Thursday, March 28, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - ডিসেম্বর ২০১৫সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদই মানবমুক্তির পথ — কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

সমাজতন্ত্র-সাম্যবাদই মানবমুক্তির পথ — কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

[গত ৭ নভেম্বর ছিল মহান রুশ বিপ্লবের ৯৮তম বার্ষিকী এবং আমাদের দল বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-র ৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেটে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন বিষয়ের পাশাপাশি পার্টি কনভেনশনে গৃহিত আন্তর্জাতিক থিসিসের ভিত্তিতে বর্তমান আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করেন। ঐ বক্তব্যগুলো সংকলন করে ও পরবর্তীতে কমরেড সাধারণ সম্পাদকের আরও কিছু সংযোজনীসহ এই বক্তব্যটি প্রকাশ করা হলো]

SPBM_Dhaka 2১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে আমাদের দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কিছুদূর এগিয়েছিল। আমরা সেই আদর্শগত হাতিয়ার নিয়েই আমাদের দেশে একটা সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সংগ্রাম করছিলাম। কিন্তু একসময় প্রতিষ্ঠাকালীন সেই ঘোষণা থেকে কেন্দ্রিয় নেতৃত্বের একটা অংশ সরে এলেন। জীবনের সর্বক্ষেত্রব্যাপী মার্কসবাদ চর্চার মধ্য দিয়ে বিপ্লবী দল গড়ে তোলা ও তার নেতৃত্বে গণআন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর ঘটানোর যে কষ্টকর সংগ্রাম — তা থেকে তারা সরে এলেন। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পথে পার্লামেন্টারি সুবিধাবাদী রাজনীতি শুরু করলেন। ফলে আমাদের নতুন করে শুরু করতে হলো। একটা দীর্ঘ সময় মতাদর্শিক লড়াইয়ের পর ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটি) এই নামে আমরা চলতে থাকি এবং ২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর কনভেনশনের মধ্য দিয়ে আমাদের দলের নাম বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) ঘোষণা করি।

এ সবই আপনারা জানেন। আমাদের দলের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যই এই কথাগুলো বলা। যে কথাটা বলতে চাইছিলাম তা হলো, মার্কসবাদী বিপ্লবী রাজনীতির একটা বাস্তবতা এই যে, দুনিয়ার দেশে দেশে তাকে প্রতিবিপ্লবী চিন্তার মোকাবেলা করেই এগোতে হয়েছে। এই মহান সভ্যতা বিকাশের যে আন্দোলন অর্থাৎ বৈষম্যমূলক সামাজিক ব্যবস্থা থেকে সম্পূর্ণ সাম্যের সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা — তার লক্ষ্যে দেশে দেশে বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্বেই গণআন্দোলনসমূহ গড়ে ওঠে। আবার সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর ঘটানোর লক্ষ্যে গণআন্দোলনসমূহ গড়ে তোলা ও তাতে নেতৃত্ব করার জন্য যে বিপ্লবী পার্টি গড়ে ওঠে, দেশে দেশে গড়ে ওঠা সেই পার্টিগুলোর মধ্যে বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিবাদী চিন্তা ও অকার্যকরী সংশোধনবাদী চিন্তা পাশাপাশি অবস্থান করে। কারণ বস্তুজগতের সবকিছুই পরস্পরবিরোধী উপাদান নিয়ে গঠিত। একটা সময় মানুষ যা জানে বস্তুর বিকাশের সাথে সাথে আরেকটা সময় তা অকার্যকরী হয়ে যায়। ফলে ক্রমবিকাশমান বস্তুজগতের বিকাশের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা, আদর্শ, মূল্যবোধ সবকিছুই পরিবর্তিত হতে থাকে — নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তরে উন্নীত হতে থাকে। তখন পুরনো অকার্যকরী সংশোধনবাদী চিন্তার সাথে তার সংঘাত হয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আজকের যুগের সর্বোন্নত প্রকাশ ঘটেছে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায়। ১৯৮০ সালে যখন আমরা শুরু করেছিলাম তখন এই সত্যকে সামনে নিয়েই যাত্রা করেছিলাম। কিন্তু সত্যকে বুদ্ধি দিয়ে বোঝা আর যাচাই করার মধ্য দিয়ে বোঝার মধ্যে গুণগত পার্থক্য থাকে। নতুনতর উপলব্ধি ও পুরনো অভ্যাস-আচরণ পাশাপাশি চলতে থাকলে, নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পুরনো অভ্যাস না পাল্টালে উপলব্ধিও একদিন পাল্টে যেতে বাধ্য। কারণ পুরনো চিন্তা, পুরনো অভ্যাসের মধ্যেই অবস্থান করে। আমাদের দলেও তাই হয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত চিন্তা ও অকার্যকরী চিন্তার এই দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার সকল বিপ্লবী পার্টিকেই যেতে হয়, আমাদেরও যেতে হয়েছে।

মানব ইতিহাসে রুশ বিপ্লবের ভূমিকা পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব যে সমাজের সবকিছুকে আবর্তিত করছে — এটা কার্ল মার্কস আবিষ্কার করলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি মানব সমাজের অগ্রগতি কোন পথে হতে পারে, কোন শ্রেণীটি বিকাশমান, কোন শ্রেণীটি অবক্ষয়ী — সেটা মানুষের সামনে উপস্থিত করলেন। তিনি দেখালেন যে পুঁজিবাদ এমন একটি শ্রেণীর সৃষ্টি করেছে যা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বন্ধন থেকে ছিন্ন হয়ে এক নতুন শক্তির জন্ম দিয়েছে এবং এই শ্রেণীটিই এখনকার সময়ের সামাজিক ব্যবস্থার সবকিছুকেই পরিচালনা করছে। তাদের শ্রমেই সবকিছু গড়ে উঠেছে এবং এটি ব্যক্তিগত শ্রম নয়, সামাজিক শ্রম। এই সামজিক শ্রমই দুনিয়ার সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। এই শ্রমিকরা তাদের কায়িক ও মানসিক শ্রমের মধ্য দিয়ে আদিম মধ্যযুগীয় সমাজ ভেঙ্গে আধুনিক উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর সমাজে রূপান্তর ঘটিয়েছে। এই শ্রেণীটি সর্বহারা শ্রেণী। তারা সমস্ত রকম সম্পত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সর্বহারা হয়েছে। এই শ্রেণীটি পুঁজিবাদী শোষণের ফলে ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে এবং এরা একমাত্র শ্রমকে কেন্দ্র করেই জীবন ধারণ করে।

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় একদিকে শ্রমজীবীদের সংখ্যা বাড়ছে, আরেকদিকে আছে অল্পসংখ্যক লোক যারা পুঁজি খাটিয়ে মুনাফা অর্জন করছে। পুঁজিবাদী সমাজে এই দুটি শ্রেণীর স্পষ্ট মেরুকরণ ঘটছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কার্ল মার্কস সমাজের এই চিত্রটি তুলে ধরেন, এই সময়ে সমাজের বিকাশ কোন পথে হতে পারে তার নিয়মগুলি মানুষের সামনে রাখেন এবং কিভাবে দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য গড়ে উঠার মধ্য দিয়ে একদিন সমস্ত মানুষ সাম্যে যাবে তার দিক নির্দেশ করেন। এটি একটি ঐতিহাসিক নিয়ম। কল্পনা নয়, বাস্তব নিয়ম। মার্কস-এঙ্গেলস দুজনে মিলে মানব সমাজকে এই নতুন ধরনের বিজ্ঞানের ভিত্তি দিয়েছিলেন। এরপর দেশে দেশে তার অনুশীলন হয়। ১৯১৭ সালে, তখনকার সা¤্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের দুর্বল গ্রন্থি রুশদেশে, কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি বিপ্লব সম্পন্ন করে। লেনিন তখনকার সময়ে বুর্জোয়াদের যে পাণ্ডিত্য ও শিক্ষা, মার্কসবাদের উপর তাদের নানা আক্রমণ — ইত্যাদি মোকাবেলা করতে করতে বিশেষ দেশে, বিশেষ বিপ্লবের জন্য, বিশেষ পার্টির যে প্রয়োজনীয়তা তা নিয়ে আসেন এবং সেই বিশেষ পার্টির ঐতিহাসিক ভূমিকা কেমন হবে তা নির্দেশ করেন। এভাবে তিনি মার্কসবাদী বিপ্লবী রাজনীতি, যা মার্কস-এঙ্গেলস এনেছিলেন, তাকে আরও উন্নত ও বিকশিত করেন। এরই প্রায়োগিক দিক ছিল রুশ বিপ্লব। রুশ বিপ্লব মানব সমাজে শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হওয়া প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।

রুশ বিপ্লব দুনিয়ার সামনে একটি নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে তা হলো শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষরা, যারা পিছিয়ে পড়া, তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে পারে এবং এটি দুনিয়ার দেশে দেশে মানুষের মুক্তির সংগ্রামে পথ নির্দেশক হিসেবে এসে যায়। এইভাবে সারা পৃথিবীতে তখন রুশ বিপ্লবের প্রভাব পড়তে থাকে। ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও!’ — এই স্লোগানকে সামনে রেখে তখন দেশে দেশে শ্রমিকরা এই বিপ্লবের জন্য কাজ করতে শুরু করে। কিন্তু বিপ্লবী আন্দোলনের পাশাপাশি বিপ্লবীদের সমস্ত বিষয়কে মোকাবেলা করার জন্য যে জ্ঞান দরকার তার অভাবের সুযোগে বিপ্লববিরোধী শক্তি এর অভ্যন্তরে কাজ করতে থাকে। এটি হলো সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শক্তি। এরা বুর্জোয়া শ্রেণী ও সর্বহারাদের মধ্যে আপোষকামী শক্তি। এরা নিজেদের সর্বহারা বলে পরিচয় দেয়, বাস্তবে বুর্জোয়াদের পক্ষেই কাজ করতে থাকে। শ্রমিকদের সুসংগঠিত আন্দোলনের মধ্যে তারা বিভ্রান্তি ও বিভ্রম নিয়ে আসে। সকল দেশেই এই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতিকে উন্মোচিত করতে করতেই সেই দেশের বুকে বিপ্লবী রাজনীতি মূর্তরূপে প্রকাশিত হয়। একাজটি লেনিন রুশদেশে করেছিলেন।

লেনিনের এই শিক্ষার ভিত্তিতেই রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয় এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজের উন্নতি ও সমৃদ্ধি হতে থাকে। মহান লেনিনের মৃত্যুর পর সমাজতান্ত্রিক সমাজ লেনিনের শিক্ষা অনুসরণ করে বেশ খানিকটা সমাজতান্ত্রিক উন্নতির পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হয়। জার্মানি ও ইতালিতে উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম হয়। সে সময় জার্মানি ও ইতালি দুটোই সাম্রাজ্যবাদী দেশ। দু’দেশেরই বাজার দখল করার দরকার। কিন্তু তার কোনো বাস্তবতা তখন ছিল না। কারণ ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স — এ তিন দেশ তখন গোটা বিশ্বের উপর প্রভাব বিস্তার করে ছিল। তারা বিশ্বের যে কোনো দেশে হস্তক্ষেপ করতো, কর্তৃত্ব করতো, কলোনি বানিয়ে শোষণ করতো। তখন জার্মানি ও ইতালির বড় কোনো কলোনি ছিল না। ফলে তাদের ছিল তীব্র বাজার সংকট। তাদের দেশে গড়ে ওঠা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের পুঁজি খাটানোর আর কোনো জায়গা ছিল না। তাই বাজার দখল ছাড়া যখন তার বেঁচে থাকার আর কোনো উপায় নেই তখন সে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করতে লাগলো। নিজ নিজ দেশের জনগণের মধ্যে জাতীয় অপমান-অবমাননাবোধ কাজে লাগিয়ে অন্য রাষ্ট্রের উপরে আধিপত্যবাদী মনোভাব তাদের মধ্যে গড়ে তুললো। এই রাষ্ট্রসমূহের পরিচালকরা মানুষকে তাদের পেছনে জড়ো করার জন্য বিজ্ঞানের কারিগরি দিকটাকে গ্রহণ করলো, কিন্তু জনগণের চিন্তাকে পুরনো ধর্মীয় কুসংস্কার-কূপমন্ডুকতায় আচ্ছন্ন করে রাখলো। উগ্র জাত্যাভিমান গড়ে তুলে এক দেশের জনগণকে অন্য দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লাগিয়ে দিলো ।

সোভিয়েত ইউনিয়ন জন্মের পর ছিল একা। তাই তখন আন্তর্জাতিক ঘটনাসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি সে অর্জন না করতে পারলেও প্রতিবাদ করার শক্তি হিসেবে সে আবির্ভূত হয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই দুনিয়ার দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে উঠছিলো এবং তা ক্রমশই পরিণতির দিকে যাচ্ছিল। ভিয়েতনাম ও কোরিয়ায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই চলছিল। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে চলছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই। এমন সময়ে জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে তখন সোভিয়েত তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বিরাট শিল্পোন্নত দেশ জার্মানীকে পিছু হটতে বাধ্য করে এবং এক সময় পরাজিত করে রাইখস্ট্যাগে লাল পতাকা উত্তোলন করে। যুদ্ধ পরবর্তীকালে চীন বিপ্লব সংগঠিত হয়। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো, যেগুলো প্রথম আক্রমণেই জার্মানির কর্তৃত্বে চলে এসেছিল, সেগুলোতে কমিউনিস্ট ও দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্য শেষ পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণতি পায়। তখন রাশিয়া, চীন, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ — এই মিলে সমাজতান্ত্রিক শিবির গড়ে ওঠে। এই সময়ে মানুষ দেখলো মানব সভ্যতাকে রক্ষা করার এক বিরাট শক্তি, যার প্রকাশ ঘটিয়েছিলো রাশিয়া। আর তখন বিশ্বে সে একা নয়, একটা সমাজতান্ত্রিক শিবির সে গড়ে তুলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন যে কোনো দেশের উপর যখন ইচ্ছা হস্তক্ষেপ করতে পারতো, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অভ্যুত্থানের পর তা আর সম্ভব হলো না। নভেম্বর বিপ্লবের পথেই এই অভ্যুত্থান ঘটে।

আরেকটি ব্যাপার সে সময় ঘটেছিল। সারা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদীদের শাসিত উপনিবেশসমূহে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম শুরু হলো। যেহেতু সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উপস্থিতির কারণে চাইলেই সাম্রাজ্যবাদীরা এসব দেশে আগের মতো অত্যাচার-হত্যা-গণহত্যা চালিয়ে আন্দোলন দমন করতে পারেনা, তখন ঔপনিবেশিক দেশসমূহ তাদের শক্তিতেই একে একে মুক্ত হওয়া শুরু করলো। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হলো। এ কারণে রুশ বিপ্লব শোষিত মানুষের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা।

SPBM_Dhaka

বাইরের শক্তি সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পতন ঘটাতে পারেনি, ঘটিয়েছে আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা
সেসময় একদিকে সমাজতান্ত্রিক শিবির সারা পৃথিবীর শোষিত-নিষ্পেষিত-পরাধীন মানুষের মুক্তির কান্ডারী, সারা দুনিয়ার মানুষের সামনে সে সাম্যের স্বপ্ন জাগিয়ে তুলেছিল, আবার একই সময়ে শোধনবাদী চিন্তা কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভ্যন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। লেনিন এ সম্পর্কে কিছু হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। স্ট্যালিনও তাঁর জীবদ্দশায় শেষ কংগ্রেসে এই সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু এগুলো ছিলো ইঙ্গিত। এ সম্পর্কে সবচেয়ে সঠিক ও কার্যকরীভাবে বলেছেন এ যুগের অন্যতম মার্কসবাদী দার্শনিক ও চিন্তানায়ক, ভারতের এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক কমরেড শিবদাস ঘোষ। ১৯৪৮ সালেই তিনি বলেছিলেন সাম্যবাদী শিবির আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করছে ঠিক; কিন্তু ভেতরে তাদের যে ঐক্য, যে সংহতি থাকা দরকার তা নেই; সমষ্টির স্বার্থের সাথে ব্যক্তি স্বার্থের যে বিরোধ — তাকে কিভাবে মীমাংসার দিকে নিয়ে যাবে, কোন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে নিয়ে যাবে — এসব প্রশ্নে তাদের বিভ্রান্তি আছে। কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশেষভাবে, কার্যকরী রূপে, কী ধরনের সমস্যার জন্য এরকম হচ্ছে — সেটা চিরে চিরে দেখিয়েছিলেন। এমনকি স্ট্যালিন জীবিতকালেও কমিউনিস্ট আন্দোলনে কী ধরনের দুর্বলতার সৃষ্টি হচ্ছে, সেটাও তিনি দেখিয়েছেন। ‘সাম্যবাদী শিবিরের আত্মসমালোচনা’ প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন, দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলন যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। এখন আর আগের মতো সা¤্রাজ্যবাদীরা যাকে ইচ্ছা তাকে আক্রমণ করতে পারে না। কিন্তু কমিউনিস্টদের উন্নততর চেতনা, মূল্যবোধ ও মার্কসবাদী রাজনীতি আরও সঠিকভাবে ধারণ করার ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণতা আছে। এগুলি বিপদ হিসেবে সামনের সময়ে আসবে। আর বাস্তব ইতিহাস হলো এই যে, সেই ত্রুটিগুলি না শোধরানোর কারণে একসময়ে দৃষ্টান্তমূলক শক্তি হিসেবে মানব সমাজের সামনে বহুরকম কার্য সম্পাদনকারী সমাজতান্ত্রিক শিবিরের একসময় পতন ঘটলো।

কমরেড শিবদাস ঘোষ কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের পরিবর্তে যান্ত্রিক সম্পর্কের যে প্রভাব তার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত পরিবতিত হচ্ছে। সেটি অনুধাবন করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টিসমূহের মধ্যে যে অভিজ্ঞতার পার্থক্য আছে সেটাকে কেন্দ্র করে তাদের পরস্পরের মধ্যে দ্বন্দ্বে উপনীত হতে হয়, ঐক্যে পৌছাতে হয় — তৎকালীন সময়ে তা ঘটেনি। ফলে পার্টিসমূহের মধ্যে যান্ত্রিক সম্পর্ক বিরাজমান ছিল। এই যান্ত্রিক সম্পর্ক আদর্শগত ক্ষেত্রে অনুন্নত অবস্থা তৈরি করে। কারণ এক সময়ের বড় আদর্শও যদি ক্রমাগত বিকশিত না করা হয় তবে এক সময় সে হয়ে পড়ে অকার্যকরী। কমিউনিস্ট দলসমূহ নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সমন্বয়ের প্রক্রিয়ায় আদর্শগত উন্নয়নের এ কাজটি তখন কার্যকরী ছিল না।

আবার সমস্ত বিশ্বেই ব্যক্তিবাদ তখন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছিল, তার প্রভাব সমাজতান্ত্রিক সমাজেও এসে পড়েছিল। সমাজতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের যে দ্বন্দ্ব — সেটির বাস্তবিক সমাধান কিভাবে হবে — কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব সে সম্পকির্ত কোনো পরিচ্ছন্ন ও সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারলেন না। কমরেড শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছেন, সমাজতন্ত্র বাস্তবে এমন একটা ব্যবস্থা নিয়ে এসেছে যেটি সমষ্টিগত স্বার্থ অধিকার প্রতিষ্ঠার সামাজিক ব্যবস্থা। মানুষের ব্যক্তিগতভাবে চাইবার যে অধিকারবোধ সেটা বুর্জোয়া সমাজ থেকে পাওয়া। সমাজতন্ত্রে সে অধিকারের প্রশ্ন নেই। কারণ শ্রমজীবী মানুষই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মালিক। তাদের যদি কোনো অভাব থাকে তবে প্রত্যেকেই ব্যক্তিগতভাবে দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জন করে সেই অভাব দূর করার সংগ্রাম করবে, ব্যক্তিগতভাবে কিছু চেয়ে সমাজের সাথে বিরোধ করার কোনো ব্যাপার নেই, কারণ তার কোনো ভিত্তিই সে সমাজে নেই। পুঁজিবাদী সমাজে যেমন পুঁজিপতি শ্রেণী বেশিরভাগ মানুষকে ঠকিয়ে সমস্ত অধিকার একাই ভোগ করে, তার বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর ব্যক্তিগত অধিকারের দাবি তুলতে হয়, তার কোনো অস্তিত্বই সমাজতান্ত্রিক সমাজে নেই। পুঁজিবাদী সমাজের বঞ্চনার কোনো ভিত্তিই সমাজতান্ত্রিক সমাজে বিরাজ করেনা। ফলে সেখানে রাষ্ট্রের সাথে ব্যক্তির অধিকার নিয়ে কোনো লড়াই থাকতে পারেনা।

সমাজতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ এবং তার ভিত্তিতে পারিশ্রমিক দেয়া — সেটা হয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়ী সমাজের দিতে না পারার সীমাবদ্ধতা সেটা সাজতান্ত্রিক সমাজের সৃষ্টি করা নয়, সেই অভাব সে অতীত সমাজ থেকে নিয়ে এসেছে। কারণ সামাজিক মালিকানার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এ ব্যবস্থায় সামাজিক কোনো বাধা নেই ব্যক্তিগত অধিকারের। শুধু ব্যক্তি যা চায় তা দেয়ার মতো সক্ষমতা সামাজিকভাবে তৈরি হয়নি, এই পার্থক্য। তাই ব্যক্তির প্রয়োজন মতো সমাজের দেয়ার যে ক্ষমতা — যৌথভাবে, ক্রমাগত সংগ্রাম করতে করতেই তা অর্জিত হতে পারে। এই অভাব যখন সামাজিকভাবে দূর হবে, তখন ব্যক্তিগতভাবেও ব্যক্তি সে অভাব থেকে মুক্ত হবে। আবার এ কথাও ঠিক যে, যতক্ষণ পর্যন্ত পার্থক্যসমূহ থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্তিসত্ত্বা ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে দ্বন্দ্বও থাকবে। এ দ্বন্দ্বের মীমাংসা কিভাবে হবে? মানুষের ন্যায়-নীতি, মূল্যবোধ, সংস্কৃতির উচ্চতর সংগ্রাম এর মধ্য দিয়ে তাদের চেতনাকে এমন উন্নত স্তরে তুলতে হবে যাতে সে বুঝতে পারে, ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু অভাব তার আছে তা দেয়ার ক্ষমতা সমাজের যে নেই সেটা কোনো বিপরীত শ্রেণীর শোষণের জন্য নয়। সেজন্য প্রতিটি মানুষকে যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করতে হবে। যোগ্যতা অনুযায়ী সে সমাজের কাছ থেকে পাবে। আর নৈতিকভাবে সে সামাজিক স্বার্থের সাথে অভিন্ন হওয়ার সংগ্রামে যুক্ত থাকবে। এইভাবে বৈষয়িয়কভাবে সমাজের যে দেয়ার ক্ষমতা সেটা ক্রমাগত বিকশিত হতে হতে মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী দেয়ার ক্ষমতা সে অর্জন করবে। আবার মানুষের মননশীলতাও সেই স্তরে উন্নীত হবে যে, সে বুঝতে পারবে, সামাজিক স্বার্থের ব্যক্তিস্বার্থকে একীভূত করার মধ্য দিয়েই ব্যক্তির মুক্তি সম্ভব। কিন্তু তখনকার সময়ে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের নেতৃত্বে থাকা সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ তা বুঝতে পারলেন না। এই দ্বন্দ্বের প্রকৃতিই তারা ধরতে পারলেন না। তখন যেভাবেই হোক উৎপাদন বাড়াবার ঝোঁকে তারা শ্রমিকদের ইনসেনটিভ দেয়া শুরু করলেন। পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই বিপজ্জনক জিনিসকে ক্রুশ্চেভ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মধ্যে নিয়ে এলেন।

স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ সোভিয়েতের নেতৃত্বে এলেন। তিনি এসেই ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে লড়াই করার নামে ব্যক্তি স্ট্যালিনকে কালিমালিপ্ত করা শুরু করলেন। স্ট্যালিন এমন একটি নাম, যে নামের সাথে সমাজতন্ত্রের এক মহিমাময় যুগের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগে লেনিনের চিন্তার যে কার্যকারিতা, তার সবচেয়ে উন্নত উপলব্ধি ছিল স্ট্যালিনের মধ্যে। স্ট্যালিনের নেতৃত্বকে কেন্দ্র করেই দেশে দেশে বিপ্লবী আন্দোলনগুলো গড়ে উঠেছিল। তার মর্মে আঘাত করে স্ট্যালিনকে কালিমালিপ্ত করার মধ্য দিয়ে তারা লেনিনবাদের প্রকৃত উপলব্ধিরই গন্ডগোল করে দিলেন। ব্যক্তিপূজার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে অথরিটিকেই অস্বীকার করে বসলেন এবং সংশোধনবাদ প্রবেশ করার দ্বার উন্মোচন করে দিলেন। স্ট্যালিনের বিরাট ভূমিকা সারা বিশ্বের বিপ্লবী সংগ্রামকে যেমন উদ্বুদ্ধ করছিল, তেমনি অন্ধতাও তার মধ্যে জড়িয়ে ছিল। অর্থাৎ তাঁকে মানার মধ্যেই এক ধরনের অন্ধতা ছিল, সেটা তাঁর জীবিতকালেই ঘটেছিল, যেটি তাঁর বিরাট ঐতিহাসিক ভূমিকাকে ঠিক ঠিকভাবে বোঝার ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে। বিপ্লবী সংগ্রামে লেনিনের চিন্তাকে স্ট্যালিন যেভাবে ধারণ করতেন, তার পারসনিফিকেশন তিনি যেভাবে ঘটিয়েছিলেন স্ট্যালিনের মৃত্যুর পর তা ধসে পড়লো মানেই হলো স্ট্যালিন যেভাবে লেনিনকে ধারণ করতেন, যৌথভাবে তা ধারণ করার মতো সংগ্রাম দলের অভ্যন্তরে হয়নি। সে সংগ্রাম অনেকখানি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। চিন্তার এই অনুন্নত মানকে কেন্দ্র করে ক্রুশ্চেভের মতো টেকনোক্র্যাট, বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ লোক নেতৃত্বে এসে গেলেন। স্ট্যালিন যে নিজে ব্যক্তিগতভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজের সাথে অভিন্ন ছিলেন, ব্যক্তি স্ট্যালিন ও সমাজতান্ত্রিক সমাজের মধ্যে যে কোনোও ফাঁক ছিল না, এটি তখন তত্ত্বগতভাবেও আসেনি। অর্থাৎ কমরেড শিবদাস ঘোষ যেভাবে যৌথ নেতৃত্বের বিশেষীকৃত রূপ হিসেবে ব্যক্তি নেতৃত্বের আবির্ভাবের কথা বলেছেন, সেভাবে বিষয়টি আসেনি। সে কারণে স্ট্যালিনকে মেনেছে অন্ধভাবে, বাতিল করেছেও অন্ধভাবে। এ পুরো কাজটিই হলো ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে। একদিকে দলের মধ্যে যান্ত্রিক চিন্তার প্রভাব, অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদকে মোকাবেলা করার জন্য বিরাট আত্মত্যাগ, অনেক নেতা-কর্মীর মৃত্যু — এই সুযোগে ক্রুশ্চেভ পার্টির নেতৃত্বে চলে এলেন। ক্রুশ্চেভ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে স্ট্যালিনকে কালিমালিপ্ত করার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে স্ট্যালিনের অথরিটিকেই ধ্বংস করে দিলেন।

এই প্রক্রিয়ায় সংশোধনবাদ সোভিয়েতের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করলো। এই মহাশক্তিকে সা¤্রাজ্যবাদীরা আক্রমণ করে হারাতে পারেনি। ভেতরের দুর্বলতার কারণে তার পতন ঘটলো। কেউ কেউ বলবেন হেরে গেলো। হেরে যায়নি, ভেতরের দুর্বলতার কারণে পর্যুদস্ত হয়েছিল। বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই বুঝতে পারবেন, যে সমাজ মানুষের সামনে এগোবার ইতিহাস রচনাকারী, একেবারে নতুন সমাজব্যবস্থা হিসেবে যেহেতু সেটি দুনিয়ায় এসেছিল, তাকে ধারণ করার অভিজ্ঞতাজনিত ঘাটতির জন্য সে টিকে থাকতে পারলো না। এভাবে সভ্যতার প্রতি ক্ষেত্রে নানারকম সংকট কাটিয়ে কাটিয়েই একটি নতুন সমাজব্যবস্থা স্থাপিত হয়। এটিই সমাজ বিকাশের প্রক্রিয়া। অনেক ক্ষেত্রে সামনে এগোবার রাস্তায় প্রবল বাধা থাকে। তখন মানুষ এক পা পিছিয়ে আবার এগোতে থাকে। তাই পিছানোটা বড় সমস্যা নয়। বিচার করে দেখতে হবে বিকাশের পথে সমাজতন্ত্র অনিবার্য কি না। সমাজের এক স্তর থেকে অপর স্তরে উন্নীত হওয়ার নিয়ম আছে। সেটি মানুষের চিন্তা-নিরপেক্ষভাবে অবস্থান করে। বস্তুজগতের (সে প্রাণীর বিকাশই হোক কিংবা সমাজের) বিকাশের ধারাবাহিকতায় মানুষের চেতনার ভূমিকা এই যে, চেতনা বস্তুর বিকাশের সেই নিয়মের উপর ক্রিয়া করে তাকে ত্বরাণি¦ত করে, কিন্তু মানুষের চেতনার উপর নির্ভর করে বস্তুজগৎ বিকশিত হয়না। বিকশিত হয় তার নিজস্ব নিয়মের দ্বারা। ফলে সমাজ বিকাশের অনিবার্য নিয়মে সমাজতন্ত্র আসতেই হবে। দেশে দেশে গড়ে ওঠা শ্রেণী সচেতন বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সে পরিণতি পাবে।

সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর বিশ্ব পরিস্থিতি
আজকের যুগে অর্থাৎ লেনিন বর্ণিত সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের এ যুগে বিশ্ব পুিঁজবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার সংকট আগের চেয়ে আরও ব্যাপক, ভয়াবহ ও জটিল রূপ ধারণ করেছে।

১৯১৬ সালে সর্বহারার মহান নেতা কমরেড লেনিন তাঁর “সাম্রাজ্যবাদ : পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর” বইটিতে দেখিয়েছিলেন, পুঁজিবাদের ঊষালগ্নের অবাধ প্রতিযোগিতার যুগ আর নেই। উন্নত পুঁজিবাদী দেশসমূহে মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতি কাঁচামাল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বৃহৎ অংশ নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে একচেটিয়া পুঁিজপতিতে পরিণত হয়েছে। এই একচেটিয়া পুঁজিপতিরা শিল্প পুঁজি ও ব্যাংক পুঁজির মিলন ঘটিয়ে লগ্নি পুঁজির জন্ম দিয়েছে ও তা তুলনামূলক সস্তা শ্রমের দেশগুলোতে খাটাচ্ছে। এভাবে পুঁজি রপ্তানি করে অন্য দেশের সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল শোষণ করার এই চরিত্রটি ছিল পুঁজিবাদের পূর্বতন বৈশিষ্ট থেকে নতুন এবং লেনিন এর নাম দিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদ। লেনিন বলেছিলেন, এই সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর। এরপর পুঁজিবাদের বিকশিত হওয়ার আর কোনো উপায় নেই। এই সাম্রাজ্যবাদীরা বাজার সংকটে পড়ে বাজার দখলের জন্যই দু’দুটো বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে, কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। কারণ এই প্রক্রিয়ায়ই পুঁজিবাদকে টিকে থাকতে হবে, এ ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে কমরেড লেনিন বলেছিলেন : “The war of 1914-18 was imperialist (that is, an annexationist,predatory, war of plunder) on the part of both sides; it was a war for the division of the world, for the partition and repartition of colonies and spheres of influence of finance capital.” (Imperialism: The Highest Stage of Capitalism)

আজকের এই সময়ে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগবৈশিষ্ট্য এক থাকা সত্ত্বেও তার মাত্রা আজ একই রকম নেই। লেনিনের সময় থেকে তার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সংকট আরও প্রকট হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সব রকম সংকট সত্ত্বেও পুঁজিবাদের যে আপেক্ষিক স্থায়ীত্ব ছিল তা আজ আর নেই। সে এখন প্রতি মুহূর্তে সংকটে পড়ছে, তা থেকে বাঁচার জন্য সে যে রাস্তা বেছে নিচ্ছে তা তাকে আরও গভীর সংকটে নিমজ্জিত করছে। এককথায় পুঁজিবাদের সংকট আজ এবেলা ওবেলার সংকটে পরিণত হয়েছে।

সংকট থেকে বাঁচার জন্য পুঁজিবাদ দেশে দেশে অর্থনীতির সামরিকীকরণ ঘটাচ্ছে। অর্থাৎ সমস্তশিল্প যখন মন্দায় ডুবছে তখন ব্যাপক পরিমাণে সামরিক শিল্পের প্রসার ঘটাচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের এই প্রবণতাটি ব্যাখ্যা করে কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছেন, “শিল্পের সামরিকীকরণ বলতে বোঝায়, সরকার যেখানে নিজেই অর্ডার দেয়, আবার সেই মাল সরকার নিজেই কেনে। উৎপাদিত মাল বিক্রির জন্য বাজারের উপর, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হয় না। শুধু সামরিক খাতে সরকারের বাজেট বাড়তে থাকে। ফলে, মন্দা — অর্থাৎ, যাকে আমরা বলি বাজার নেই, কাজকর্ম নেই, অর্ডার নেই — এই সমস্যার হাত থেকে সাময়িকভাবে হলেও শিল্পগুলো বাঁচে। অবস্থাটা দাঁড়ায় এইরকম যে, সরকার নিজেই ‘প্লেন’ তৈরি করার, ‘ফাইটার’ তৈরি করার এবং নানা সামরিক সরঞ্জাম তৈরি করার অর্ডার দেয়, আবার এই তৈরি মালগুলো সরকারই কেনে। ফলে, বাজারের উপর বা লোকের ক্রয়ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে হয়না বলে সাময়িকভাবে ‘রিসেশন’ বা বাজার-মন্দার চাপ থেকে অর্থনীতিকে কিছুটা পরিমাণে রক্ষা করা সম্ভব হয়। কিন্তু, এই পরিকল্পনার আবার একটা কনট্রাডিকশন বা উল্টোদিক আছে। তা হলো এই যে, যত মাল বা অস্ত্রশস্ত্র তৈরি হতে থাকবে সেগুলি যদি বসে থাকে, অর্থাৎ সেগুলি যদি খালাস করা না যায়, তাহলে মাল ক্রমাগত জমতে থাকার ফলে অর্থনীতিতে বন্ধ্যাত্বের ঝোঁক (টেনডেনসি অব স্ট্যাগনেশন) এর জন্ম হবে এবং এর ফলে সামরিক শিল্পেও আবার লালবাতি জ্বলতে শুরু করবে। অথচ সরকার বিনা প্রয়োজনে এই মালগুলো কিনে গুদামজাত করতে পারে না। কাজেই এই মাল খালাস করার প্রয়োজনেই তাদের চাই স্থানীয় ও আংশিক যুদ্ধ।”

তাই আজ দেখা যায়, অর্থনীতির সামরিকীকরণই সকল বড় বড় পুঁজিবাদী দেশের বেঁচে থাকার একমাত্র পথ। আমেরিকার দিকে তাকিয়ে দেখুন, আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দেশ। বিশ্বের মোট জিডিপির ২২ শতাংশের যোগানদাতা হলো আমেরিকা। কিন্তু এ দিয়ে আমেরিকার অর্থনীতিকে বোঝা যাবেনা। ঐ বিশাল অর্থনীতি আজ কাঁপছে। আমেরিকার অর্থনীতির আকার ১৭.৮৪১ ট্রিলিয়ন ডলার। আর তার ঋণের পরিমাণ ১৮.১ ট্রিলিয়ন ডলার। আজ আমেরিকা বিশ্বের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত জাতি। অথচ সে বাহ্যিকভাবে মহাশক্তি নিয়ে আছে। সেটি অস্ত্র উৎপাদনের মধ্য দিয়ে গায়ের জোরে অন্য দেশের উপর হামলা করে। বাস্তবে তার গোটা অর্থনীতিই যুদ্ধ অর্থনীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সে চোরাবালির উপর দাঁড়ানো। যে কোনো সময় ধসে পড়লো বলে।

আমেরিকার ১৬টির বেশি গোয়েন্দা সংস্থা আছে দেশে-বিদেশে গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর জন্য। যেখানে এক লক্ষ সাত হাজারেরও বেশি লোক কাজ করে। সম্প্রতি কাউন্টার টেররিজম সিস্টেমে নতুন করে দশ হাজার লোক নেয়া হয়েছে। এরা হলো আর্মি ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির বাইরের লোক। আর্মি ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সিতে দশ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হয়। এগুলো হলো গোটা ডিফেন্স সিস্টেমে সরাসরি যুক্তদের একটি গড় হিসাব। তাও যে সকল তথ্য প্রকাশিত, সেগুলো অনুসারে। এর সাথে যুক্ত হবে এই বিরাট অস্ত্র উৎপাদনের সাথে সহযোগী শিল্প ও ব্যবসাসমূহ। সেখানে যুক্ত আরও লক্ষ লক্ষ লোক। ডিফেন্স বাজেট কমানোর কথা কংগ্রেসে এক সদস্য বলেছিলেন। কয়েকজন তাকে সমর্থনও করেছিলেন। অস্ত্র কোম্পানির মালিকেরা তাতেই চোখ রাঙ্গিয়ে বললেন, তাহলে আমেরিকায় এক ধাক্কায় মিলিয়ন মিলিয়ন লোক বেকার হয়ে যাবে। এই হলো আমেরিকার শিল্পোন্নতির নমুনা।

আমরা আগেই বলেছি, অস্ত্র উৎপাদন চালু রাখতে হলে তাকে খালাসও করতে হবে। এর জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন। আজ আমেরিকা সারা বিশ্বে আংশিক ও খন্ড যুদ্ধ চালু রেখেছে। আমেরিকা যে সারা দুনিয়া ঘুরে সবার ভালো করতে চায়, সবার স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সে যে ছটফট করে, ছুটে যায় — তার আসল রহস্য এখানে। তার অস্ত্র খালাসের প্রয়োজনে সে এর খবর তাকে বলে, ওর খবর একে দেয়, খবর তৈরি করে, খবর বিক্রি করে,এর বিরুদ্ধে তাকে লাগায়। অর্থাৎ যুদ্ধ বা সংঘর্ষ না থাকলে তার অর্থনীতি চোখ বুঁজবে।

তাই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য যার বিরুদ্ধে সে যুদ্ধ করে তাকেই আবার অস্ত্র সরবরাহ করে। অর্থাৎ এ যুদ্ধ জয়ের জন্য নয়। বিজয়ী হলে যুদ্ধ থেমে যাবে। তাই জয় দরকার নেই, যুদ্ধ দরকার। আই.এস এর ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। আবার রাশিয়া আইএস ঘাঁটিতে হামলা মৌলবাদের হাত থেকে মানবতা রক্ষার জন্য করেনি। একদিকে আসাদের পতন ঘটলে ও সিরিয়ায় মার্কিন আধিপত্য তৈরি হলে রাশিয়ার জন্য ভীষণ সমস্যা, আবার তার অস্ত্রও খালাস হওয়া দরকার। আমেরিকার পরে সে বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র ব্যবসায়ী দেশ। আমেরিকা বিশ্বের অস্ত্র রপ্তানীর ৩১ শতাংশের যোগানদাতা, রাশিয়া ২৭ শতাংশের। তাই তারও যুদ্ধ দরকার।

গোটা দুনিয়ায় যখন যাকে দরকার তাকেই আক্রমণ করছে আমেরিকা ও ন্যাটো জোট, যেখানে আছে বড় বড় পুঁজিবাদী দেশসমূহ। তার জন্য কোনো কারণ দেখানোর দরকার নেই। পত্রিকায় একটা কিছু বললেই হলো। তার ঠিক-বেঠিকেরও ব্যাপার নেই। ভুল অভিযোগ তুলে ইরাক আক্রমণ করে গোটা ইরাককে তছনছ করে দেয়া হলো। আজ বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার স্বীকার করছেন, সেটি ভুল ছিল। তাহলে কেন আক্রমণ করা হলো? কারণ আক্রমণ না হলে, যুদ্ধ না হলে তাদের অর্থনীতি বাঁচবেনা।

প্রায় সকল পুঁজিবাদী দেশই ঋণগ্রস্ত, উৎপাদন বন্ধ, বেকার বাড়ছে
এ দশা সারা বিশ্বের সকল বড় বড় পুঁজিবাদী দেশের। গণতন্ত্রের সূতিকাগার ফ্রান্সের জাতীয় ঋণ তার মোট জিডিপির ৯৩.৫%, ব্রিটেনের ৯০.৬%, জার্মানির ৭৮.৪%। পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠার কালে এরাই বিশ্বকে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। গ্রিস দেউলিয়া। সেদেশের কর্মক্ষম যুবকদের অর্ধেকই আজ বেকার। ব্রিটেনে বেকারের সংখ্যা ১.৮৫ মিলিয়ন, জার্মানিতে ২.৭২ মিলিয়ন। গত দশ বছরে আমেরিকায় কাজ হারিয়েছে প্রায় ১২ মিলিয়ন লোক। এই হলো পুঁজিবাদী উন্নতির নমুনা। সমস্ত উৎপাদন খাত বন্ধ পড়ে আছে এসব দেশে। পুঁজি খাটছে সার্ভিস সেক্টরে, সুদ ব্যবসায় অর্থাৎশেয়ার বাজার, গরিব দেশকে ঋণ দেয়া-সুদ নেয়া কিংবা মাইক্রোক্রেডিটে। আর এখন সব চেয়ে বড় খাত হলো অস্ত্র উৎপাদন।

গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে কবর বানানো হয়েছে আমেরিকার অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই
মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত যাদের কষ্ট দেয় তারা যদি এর পেছনে ঐ সব বিশেষ বিশেষ সংঘাতের বিশেষ কারণ খুঁজতে যান তাহলে কিছুতেই সমাধানে আসতে পারবেন না। এই পুরো যুদ্ধকান্ডে বিশ্ব অর্থনীতির সংশ্লিষ্টতা কী এবং কী কারণে এসব হয়, সঠিক বৈজ্ঞানিক বিচার-বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই তা বুঝতে হবে। পূর্বের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ লাগিয়ে অস্ত্র বিক্রি করা, পাশাপাশি তার তেল সম্পদ লুট করার জন্য আমেরিকা এই অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। এখানে তার আরেক সহযোগী ইসরায়েল। ইসরায়েল দফায় দফায় ফিলিস্তিনে হামলা চালাচ্ছে। সম্প্রতি ২০১৪ সালের ৭ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা ইসরায়েলি হামলায় ১৪৬২ জন সাধারণ নাগরিকসহ মোট ২২৪১ জন নিহত হয়েছে। ইসরায়েলের অস্ত্র যোগান দিচ্ছে আমেরিকা। ২০১৫ সালের মে মাসে সে ইসরায়েলের কাছে ১.৯ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে। সৌদি আরব হুত্থিদের দমনের নামে ইয়েমেনে যে আগ্রাসন চালাচ্ছে সেজন্য অস্ত্র কিনছে আমেরিকার কাছ থেকে। এরই মধ্যে আমেরিকা ৮০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করছে সৌদি আরবের কাছে।

আবার আইএস-এর বিরুদ্ধে আমেরিকা সবাইকে সাথে নিয়ে যুদ্ধের ডাক দিলেও সে নিজেই আইএস-এর কাছে অস্ত্র বিক্রি করেছে। ইরাকি সেনারা কয়েকবার আইএস-এর জন্য অস্ত্র নিয়ে যাওয়া আমেরিকান বিমান গুলি করে নামিয়েছে। এখানে মধ্যস্থতা করছে ইসরায়েল। আইএস তেল বিক্রি করে অস্ত্র কিনছে। আর আইএস অধিকৃত তেলক্ষেত্র থেকে বেআইনিভাবে তেলবাহী ট্যাংকারের মাধ্যমে ইসরায়েলের আশকেলন বন্দরে তেল জাহাজে বোঝাই হচ্ছে ও পাচার হচ্ছে।

এই মৌলবাদী শক্তিসমূহকে কে তৈরি করেছে? তাদের অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে কারা সহযোগিতা করছে? তালেবান ও তারপর আল-কায়েদা তৈরি হয়েছে আমেরিকার প্রত্যক্ষ ভূমিকায়। আইএস আল-কায়েদারই একটি ফ্র্যাকশন। আজ আমেরিকার রাজনীতিবিদদের মুখেই এই কথা শোনা যাচ্ছে। রিপাবলিক দলের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট রিক স্যান্তোরাম বলেছেন, ওবামাই আইএস সৃষ্টির জন্য দায়ী। ওবামা বলেছেন, তিনি নন। দায়ী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ। সবাইকে সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ বিশেষ করে আমেরিকা অস্ত্র জুগিয়েছে। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন অভিযোগ করেছেন, আমেরিকাসহ ইউরোপের অনেকগুলো দেশ (সব মিলিয়ে প্রায় ৪০টি দেশের কথা বলেছে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা) আইএস-কে সরাসরি অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে, আবার তার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে।

আরেকটা বিষয় এখানে বলে রাখা ভাল, অস্ত্রের একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। কাউকে অস্ত্র দিয়ে অন্য কারও বিরুদ্ধে দাঁড় করালে, কাজ শেষ হবার পর, কোনো বিশেষ বিষয়ে যখন অস্ত্রদাতার সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তখন সে অস্ত্রদাতার বিরুদ্ধেই সেই অস্ত্র ব্যবহার করে। তালেবান, আল-কায়েদা এরা আমেরিকার ক্ষেত্রে তাই করেছে।

কিন্তু এই শেষ নয়, নাইজেরিয়ার জঙ্গীগোষ্ঠী ‘বোকো হারাম’কে অস্ত্র দিচ্ছে আমেরিকা — এই অভিযোগ খোদ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে করেছেন নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বুহারি।সিরিয়ায় আসাদ বিরোধী ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’-কে সব রকম সহায়তা দেয়া হচ্ছিল আসাদকে গদি থেকে সরানোর জন্য। ইসরায়েল এদের প্রত্যক্ষভাবে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা দিয়ে সহায়তা করছে, এমন অভিযোগ করছে খোদ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী। ইসরায়েলের পেছনে আছে আমেরিকা। ২০১৩ সালে আসাদবিরোধী ফ্রি সিরিয়ান আর্মিকে ফ্রান্স অস্ত্র সরবরাহ করতে প্রস্তুত বলে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ। এই ‘ফ্রি সিরিয়িান আর্মি’ এখন আল নুসরা, হরকত হাজাম প্রভৃতি নামে আইএস-এর হয়ে কাজ করছে। ইদানিং আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাশিয়ার সাথে চুক্তি করেছে ফ্রান্স। অর্থাৎ বিশ্বের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অস্ত্র রপ্তানীকারী দুই দেশ এখন সিরিয়ায় অস্ত্র খালাস করতে নামবে আইএস দমনের নামে। ইতিমধ্যে সিরিয়ায় ৪ লক্ষ লোক মারা গেছে। ১০ লক্ষ লোক ঘরছাড়া। ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ায় মারা গেছে লক্ষ লক্ষ লোক। গোটা মধ্যপ্রাচ্য আজ এক বিরাট কবরস্থান। ইরাক আপেক্ষিক অর্থে একটি অগ্রসর রাষ্ট্র ছিল। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফী নানা সংঘর্ষে যুক্ত উপজাতি গোষ্ঠীসমূহকে একত্রিত করেছিলেন। আজ ইরাকের কী অবস্থা? গাদ্দাফিকে হত্যা করে লিবিয়ায় কী প্রতিষ্ঠা করা হলো?

Stockholm International Peace Research Institute (SIPRI) ২০১৪ সালের এক রিপোর্টে দেখিয়েছে, ২০১৩ সালে আমেরিকার অস্ত্র কোম্পানিগুলোর বিক্রি ২০১২ সালের তুলনায় ৪.৫% কমে যায়, কারণ তখন আমেরিকা ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করছিল। বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি অস্ত্র কোম্পানির মধ্যে ২০১১ সালে আমেরিকার ৪২টি কোম্পানি ছিল, ২০১৩ সালে তা নেমে আসে ৩৮-এ। অর্থাৎ যুদ্ধ বন্ধ মানেই অর্থনীতি স্তব্ধ।

ফলে বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই — কি কারণে যুদ্ধ, কেন সংঘাত, কেন দ্বন্দ¦, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ কার লাভের জন্য, কার অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার জন্য। ফলে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দুই’ই টিকিয়ে রাখতে হবে। না হলে পুঁজিবাদ অন্তিম শয্যা নেবে।

মানুষের অপমান-অবমাননাবোধকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় কূপমন্ডুক চিন্তা ও উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রসার ঘটাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীরা
যেহেতু মানুষ এই অত্যাচারের শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করার জন্য কোনো দীর্ঘস্থায়ী লড়াই দেখতে পাচ্ছে না, কোনো কিছুই করতে পারছে না, এই কোনো কিছুই করতে না পারা মানুষের মধ্যে এর অপমান-অবমাননাবোধ তীক্ষè-তীব্র থাকে। মানুষের এই অপমান-অবমাননাবোধকে কাজে লাগিয়ে তাকে বিভক্ত করে রাখার জন্য পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ আজ ধর্মীয় কূপমন্ডুকতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিচ্ছে। ইউরোপের দেশে দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের হাওয়া বইছে। সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ প্রত্যক্ষ যে জবরদস্তি করছে তা মানুষ বুঝতে পারছে, কিন্তু কীভাবে তাকে মোকাবেলা করবে তাকে বুঝতে না পেরে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনীতির মধ্যে যে এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথ আছে তা ধরতে না পেরে, তার দিশা না পেয়ে, ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনার যে উগ্র রূপ তার ভিত্তিতে তারা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছে। এইরকমের অন্ধ শক্তির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিণতিতে তারা পারস্পরিক পার্থক্যকে কেন্দ্র করে হানাহানিও করছে। গোটা বিষয়টাই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আমেরিকা বোমা মেরে ইরাক ধ্বংস করলো, আফগানিস্তান করলো, লিবিয়া করলো — এইসকল দেশের জনগণের মধ্যে আমেরিকার বিরুদ্ধে যে তীব্র ক্ষোভ-রাগ, যেটা সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রকৃত পথ মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী সংগ্রামের পথে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা যেত, তার দিশা না পেয়ে সেই ক্ষোভ-রাগ-ক্রোধ ধর্মীয় কুসংস্কার-কূপমন্ডুকতার পথেই প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণেই আজকে এই ঘটনাগুলো দেখছি।

তাই মানুষের দুঃখ-কষ্টও সাম্রাজ্যবাদীরা সৃষ্টি করেছে, আবার মানুষের মধ্যকার পার্থক্যকে কেন্দ্র করে একদলকে আরেকদলের বিরুদ্ধে লাগানোর আয়োজনও তারা করছে। সমস্ত কিছুর মধ্যে রয়েছে অস্ত্র বিক্রি, অস্ত্র চলাচল।

আমেরিকার একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে একত্রিত হচ্ছে নতুন বিশ্বশক্তিসমূহ
বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দে¦র পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বরাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে আমেরিকার যে একক আধিপত্য সেটা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। রাশিয়া-চীন-ইরান মিলে এক নতুন মেরুকরণ ঘটাচ্ছে। ভারতও একটু একটু করে এতে যুক্ত হচ্ছে।

Purchasing power parity এর ভিত্তিতে বিবেচনা করলে চীনের অর্থনীতি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড়।যদিও সামগ্রিক অর্থনীতি হিসাব করলে এখনও আমেরিকাই বড়। চীনের গড় প্রবৃদ্ধি ৭.৫% যেখানে আমেরিকার ২.৫%। এভাবে চলতে থাকলে ২০১৯ সালে চীন আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে “ইকোনমিস্ট” ভবিষ্যদ্বাণী করেছে। চীনের একক অর্থায়নে গঠিত হয়েছে  Asian Infrastructure Investment Bank (AIIB)। এটি সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। আমেরিকান অর্থনীতিতেও চীনের ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। আবার রাশিয়া অনেক আগে থেকেই পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক জোট গড়ে তুলেছিল। এর মধ্যে আছে Commonwealth of Independent States (CIS), Collective Security Treaty Organisation (CSTO), Eurasian Economic Union (EEU)| এসব করার মধ্য দিয়ে তারা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত বেশিরভাগ দেশের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চালু করেছিল।

এই রাশিয়া ও চীন মিলে ২০০১ সালে গঠন করে Sanghai Co-operative Organisation (SCO)। প্রথমে রাশিয়া ও চীন বাদে মধ্য এশিয়ার কিছু দেশ ছিল এর সদস্য। তারা আন্তঃরাষ্ট্র অর্থনৈতিক সম্পর্কের পাশাপাশি যৌথ সামরিক মহড়াও চালু করেছে যেটি “পিস মিশন” নামে পরিচিত। সম্প্রতি এই SCO-এর সদস্য হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। ইরানের পর্যবক্ষেক সদস্য এবং ২০১৬ সালে জাতিসংঘের সহায়তা শেষ হলে সে এর পূর্ণ সদস্য হবে।

আবার ইতিমধ্যে রাশিয়া-চীন-ভারত-ব্রাজিল-দক্ষিণ আফ্রিকা মিলে গঠন করছে BRICS। সম্প্রতি এই জোট একটি ব্যাংকের জন্ম দিয়েছে New Development Bank (NDB) নামে যার শুরুর পুঁজি ৫০ বিলিয়ন ডলার এবং ক্রমেই তা ৪০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। AIIB এবং NDB মিলে বিশ্বব্যাংকের একচ্ছত্র ভূমিকা আর থাকতে দিচ্ছে না। ফলে BRICS, NDB, EEU, SCO, AIIB মিলে এক নতুন বার্তা দিচ্ছে যা আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক নতুন মেরুকরণ।

চীন বিরাট অর্থনৈতিক শক্তি। রাশিয়াও বিশ্বের বড় পরাশক্তি। ইরান ভূরাজনৈতিক দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশ। পারস্য উপসাগরের মধ্য দিয়ে উত্তর আফ্রিকার দেশসমূহে তার যোগাযোগ, সড়কপথে তার যোগাযোগ মধ্য এশিয়ার দেশসমূহের সাথে। আবার ইরানেরও ইসরায়েল ও সৌদি আরবকে মোকাবেলা করে মধ্যপ্রাচ্যে টিকে থাকার জন্য রাশিয়া ও চীনের সহযোগিতা দরকার।

ভারত একটা মধ্যবর্তী অবস্থানে আছে। আমেরিকা নিজে কোণঠাসা হওয়ার কারণেও আবার ভারত মহাসাগরে নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্যেও ভারতকে হাতছাড়া করতে চায় না। গত জুন মাসে আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার প্রতীক হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। ভারত এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমেরিকার বাজারে সুবিধা নিতে চায়। চীন ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন একটি দেশ। চীনের সাথে আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নে, বাজার দখল ও বাণিজ্যের প্রশ্নে তার দ্বন্দ্ব আছে। আবার রাশিয়া-চীনের সাথেও সে সম্পর্ক রেখে চলেছে। কারণ ইউরেশিয়ান অর্থনৈতিক ইউনিয়ন বিস্তৃত হচ্ছে। ভারত,ইরান, ভিয়েতনাম, মিশর ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহ – আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে ইত্যাদিতে EEU বিস্তৃত হচ্ছে। ফলে একদিকে ইউরেশিয়ান অঞ্চল, তার সাথে চীন ও এই সমস্ত দেশগুলো মিলে যে বিরাট অর্থনৈতিক মুক্ত অঞ্চল গঠিত হতে যাচ্ছে – এর অংশীদার হওয়ার সুযোগ ভারত হাতছাড়া করতে চায় না। আবার তুর্কেমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ভারত গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের যে পরিকল্পনা আছে তা বাস্তবায়িত হলে সেই গ্যাসের ৪২% ভারত পাবে। ফলে ভারতের এ জোটে সম্পর্ক বজায় রেখে চলাই বাস্তবসম্মত। তবে ভারতের চীনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা সবসময় আছে। ফলে একেবারে চীনের সাথে একত্রিত হওয়ার এখনই কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে আমেরিকা ও রাশিয়া-চীন মেরুকরণের দুদিক থেকে যতটুকু সুবিধা নেয়া যায় সে নেবে।

এদিকে ভারত এক মহাপরিকল্পনার সাথেও যুক্ত হচ্ছে। চীন-রাশিয়া-ইরান-ভারত মিলে এক মহাপরিকল্পনা হচ্ছে চীনের নেতৃত্বে। একদিকে চীন, অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্য মিলে ‘One belt, one road’ প্যাটার্নের ‘সিল্ক রোড’ এর মহাপরিকল্পনা নিয়েছে চীন। চীন, ভারত, রাশিয়া ও পাকিস্তানসহ মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় ৫০টি দেশ এতে যুক্ত হবে। যুক্ত দেশগুলো আবার আন্তঃসম্পর্কের জন্য এই রোডকেও বিস্তৃত করবে। যেমন ৬০০০ কি.মি দীর্ঘ সিল্ক রোডকে আবার পাকিস্তান-চীন অর্থনৈতিক করিডোর করে পাকিস্তানের দিকে ৩০০০ কি.মি বিস্তৃত করবে চীন। আবার চীন-মায়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত করিডোরের মাধ্যমে চীন-ভারত মাল্টিলেন হাইওয়ে তৈরি হবে। এই ভারত, চীন, পাকিস্তান ও গোটা মধ্য এশিয়া এবং ইরান Ñ এই বিরাট অঞ্চলটি সুপার হাইওয়ে, হাইওয়ে, সমুদ্র বন্দর, বিমান বন্দর, স্থল পথ, নৌপথ, আকাশপথ, পাইপলাইন ও ফাইবার ক্যাবলের মাধ্যমে এক কমপেক্সে নেটওয়ার্কে যুক্ত হবে।

মূলত মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার তেলক্ষেত্রের বিরাট বাজারই এ নেটওয়ার্ক তৈরির পরিকল্পনার পেছনে আছে। আর আছে বাজার সংকট, বাজার দখলের প্িরতযোগিতা, এক সাম্রাজ্যবাদীর আধিপত্যকে আরেক সাম্রাজ্যবাদীর টেক্কা দেয়ার প্রতিযোগিতা। আবার এই নেটওয়ার্ককেই জনসম্মুখে দেখানো হবে উন্নয়ন বলে, সুযোগ বলে, জনগণের জন্য মানবিক(!) পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সেবা বলে। এই নতুন চিত্রায়নে যাই হোক পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের সংকট দূর হবে না, অর্থনীতির সামরিকীকরণ আরও বাড়বে এবং তা আরও যুদ্ধের জন্ম দেবে।

একটি বিশ্বযুদ্ধ হলে সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সংকটের সাময়িক সমাধান করতে পারতো। বিপুল পরিমাণ অস্ত্র খালাস করে তার ধ্বংসোন্মুখ অর্থনীতিতে সাময়িক তেজিভাব নিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু এই মুহুর্তে তারা তা করতে পারছে না। জাপানি সেনারা মিত্র দেশের নিরাপত্তার প্রয়োজনে যৌথভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারবে, এই মর্মে জাপানী পার্লামেন্ট যখন তার সংবিধানে সংশোধনী আনলো, তখন জাপানের লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। প্রবল বিরোধিতার ঢেউ তৈরি হয় দেশের ভেতরে। একই পরিস্থিতি ইউরোপেও। দুটো বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ইউরোপের মানুষকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। প্রচন্ড যুদ্ধবিরোধী মনোভাব ইউরোপে। তাই ইউরোপের এই মুহূর্তে যুদ্ধে যাওয়ার কোনো উপায় নেই।

ফলে এই মুহূর্তে বিশ্বযুদ্ধ লাগানো সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু সংঘাত, সংঘাতময় পরিস্থিতি, যুদ্ধের পরিস্থিতি, যুদ্ধের টেনশন ইত্যাদি তৈরি থাকবেই। না হলে অস্ত্র বিক্রি হবে না। CSTO এখনও NATO-র বিরোধিতা করার মতো শক্তিশালী হয় নি। কিন্তু চীন-রাশিয়া-ইরানকে কেন্দ্র করে যে অর্থনৈতিক জোট দানা বাঁধছে তা অচিরেই যদি সামরিক জোটের দিকে যায় — তখন দুই জোট যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তৈরী করবে, দুই জোটের শরীকরা নিজ নিজ প্রতিরক্ষার জন্য আরও অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হবে, অর্থনীতির আরও ব্যাপক সামরিকীকরণ ঘটবে।

তবে নতুন বৈশ্বিক মেরুকরণের ব্যাপারে আমাদের এ ব্যাখ্যাটি বেশ কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের ধারণা মাত্র। এটা যে ঘটে গেছে এমন নয়। এটা যে পরিবর্তিত হতে পারে না তাও নয়। তবে সা¤প্রতিক আন্তর্জাতিক ঘটনাসমূহের বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনায় ঘটনাসমূহ এই ধরনের মেরুকরণেরই আভাস দিচ্ছে।

আমাদের দেশের পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই বুঝতে হবে
পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই চরম বন্ধ্যাত্ব মানুষের বিকাশের সবরকম রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। সব দিক থেকে ব্যর্থ এ ব্যবস্থা জবরদস্তি করে টিকিয়ে রাখার জন্য পুঁজিপতিদের আজ্ঞাবহ রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করছে। নির্বাচনের নাটক সাজিয়ে দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের নামে ফ্যাসিবাদ দেশে দেশে অনেক আগে থেকেই কায়েম হয়েছে। ওই নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যতটুকুও বা গণতন্ত্রের চিহ্ন ছিল তাও আজ তারা রাখতে চাইছে না। আমাদের দেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন। জনগণ এখন দর্শকমাত্র। দেশে অবারিত সস্তা শ্রম, হ্রাসকৃত মূল্যে জ্বালানি, ভূমিসহ অবকাঠামো সরকারি উদ্যোগে বরাদ্দ করা, যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে কর মওকুফ — ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো এখানে পুঁজি খাটাতে চায়। দেশীয় বৃহৎ বুর্জোয়ারা তাদের সাথে কোলাবোরেশনে সেই মুনাফার ভাগ পেতে চায়। ইতোমধ্যেই পিএইচপি তার ফ্যাক্টরি চীন থেকে সরিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। স্যামসাংকে চট্টগ্রাম ইপিজেডে ৫০০টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এজন্য দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ দরকার। এই বিরাট শ্রমশোষণ যাতে নিরবে হতে পারে, কোনো প্রতিবাদ যাতে ধ্বনিত না হয় — সেজন্য তারা আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় রাখবে। রাখবে জোর করে, মানুষকে শব্দও করতে দেবে না। গোটা দেশকে তারা কাপুরুষ বানিয়ে দিতে চাইছে।

এই সময়ে টানা ব্লগার-লেখক-প্রকাশকদের হত্যা করা হচ্ছে। একটা ষড়যন্ত্রমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে দেশে। মানুষ এসব ঘটনায় আতঙ্কগ্রস্ত। এসবের মাধ্যমে বাস্তবে মানুষকেই হুমকির মধ্যে রাখা হয়েছে। সরকার নির্বিকার। জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমনের জন্য যত কঠোরতা সরকারের পক্ষ থেকে লক্ষ করা যায়, এ ব্যাপারে তার অণু পরিমাণও দেখা যাচ্ছে না।

এসবের সাথে সাথে শাসকগোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে নষ্ট করে দিচ্ছে মানুষের নৈতিক বল। প্রতিবাদের শক্তি নষ্ট করার জন্য সুবিধাবাদিতা, ঠকানো, প্রতারণা করা, নীচ প্রবৃত্তিকে উস্কে দেয়াসহ হীন মনোবৃত্তির জন্ম দিয়ে চলেছে প্রতিদিন। যারা সমাজে মত তৈরি করে, জনগণের মধ্যকার সেই শিক্ষিত সচেতন অংশকে তারা বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে কিনে নিচ্ছে। যারা বুঝে শুনে তাদের পক্ষে যাবার লোক নয় তাদেরও বিভিন্ন পদ, পুরস্কার দিয়ে, সম্মান দিয়ে সূক্ষ্মভাবে পুঁজিপতিরা তাদের শোষণের পক্ষে মতামত গড়ে তোলার কাজে লাগাচ্ছে। দেশকে যারা দুর্দিনে পথ দেখাবেন বলে মানুষ মনে করে, সেই বুদ্ধিজীবীরা রীতিমত ভাড়া খাটছেন, ফ্যাসিবাদী শাসনকে জায়েজ করার জন্য নানা মিষ্টি যুক্তি মানুষের সামনে হাজির করছেন। যারা এই শিবিরে এখনও সচেতনভাবে যুক্ত হয়ে যাননি, তারা হতাশ। ফলে সমাজে এক চূড়ান্ত নৈতিক সংকট বিরাজ করছে।

সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের মাধ্যমেই দেশে দেশে সর্বহারাশ্রেণীর ঐক্য গড়ে উঠতে পারে
বিশ্ব পরিস্থিতি আজ সমাজতন্ত্রের অনিবার্যতার কথা ঘোষণা করছে। একদিন পরীক্ষিত সত্য হিসেবে যা এসেছিল, ভেতরের দুর্বলতার কারণে সে পর্যুদস্ত হলেও তার বিপুল সম্ভাবনা এখনও বিদ্যমান। একদিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অবস্থান পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করেছিল। পৃথিবীর বুকে শান্তি স্থাপন করেছিল। আজ সমাজতান্ত্রিক শিবির নেই। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ আজ গোটা পৃথিবীতে স্থানীয় ও আঞ্চলিক যুদ্ধ লাগিয়ে রেখেছে। এখন সারা বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বেশি। তাই আজ দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ব্যতিরেকে বিশ্বে শান্তি স্থাপন অসম্ভব। পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা যে ভয়াবহ সংকটের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিনিয়ত দিচ্ছে তা থেকে রক্ষা পাওয়ারও আর কোনো উপায় নেই।

কিন্তু সংকট বাড়লেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিপ্লব হবে না। প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সংকটে জেরবার মানুষ প্রতিদিনই তো বিক্ষুব্ধ হচ্ছে, সহ্য করতে না পেরে একসময় রাস্তায় নামছে, পুলিশের বিরুদ্ধে লড়ছে, গুলি খাচ্ছে — কিন্তু সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সংকট ফিরে ফিরে আসছে। সাম্প্রতিক ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট ও আরব বসন্তে লক্ষ কোটি মানুষ রাস্তায় নেমেছে। ইউরোপে একের পর এক ধর্মঘট হচ্ছে শ্রমিকদের। কিন্তু সমাধান হলো কোথায়? এত ব্যাপক জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে কেন? আবার এগুলো গড়ে উঠছেই বা কিভাবে?

স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এত লোক একত্রিত হয়ে বেশ কিছুদিন একসাথে চলতে পারে না। আসলে মানুষের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ-অসন্তোষ সব সময় লাঠির জোরে দমন করা যায় না। এটা পুঁজিপতিরা বোঝে। এ জন্যই এ সকল বিক্ষোভে এনজিওগুলো ঢোকে, নেতৃত্ব দেয়, সেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করে। এরা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে কথা বলে। সরকারের বিরুদ্ধেও বলে। তথ্য-ঘটনা-বর্ণনা দিয়ে তারা অনেক কথা বলে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে যে সামাজিক ব্যবস্থার কারণে এসকল ঘটনা ঘটছে তা এড়িয়ে যায়। আবার কখনও উপর উপর পুঁজিবাদবিরোধী কথাবার্তাও তারা বলে। কিন্তু পুঁজিবাদবিরোধী কথাটা বললেই শুধু হবে না। পুঁজিবাদবিরোধী শক্তি, যারা পুঁজিবাদকে উৎখাত করবে, সেই শক্তি গড়ে ওঠার সংগ্রাম ব্যতিরেকে পুঁজিবাদবিরোধী কথা কিছু স্লোগান মাত্র, তার কোনো কার্যকারিতা নেই। সেই শক্তি বিপ্লবী পার্টির নেতৃত্ব ছাড়া কোথাও বিকশিত হতে পারে না। ফলে বিরাট বিরাট আন্দোলনগুলো কালক্রমে হয়ে পড়ছে বিরাট বিরাট ঘটনা, তা কোনো পরিণতিতে যেতে পারছে না। দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনে পরিণত হওয়ার মতো সুসংগঠিত রূপ সে পাচ্ছেনা। সেই রূপ পুঁজিবাদবিরোধী বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব ছাড়া পাবেও না। তাই জনগণের যত ক্ষোভ নিয়েই সে আসুক না কেন তা কোনো পরিণতি পাবে না। সিয়াটল থেকে আরব বসন্ত পর্যন্ত খেয়াল করে দেখলে তাই দেখা যাবে।

এ বিষয়গুলো পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার কর্তারা ঠিকই বোঝে। তাই সে নানা ইনডিরেক্ট ফোর্স তৈরি করে যাদের সাথে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও সাম্রাজ্যবাদী ফোর্সসমূহের যোগাযোগ প্রত্যক্ষভাবে বোঝা যায় না। তারা বিভিন্ন ফোরাম তৈরি করেছে, পরিবেশবাদী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন তৈরি করেছে। ফলশ্রুতিতে মানুষ বারে বারে তাদের তাৎক্ষণিক চেতনা থেকে যে বিক্ষোভ তৈরি করছে তা সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে পরিণত হতে পারছে না।

এ জন্য লাগবে সেই পার্টি, সেই আদর্শ, যার ভিত্তি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং তার আজকের যুগে সবচেয়ে উন্নত রূপ কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা। সেই চিন্তাধারাকে ধারণ করেই আজকের যুগে দেশে দেশে দল গড়ে তোলার সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। কারণ একটি সঠিক বিপ্লবী দলের নেতৃত্ব ব্যতিরেকে এই সমস্ত আন্দোলন সংগ্রাম লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে গড়ে উঠা বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে দেশে দেশে পুঁজিবাদবিরোধী গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেই আজকের দিনে যথার্থ মুক্তির সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।

এইরকম পরিস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে ও সারা বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তোলার জন্য বাম গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ ও দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার জন্য আমরা আবেদন করছি।

সাম্যবাদ ডিসেম্বর ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments