Saturday, November 23, 2024
Homeছাত্র ফ্রন্টযুব সমাজের কর্তব্য — লেনিন

যুব সমাজের কর্তব্য — লেনিন

কমরেডগণ, আজ আমি আপনাদের যুব কমিউনিস্ট লীগের মৌলিক দায়িত্ব সম্পর্কে কিছু বলব এবং সেই প্রসঙ্গে একটি সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে যুব সংগঠনগুলি সাধারণভাবে কী জাতীয় হওয়া উচিত তা-ও আলোচনা করব।

স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মনে প্রথম যে-ধারণা জন্মায় সেটা এই যে, সাম্যবাদ সম্পর্কে জ্ঞানার্জনের অর্থ হলো সাম্যবাদী পত্রিকাসমূহ, পুস্তিকা এবং গ্রন্থরাজির দ্বারা আহৃত জ্ঞানার্জনের সমন্বয় সাধন। কিন্তু সাম্যবাদ অধ্যয়নের এই সংজ্ঞা অত্যন্ত কাঁচা এবং অসম্পূর্ণ। যদি সাম্যবাদ-অধ্যয়ন কেবলমাত্র সাম্যবাদী গ্রন্থ এবং পুস্তিকাগুলিতে প্রচারিত বিষয়সমূহের সমন্বয় সাধনই হয় তাহ’লে আমরা অতি সহজেই পুঁথির ভেল্কি-দেখানো কমিউনিস্টদের অথবা অসার দাম্ভিকদের সন্ধান করব, এবং এর ফলে প্রায়ই আমাদের ক্ষতি হবে, কেননা এই সমস্ত লোকেরা সাম্যবাদী গ্রন্থ এবং পুস্তিকাসমূহ কেবল মুখস্থ করে যা শিখবে তার ফলে তারা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সমন্বয় ঘটাতে অসমর্থ হবে এবং সাম্যবাদ-নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তারা কাজও করতে পারবে না।

পুরোনো পুঁজিবাদী সমাজ আমাদের ওপর সর্বাপেক্ষা ক্ষতিকর এবং দুর্ভাগ্যজনক যে বোঝাটি চাপিয়ে দিয়েছে তাহ’ল বইয়ের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ সাধন; আমরা এমন সমস্ত বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি যে-গুলিতে প্রায় সমস্ত বিষয়েরই অতি চমৎকার ব্যাখ্যা আছে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই বইগুলি অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং ভন্ডামিপূর্ণ মিথ্যা বোঝাই এবং এগুলিতে পুঁজিবাদী সমাজ সম্পর্কে মিথ্যা বর্ণনা দেওয়া আছে।

তাহ’লে প্রশ্ন ওঠে এই যে, সমস্ত ভাবধারাকে মিশিয়ে কীভাবে সাম্যবাদ অধ্যয়ন সম্ভব? আমরা প্রাচীন মতবাদ থেকে এবং পুরনো ধরনের বৈজ্ঞানিক চেতনা থেকে কী কী গ্রহণ করব? পুরনো ধাঁচের বিদ্যালয়গুলির একটা ঘোষিত নীতি ছিল, সব বিষয়ে শিক্ষিত ও সাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ তৈরি করা। আমরা জানি এই নীতি হচ্ছে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, কারণ সমস্ত সমাজ শোষক ও শোষিত — এই দুই শ্রেণীতে জনগণের বিভক্ত হওয়ার উপর নির্ভরশীল এবং এর দ্বারাই পরিচালিত। যেহেতু পুরনো ধাঁচের বিদ্যালয়গুলি শ্রেণী মনোভাবের দ্বারা সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন, তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা বুর্জোয়াদের জ্ঞান বিতরণ করে। এই সমস্ত বিদ্যালয়ে শ্রমিক এবং কৃষকদের, তরুণ উত্তরাধিকারীরা ঠিক ততটুকুই শেখে যতটুকু বুর্জোয়াদের স্বার্থের পক্ষে প্রয়োজনীয়। তাদের এমনভাবে শেখানো হয় যাতে তারা বুর্জোয়াদের প্রয়োজনীয় ভৃত্য হয়ে উঠতে পারে এবং বুর্জোয়াদের শান্তি ও বিশ্রামের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে মুনাফার যোগান দিয়ে যেতে পারে। সেই জন্যই পুরনো ধাঁচের বিদ্যালয়গুলি বর্জন করার সময় আমরা সিদ্ধান্তই নিয়েছি যে, যথার্থ সাম্যবাদী শিক্ষার জন্য যা প্রয়োজন কেবলমাত্র সেটুকুই আমরা এর থেকে গ্রহণ করব।

পুরনো বিদ্যালয় সম্পর্কে যে-সব সমালোচনা আমরা অবিরত শুনে থাকি এবং যার থেকে প্রায়ই ভুল সিদ্ধান্ত টানা হয় আমরা সেই প্রসঙ্গে এসে পড়ছি। এমন কথা বলা হয় যে, পুরনো বিদ্যালয়গুলিতে কেবল পুঁথি-সর্বস্ব জ্ঞান অর্জন করা হত এবং সেখানে গতানুগতিক অনুশীলন ও মুখস্থবিদ্যার চর্চা চালানো হয়। একথা সত্য, কিন্তু পুরনো ধাঁচের বিদ্যালয়গুলিতে কী কী বাজে জিনিস ছিল এবং এদের মধ্যে কোনগুলিই বা আমাদের পক্ষে প্রয়োজনীয়, আমাদের তা অবশ্যই বিচার করে দেখতে হবে। এদের মধ্য থেকে সাম্যবাদের পক্ষে যা প্রয়োজনীয় তাকে বেছে নিতে হবে।

পুরনো বিদ্যালয়গুলিতে কেবল পুঁথিসর্বস্ব জ্ঞান বিতরণ করা হত; তারা ছাত্রদের অপ্রয়োজনীয়, অনাবশ্যক ও ভাসা-ভাসা জ্ঞান অর্জনে বাধ্য করত, এই সমস্ত জ্ঞান তরুণদের মাথার মধ্যে বিশৃঙ্খলভাবে জড়ো হয়ে তাদের নির্দিষ্ট একটি ছাঁচে-ঢালা আমলা পরিণত করত। কিন্তু যদি কেউ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় যে, মানবজাতি যে-জ্ঞান সম্পদ আহরণ করেছে তাকে আত্মস্থ না করে যে কেউ সাম্যবাদী হতে পারে তাহ’লে সে প্রচন্ড ভুল করবে। যে-জ্ঞান সমষ্টির পরিণত ফল হচ্ছে সাম্যবাদ, তাকে না জেনে কেবল সাম্যবাদী স্লোগান ও সাম্যবাদী বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তসমূহকে জানাটাই যথেষ্ট, এরকম চিন্তা করাটাও ভুল হবে। মানবজাতির অর্জিত জ্ঞান সমষ্টি থেকেই সাম্যবাদ উদ্ভূত হয়েছে —মার্কসবাদ নিজেই হচ্ছে তার নজির।

তোমরা নিশ্চয় পড়েছ এবং শুনেছ যে, সাম্যবাদী তত্ত্ব — সাম্যবাদের বিজ্ঞান প্রধানত মার্কসেরই সৃষ্টি বলে একে মার্কসবাদী মতবাদও বলা চলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে আর কেবলমাত্র একমাত্র সমাজতন্ত্রীর সৃষ্টি বলে বিবেচিত হয় না, যদিও মার্কস ছিলেন একজন মহাপ্রতিভাশালী ব্যক্তি। পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ এবং কোটি কোটি সর্বহারা যারা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই মতবাদকে প্রয়োগ করেছে —এখন তাদেরই সম্পত্তি হয়ে গেছে। যদি আপনাদের জিজ্ঞাসা করতে হয় যে, কেন মার্কস-এর শিক্ষা লক্ষ লক্ষ এবং কোটি কোটি সবচেয়ে বিপ্লবশ্রেণীর মানুষের হৃদয় এবং মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিল তাহলে আপনারা এর একটাই উত্তর খুঁজে পাবেন, মার্কস-এর এই সাফল্যের কারণ তিনি পুঁজিবাদী সভ্যতায় অর্জিত মানুষের জ্ঞানের দৃঢ় ভিত্তিতেই তাঁর তত্ত্বকে দাঁড় করিয়েছিলেন। যে-সমস্ত নিয়মাবলী মানবসমাজের অগ্রগতি নির্ধারিত করেছে সেগুলি বিশ্লেষণের পর পুঁজিবাদ যে অনিবার্যভাবেই সাম্যবাদে পরিণত হবে মার্কস তা উপলব্ধি করেছিলেন। সবচেয়ে যেটা জরুরি তাহ’ল, মার্কস পুঁজিবাদী সমাজের সংহত, বিস্তৃত ও অন্তর্নিহিত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই এই সত্য প্রমাণ করেছিলেন, প্রথম যুগের বিজ্ঞানের সমস্ত আবিষ্কারকেই তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। মানব সভ্যতা আজ পর্যন্ত যা কিছু সৃষ্টি করেছে, তার প্রত্যেকটিকেই তিনি যুক্তিনিষ্ঠ দৃষ্টিতে ঢেলে সাজিয়েছেন, কোনো খুঁটিনাটি বিষয়ও তিনি অগ্রাহ্য করেননি। মানুষের চিন্তাধারা আজ পর্যন্ত যা কিছু সৃষ্টি করেছে, শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সেই সমস্ত বিষয়ের পুনর্বিবেচনা, সমালোচনা এবং যাচাই করেছেন; এবং তার থেকে তিনি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা বুর্জোয়া-সীমাবদ্ধতা বা বুর্জোয়া-সংস্কারের মধ্যে আবদ্ধ মানুষের পক্ষে সম্ভবপর হত না।

উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, যখন আমরা সর্বহারার সংস্কৃতি সম্পর্কে কথা বলব তখন আমাদের এই সত্যটি মনে রাখা দরকার। যতদিন না আমরা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারব যে, মানবজাতির সামগ্রিক  অগ্রগতি ও বিকাশের ফলে যে-সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে তাঁর সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞান অর্জন না করলে আমরা সর্বহারার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে পারব না, ততদিন আমাদের পক্ষে এই সমস্যার সমাধানও সম্ভব হবে না। সর্বহারার সংস্কৃতি নামক বস্তু হাল্কা বাতাসে ভেসে বেড়ায় না; যারা নিজেদের সর্বহারার সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞ বলে মনে করেন এটা তাদের আবিষ্কারও নয়। এসমস্তই বাজে কথা। মানব সমাজ পুঁজিবাদী, জমিদার এবং আমলাতান্ত্রিক সমাজের অধীনে থেকে যে-জ্ঞানসমূহ অর্জন করেছে সর্বহারার সংস্কৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং ক্রমাগতই নিয়ে যেতে থাকবে, যেমন করে মার্কস অর্থনীতির নব-রূপায়ণ করে আমাদের দেখিয়েছেন যে, মানব সভ্যতার চূড়ান্ত পরিণতি কী, শ্রেণী সংগ্রাম ও সর্বহারার বিপ্লবের সূচনার পথই বা কী?

আমাদের কেবল মুখস্থ করার কোনো প্রয়োজন নেই, কিন্তু প্রত্যেক ছাত্রের মন যাতে মূল বিষয়বস্তুগুলির জ্ঞানে উন্নত ও খাঁটি হয়ে ওঠে সেটা আমাদের নিশ্চয়ই প্রয়োজন। একজন সাম্যবাদী যে-সমস্ত জ্ঞান অর্জন করেছে তা যদি সে পরিপাক করতে না পারে তাহ’লে সাম্যবাদ একটি শূন্যগর্ভ শব্দ অথবা কেবল একটা সাইনবোর্ড হিসেবে টিকে থাকবে এবং সাম্যবাদীরা নিছক হামবড়া মানুষ হয়ে থাকবে। তোমরা কেবল এই জ্ঞানকে আত্মস্থ করবে না, একে সমালোচনার সঙ্গে গ্রহণ করবে, যাতে তোমার মন নিরর্থক ক্লান্তির ভারে আচ্ছন্ন হয়ে না পড়ে এবং আজকের দিনে একজন সুশিক্ষিত মানুষের যা যা অপরিহার্য সেই সমস্ত তথ্যের দ্বারা তোমার মন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। যদি একজন সাম্যবাদী গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠোর কার্যপ্রণালীর মধ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না চালিয়ে এবং যে-সমস্ত তত্ত্ব তাঁর খুঁটিনাটিভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন ছিল সেগুলিকে বিশ্লেষণ না করে, কেবলমাত্র ছকে তৈরি সিদ্ধান্তসমূহে পৌঁছানোর ভিত্তিতে তার সাম্যবাদ সম্পর্কে অসার দম্ভ প্রকাশ করতে থাকে, তাহ’লে বাস্তবিকপক্ষে সে একজন নিন্দনীয় সাম্যবাদী বলে গণ্য হবে। এই জাতীয় ভাসা-ভাসা মনোভাব নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। যদি আমি জানি যে, আমার জ্ঞান অত্যন্ত কম, তাহলে আমি আরও কিছু শিখবার চেষ্টা করব; কিন্তু যদি কেউ বলে বসে যে, সে একজন সাম্যবাদী এবং তার কোন কিছুই বিস্তৃতভাবে জানার প্রয়োজন নেই, তাহলে সে আর যাই হোক, কোনদিনই একজন সাম্যবাদী হতে পারবে না।…

[ ‘যুব লীগসমূহের  কর্তব্য’, ১৯২০ পুস্তিকা থেকে সামান্য সংক্ষেপিত ]

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের চতুর্থ কেন্দ্রীয় সম্মেলনে প্রকাশিত স্মরণিকা

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments