পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি সাধারণ পাবলিকের জন্য নাকি পাবলিকের টাকায় ধনীর জন্য – এ নীতিগত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রচনা করল ন্যায়নিষ্ঠ ছাত্র আন্দোলনের আরেকটি দৃষ্টান্ত। বাণিজ্যিক লক্ষ্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেভাবে রাইফেলবাহী পুলিশ আর পিস্তলবাহী ছাত্রলীগ দিয়ে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্র্ণ সমাবেশে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তা কেবল বিবেকবান মানুষকে স্তম্ভিত করেনি, শিক্ষক সমাজের অতীতের সম্মান-গৌরবের আসনকে কলঙ্কিত করেছে।
ঘটনা পরম্পরা
সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ৭টি বিভাগে বাণিজ্যিকভিত্তিতে নাইট কোর্স চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং বিভিন্ন খাতে ২ থেকে ৫ গুণ পর্যন্ত ফি বৃদ্ধি করা হয়। শুরুতে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট প্রগতিশীল ছাত্রজোটের উদ্যোগে নাইটকোর্স বাতিল ও ফি প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনের সূচনা হলেও পরবর্তীতে ‘বাণিজ্যিক সান্ধ্যকোর্স ও বর্ধিত ফি বিরোধী শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ’র ব্যানারে হাজার হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে নেমে আসে। ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচি পালনের পর ৩০ জানুয়ারি থেকে লাগাতার ধর্মঘট পালিত হচ্ছিল। প্রশাসনিক ভবনের সামনে সমাবেশ চলাকালে ছাত্রলীগ সশস্ত্র মিছিল নিয়ে সমাবেশে হামলা চালালে ১২ জন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয় এবং শতাধিক আহত হয়। আন্দোলন স্তিমিত করতে সেদিনই প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে এবং ছাত্রদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয়। এরপর প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে ছাত্রজোট নেতৃবৃন্দ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের জড়িয়ে ৬টি মামলা করা হয়, অথচ হামলাকারী অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা হয় নি। স্পষ্টতই বোধগম্য, প্রশাসনের ইন্ধনেই এ ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ প্রশাসনও তা স্বীকার করেছে।
প্রশাসন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য আড়াল করতে চাইছে
প্রশাসনের পক্ষ থেকে যুক্তি করা হচ্ছে – ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি তো খুব সামান্য’, ‘প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এরচে অনেক বেশি ফি দিয়ে কি ছাত্ররা পড়ে না?’, ‘বিকেল ৫টার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামো তো পড়ে থাকে’, ‘অবকাঠামো ব্যবহার করে আরো কিছু ছাত্র পড়ার সুযোগ পেলে কি অসুবিধা’ ইত্যাদি। এছাড়া আরও একটি মুখরোচক কথা এরা চালু করেছে, ‘ছাত্ররা মাত্র ১২/১৮ টাকা বেতনে পড়ে’। ‘এই ছাত্ররা মোবাইল-সিগারেটের পেছনে শত শত টাকা খরচ করে, আর এক টাকা-দু টাকা বেতন বাড়ানোর কথা বললেই আন্দোলনে নামে’। আলাদাভাবে শুনলে কখনো মনে হবে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যই বুঝি এ উদ্যোগ। ছাত্রদের মতের তোয়াক্কা না করে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে যারা সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে, পুলিশ দিয়ে দমন করে তাদের উদ্দেশ্য কতটা মহৎ সে প্রশ্ন বাদ রেখেও বক্তব্যগুলোকে একটু খতিয়ে দেখা দরকার।
শিক্ষা বিস্তারই লক্ষ্য হলে সান্ধ্যকালীন কোর্সে বেশি ফি নেয়া হবে কেন? উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করলে তো রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করা হত অথবা প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে আসন বাড়ানো হত, যাতে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। তা না করে একের পর এক বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে কেন?
যে কৃষক সারাদেশের মানুষের মুখের অন্ন জোগায় অথচ ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না, উদয়াস্ত শ্রমে যে শ্রমিক সর্বোচ্চ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বয়ে আনে, আগুনে পুড়ে কিংবা ভবন ধসে মরে মালিকের কোটি কোটি টাকার সম্পদ বৃদ্ধি করে, তার বা তাদের সন্তানেরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে না? যে জনগণ ট্যাক্স দেবে তারা কি শিক্ষা-চিকিৎসার নাগাল পাবে না?
শিক্ষা বিক্রি করতে গিয়ে শিক্ষকরাও নিচে নামছেন
বিস্ময়ের ব্যাপার হল, বর্ধিত ফি’র মাধ্যমে বছরে আদায় হবে প্রায় ২০ লক্ষ টাকা। অথচ এই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৩ বছরে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক বিবেচনায় যে ২২০০ শিক্ষক, স্টাফ নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের বেতন দিতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ঘাটতি হয়েছে ৩৬ কোটি ৪৩ লক্ষ টাকা। এর দায় কেন ছাত্রদের ওপর চাপানো হবে?
ইভিনিং কোর্স-এ প্রত্যেক লেকচারের জন্য একজন শিক্ষক পাবেন ১৫০০-২০০০ টাকা। ছাত্রদের গলা কেটে কি শিক্ষা দেবেন সম্মানিত শিক্ষকরা? পরাধীন ব্রিটিশ আমলে অভাব দারিদ্র্যের মধ্যে থাকা পণ্ডিত মশাইরা ছাত্রদের মাথা উচুঁ রাখার শিক্ষা দিতেন, দুর্নীতির কথা মাথাতেই আনতে পারতেন না, আর আজ স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে শিক্ষকদের এ হাল কেন – এটা গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমরা শিক্ষকদের মানসম্পন্ন জীবন চাই, তার জন্য বেতন বৃদ্ধির দাবি করি। কিন্তু সে টাকা জোগাবে তো রাষ্ট্র। আজ এক শ্রেণীর শিক্ষক বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অথবা আপন স্বার্থ হাসিলের জন্য ছাত্র-শিক্ষকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন। বস্তুত পক্ষে একটু একটু করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রাইভেট করার চক্রান্ত থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি বৃদ্ধি, নাইটকোর্স চালুর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
শাসকগোষ্ঠীর শিক্ষা সর্ম্পকিত দৃষ্টিভঙ্গিই জনগণের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে
বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদী দেশ ও সংস্থাগুলো বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের শ্লোগান তুলছে। এর মূল কথা হল সেবাখাতগুলোকে ব্যবসার জন্য উন্মূক্ত করে দিতে হবে। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো জন-সংশ্লিষ্ট খাতগুলোকে আর সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। এর ফল কি আমাদের জন্য সুখকর হচ্ছে? একচেটিয়া পুঁজির লালসা মেটাতে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের খাদ্য-পানীয়-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার বিপন্ন হচ্ছে। বাংলাদেশেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বিদ্যুৎকেন্দ্র সংখ্যায় বাড়লেও গরিব মানুষের শিক্ষা-চিকিৎসার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ছে।
উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ইউজিসি উচ্চশিক্ষার যে কৌশলপত্র (২০০৬-২৬) প্রণয়ন করেছে তার মূল কথা হল : সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বরাদ্দ দিন দিন কমিয়ে আনবে। এর ফলে যে বাজেট ঘাটতি হবে তা পূরণ করা হবে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে। অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে – ছাত্র বেতন বৃদ্ধি, আবাসন ও ডাইনিং চার্জ বৃদ্ধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা ভাড়া দেয়া, ক্যাফেটেরিয়া ভাড়া দেয়া ইত্যাদি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন এ নীতিই বাস্তবায়নের নানা আয়োজন চলছে।
সরকারের এই জনবিরোধী, ছাত্রস্বার্থবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সর্বশেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ এবং শিক্ষকদের একটা বড় অংশ। সময় এসেছে, শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্ত প্রতিহত করতে শিক্ষার অধিকার রক্ষার এই আন্দোলনকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নেয়া।