Every relationship of domination, of exploitation, of oppression, is by definition violent, whether or not the violence is expressed by drastic means. In such a relationship, dominator and dominated alike are reduced to things- the former dehumanized by an excess of power, the latter by lack of it. :Paulo Freire
এক
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, শিক্ষা হচ্ছে অবয়ব, আর তার লাবণ্য হচ্ছে সংস্কৃতি। তাই একজন মানুষ যতবেশি শিক্ষিত হয়, ততবেশি সংস্কৃতিবান হয়। এজন্যই উচ্চতর শিক্ষা উচ্চতর সংস্কৃতি-মূল্যবোধের জন্ম দেয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি হওয়ার কথা ছিল। অথচ আজ দেখা যায়, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংস্কৃতি চর্চার চেয়ে, বিকৃতির পরিমাণই যেন বেশি। বিকৃতির চরম নিদর্শন বিশ্ববিদ্যালয়ে রাগিং। রাগিং-এ মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে কত শিক্ষার্থী যে নীরবে ক্যাম্পাস ছেড়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। অনেকে এমন লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে যে সারাজীবন তাকে ওই দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে ফেরে, ভয়াবহ মানসিক নির্যাতনে অনেকে মানসিক রোগের শিকার হয়েছে। এমনকি রাগিং-এ মৃত্যুবরণের ঘটনাও বিরল নয়।
সম্প্রতি উত্তরায় এক বেসরকারি মেডিকেল কলেজে সহপাঠীদের দ্বারা লাঞ্ছিত বা রাগিং-র শিকার হয়ে এক কাশ্মীরী ছাত্রী কলেজ ও দেশ ত্যাগ করেছে। রাগিং-এর ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সব প্রতিষ্ঠানকে ছাড়িয়ে গেছে। গত কয়েকদিন আগেও দুই শিক্ষার্থী রাগিং-র ভয়াবহ মানসিক নির্যাতনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থী পত্রিকায় বলেছেন, তিনি যখন হলে ওঠেন তখন তাকেসহ ৫ জনকে একটি রুমে ডেকে নেয়া হয়। রাত তখন বাজে ২টা। এর মধ্যে রুমে নিয়েই অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু হয়। বাবা-মায়ের নামে গালি দিলে তিনি এর প্রতিবাদ করেন। এর শাস্তিস্বরূপ তাকে বাকি রাতটা একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। আর অপর ৪ জনকে বিবস্ত্র করে ক্যাটওয়াক করানো হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগও জানিয়েছেন। একের পর এক অভিযোগ এবং ঘটনা ঘটার পরও প্রশাসনের তরফ থেকে কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ফলে এরকম ঘটনা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় শিক্ষার্থীরা উন্নত রুচি-সংস্কৃতি চর্চার বদলে এরকম বিকৃতি নিয়ে গড়ে উঠছে কেন? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের আরেকটু গভীরে খতিয়ে দেখা দরকার।
আমাদের সমাজ একটি বৈষম্যমূলক সমাজ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও বৈষম্যমূলক। একটি বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপজাত হিসেবে আধিপত্যবাদের জন্ম হয়। বৈষম্য আছে মানে সমাজের এক শ্রেণী আরেক শ্রেণীর উপর কর্তৃত্ব কায়েমের চেষ্টা করবে। এই চেষ্টা শারীরিক, মানসিক দুই ক্ষেত্রেই হতে পারে। আবার সমাজ অভ্যন্তরে একই শ্রেণীর মধ্যেও শক্তির তারতম্যের ভিত্তিতে আধিপত্য তৈরির চেষ্টা চলে। আমাদের দেশ ও সমাজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অন্তর্গত। পুঁজিবাদ যেহেতু একটি শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, জোর-জবরদস্তির শাসন, বেশিরভাগ মানুষের অধিকারকে মুষ্টিমেয় মানুষের কেড়ে নেয়ার বিধান, এখানে প্রতিমূহুর্তে আধিপত্য-দমন-পীড়নের পরিবেশ তৈরি হয়েই থাকে। কিন্তু তারপরও বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ ব্যবস্থাটিকে পাল্টাতে পারে না কেন? এখানেই সংস্কৃতির প্রশ্নটি যুক্ত। শোষকের আধিপত্যের সংস্কৃতি ছড়িয়ে আছে সমাজের স্তরে স্তরে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এমন মনোভাব হর-হামেশাই দেখা যায়। অর্থ আর পেশিশক্তির কাছে যেন নত হয়েছে অন্য সবকিছু। তাই অন্যায় আধিপত্য দেখলেও কখনো মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়, কখনো বা তাকেই ভবিতব্য মেনে অনুসরণ করে। সুযোগ পেলে অপেক্ষাকৃত দুর্বলের উপর সেই কর্তৃত্ব খাটানোর চেষ্টা চলে। তাই সমাজ জুড়ে দেখব নারীদের উপর পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য, সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগরিষ্ঠের কর্তৃত্ব। পারস্পরিক এই মনোভাব থাকলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যায় না। তাই এত অন্যায়-জুলুমের পরও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের শক্তি খুব দুর্বল। একটি শোষণমূলক ব্যবস্থা টিকে থাকার এটিও অন্যতম শর্ত। সমাজ আমাদের আগে নিজেরটা দেখার কথা শেখাচ্ছে, বলছে ‘খাও দাও স্ফূর্তি কর’। সমাজের একদম উপর থেকে নিচ তলা পর্যন্ত এই ভোগবাদী সংস্কৃতি আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
সমাজ অভ্যন্তরে বয়ে চলা এই মনোভাব বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও যে থাকবে তাতে আর আশ্চর্য হবার কি আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যদি আমরা তাকাই দেখতে পাব সেখানে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বিরাজ করছে আধিপত্য, ক্ষমতাবাজি আর ভোগের সংস্কৃতি। জ্ঞানচর্চার জন্য যে ন্যূনতম সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রয়োজন তার ছিঁটেফোঁটাও বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেও সমাাজিক স্বার্থে আমরা পরান্মুখ। সামগ্রিক এই বাস্তবতার সাথে রাগিং, রাগিং সংস্কৃতির বিষয়গুলো যুক্ত।
রাগিং-এর সংজ্ঞা উইকিপিডিয়ায় বলা আছে, “Ragging is a practice similar to hazing in educational institutions. The word is mainly used in India, Pakistan, Bangladesh and Sri Lanka. Ragging involves existing students baiting or bullying new students. It often takes a malignant form wherein the newcomers may be subjected to psychological or physical torture.”
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত রাগিং চালু আছে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানোর মধ্য দিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপনের একটি প্রক্রিয়া হিসেবে। এই প্রক্রিয়ায় কি ধরনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাতে আদৌ কোনো সুস্থতা থাকে কিনা সে ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। ব্যাপারটা এখন এমন হয়েছে যে ক্যাম্পাসে সিনিয়র হলে একটু আধটু শারীরিক-মানসিক নির্যাতন চালাতে পারবেন, কখনো ইচ্ছেমত ও যা খুশি তা করে ‘মজা নিতে পারবেন’। বিশ্ববিদ্যালয়কে দখল করে নিরঙ্কুশ আধিপত্য কায়েমের অন্যতম অস্ত্র হিসেবেওরাগিং সংস্কৃতিকে ব্যবহার করা হয়। নোংরামি ও অশ্লীলতার চূড়ান্ত ব্যবহারের সাথে সাথে নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে প্রথম বর্ষ থেকেই একজন শিক্ষার্থীকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির দাসে পরিণত করা হয়।
অনেকে রাগিং-কে ইতিবাচক দিক থেকেও দেখতে চান। যুক্তি করেন নতুন শিক্ষার্থীদের সামজিকীকরণে সহায়তা করা, ক্যাম্পাসের পরিবেশ সম্পর্কে অবহিত করার জন্য এমনটি করা হয়। কেউ এভাবে ক্যাম্পাসে আসা নতুন শিক্ষার্থীর সাথে যুক্ত হলে সমস্যার কিছু থাকে না। কিন্তু সহযোগিতা, সামাজিক করার মানে যদি হয় তাকে নানাভাবে অপমান করা, সতীর্থ বা ক্যাম্পাসের অন্যদের (ক্যাম্পাসের বড় ভাই, বোন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী) অপমান করতে শেখানো বা নীরবে অপমানিত হতে শেখানো— তাহলে তার একটা ভয়াবহ সামাজিক কুপ্রভাব থেকে যায়। এর ফলে সাধারণভাবে পরিবার থেকে পেয়ে আসা নৈতিক-মানবিক মূল্যবোধগুলোও ধ্বংস হয়ে যায়। আত্মমর্যাদা-রুচি হারিয়ে একজন ব্যক্তিত্বহীন মানুষে পরিণত হবার সম্ভবনা থাকে। ফলত সমস্ত ধরনের সামাজিক ও নৈতিক প্রশ্নকে অস্বীকার করে বা সুবিধামত স্বীকার করে চলতে পারার এক ধরনের মনোভাব শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড়ে উঠে।
দুই
মার্কস বলেছেন, মানুষে মানুষে সম্পর্ক মানে ‘প্রোডাকশন রিলেশন’ (উৎপাদন সম্পর্ক)। ‘প্রোডাকশন’ বলতে তিনি ‘স্পিরিচুয়াল প্রোডাকশন’ (ভাবগত উৎপাদন) এবং ‘মেটিরিয়াল প্রোডাকশন’ (বস্তুগত উৎপাদন)— দুটোই বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ, এই যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, মূল্যবোধ, শিক্ষা ব্যবস্থা এগুলো সবই ভাবগত উৎপাদন। আর বস্তুগত উৎপাদন হচ্ছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে যে উৎপাদন হয় এবং আমরা যা ভোগ করি। সাথে মার্কস এটিই বলেছেন, এই বস্তুগত উৎপাদনকে যে শ্রেণী নিয়ন্ত্রণ করে, ভাবগত উৎপাদনকে তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং সমাজের বস্তুগত উৎপাদনটা যে শ্রেণীর হাতে, যার নিয়ন্ত্রণে, যার আধিপত্যে— সমাজে ভাবগত উৎপাদন, অর্থাৎ সমাজের গোটা মানসিকতাকেও তারাই মূলত প্রভাবিত করে।
আমাদের দেশে বস্তুগতভাবে বা অর্থনৈতিকভাবে যারা শক্তিশালী তাদের অর্থের উৎস কোথায় আমরা জানি। দুর্নীতি-লুটপাট আর রাষ্ট্রীয় শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এদেশে একেকজন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। দেশের পুরো অর্থনীতির একটা বিশাল অংশ কালো টাকা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উচ্চডিগ্রি নিয়ে একজন শিক্ষক যা আয় করেন তার থেকে বহুগুণ আয় করেন একজন ব্যবসায়ী। সামরিক-বেসামরিক আমলা বা সরকারী নেতার জন্য কোটি টাকার বাড়ী নির্মাণ হবার ঘটনা অহরহ। নদী-বন-লেক-খোলা অঞ্চল কোনোটিই ক্ষমতাসীনদের দখলের বাকী নেই। এমন দুর্বৃত্তপনা করেই আজকে এরা অঢেল বিত্ত- বৈভবের মালিক হয়েছে।
সমাজের উপর তলার এই অবস্থা প্রভাবিত করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীদেরও। ক্ষমতা দেখিয়ে আয় উপার্জনের এই প্রবণতা যে অর্থনীতিতে প্রধান, সেখানে ক্ষমতার সহযোগী সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিতে লিপ্ত থাকবে এমনটাই তো স্বাভাবিক। সরকার কিংবা কোটিপতিদের সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলয় তাদেরকেই পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করবে সেটাও তাই খুব বিস্ময়কর নয়। এরা শিক্ষিত এবং মেধাবী। তাই ক্ষমতাসীনদের অন্যায় শাসন-শোষণের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। সরকার এবং ক্ষমতাসীনরা তাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ঝঁঢ়ঢ়ষু পযধরহ-এর মতো শিক্ষার্থীদের ঃধৎমবঃ করে। শিক্ষার্থীদের এমনভাবে গড়ে তোলার আয়োজন করা হয় যেন অন্যায়ের প্রতি প্রতিবাদ করা, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার ন্যূনতম বোধগুলোও তার নষ্ট হয়ে যায়। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাই আজ মাদক-পর্নোগ্রাফির অভয়ারণ্য। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। বন্ধু হয়েও বন্ধুর গলায় ছুরি চালানো, গুলি করা, পিটিয়ে হত্যা করার মতো নৃশংস-হিংসাত্মক ঘটনাগুলো ঘটছে প্রতিনিয়ত। র্যাগিং সংস্কৃতি এক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে মাত্র।
লুটপাটের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে এমন উগ্র-ভোগবাদী সাংস্কৃতিক পরিবেশই শাসকদের প্রয়োজন। রাষ্ট্র যখন ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করে, তখন তার সবচেয়ে বড় ভয় থাকে শোষিত-নির্যাতিত মানুষের সংগঠিত অবস্থান। তাই মানুষকে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন করে, ভোগবাদিতায় আচ্ছন্ন রাখতে পারলে শাসনকাল দীর্ঘ করা সম্ভব হয়। শাসকদের সবচেয়ে বেশি ভয় থাকে সমাজের শিক্ষিত মানুষদের ব্যাপারে। কেননা তারাই প্রথমে মিথ্যাচারগুলো ধরতে পারে। তাই তাদের উপর আক্রমণটাও থাকে সবচেয়ে বেশি। এ প্রসঙ্গে এ যুগের একজন বিশিষ্ট মার্কসবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, “মনে রাখবেন, একটা জাতি খেতে না পেলেও উঠে দাঁড়ায়, না খেতে পেলেও সে লড়ে যদি মনুষ্যত্ব থাকে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠলে মানুষ বলতে দেশে আর বিশেষ কেউ থাকবে না। কারণ মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সে বাধা সৃষ্টি করে।” তাই আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রশাসন বা সরকারের তরফ থেকে এমন কোনো উদ্যোগ দেখবো না যাতে একজন শিক্ষার্থী নৈতিক-সামাজিকভাবে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। সবক্ষেত্রেই ভোগবিলাস আর গড্ডালিকায় গা ভাসিয়ে দেয়ার আয়োজন। সুস্থ ধারার সংস্কৃতির চর্চা হয় না, বরং প্রশাসনের মদতে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে এমন সব আয়োজন থাকে যা অনেকক্ষেত্রেই স্থুল, যৌন উদ্দীপক। উন্নত রুচি-সংস্কৃতির আধারে নয় বরং শেখানো হচ্ছে ‘যেভাবেই হোক ভোগ কর’। রাগিং বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অবনমন বা বিকৃতিকে আমাদের এই আলোকেই বুঝতে হবে।
তিন
সমাজে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এইরূপ পরিবেশ দেখে অনেকে নির্লিপ্ত-উদাসীন থেকে কোনোরকমে বাঁচার পথ খুঁজছেন। অনেকে উপায়হীন হয়ে হতাশ হয়ে পড়ছেন। চারিদিকে যেন এক ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। সন্ত্রাস, আতঙ্ক, জবরদস্তি ও স্বেচ্ছাচারিতা এই সংস্কৃতির উপাদান। আমাদের পরিবেশের দিকে তাকালে তার স্বরূপ বোঝা যাবে। যে হারে আইন-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা বেড়েছে, যে হারে গুম/রহস্যজনক অন্তর্ধান হচ্ছে, স্বাভাবিক মৃত্যু যেখানে অস্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে, পিটিয়ে মারা যেভাবে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে এবং তা নিয়ে সমাজে যে কোনো উদ্বেগ নেই, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের জন্য যেভাবে প্রকাশ্যে হত্যাকা- ঘটছে— তাতে মানুষের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সবসময় আশঙ্কায় থাকা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। যারা আধিপত্য চালাচ্ছে, তারা যেমন দুর্বলের উপর সমাজে প্রবাহিত নানা বিকৃত আকাক্সক্ষাগুলো চরিতার্থ করছে, তেমনি যারা অত্যাচারিত হচ্ছে তারা আরও ন্যূব্জ হয়ে অন্ধকারে মুখ লুকাচ্ছে। একদিকে র্যাগিংসহ নানা আধিপত্যকামী কর্মকা- ও অন্যদিকে মানুষের চুড়ান্ত নিস্পৃহতা — এই অবরুদ্ধ পরিবেশের দুইটি বিপরীত ফলাফল। এর ফলে সুকোমল বৃত্তিগুলো নষ্ট হচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে নানা বিকৃতির। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সেই দুর্বলমনা মানুষগুলোও অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের উপর কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে। এ যেন এক অন্তহীন প্রক্রিয়া।
এই হতাশাজনক পরিস্থিতি কাটবে কিভাবে? এক্ষেত্রে অল্প হলেও আমাদের সামনে কিছু অভিজ্ঞতা আছে। রাগিংসহ শিক্ষার্থী নিপীড়নের নানা ঘটনায় সারাদেশে যখনই ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছে তখনই সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি, এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে — বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এর সাথে সাথে আমাদের সন্ধান করতে হবে নতুন আদর্শের। সমাজ বাস্তবতার অধঃগতি তথা সাংস্কৃতিক চূড়ান্ত নিম্নমান দেখে যেমনটি কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, ‘পুরনো ধর্মীয় মূল্যবোধের আবেদন অনেক আগেই নিঃশেষিত হয়ে গেছে এবং বুর্জোয়া মানবতাবাদী মূল্যবোধও আজ প্রায় নিঃশেষিত। অথচ, সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী মতাদর্শ ও নতুন মূল্যবোধ দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ও সমাজজীবনে আজও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করতে না পারার ফলে আদর্শ ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলেই দেশের নৈতিকতার ক্ষেত্রে এই সর্বাত্মক সংকট।’ তাই আজ আমাদের অতীত দিনের সমস্ত বড় গণ-আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মানুষের মুক্তি সংগ্রামে, সমাজ প্রগতিতে যে বড় মানুষরা ভূমিকা রেখেছেন সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, চিত্রকলা, ইতিহাসসহ নানা ক্ষেত্রে, তাঁদের জীবন ও কর্মকে সামনে তুলে ধরতে হবে। বিগত দিনের সমাজের স্বার্থে-মানুষের কল্যাণে সমস্ত উন্নত সৃষ্টির নিরন্তর চর্চার মাধ্যমে উদ্বোধন ঘটবে আজকের দিনের নতুন মূল্যবোধ। সেজন্য প্রয়োজন জোরদার সাংস্কৃতিক আন্দোলন। তবে এ আন্দোলন একটি বৈষম্যহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার নিরন্তর সংগ্রাম থেকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন নয়।
তথ্যসূত্র :
১. ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও আমাদের কর্তব্য- শিবদাস ঘোষ
২. ফ্যাসিবাদ ও বাম-গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নৈতিকতার সংকট- শিবদাস ঘোষ
৩. ভয়ের সংস্কৃতি- আলী রিয়াজ
৪. Paulo Freire: Education: The Practice of Freedom, ১৯৭৩