গত ২২ আগষ্ট সকালে তোপখানা রোডে নির্মল সেন মিলনায়তনে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীরা প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগ করতে বলে বাস্তবে উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এই রায়কে কেন্দ্র করে সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের মাননীয় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে সাক্ষাৎ, রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত সরকারে নীতি-নির্ধারকদের দৌড়ঝাপ এবং রায় ও পর্যবেক্ষণ পরিবর্তনে মাননীয় প্রধান বিচারপতি তথা উচ্চ আদালতের উপর বহুমুখী চাপ, হুমকি, অপবাদ ও চরিত্রহনের মাধ্যমে বলপ্রয়োগের এক অপরাজনীতির জমিন উর্বর করে তুলছে। বাস্তবে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরী করা হচ্ছে যাতে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন। এটা সরকার ও সরকারি দলের চরম অসহিষ্ণু, অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।
এটা অত্যন্ত পরিস্কার যে, অতীতের সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারও অপরাপর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মত বিচার বিভাগকেও তাদের আকাংখা পূরণের অনুগত প্রতিষ্ঠান হিসাবেই দেখতে চায়। এই সব চিন্তা ও তৎপরতার সাথে প্রকৃত প্রস্তাবে আইনের শাসনের কোন সম্পর্ক নেই।
আর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক রাষ্ট্রের লাভজনক পদে বহাল থেকে উচ্চ আদালতের এই রায় সম্পর্কে ধারাবাহিকভাবে যে বক্তব্য প্রদান করছেন তা তার ক্ষমতা ও এখতিয়ারের পরিপন্থী এবং গুরুতর আদালত অবমাননা। তার এই আচরণ প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি হিসাবে নৈতিক শৃঙ্খলারও পরিপন্থী। তিনি কার্যত সরকার ও সরকারি দলের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, গত ৩রা জুলাই আপিল বিভাগ কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেশের স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক এবং এই ঐতিহাসিক রায়ের মধ্যে দিয়ে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ ও পার্লামেন্টের হস্তক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার পক্ষে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাংখার প্রতিফলন ঘটেছে। যুগান্তকারী এই রায়ের মধ্য দিয়ে নির্বাহী বিভাগ ও জনসম্মতিহীন সংসদের অনভিপ্রেত প্রভাব ও অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্বের বাইরে বিচার বিভাগের স্বাধীন ও কার্যকরী ভূমিকার ক্ষেত্র প্রসারিত হল। এই রায়ের মধ্য দিয়ে সরকার ও তাদের বিনা ভোটে নির্বাচিত সংসদের রাজনৈতিক ও নৈতিক পরাজয় ঘটলেও এই রায় রাষ্ট্রের দুর্বল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাধীন বিকাশে শক্তি ও আস্থা যোগাবে।
সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় বা পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে সরকার বা সরকারি দলের যদি কোন ভিন্নমত বা আপত্তি থাকে তা জানানো অথবা ‘রিভিউ’ চাওয়ারও আইনত বিধিবিধান রয়েছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন বা আইনের শাসনের প্রতি যদি সরকারের নূন্যতম কোন অঙ্গীকার অবশিষ্ট থাকে তাহলে সরকার প্রথাগত আইনী পথেই তাদের বক্তব্য তুলে ধরতে পারতেন। তা না করে সরকার ও সরকারি দল, মন্ত্রীবর্গ, তাদের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ ও তাদের আইনজীবীরা যেভাবে এই রায়, রায়ের পর্যবেক্ষণ, উচ্চ আদালত, এমনকি মাননীয় প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আক্রমনাত্মক বক্তব্য ও তৎপরতা অব্যাহত রেখেছেন তা উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। তাদের বক্তব্য-বিবৃতি ইতিমধ্যে শিষ্টাচারেরও সকল সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাদের এমন তৎপরতা আদালত অবমাননার নজিরবিহীন সব উদাহরণও সৃষ্টি করছে। আইনসিদ্ধ পথে না হেঁটে যুদ্ধাংদেহী মনোভাব নিয়ে উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে তারা যেভাবে তোপ দাগছেন তা বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিচার ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাতের সামিল।
সংবাদ সম্মেলনে সরকার ও সরকারি দলকে বিচার বিভাগের অবশিষ্টাংশকে ধ্বংস করার এই আত্মঘাতি খেলা অনতিবিলম্বে বন্ধ করার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। একই সাথে প্রজাতন্ত্রের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বি হিসাবে দাঁড় না করিয়ে সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বাধীন কার্যকরী ভূমিকা নিশ্চিত করতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীলতার সাথে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেনবাম মোর্চার সমন্বয়ক বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতা বাসদ (মার্কসবাদী) এর শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আহ্বায়ক হামিদুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত সমন্বয়ক আবুল হাসান রুবেল, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় নেত্রী বহ্নিশিখা জামালী, মোর্চার কেন্দ্রীয় নেতা ফখরুদ্দীন কবীর আতিক, মীর মোফাজ্জল হোসেন মোশতাক, মমিনুর রহমান মমিন প্রমুখ।