মহান নভেম্বর বিপ্লব প্রমাণ করেছে অজ্ঞ, নিরন্ন মজুর-চাষির সংঘবদ্ধ শক্তি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রকে উচ্ছেদ করতে পারে
— কমরেড শিবদাস ঘোষ
… নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের বহু শিক্ষা রয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, আন্দোলনের মূল রাজনৈতিক লাইন সঠিক না হলে হাজার লড়ালড়ির মধ্যেও যেমন অতীতে হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতেও শোষিত মানুষের মুক্তি আন্দোলনগুলি বারবার ব্যর্থ হবে। যাঁরা বলেন, বিপ্লবের শক্তি এদেশে নেই, বিপ্লব করবার মনপ্রাণ বা তেজ এদেশে নেই, এদেশের যুবকরা প্রাণ দিতে জানে না, লড়তে জানে না, এদেশের চাষি-মজুর লড়তে এবং লড়াইয়ে সর্বস্ব দিতে জানে না—তাঁরা ইতিহাসকে অস্বীকার করেন। একথা সত্য নয়। এদেশের চাষি-মজুর, খেটে খাওয়া মানুষ, অগণিত মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা এবং যুবকরা বারবার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ‘অত্যাচারীর বিরুদ্ধে লড়তে হবে, বিপ্লব করতে হবে’ — শুধু এই স্লোগানটা কেউ যদি তুলে দিতে পেরেছে সময়মতো এবং তাদের শক্তি থেকেছে খানিকটা এই সমস্ত কর্মকান্ড গড়ে তোলবার, তাহলে বারবার দেশে দেখেছি লড়াইয়ের বন্যা এসেছে। শুধু ‘বিপ্লব করতে হবে’ — এই একটা কাল্পনিক ধারণাকে নিয়ে, শুধু এইটুকুকে সম্বল করে যুবকরা বারবার ময়দানে এসেছে, প্রাণ দিয়েছে, লড়েছে। কী বিপ্লব, কোথায় বিপ্লব, কীভাবে হবে, কার নেতৃত্বে হবে, রাস্তা কী — এতসব কিছু নিয়ে তারা মাথাই ঘামায়নি।
কাজেই লড়তে চায় না আমাদের দেশের ছেলেরা, লড়তে চায় না চাষি-মজুররা — তারা রাশিয়ার শ্রমিকদের মতো, চীনের শ্রমিক-চাষির মতো, ভিয়েতনামের চাষিদের মতো লড়াকু নয়, মরণপণ করে তারা বিপ্লব করতে পারে না, কেউ যদি তাদের জন্য ফাঁকিতে বিপ্লব করে দেয় তাহলে তারা বিপ্লবটা চায়, নাহলে তারা স্বভাবতই শান্তিপ্রিয়, তারা এত ঝঞ্ঝাট এবং লড়াই করতে চায় না — এসব কথাও ঠিক নয়। আসল গন্ডগোল হচ্ছে অন্য জায়গায়। আসল গ-গোলটা হচ্ছে তারা পথ পায়নি, তাদের রাস্তা ঠিক হয়নি। আর রাস্তা যদি ঠিক না হয় — আন্দোলনের কলাকৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রে, আন্দোলনের লক্ষ্য স্থির করার ব্যাপারে, বিপ্লবের স্তর নির্ণয়ের ক্ষেত্রে যদি ধারণা সঠিক না থাকে — অর্থাৎ আন্দোলনের মূল রাজনৈতিক লাইন এবং উদ্দেশ্য যদি ভ্রান্ত হয় তাহলে লড়াই করবার যত তেজ এবং কোরবানি করবার যত শক্তিই মানুষের থাকুক, সমস্ত আত্মত্যাগ এবং কোরবানি বিফলে যায়। শুধু কি এই আত্মত্যাগ এবং কোরবানি তখনকারমতই বিফলে যায়? না, এই বিফলতাকে কেন্দ্র করে নিরাশা এবং হতাশা জনমনকে ছেয়ে ফেলে। লড়াই এবং আন্দোলন করা সম্পর্কেই তাদের মনে প্রশ্ন দেখা দেয়। তারা ভাবতে থাকে, ‘এই তো লড়লাম। এত প্রাণ দিলাম, এত ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করলাম। কিন্তু তাতে কী হল?’ বামপন্থী কর্মীদের প্রশ্ন করতে শুরু করে, ‘আন্দোলনে তো আমরা সমর্থন দিয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই তো হল না। এদেশে কিছু হবে না। ও আপনাদের সকলকে দেখা গেছে, আপনারা সব দল সমান। কোনও পার্টিকে দিয়ে কিছু হবে না।’ এইরকম সব মনোভাবনা আন্দোলনের বিফলতাকে কেন্দ্র করে তাদের মনকে ছেয়ে ফেলতে থাকে।
এমনকী এর দ্বারা একটা সাধারণ কথা পর্যন্ত তারা গোলমাল করে ফেলে — যেটা বর্তমানে খুব প্রবল। এবিষয়টা আমি একটু বলে নিতে চাই। তাদের কথায় আমি নাহয় ধরেই নিলাম যে, আমাদের কারওর দ্বারাই কিছু হবে না। কিন্তু হবে না বলে কী করবেন? আমাদের সকলকে দেখে নেওয়া হয়েছে বলে কি এইভাবেই তাদের জীবনযাপন করা চলবে? না, চলতে পারবে? পেট মানবে? জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, চাকরির স্থিরতা নেই, জমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, বেকার সমস্যা বাড়ছে, পরিবার ভাঙছে, সংসারে শান্তি নেই, স্নেহ-প্রীতি-মমতা সব উবে যাচ্ছে, চোখের সামনে ছেলেপিলেগুলো দিনের পর দিন অমানুষ হয়ে যাচ্ছে, নিজেরাও অমানুষ হয়ে যাচ্ছেন এবং তা যে যাচ্ছেন তাও তাঁরা নিজেরা টের পাচ্ছেন — তাহলে চলবে এভাবে? না, এভাবে বেশিদিন চলে না। তাই কী দেখা যায়?
মাঝে মাঝে তাদের সুপ্ত মনুষ্যত্ব জেগে ওঠে। আর মনুষ্যত্বে খেয়াল যদি কেউ নাও করে পেটের খেয়াল, দেহের খেয়াল তাদের করতেই হয়। কারণ পেট বড় বালাই। বুদ্ধি না থাকলে, রুচি-সংস্কৃতির পর্দা উঁচু না থাকলে মনুষ্যত্বের খেয়াল হয়তো অনেকেই করেন না। কিন্তু পেটের খেয়াল সকলকেই করতে হয়। ফলে মার খেয়ে আবার তাঁদের উঠে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে তখন আবার পাগলের মতন, না হয় বাচ্চা ছেলের মতন হাত পা ছোঁড়েন। কারণ আন্দোলনগুলোর সামনে প্রয়োজনীয় সংগঠন কোথায়? সঠিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব কোথায়? এইভাবে পাঁচ বছর, সাত বছর, আট বছর, দশ বছর বাদে-বাদেই দেশে এক-একটা লড়াইয়ের ঢেউ আসছে। আর প্রত্যেকটি লড়াইয়ে পরাজয়ের পর তাদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে হতাশা। মনে হচ্ছে কিছুই হবে না। সেই মানুষগুলোই কিছুদিন বাদে অস্থির হয়ে আবার একটা কিছু করার জন্য চারিদিক থেকে শোরগোল শুরু করেন। তাহলে লড়াই দরকার এবং লড়াইয়ের ময়দানে তাঁদের আসতেও হবে। আজ না এলে দু’বছর বাদে আসতে হবে, দু’বছর বাদে না এলে পাঁচ বছর বাদে আসতে হবে। কিন্তু এসে আবার সেই বাচ্চা ছেলের মতো তাঁরা লাফাবেন, যে কোনও একটা স্লোগান আওড়াতে আওড়াতে তাঁরা মনে করবেন বিপ্লব করছেন এবং তার জন্য প্রাণ দেবেন। আবার মার খাবেন। আবার বিপথগামী হবেন। তাই প্রতিটি আন্দোলনের সামনে নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের এই মূল শিক্ষাটাকে আমাদের মনে রাখতে হবে। …
… আদর্শ এবং রাজনৈতিক লাইন ভুল হলে কোনও একসময়ে যদি কেউ প্রচুর শক্তির অধিকারীও হয় শেষপর্যন্ত সেই শক্তি তার থাকবে না। এই ‘আদর্শ’ কথাটা আবার অনেক ব্যাপ্ত। আন্দোলনের নীতি-নৈতিকতা, রুচি-সংস্কৃতি সমস্ত প্রশ্ন এই আদর্শ কথাটার মধ্যে জড়িয়ে আছে। আমাদের দেশের আন্দোলনের মধ্যে এই যে একটা ধারা চলেছে — আমরা লড়ব, স্লোগান দেব — কিন্তু আমাদের মুখে কোনও লাগামের দরকার নেই, রুচি-সংস্কৃতির দরকার নেই, শালীনতার সঙ্গে, ভদ্র আচার-আচরণের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্কের দরকার নেই — এটা মারাত্মক ক্ষতি করছে। আন্দোলনের মধ্যে যাঁরা এ ধরণের আচরণ করছেন তাঁরা মনে করছেন, আমাদের যেমন খুশি আমরা কথা বলব, বয়স্ক মানুষকে যেমন মনে করব গালাগালি করব, তাদের সঙ্গে যে কোনও ভাষায় কথা বলব, স্লোগান দিতে দিতে কোমর দুলিয়ে যা হয় অঙ্গ ভঙ্গি করব, — কিন্তু স্লোগানটা যখন বিপ্লবেরই দিচ্ছি তখন বিপ্লবটা হয়ে যাবে। তাদের মনে রাখা দরকার যে, তা হয় না, হতে পারে না। মানুষ খেতে পাচ্ছে না বলে স্লোগান দেখে হয়তো আন্দোলনে খানিকটা আসে, কিন্তু কোমর দোলা দেখে আতঙ্কিত হয়। আন্দোলনের কর্মীদের অশ্লীল কথাবার্তা শুনে আতঙ্কিত হয়। তাদের স্বার্থপরতা দেখে তাঁরা কুকঁড়ে যায়। ফলে তাদের মধ্যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কেই অবিশ্বাস এবং সংশয় দেখা দেয়।
… আজ অবস্থা যতই খারাপ হোক, একটা কথা আপনাদের সবসময় মনে রাখতে হবে — যে কথাটা বুদ্ধিমান লোকদের, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদীদের বা বিজ্ঞান সাধকদের কেবলমাত্র জানা ছিল এবং মানুষ যুক্তি দিয়ে বুঝলেও মন দিয়ে গ্রহণ করতে পারত না। তারা ভাবত, প্রতিক্রিয়াশীলদের ,বুর্জোয়াদের এই যে জগদ্দল পাথরের মতো বিরাট রাষ্ট্রশক্তি — যার এত মিলিটারি, এত ক্ষমতা, এত টাকা-পয়সা — তার বিরুদ্ধে কি নিরন্ন, অজ্ঞ, নিরক্ষর জনসাধারণ কখনও সংঘবদ্ধ হয়ে এমন রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিতে পারে বা দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব, যার ফলে সেই শক্তি ভেঙে পড়বে এবং বিপ্লব সফল হবে? নভেম্বর বিপ্লব দুনিয়ায় প্রথম এই কথাটাকে আর তত্ত্বে না বুঝিয়ে বাস্তবে প্রমাণ করে দিয়ে গেল — হ্যাঁ সম্ভব।
… রাশিয়ার অজ্ঞ মজুর-চাষি বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ক্ষমতা দখল করে একদল আমলাকেও তাদের অধীনে আনতে সক্ষম হল। কারণ তাদের বিপ্লবটা ভোটের মারফত ক্ষমতা দখল ছিল না, বা শুধু মিটিং-প্রসেশন করে কিছু লাঠালাঠি করা বা ঢিল-পাটকেল ছোঁড়াও ছিল না। তাদের বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল একটা বিরাট কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে জনতার রাজনৈতিক শক্তির অভ্যূত্থান ঘটানোর মাধ্যমে। এই রাজনৈতিক শক্তির অভ্যূত্থান কথাটার মানে হচ্ছে, কমিটিগুলো গঠন করে সংগঠিতভাবে বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনার মধ্য দিয়ে অজ্ঞ মজুর-চাষি লেখাপড়া না জানলেও অনেক কর্মক্ষমতা ও সংগঠন প্রতিভা — অর্থাৎ সংগঠন চালানো, নানা দিকে নজর নেওয়া প্রভৃতি বহু গুণের অধিকারী হয়ে স্তরে স্তরে গড়ে ওঠা। কাজেই বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই জনতার রাজনৈতিক শক্তির জন্ম হয় এবং সেই শক্তি পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থার দায়িত্ব নিতে পারে। ফলে মজুর-চাষি রাষ্ট্রক্ষমতা চালাতে পারবে না — এই ধারণাটাও যে ভ্রান্ত, নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তা প্রমাণ হয়ে গেল। হয়ে যাওয়ার পর এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ইউরোপের, চীনের, ভিয়েতনামের মজুর-চাষিরা নিজেদের রাজত্ব কায়েম করার জন্য এগিয়ে চলল।
নভেম্বর বিপ্লবের এই শিক্ষাগুলো মনে রাখার সঙ্গে সঙ্গে যে কথাটা আপনাদের মনে রাখতে হবে, তা হচ্ছে, বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যাম্ভাবী। বুর্জোয়ারা শক্তিশালী বলে, তাদের হাতে প্রবল রাষ্ট্রক্ষমতা রয়েছে বলে চিরকাল তারা জগদ্দল পাথরের মতনই আমাদের ঘাড়ের উপর বসে থাকবে — এমন ঘটলে বুর্জোয়াদের হয়ত ভালো হত এবং এ ভেবে তারা খুশিও হতে পারে, কিন্তু এরকম ঘটে না। তবে এই পরিবর্তন কতদিনে ঘটবে, এটা নির্ভর করছে আপনাদের উপর। যথার্থ বিপ্লবী আদর্শ এবং লাইন গ্রহণ করে, যথার্থ বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়ে স্তরে স্তরে গণআন্দোলনগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালনার মারফত জনগণের রাজনৈতিক শক্তির অভ্যূত্থান, অর্থাৎ সোভিয়েটের মতন বিপ্লবী কাউন্সিল এবং গণকমিটিগুলো গড়ে তুলতে কতদিন আপনারা নেবেন তার ওপর নির্ভর করছে কত তাড়াতাড়ি বিপ্লব হবে। আপনারা মনে রাখবেন, এ কাজ ফাঁকি দিয়ে হবে না, মাঠে-ঘাটে শুধু চিৎকার করেও হবে না বা ভোটের বাক্সে কেরামতি-কারসাজি দেখিয়েও হবে না। বিপ্লব তখনই করতে আপনারা সক্ষম হবেন যখন সঠিক মূল বিপ্লবী রাজনৈতিক লাইন ও আদর্শের ভিত্তিতে এবং সঠিক বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বে জনতার নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তির জন্ম আপনারা দিতে পারবেন। ভোটেও যে আপনারা লড়েন এবং অর্থনৈতিক দাবি দাওয়া নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন যেগুলো আপনারা গড়ে তোলেন — সেগুলোকেও এই অর্থে লড়াই হিসাবে যদি আপনারা দেখেন এবং মূল বিপ্লবী আন্দোলনের পরিপূরক অর্থে সেগুলোকে গড়ে তুলতে পারেন — তবেই মনে রাখবেন, এগুলোর সার্থকতা আছে। তাছাড়া এক ইঞ্চিও বেশি এর কার্যকারিতা নেই। আর, এইটা যদি আপনারা ধরতে সক্ষম হন তাহলে সাথে সাথে এটাও আপনাদের বুঝতে হবে, যে গণআন্দোলনগুলো আপনারা গড়ে তুলছেন এর আগে যাওয়া আছে, পিছু হঠা আছে, জয় আছে, পরাজয় আছে, মার খাওয়া আছে — কারণ এর আঁকাবাঁকা পথ আছে। কিন্তু মূল কথা হচ্ছে, এই গণআন্দোলনগুলোর আদর্শ, নীতি, মূল রাজনৈতিক লাইন, বিপ্লবের রাজনৈতিক লাইন, বিপ্লবের স্তর নির্ণয় আপনারা ঠিক করেছেন কিনা — অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদীদের জায়গায় বুর্জোয়াশ্রেণি যে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন এবং এই বুর্জোয়াশ্রেণিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করাই যে বিপ্লবের প্রধান কার্যক্রম — এটা আপনারা ধরতে সক্ষম হয়েছেন কিনা।
… আমি আগেই বলেছি, আমাদের দেশে সামন্ততান্ত্রিক আর্থিক সম্পর্ক বা উৎপাদন সম্পর্ক বলতে কিছুই নেই — যা আছে তা সামন্ততন্ত্রের অবশিষ্টাংশ হিসাবে বর্তমান সমাজের উপরিকাঠামোর মধ্যে — আচার, রুচি, নীতি, ফর্মের মধ্যে— খাদ হয়ে মিশে আছে। তা সত্ত্বেও যারা বলছেন, ভারতবর্ষের গ্রামীণ অর্থনীতিতে আজও সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক রয়েছে, তর্কের খাতিরে যদি তাদের কথা মেনেও নিই তাহলেও একথা কি সত্য যে, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রক্ষমতাটি ভারতবর্ষের বুর্জোয়াশ্রেণি পরিচালনা করছে এবং আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী দুনিয়ায় যে চরম সঙ্কট চলছে সেই সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে এবং দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থায় তার প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে তারা ভারতবর্ষের পুঁজিবাদকেই সংহত করার চেষ্টা করছে? যদি তাই হয়, তাহলে একথা তাদের মানতেই হবে যে, ভারতবর্ষের রাষ্ট্রটি নিঃসন্দেহে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং এখানে ক্ষমতাসীন বুর্জোয়াশ্রেণিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে সর্বহারা শ্রেণি কর্তৃক ক্ষমতা দখলই বিপ্লবের প্রধান কার্যক্রম — অর্থাৎ ভারতবর্ষের বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।
এ প্রসঙ্গে লেনিনের একটা বিখ্যাত উক্তি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিই। একসময়ে কাউটস্কির সঙ্গে — কাউটস্কি তখনও ‘রেনিগেড’ হয়নি — রোজা লুক্সেমবুর্গ জাতীয় রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণের প্রশ্নে একটা বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। রোজার বক্তব্য ছিল, যেসব দেশ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন, অথচ আর্থিক দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর বা বিদেশি পুঁজিবাদী দেশগুলোর পদানত, সেইসব দেশগুলোকে স্বাধীন বুর্জোয়া রাষ্ট্র বা জাতীয় রাষ্ট্র বা সেইসব দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রকে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র বলা যায় না। কাউটস্কি বলেছিলেন — না, এইসব রাষ্ট্রগুলির চরিত্রও স্বাধীন জাতীয় বুর্জোয়া রাষ্ট্রের চরিত্র। রোজা তাঁর উপরোক্ত ধারণার ভিত্তিতে বলেছিলেন — না, ওটা নামে স্বাধীনতা। ফলে ঐসব দেশের জনসাধারণের মূল লড়াইটা পরিচালনা করতে হবে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এবং তাদের সহযোগী যে বুর্জোয়ারা তাদের দেশে রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে — ঠিক যেমন করে আমাদের দেশের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতারা বলছেন। লেনিন তার উত্তরে বলেছিলেন, অর্থনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির দাসত্ব থাকার জন্য যাঁরা মনে করছেন, এগুলো স্বাধীন জাতীয় বুর্জোয়া রাষ্ট্র নয়, তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী যুগটাকেই ধরতে পারেননি। তাঁরা ধরতেই পারেননি, সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের বর্তমান যুগে এমন ঘটনা আকছার ঘটবে। পুঁজিবাদের অসম বিকাশের জন্য কয়েকটি পুঁজিবাদী দেশ যারা অনেক এগিয়ে গিয়েছে এবং পুঁজিবাদী দুনিয়ার মধ্যমণি হিসাবে বিরাজ করছে, যারা সাম্রাজ্যবাদের শিরোমণি — এযুগে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সকল দেশের বুর্জোয়ারাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির দিক থেকে তাদের উপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য। তাই তিনি বললেন যে, শুধু ছোট ছোট বলকান রাষ্ট্রগুলোই নয়, এতবড় যে ‘জারিস্ট’ রাশিয়া, যার বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে, তারও অর্থনীতিতে রয়েছে ধনী ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রবল প্রভাব। সেখানে যে পুঁজিবাদ গড়ে উঠল তার ওপরে রয়েছে পশ্চিমী পুঁজিপতিদের প্রবল দাপট। তার জন্য জারিস্ট রাশিয়াকে তো কেউ আর সাম্রাজ্যবাদের কলোনি বলে মনে করে না, বরং সে নিজেই তো এক ধরনের সাম্রাজ্যবাদ চালু করে বসে আছে।
… সকলেই জানেন ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে’র মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় বুর্জোয়া কেরেনস্কি সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও সেখানে প্রতিরক্ষা দপ্তর ছিল জারের পরিবারের হাতে। আর রাশিয়ায় যে তখনও সামন্ততন্ত্র প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল সে তো ইতিহাসের অ, আ, ক, খ জ্ঞান যাঁদের আছে তাঁরাই জানেন। এই সামন্তপ্রভুরা — ‘ক্যাডেট’দের সঙ্গে যাদের মিত্রতা ছিল—নভেম্বর বিপ্লব পর্যন্ত পুরো সময় ধরে বারবার বলশেভিকদের সঙ্গে লড়ালড়িতে এসেছে। তার জন্য লেনিন ‘এপ্রিল থিসিসে’ রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ করতে গিয়ে কি একথা বলেছিলেন যে, এটা বৃহৎ বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে পরিচালিত বুর্জোয়া-জার সরকার? কেন বলেননি? কারণ একটা সোজা কথা যে, রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে রয়েছে বুর্জোরাই।
… তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রশক্তি পুরনো শ্রেণি অর্থাৎ নিকোলাই জারের হাত থেকে একটি নতুন শ্রেণি অর্থাৎ রাশিয়ার বুর্জোয়াশ্রেণির হাতে চলে গিয়েছে। তাহলে কী দেখা যাচ্ছে? দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রশক্তি কোন শ্রেণির হাতে রয়েছে, বিপ্লবের স্তর নির্ণয়ে এটাই মূল বিচার্য বিষয়।
… এদিক থেকে যদি আমরা বিচার করি, ভারতবর্ষে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর, বুর্জোয়াশ্রেণি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর কৃষি উৎপাদনের চরিত্র এবং ভূমি সম্পর্কের বর্তমান রূপ যা দাঁড়িয়েছে তা ভালোভাবে না বুঝলেও ভারতবর্ষের রাষ্ট্র যে ভারতবর্ষের পুঁজিবাদকেই সংহত করার চেষ্টা করছে, শুধু এইটুকু বুঝলেই বোঝা যাবে যে, এটা একটা জাতীয় রাষ্ট্র। আর মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পরিভাষায় জাতীয় রাষ্ট্র মানে আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র নয় Ñ তা বুর্জোয়া রাষ্ট্র। আর বুর্জোয়া জাতীয় রাষ্ট্র লেনিনের পরিভাষায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। তাহলে সেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র উচ্ছেদের বিপ্লব বুর্জোয়াশ্রেণিকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিপ্লব এবং সেই অর্থে ‘টু দ্যাট এক্সটেন্ট’ ভারতবর্ষের বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। …
[১৯৭৪ সালের ৮ নভেম্বর কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রদত্ত ভাষণটি ‘মহান নভেম্বর বিপ্লবের পতাকাতলে’ শিরোণামে ‘শিবদাস ঘোষ নির্বাচিত রচনাবলী’ ৩য় খন্ডে সংকলিত হয়। ওই রচনার অংশ বিশেষ এখানে প্রকাশ করা হল।]