Wednesday, November 20, 2024
Homeছাত্র ফ্রন্টমুক্তচিন্তা ও চিন্তার স্বাধীনতা

মুক্তচিন্তা ও চিন্তার স্বাধীনতা

Moktomonaসূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে নাকি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে — এই প্রশ্নে যদি কেউ বলে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে — তাহলে লোকে তাকে নির্ঘাত আজ বাতুল ভাববে। অথচ একসময় এই ধারণাই ছিল প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠিত সেই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্রুনো, কোপার্নিকাস বলেছিলেন — পৃথিবী-ই সূর্যের চারদিকে ঘোরে। গাণিতিকভাবে তা প্রমাণও করে দেখিয়েছেন। এই সত্য আবিষ্কার ও প্রচারের কারণে ধর্ম যাজকরা ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ছিল। গ্যালিলিওকে সারাজীবন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনাতিপাত করতে হয়েছিল। তাতে সত্য চাপা পড়েনি, মেঘে ঢাকা সূর্যের মতোই অন্ধকার সময়ের অবগুণ্ঠন খুলে সূর্যের মহিমা স্ব-মহিমায় আত্মপ্রকাশ করেছে। অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকার জীবন থেকে মানুষকে সত্য ও যুক্তির আলোয় উদ্ভাসিত করেছে। অন্ধকার রাস্তায় টর্চ জ্বেলে মানুষ যেমন সঠিক পথে এগিয়ে যায়, বিজ্ঞানও তেমনি মানুষের অচেনা পৃথিবীর অন্ধকার পথকে আলোকিত করে সঠিক পথের সন্ধান দেয়, অজানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রক্ষণশীল সমাজের সত্যের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। স্বার্থে আঘাত লাগে বলে রক্ষণশীলরা বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়, বিজ্ঞানের চিন্তাকে যারা ধারণ করে, লালন করে তাদের উপর অত্যাচার চালায়, কখনো কখনো জীবননাশের পথও বেছে নেয়। জীবন সংহার করতে পারলেও চিন্তাকে, সত্যকে সংহার করা যায় না। বিজ্ঞান সেই সত্যকেই ঊর্দ্ধে তুলে ধরে, যে সত্য অমোঘ। তাই সত্যের শক্তি-ই বিজ্ঞানের শক্তি। আধুনিক সভ্যতার ভিত। যে জাতি বিজ্ঞানের এই শক্তিকে যতবেশি চিনতে পেরেছে, ধারণ করতে পেরেছে ও কাজে লাগিয়েছে তারাই উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করেছে। এই উন্নতি শুধু বস্তুগত সম্পদের প্রাচুর্য তৈরিতে নয়, বিজ্ঞানের সাধনা তো সত্যের সাধনা, আর সত্যের সাধনাই তো মনুষ্যত্বের সাধনা, তাই বিজ্ঞান উন্নত নৈতিকতা ও মূল্যবোধের আধারে সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছে। আর যখনই যারা বিজ্ঞানকে প্রত্যাখান করে বদ্ধমূল বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করেছে, সে জাতির বৌদ্ধিক ও নৈতিক বিকাশ হয়ে পড়েছে স্থবির।

অভিজিৎ হত্যা ভিন্নমত নয়
বৈজ্ঞানিক চিন্তার উপরই আক্রমণ

শত শত বছর আগে বিজ্ঞানের সত্যকে তুলে ধরার জন্য ব্রুনোকে অগ্নিকুন্ডে জীবন দিতে হয়েছিল। সেটা ছিল অন্ধকার যুগ। আর আজ তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও বিজ্ঞানের চিন্তাকে প্রচারের কারণে খুন হতে হয় অভিজিৎ রায়কে। অভিজিৎ রায় প্রচারিত মতের সাথে কারও মতভিন্নতা হতেই পারে। তাই বলে তাঁকে হত্যা করতে হবে? যে আদর্শের কথা বলে তাঁকে হত্যার কথা স্বীকার করা হলো— রক্তপিপাসু ওই হাত কোন্ ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করল? এতেই কি তার মহত্ত্ব? এতেই কি সমাজে সেই আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হলো? মতভিন্নতা হলে যুক্তি দিয়ে তাকে খ-ন করাই তো আদর্শের সঠিকতা প্রমাণের প্রকৃষ্ট পন্থা। এতটুকু পরমতসহিষ্ণুতা না থাকলে সে আদর্শের উদারতা-মানবিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আবার অন্যমত, ভিন্নমত বলে সবাই যেভাবে বিষয়টিকে দেখছেন তাতেও বড় একটি সত্য আড়ালেই চাপা পড়ছে। সমাজে বিভিন্ন ধরনের মানুষের বাস। তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, বেড়ে উঠা, আর্থ-সামাজিক অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদির ভিন্নতার কারণে একই বিষয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন ধারণা জন্ম লাভ করে। তাই বলে সবক’টি ধারণাই সত্য নয়। সাধারণভাবে ভিন্ন কথাটি ব্যবহৃত হলেও তার মধ্যে যেকোন একটি সত্য আছে অথবা কোনটিই সত্য নয়, সঠিকটি খুঁজে নিতে হবে। যুক্তি ও বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে এই সত্যকে চিনে নিতে হয়। অভিজিৎ রায় জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সেই বৈজ্ঞানিক সত্যের অনুসন্ধানেই নিয়োজিত ছিলেন। তাই একে বিজ্ঞানচিন্তা না বলে ভিন্নমত বললে বৈজ্ঞানিক সত্যকে পরোক্ষে আর আট-দশটি সাধারণ ধারণার পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়। এইভাবে পরমতসহিষ্ণুতা, গণতান্ত্রিক চেতনার কথা বলতে বলতে নিজের অজান্তেই কেউ কেউ বৈজ্ঞানিক সত্যকেই খাটো করে ফেলেন।
রাষ্ট্রই আজ মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে
বিজ্ঞান সমস্ত রকম অতি প্রাকৃতিক রহস্যের আবরণ উন্মোচন করে বিধায় কায়েমী স্বার্থবাদী মৌলবাদীরা বৈজ্ঞানিক চিন্তাসহ সকল প্রকার মুক্তচিন্তার ঘোরতর বিরোধী। এর বিরুদ্ধে মানব জাতি লড়াই করে একদিন যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেই বুর্জোয়া গণতন্ত্রও আজ আর মুক্তচিন্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। যেমন আমেরিকা নিজের দেশের নাগরিক তো বটেই, বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনেতাদের টেলিফোনেও আঁড়ি পাতছে। বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রের ফেরি (!) করে যে রাষ্ট্র, সেই দেশে এই হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা-গণতন্ত্রের নমুনা। আমাদের দেশেও টেলিফোন-মোবাইলে আড়ি পেতে রাষ্ট্র নজরদারি করছে। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তির স্বাধীনতা নেই, গণতন্ত্রে আছে— এই মতের প্রবক্তরা এইসব দেখে শুনে কি বলবেন? রাষ্ট্র নিজেই যেখানে এরকম, স্বৈরতান্ত্রিক-অগণতান্ত্রিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে সেখানেই মৌলবাদী চিন্তার বীজ তরতর করে বেড়ে উঠে। তাই মুক্তচিন্তার প্রতিপক্ষ শুধু মৌলবাদীরা নয়, রাষ্ট্র নিজেও। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলো, সে রাষ্ট্র কেন এমন প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র ধারণ করে? মুক্তচিন্তাকে ভয় পায়? চিন্তার স্বাধীনতাকে হরণ করে?

মুক্তচিন্তা ও চিন্তার স্বাধীনতা কি?
মুক্তচিন্তা এক প্রকার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি যা মনে করে, জীবন-জগতের সামনে আসা সমস্ত প্রশ্নকে বিজ্ঞান এবং যুক্তির আলোকে বিচার করা উচিত; মতামত গঠনের ক্ষেত্রে প্রথা, অন্ধবিশ্বাস এবং পূর্ব নির্ধারিত সত্য দ্বারা প্রভাবিত হওয়া অবাঞ্চনীয়। মুক্তচিন্তা বলে যে, জ্ঞান ও যুক্তির অনুপস্থিতিতে দাবিকৃত কোন মতকেই সত্য হিসেবে গ্রহণ বা প্রত্যাখান করা উচিত নয়। সুতরাং মুক্তমনারা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, বাস্তবসত্য এবং যুক্তির আলোকে মত গড়ে তোলে। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলতে হয়, মুক্তচিন্তা বলতে আসলে কিসের থেকে মুক্ত বুঝব? মুক্ত মানে সমস্ত অজ্ঞতা-ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার-পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্তচিন্তা। এর মানে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় চিন্তা না করেই খেয়াল-খুশি মতো যেকোন কিছু করা বা বলা নয়। অনেকেই মুক্তচিন্তা বলতে ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম করে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করাকে বোঝেন, কোনো নিয়ম না মানাকে বোঝেন। তারা এই সত্যটি ভুলে যান যে, জাগতিক কোনো কিছুই নিয়মের বাইরে নয়, সবকিছু নিয়মের শাসনাধীন। এমনকি মানুষের চিন্তার উৎপত্তির ও প্রতিদিনের চিন্তা করার পদ্ধতিরও একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়ম সম্পর্কে জানা ও তদনুযায়ী ক্রিয়া করতে পারার নামই স্বাধীনতা। সমাজ বিকাশের নিয়ম মেনে চিন্তা ও কাজ করতে পারার নামই প্রগতিশীলতা। এ না হলে জেনে হোক বা না জেনে হোক প্রচলিত সামাজিক নিয়ম বা স্থূল প্রাকৃতিক প্রয়োজনের ভিত্তিতেই জীবন পরিচালনা করা হয়। এভাবে কখনো মুক্তচিন্তক বা স্বাধীন মানুষ হওয়া যায় না। বিজ্ঞান ও যুক্তির আলোকেই মানুষের স্বাধীনতা অর্জিত হতে পারে। এ স্বাধীনতা যে অর্জন করতে পারে, সেই অন্ধবিশ্বাস, চিরায়ত প্রথা ইত্যাদি সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শেখে। এই প্রশ্নই নতুন জ্ঞান-নতুন চিন্তার জন্ম দেয়। একটি সত্যিকারের মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র মুক্তচিন্তা করা ও চিন্তার স্বাধীনতার পরিবেশ তৈরি করে দেয়।
ইউরোপে মুক্তচিন্তার লড়াই
বাধাহীন পরিবেশ নতুন জ্ঞান সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করে — এ কথা যেমন ঠিক তেমনি যুগে যুগে নতুন জ্ঞান, নতুন সত্য পুরাতন জীর্ণ সমাজকে চ্যালেঞ্জ করে বলে, সেই সমাজের যারা রক্ষক তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় বলে, তারা নতুন সত্যের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এই প্রতিকূলতা মোকাবেলা করেই নতুন সত্য জায়গা করে নেয়। যেমন করে মধ্যযুগের অন্ধকার ভেদ করে ইউরোপে একদিন মুক্তজ্ঞানের সূর্য উদিত হয়েছিল, নবীন জীবনের প্রয়োজনে অন্ধ বিশ্বাস আর শাস্ত্রের আনুগত্য ভেঙে বিজ্ঞান আর যুক্তির দ্বারস্থ হয়েছিল। অর্থনৈতিক উন্নতি ও বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানুষের মনে নতুন চিন্তা, নতুন ভাবের আলোড়ন তুলেছিল। সেই ভাবসম্পদ ধারণ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাসহ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণের জোয়ার এসেছিল। ইতিহাসে এটি ইউরোপের রেনেসাঁ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। রেনেসাঁ শব্দের বাংলা অর্থ পুনর্জন্ম। সত্যিকার অর্থেই সেদিন ইউরোপে মানুষের পুনর্জন্ম হয়েছিল। রেনেসাঁ সমস্ত রকম পূর্বচিন্তা পরিহার করে মানুষকে মুক্ত দৃষ্টিতে পৃথিবীকে চিনতে শিখিয়েছে। কিন্তু নির্বিঘেœ এই কাজ হয়নি। যাজকতন্ত্র মুক্তজ্ঞানের পথে বড় বাধা ছিল। এর বিরুদ্ধে লড়েই সেদিন ইউরোপে মুক্তজ্ঞান অর্জন তথা চিন্তা করার স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছিল।
ভারতবর্ষে মুক্তচিন্তার প্রসার
ভারতবর্ষের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। শাস্ত্রের শাসন এখানে মানুষকে মানবিক জীবন থেকে বঞ্চিত করে হীন অবস্থায় পতিত করেছিল। কুসংস্কার-অন্ধবিশ্বাস, জাত-পাত-বর্ণে বিভক্ত ছিল সমাজ। অন্ধকার পাঁচিলে ঘেরা পূঁতিগন্ধময় জীবন। সে সময় বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আধুনিক শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, আধুনিক ধ্যান-ধারণার সাথে পরিচিত হয় এখানকার মানুষ। ফলে অর্থনৈতিক ও সমাজ জীবনেও পরিবর্তন সূচিত হতে থাকে ক্রমান্বয়ে। এসবের সংস্পর্শে এখানকার মানুষের মধ্যে আধুনিক গণতান্ত্রিক জীবনবোধ, উন্নত রুচি-সংস্কৃতি, স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা তৈরি হতে থাকে। একদিকে ইউরোপীয় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিন্তা-ভাবনার প্রভাব এবং অন্যদিকে পুরনো সামন্তীয় ব্যবস্থার গর্ভেই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান এর পিছনে মূল ভূমিকা রাখে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, ডিরোজিও, অক্ষয় কুমার দত্তরা এরই ফসল।

এ প্রসঙ্গে এ যুগের অন্যতম মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের ঐতিহাসিক মূল্যায়ন স্মরণীয়। তিনি বলেছেন, “ রাজা রামমোহন রায় থেকেই এদেশের রেনেসাঁস আন্দোলনের শুরু বলা চলে। ইউরোপের বুর্জোয়া মানবতাবাদী ধ্যানধারণা ও চিন্তাভাবনাগুলিকে ধর্মের মূল সুরটির সঙ্গে মিলিয়ে ধর্মীয় সংস্কারের পথেই তিনি এদেশে রেনেসাঁস আন্দোলনের জন্ম দেন। ফলে, এদেশের রেনেসাঁস আন্দোলন ‘রিলিজিয়াস রিফর্মেশন’-এর (ধর্মীয় সংস্কারের) পথ ধরে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের অভ্যুত্থান রেনেসাঁস আন্দোলনে একটি অভুতপূর্ব ঘটনা এবং যতদূর মনে হয় বিদ্যাসাগর মশাই-ই প্রথম ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় সংস্কারের পথে রেনেসাঁস আন্দোলনের মধ্যে একটা ব্রেক ঘটালেন। তিনিই প্রথম এদেশে যতদূর সম্ভব মানবতাবাদী আন্দোলনকে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও যুক্তির শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে চাইলেন।” ফলে আমরা বলতে পারি এদেশের মানুষকে মধ্যযুগীয় কূপমণ্ডুকতা থেকে মুক্ত করার জন্য ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এনে বিদ্যাসাগর-ই প্রথম সেক্যুলার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তথা মুক্তচিন্তার প্রসারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর অজ্ঞতা থেকে মুক্ত উদার মানবিক-গণতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। শিক্ষার মধ্য দিয়েই তা সম্ভব বলে আজীবন শিক্ষাবিস্তারে ব্রতী ছিলেন। শিক্ষাবিস্তার বলতে যথার্থ শিক্ষাদানের কথাই তিনি বলেছিলেন। তাই পাঠ্যবিষয়বস্তু কি হবে—এটা নিয়ে ইংরেজদের সাথেও বাদানুবাদ করেছেন। বার্কলের দর্শন না পড়িয়ে মিলের লজিক পড়ানোর কথা বলেছিলেন। যাতে করে “ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দুই দর্শনেই সম্যক জ্ঞান থাকলে, এদেশের পণ্ডিতদের পক্ষে আমাদের দর্শনের ভ্রান্ত ও অসারতা কোথায় তা বোঝা সহজ হবে। … আমার ধারণা, সর্বমতের দর্শন পাঠ করার সুযোগ দিলে ছাত্রদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত গড়ে উঠবে। তার সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান থাকলে দুই দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য কোথায় তাও তারা বুঝতে পারবে।”(নোট্স অন সংস্কৃত কলেজ- বিদ্যাসাগর) এইভাবে বিদ্যাসাগর চেয়েছিলেন সমস্ত রকম পূর্ব ধারণা, সংস্কারমুক্ত হয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জগৎ-জীবনকে দেখার, বিচার করার দৃষ্টিভঙ্গি-যুক্তিবোধ গড়ে উঠুক। তাহলেই তারা যথার্থ মুক্তমনের অধিকারী হবে, স্বাধীন আত্মমর্যাদাশীল মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে। বিদ্যাসাগরের আগে-পরে রামমোহন-ডিরোজিও-অক্ষয়কুমার দত্তও মুক্তচিন্তার পতাকাবাহী ছিলেন। মুক্তচিন্তার প্রসারে ভূমিকা রাখায় সমাজপতিদের বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন কমবেশি সবাই। রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজেদের কৃতকর্মে অটল থেকেছেন। আর এটা করতে গিয়ে একটা চারিত্রিক দৃঢ়তাও অর্জন করেছিলেন। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের পর ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্রকে লেখা পত্রে বিদ্যাসাগর বলছেন, “বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম। এই জন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোন সৎ কর্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই। এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্ত স্বীকারে পরাঙ্মুখ নহি।.. আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি; নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব; লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচিৎ সংকুচিত হইব না।” এই পত্র থেকেই বিদ্যাসাগরের লড়াই ও চারিত্রিক দৃঢ়তা বোঝা যায়। বিদ্যাসাগর প্রমুখের চেষ্টায় বাঙলার হিন্দু সমাজ ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে, পাশ্চাত্যের আধুনিক জ্ঞানের সন্ধান পেয়ে যতটা আলোকিত হয়েছিল, সেই সময় বাঙলার মুসলিম সমাজ ইউরোপীয় আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান বর্জন করে আধুনিক জ্ঞান ও চিন্তার ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল। এ প্রেক্ষাপটে ৩০’র দশকে বহুমুখী উদ্যোগে ঢাকায় শিখাগোষ্ঠী কর্তৃক ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’ পরিচালিত হয়। উদ্যোক্তাদের মধ্যে আবুল হুসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন অন্যতম। জ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে তাঁরা অন্ধবিশ্বাসকে প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। ফলাফলে রক্ষণশীল-গোঁড়া মুসলিম ধর্মান্ধদের আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। একপর্যায়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে মুসলিম সাহিত্য সমাজের সভা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ঢাকার নবাব বাড়িতে আবুল হুসেন ও আব্দুল ওদুদদের নিয়ে বিচারসভাও বসে। তারপরও এঁরা দমে যান নি। ‘বুদ্ধির মুক্তি অর্থাৎ বিচারবুদ্ধি থেকে অন্ধ সংস্কার ও শাস্ত্রানুগত্য থেকে মুক্তিদান’ এর উদ্দেশ্যে লড়েছেন। যদিও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের এই আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিধারাতে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারেনি।

ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেস মূলত ভারতীয় নব্যধনিকদেরই স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করেছে। উপরন্তু এখানে বর্ণ হিন্দুদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, ফলে তারা মুসলিম সমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে টেনে আনতে পারেনি। কংগ্রেসের হিন্দু ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনবাদের প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম সামন্ত অভিজাতদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে মুসলিম লীগ। পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে মুসলমানদের অর্থনৈতিক উন্নতি হবেÑ নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য লীগ নেতৃত্ব এই বলে এ অঞ্চলের শোষিত মানুষকে বিভ্রান্ত করে। ফলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জন্ম নেয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় গোটা সমাজ সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে আচ্ছন্ন হয়েছে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই শাসকরা ধর্মকে কেন্দ্র করে কৃত্রিম এক জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। সেজন্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই বাংলা হিন্দুর ভাষাÑএই বলে ভাষার উপর খড়গহস্ত হয়। ভাষা যেহেতু চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম, সেহেতু ভাষার উপর আক্রমণ মানে চিন্তার স্বাধীনতার উপরই আক্রমণ। তাই অত্যল্প কালের মধ্যেই শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানের ব্যাপারে মোহভঙ্গ ঘটে। শুরু হয় ভাষার অধিকার তথা চিন্তার স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই। এ এক অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, যেখানে বুদ্ধিজীবী ছাড়াও সমাজের সর্বস্তরের শ্রেণী-পেশার মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। এরপরও বাংলা সাহিত্যের ইসলামীকরণ, আরবি হরফে বাংলা লেখা, রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করাসহ নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের পথে বাঙালি সংস্কৃতির উপর আক্রমণ চালায় পশ্চিমী শাসকবর্গ। এক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধি বা চিন্তাচর্চার প্রতিষ্ঠান হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন হরণের চক্রান্ত শুরু হয়। কিন্তু সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে একদিকে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান সৃষ্টির বাধাহীন গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছে অন্যদিকে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমাজও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের আড়ালে শোষণমূলক ব্যবস্থার স্বরূপ উদ্ঘাটনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। আনোয়ার পাশা, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আখলাকুর রহমান প্রমুখ এই লড়াইয়ের সামনের কাতারে শামিল ছিলেন।

গোটা পাকিস্তান পর্বে জনগণকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশের চেষ্টা করা হয়নি। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তান সে চেষ্টা করবে না এটাই ছিল স্বাভাবিক। বরং পদে পদে শিক্ষার অধিকার হরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ, সকল রকম অধিকার হরণের চক্রান্ত করেছে। সেদিন শিরদাঁড়া উঁচু করে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে সচেষ্ট হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এখানে প্রবল অর্থনৈতিক ও প্রত্যক্ষ জাতিগত শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনার কারণে বাংলার মানুষ অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। জন্ম হয় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের।

গণতান্ত্রিক শাসন ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি
10407966_642207479242480_1770846673413514034_nমুক্তিযুদ্ধের পর গণতান্ত্রিক শাসন, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আকাক্সক্ষা ছিল এদেশের মানুষের। বৈষম্যহীন সমাজের আকাক্সক্ষা ছিল, আকাক্সক্ষা ছিল বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার। কিন্তু একটিরও বাস্তবায়নের জোর চেষ্টা কেউ চালায়নি। কারণ এখানকার স্বাধীনতার সংগ্রামে আপোষকামী বুর্জোয়া নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল, তারা রাজনৈতিক সংগ্রামটা উপর উপর করলেও সাংস্কৃতিক সংগ্রামটা পরিচালনা করেনি। ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের যুগে সর্বহারা বিপ্লব-ভয়ে ভীত বুর্জোয়া নেতৃত্বের পক্ষে যা সম্ভবও নয়। শ্রেণীগত ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতার কারণে সম্ভব নয় পুঁজিবাদ উত্থানের যুগে যে উন্নত গণতান্ত্রিক চেতনা-সংস্কৃতি, সেক্যুলার মানবতাবাদ ও বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা এনেছিল-তাকে ধারণ করা। এই অন্তর্নিহিত দুর্বলতা নিয়েই এখানে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন অর্থাৎ আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই স্বাধীনতার পর থেকেই একদলীয় শাসন, স্বৈরশাসন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করে তথাকথিত গণতান্ত্রিক শাসন, সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেয়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারাই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বুলি আওড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের সমস্ত মানুষকে মতপ্রকাশের উপযোগী করার জন্য তাদের আধুনিক গণতান্ত্রিক ও বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত করেনি। পারিবারিক-সামাজিক বা অর্থনৈতিক সুবিধার কারণে কিছু সংখ্যক ব্যক্তি মত প্রকাশের সামর্থ্য তৈরি করতে পারলেও বাকী বিরাট অংশের জনগণ শিক্ষার অভাবে মত প্রকাশের শক্তি-সামর্থ্যই রাখে না। যারাও শিক্ষালাভের সুযোগ পাচ্ছে তাদের প্রকৃত শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না। একদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে মৌলবাদকে জিইয়ে রাখা হচ্ছে অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যমূলক উপাদান মিশিয়ে দিচ্ছে। কারিগরি শিক্ষার প্রসার করছে, বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। ফলে মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিকাঠামো গড়ে উঠছে না। শাসকরা চায় না, মানুষ বিজ্ঞান শিক্ষার আলোয় আলোকিত হোক। কারণ বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হলে মানুষ ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই করতে শিখবে। তারা তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হবে। শাসকদের সকল প্রকার অন্যায় অবিচার বুঝতে পেরে তাদের নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই করবে। তাই জনগণকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো থেকে যত দূরে রাখা যায় ততই শাসকদের জন্য মঙ্গল।

আমরা দেখছি ফেসবুক, ব্লগে সরকারি দল বা দলের কাউকে নিয়ে বিরুদ্ধ মত দিলে পুলিশ গিয়ে ধরে নিয়ে আসছে, শাস্তি বিধান করছে। কিন্তু বিজ্ঞানের চিন্তা প্রচারকদের প্রকাশ্যে মৌলবাদীরা কতলের হুমকি দিচ্ছে। কুপিয়ে হত্যা করছে অথচ রাষ্ট্র এইসব নাশকতার বিচার করছে না। সংবিধানের ৩৯ ধারায় উল্লেখ আছে, “১. চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল ২. তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা অধিকারের (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান-অক্টোবর ২০১১)। সংবিধানের ৩৯, ৯ এবং ৩২ অনুচ্ছেদের তথ্যপ্রাপ্তি ও পরবর্তীতে মত প্রকাশ এবং অন্যান্য প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মাধ্যমের প্রকাশের অধিকার সম্পৃক্ত।” (তথ্যের অধিকার ২০০৭)

অথচ সংবিধানের বিরুদ্ধে গিয়ে অথবা নিজেদের স্বার্থে জনগণের মত না নিয়ে নিজেদের প্রয়োজনে সংবিধানকে পরিবর্তন করে তৈরি করছে সম্প্রচার নীতিমালা বা আইসিটি এ্যাক্ট। যা গণমাধ্যম বা জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। অথচ সংবিধান রক্ষার কথা বলে বিগত বছরে এই আওয়ামী লীগ-ই অগণতান্ত্রিক ও একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসেছে। এই হচ্ছে গণতন্ত্রের অতন্দ্র পাহারাদার সরকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নমুনা। গণতান্ত্রিক শাসন যে সমাজে নেই, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সে সমাজে গড়ে উঠে না। বরং অগণতান্ত্রিক পরিবেশের সুযোগ নিয়ে মৌলবাদী চিন্তা সমাজে বিস্তার লাভ করে।

শোষণের প্রয়োজনে শাসকরাই মৌলবাদী চিন্তার বিস্তার ঘটায়, চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করে
পুঁজিবাদের উত্থানের যুগে বুর্জোয়ারা বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে যে ইহজাগতিক চেতনা, উন্নত গণতান্ত্রিক চেতনা এনেছিল তা আমাদের এখানে সেভাবে আসেনি। কারণ ততদিনে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তাই এখানে পুঁজিবাদ এসেছে সামন্ততন্ত্রের সাথে নয়তো সাম্রাজ্যবাদের সাথে অথবা উভয়ের সাথে বিভিন্ন মাত্রায় আপোষ করে। স্বাধীনতার পর এদেশেও এই ক্ষয়িঞ্চু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে অভাব-দারিদ্র্য-বঞ্চনার যে পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, তাকে যেন চিনতে না পারে, সমাজ পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী নিয়মকে বুঝতে না পেরে অদৃষ্টকে দোষারোপ করতে শেখে শাসকরা সেই চিন্তার প্রসার চায়। সমাজে যুক্তির বদলে অন্ধ বিশ্বাসের শক্তি, পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণা, ফ্যাসিবাদী মনন তৈরির উপযোগী সংস্কৃতি সমাজ অভ্যন্তরে তৈরি করতে চায়। শিক্ষা ও সংস্কৃতিক্ষেত্রে এই হাল দেখে বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, “ন্যায়নীতিবোধের ন্যূনতম ধারণা গড়ে না ওঠার দরুন ছাত্র-যুবক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সামাজিক যে কোনও সমস্যার প্রতি চরম অনীহা ও ঔদাসীন্য ক্রমাগত বাড়ছে। ছাত্রদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ও সুশৃঙ্খল যুক্তিধারা গড়ে তোলার পরিবর্তে অধ্যাত্মবাদ ও কারিগরি বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটানোর প্রবণতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাজীবনে এই ঝোঁকটি বাস্তবিকপক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ এ হচ্ছে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য।” এই ফ্যাসিবাদ সমস্ত প্রকার যুক্তির বিরোধী। যে চিন্তা মানুষের মানবিক গুণ, সেই চিন্তা করার ক্ষমতাই কেড়ে নেয়। মন্যুষত্বহীন জীবনের দিকে ঠেলে দেয়, এক ক্লীব জীবে পরিণত করে। এইভাবে মৌলবাদী চিন্তার বিস্তার আর ফ্যাসিবাদের দ্বারা চিন্তার স্বাধীনতাও হরণ করে। ভয়ংকর সত্য হচ্ছে আমাদের দেশে আজ এই প্রক্রিয়াটিই চলছে।
ভোগবাদও মুক্তচিন্তার পথে বাধা

পুঁজিবাদ শুধু মৌলবাদের মাধ্যমে চিন্তার স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করে তাই নয়, ভোগবাদের দাসত্ব তৈরি করেও চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করে। পুঁজিবাদী শোষণের চাপে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাধীনে বেশিরভাগ মানুষ ক্রমাগত ক্রয়ক্ষমতা হারাতে থাকে। এ অবস্থায় মুনাফার প্রয়োজনে মানুষের মধ্যে কৃত্রিম ভোগের আকাক্সক্ষা তৈরি করতে হয়। রেডিও টেলিভিশনসহ প্রচার মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতার মধ্যে এই আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তুলে বাজার সম্প্রসারণের চেষ্টা করে। প্রতিদিন নিত্য-নতুন মোবাইল ফোন, ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপন কৃত্রিম অভাববোধ তৈরি করে। এই অভাব পূরণের জন্য মানুষ উদয়াস্ত ছুটে। আর কোন ভাবনার অবকাশ থাকে না, জীবনের রস-সৌন্দর্য আহরণের সুযোগ থাকে না। আবার এমন কিছু বিজ্ঞাপন আছে যা মানুষের মনস্তত্ত্বকে সূক্ষভাবে প্রভাবিত করে। যেমন গায়ের রং ফর্সা করার ক্রিম। এই বিজ্ঞাপন আমাদের সৌন্দর্য সম্পর্কিত ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বুদ্ধি বা চিন্তা নয়, শরীরসর্বস্ব স্মার্টনেসের ধারণা তৈরি করে। ফলে আত্মমর্যাদাশীল হবার পরিবর্তে মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। ভোগবাদের আদর্শ-ই এই— নিজে ভোগ কর, অন্যের কার কি হল, কে খেতে পেল কি পেল না, কেউ বিনা চিকিৎসায় মরল কি বাঁচল— তাতে তোমার কি? নিজের পছন্দের জিনিস সবার আগে বেছে নাও। আমাদের চারপাশের পরিবেশে, সমাজে এই রকম রুচি, চিন্তা-ভাবনারই প্রাধান্য— পড়ালেখা কর, ক্যারিয়ার গড়, অর্থ উপার্জন কর—টাকা না থাকলে কি জীবনকে উপভোগ করা যায়? ফলে শৈশব থেকেই একজনের মধ্যে এই আকাক্সক্ষাগুলো গড়ে উঠতে থাকে। এই রকম মনস্তত্ত্ব, রুচি-সংস্কৃতি নিয়েই আমাদের ছেলে-মেয়েরা বড় হচ্ছে। এই রুচি-সংস্কৃতি হচ্ছে বুর্জোয়া ভাবাদর্শ প্রভাবিত। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্যই শাসকরা এই সংস্কৃতির প্রসার চায়। আর বুর্জোয়া ভাবাদর্শে, চিন্তায়, রুচিতে অভ্যস্ত মানুষ এর বাইরে বেরুতে পারে না। নিজের অজান্তে বুর্জোয়া সংস্কৃতির দাসত্ব করে, বুর্জোয়াদের সেবাদাসে পরিণত হয়। ফলে আমরা যে ভাবছি— আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা আছে, আমরা মুক্তচিন্তা করিÑআমরা কি এই বুর্জোয়া ভাবাদর্শের প্রভাব থেকে মুক্ত? এই সমাজ সৃষ্ট স্বার্থপরতা, কলুষতা, আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত? মুক্ত না হলে আমরা স্বাধীন হলাম কীভাবে? স্বাধীনভাবে চিন্তাই করবো কীভাবে? ফলে আমাদের বুঝতে হবে, আজকের দিনে পুঁজিবাদী সমাজে বুর্জোয়া ভাবাদর্শ-সংস্কৃতিই মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমাদের অজান্তেই চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করে। তাই এই পরম সত্যটিকে বুঝতে না পারলে, বুর্জোয়া ভাবাদর্শের অন্তর্গত সমস্তরকম ব্যক্তিসম্পত্তিজাত মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে না পারলে ‘মুক্তচিন্তা’, ‘চিন্তার স্বাধীনতা’ কতগুলি কথার কথা হিসেবেই থেকে যাবে। এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বুঝতে পারেন না বলেই অনেকে মুক্তচিন্তার নামে, চিন্তার স্বাধীনতার নামে, ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেন। তাই যারা মুক্তচিন্তার স্বাধীনতার কথা বলছেন তাদের মনে রাখা দরকার যেনতেনভাবে দায়-দায়িত্বহীন একটা মত প্রকাশ করার নামই চিন্তার স্বাধীনতা নয়। বিদ্যাসাগর, রোকেয়া, আব্দুল ওদুদ প্রমুখ মনীষী যে মুক্তচিন্তার চর্চা করেছেন তা সমাজকে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি, কূপম-ূকতার অন্ধকার গহ্বর থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করেছে। আজকের দিনের মুক্তচিন্তা যদি সমাজে অবস্থিত অসঙ্গতি, কুসংস্কার, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা,পশ্চাদপদতাকে দূর করতে না পারে, মানুষের চিন্তা-চেতনাকে প্রগতির পথে পরিচালিত করতে না পারে, মানুষ হিসেবে মানবিকতা-মূল্যবোধসম্পন্ন করে তুলতে না পারে, তাহলে এমন দায়িত্বহীন মুক্তচিন্তা সমাজের জন্য ক্ষতিকর। তাই মুক্ত মানুষ, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন স্বাধীন মানুষ হতে চাইলে ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে মানুষের সত্যিকারের মুক্তির পথেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
সহযোগিতা ও তথ্যসূত্র ঃ
১.শরৎমূল্যায়ন প্রসঙ্গে—শিবদাস ঘোষ
২. ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও আমাদের কর্তব্য—শিবদাস ঘোষ
৩. শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সমস্যা সমাধানে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি—শিবদাস ঘোষ
৪. নির্বাচত প্রবন্ধ—আবুল ফজল
৫. শিখা সমগ্র – মুস্তফা নূরউল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি
৬. বিদ্যাসাগর স্মারকগ্রন্থ ২০১২ – ঈশ্বচন্দ্র বিদ্যাসাগর মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট সোসাইটি, কলকাতা

অনুশীলন : এপ্রিল ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments