Saturday, December 21, 2024
Homeবিশেষ নিবন্ধশিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ-সংকোচননীতি বিরোধী শিক্ষা কনভেনশনের ঘোষণা

শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ-সংকোচননীতি বিরোধী শিক্ষা কনভেনশনের ঘোষণা

finial coverসর্বজনের শিক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাস বেশ পুরনো। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন থেকে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি রচনাকারী ঐতিহাসিক ১১ দফা কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তী কালে ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১০ দফায় সর্বজনীন শিক্ষার দাবি উচ্চারিত হয়েছিল। এই দীর্ঘ পরিক্রমায় ছাত্রআন্দোলন কখনো এমন তীব্র রূপ নিয়েছিল যে শাসকের অন্যায় শোষণের ভিত পর্যন্ত কেঁপে উঠেছে। আমাদের পূর্বসূরীদের এরকম আত্মোৎসর্গের কারণেই আজও আমরা শিক্ষার ন্যূনতম অধিকারটুকু ভোগ করছি। লড়াইয়ের এই ধারাবাহিকতায় শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ-সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষা কনভেনশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

এদেশের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস যেমন আমাদের প্রেরণা দেয়, তেমনি স্মরণ করিয়ে দেয়, এত লড়াই-সংগ্রাম-আত্মদানের পরও ছাত্রসমাজের প্রতি শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতা। সেই ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে এদেশের ছাত্রসমাজের দাবি ছিল সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা, ১৯৭৫ সালের মধ্যে অন্তত দশম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা, শিক্ষাখাতে জাতীয় বাজেটের ন্যূনতম ২৫ ভাগ বরাদ্দ নিশ্চিত করা ইত্যাদি। স্বাধীন দেশেও সেই ৫২ বছরের পুরনো দাবি অর্জিত হয়নি। বরং দেখা যাবে, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রে রাষ্ট্র শিক্ষার দায়িত্ব থেকে ক্রমাগত সরে এসেছে। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছে সামান্য কিন্তু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে অবিশ্বাস্য হারে।

রাষ্ট্র দায়িত্ব না নিলেও দেশে শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হার বেড়েছে ক্রমাগত। এর অন্যতম কারণ গত ৪৩ বছরে সীমাহীন লুটপাট-দুর্নীতি করে দেশের একদল মানুষের হাতে প্রচুর পরিমাণে পুঁজি সঞ্চিত হয়েছে যারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে এই পুঁজি বিনিয়োগ করতে চায় অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে বেড়েছে শিক্ষা গ্রহণের প্রবল আগ্রহ। তাই জনগণের মধ্যে সর্বস্ব দিয়ে হলেও সন্তানকে শিক্ষিত করতে চাওয়ার মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা ব্যবসা চলছে ব্যাপকভাবে। ব্যবসা কেবল মুনাফা বোঝে। তাই মানুষ মাত্রই শিক্ষার অধিকার পাবে এই চেতনার মাধ্যমে নয় বরং আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হলেই কেবল শিক্ষার্জনের যোগ্যতা থাকবে – এই আজ শিক্ষালাভের মাপকাঠি।

পৃথিবী জুড়েই পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর কাছে শিক্ষাক্ষেত্র অন্যতম লাভজনক বিনিয়োগের খাত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের পর থেকে শিক্ষাবাণিজ্যের ধারা তীব্রতর হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানি, সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান শিক্ষাখাতে বিনিয়োগ করছে। দেশে দেশে বিভিন্ন নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস খুলে ব্র্যান্ড বিক্রি করছে। একইসাথে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার উপযোগী, বাজারমুখি বিষয়বস্তু পড়ানো হচ্ছে। ফলে চিন্তাশীল, মানবিকবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি হবার বদলে যন্ত্র চালানোতে দক্ষ তথাকথিত skilled labour বের হচ্ছে।

শিক্ষা বাণিজ্যের এই করাল থাবা মন্যুষত্ব-মানবিকতা অর্জনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। যে সম্পদের উপর মানবসভ্যতার সকলের সমান অধিকার, তা মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি গোষ্ঠীর হাতে কুক্ষিগত। সভ্যতাধ্বংসকারী এই প্রক্রিয়া চলমান থাকতে পারে না। আমাদের সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে আমরা শিক্ষা কনভেনশনের আয়োজন করেছি। আমাদের সীমিত সামর্থ্যে সারাদেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, এলাকায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক-অভিভাবক-বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গদের কাছে আমরা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণবিরোধী মতামত তুলে ধরেছি এবং তাদের মতামত গ্রহণ করেছি। শিক্ষার উপর বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ-সংকোচনের যে সর্বনাশা আক্রমণ নেমে এসেছে সেই বিবেচনায় আমাদের আয়োজন হয়ত সীমিত। কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা যাবে। এই প্রয়োজনে দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।

এই কনভেনশন থেকে আমরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন-ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। সাথে সাথে শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা করছি। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কোচিং ও ভর্তি বাণিজ্য বন্ধ ও স্কুলকে শিক্ষার মূূল কেন্দ্রে পরিণত করা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নিরসন করা ও প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ, পরীক্ষার হল নির্মাণ করে শিক্ষার আনুষঙ্গিক আয়োজন নিশ্চিত করা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্র বাতিল করা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধ করা, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করা এবং শিক্ষক সমাজের উপযুক্ত বেতন-সামাজিক মর্যাদার জন্য ধারাবাহিক ও কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা করছি।

এই শিক্ষা কনভেনশন আয়োজন করতে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে যে সংযোগ স্থাপিত হলো তাকে সংহতকরণের লক্ষ্যে আমরা আগামী মাসগুলোতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেব। ধারাবাহিক কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে জোরদার করব। সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, শিক্ষক-শিক্ষাবিদ-পেশাজীবীদের সাথে মত বিনিময়-আলোচনার প্রক্রিয়া পরিচালিত করব, যার মধ্য দিয়ে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণবিরোধী একটা প্ল্যাটফরম নির্মাণের উদ্যোগ কার্যকর করা যায়। আগামী ২০১৫ সালে আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে ঢাকায় বৃহৎ আকারে ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করা হবে।

আমরা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে এই শিক্ষা আন্দোলন সম্পর্কে মতামত প্রত্যাশা করি। সাংগঠনিক সীমার মধ্যে আন্দোলনকে গণ্ডীবদ্ধ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষার অধিকার রক্ষা ও সমাজ প্রগতির প্রয়োজনই আমাদের কাছে বড়। স্পষ্টভাবে এ কথা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে। এর সঙ্গে কেউ একমত নাও হতে পারেন। কিন্তু যারাই দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সংকটের গভীরতা অনুভব করেন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান ব্যক্ত করেন তারাই এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবেন বলে আমরা আশা করি।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪, টিএসসি মিলনায়তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments