নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। অধিকার রক্ষা তো দূরের কথা অধিকার হরণের অভিযোগ গণতন্ত্রের ধ্বজাধারি খোদ আমেরিকার বিরুদ্ধে। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই-এর সাবেক কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেনের ফাঁস করা তথ্যের বরাতে এ খবর বিশ্ববাসী জেনেছে অনেক আগেই। এবার শুধু নিজ দেশের নাগরিকের ওপর নয়, অভিযোগ উঠেছে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল-সহ বিশ্বের ৩৫টি দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ফোনে আড়িপাতার।
জার্মানির সাপ্তাহিক পত্রিকা ডার স্পাইগেল পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গত ১০ বছর ধরেই মার্কেলের ফোনে আড়ি পেতেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ঘটনায় জার্মানি সরকার তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। শুধু জার্মানি নয়, এডওয়ার্ড স্নোডেনের বরাতে ব্রিটিশ গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, ৩৫টি দেশের নেতাদের ওপর এই নজরদারি কার্যক্রম চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফ্রান্স, স্পেন, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিলের মতো দেশ রয়েছে এই তালিকায়। গণতন্ত্রের দাবিদার রাষ্ট্রের এই হচ্ছে গণতন্ত্রের নমুনা।
গণতন্ত্র যে শুধু নির্বাচনী বিধিব্যবস্থা নয়, মানুষের জীবনকে উন্নত করার প্রয়োজনে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ তার মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা – একথা মানুষ ভুলতেই বসেছে। মৌলিক অধিকার যেমন, তেমনি মতামতের স্বাধীনতাও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। ব্যক্তিতো বটেই, এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করবে না আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ নীতি গণতন্ত্রের ভিত। কিন্তু আমরা দেখেছি আমেরিকা কখনো এ নীতির তোয়াক্কা করে নি। কখনও স্বৈরাচার কখনও জঙ্গীবাদ সন্ত্রাস ইত্যাদির ধুয়া তুলে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে যুদ্ধ বাধিয়েছে। এসব দেশে যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট হয়েছে মানবিক বিপর্যয়।
কার স্বার্থে এ যুদ্ধ? আমেরিকার পুঁজিবাদি-সাম্রাজ্যবাদি অর্থনীতি বাজার সংকট মোকাবেলার পথ না পেয়ে দিশেহারা। এ অবস্থায় সংকটগ্রস্ত অর্থনীতি তথা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের বাঁচিয়ে রাখতে অর্থনীতির সামরিকীকরণ করছে। এর অনিবার্য ফল যুদ্ধ। যুদ্ধ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদি অর্থনীতির বাঁচবার কোনও পথ খোলা নেই। যুদ্ধ মানুষের জীবন বিপন্ন করে, জনপথে মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়িয়ে রাখে। যুদ্ধ-ব্যয় মেটাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের অধিকার সংকুচিত করছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার। কাজ না পেয়ে পথে পথে ঘুরছে। সাম্প্রতিক সময়েও ‘শাট ডাউন’-এ প্রায় আট লক্ষ মানুষ বেতন না পেয়ে বাড়িতে বসে থাকতে বাধ্য হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ বলে পরিচিত আমেরিকার পুঁজিবাদি অর্থনীতি এমনই সংকটগ্রস্থ যে, মানুষের অন্ন-বস্ত্র-স্বাস্থ্য-বাসস্থানের সমস্যা মেটাতে না পেরে, বিক্ষুব্ধ জনগণের হাত থেকে শোষণ-বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে নিজ দেশের নাগরিকদেরই হুমকি মনে করছে। নাগরিকদের স্বাধীনতা হরণ করে ব্যক্তিগত টেলিফোনে আড়ি পাতছে। মানুষের কোনো রকম গোপনীয়তা বলে আর কিছু থাকছে না। এটাও গণতন্ত্রের লঙ্ঘন। যে আমেরিকা একদিন গণতন্ত্রের স্লোগান তুলে বলেছিল – অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল – কোথায় সে গণতন্ত্র? কোথায় আজ মতামতের স্বাধীনতা? ব্যক্তির স্বাধীনতা? একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থ রক্ষার্থে সে তার সমস্ত প্রতিশ্রুতি জলাঞ্জলি দিয়েছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, মূল্যবোধকে গলা টিপে মারতে চাইছে। সাম্রাজ্যেবাদী লুণ্ঠনের স্বার্থে দেশে দেশে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের পথ ধরে যুদ্ধ বাধাচ্ছে।
আমেরিকার এই লুণ্ঠণ-আগ্রাসনের কাজে ঘনিষ্ঠ সহযোগী দেশগুলোও আমেরিকার নজরদারি-খবরদারি থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আসলে গণতন্ত্র তাদের মুখের বুলি। পুঁজিই এখন সর্বময় ক্ষমতার মালিক। পুঁজিতন্ত্রই রাষ্ট্রতন্ত্রকে পরিচালিত করছে। তাই পুঁজিতন্ত্র ও মানুষের স্বাধীনতা Ñ এ দুটো আজ একসাথে থাকতে পারে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বেকারি সংকটের জন্য দায়ী যে পুঁজিবাদি-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা, সেই ব্যবস্থা তার অস্তিত্বের স্বার্থে ভিন দেশের সার্বভৌমত্ব, মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। তাই সত্যিকারের স্বাধীনতা পেতে চাইলে এই পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে।
মার্কিন গোয়েন্দা নজরদারি ঃ এরই নাম গণতন্ত্র!
RELATED ARTICLES