিল লালবাগ থেকে শুরু হয়ে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
গাইবান্ধা : বাসদ গাইবান্ধা জেলা শাখার উদ্যোগে ১৪ নভেম্বর বিকেলে পৌর শহীদ মিনার চত্বরে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভার পূর্বে একটি বিশাল মিছিল শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। জেলা বাসদ আহবায়ক আহসানুল হাবীব সাঈদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তব্য রাখেন জেলা বাসদ সদস্য সচিব মঞ্জুর আলম মিঠু, কাজী আবু রাহেন শফিউল্যা, আমিনুল ইসলাম ও গিদারী ইউপি চেয়ারম্যান প্রভাষক গোলাম ছাদেক লেবু।
খাগড়াছড়ি : বাসদ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার উদ্যোগে একটি প্রচার মিছিল ও আলোচনা সভা। ১৬ নভেম্বর সকাল ১১টায় মিছিল শেষে স্থানীয় শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য উজ্জল রায়, বাসদ চট্টগ্রাম জেলার নেতা অপু দাশগুপ্ত, জেলা বাসদ আহ্বায়ক জাহেদ আহামেদ টুটুল ও সদস্য সচিব শাহাদাত হোসেন, পরিচালনা করেন কৃষ্টি চাকমা। সভায় বক্তারা নীতিহীন বুর্জোয়া রাজনীতির বিপরীতে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির নেতৃত্বে পাহাড় ও সমতলে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সমগ্র দেশবাসীর পাশাপাশি পার্বত্যবাসীকেও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান।