Tuesday, December 24, 2024
Homeছাত্র ফ্রন্টশিক্ষিত মানুষ প্রসঙ্গে — কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

শিক্ষিত মানুষ প্রসঙ্গে — কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

সামাজিক প্রয়োজনের জন্য যদি শিক্ষা হয়, তাহলে
এই প্রয়োজন ধারণ করা ছাড়া শিক্ষিত মানুষ হওয়া অসম্ভব

12885787_10206085717365263_4903636621688904802_oবিপ্লবী পার্টির একজন সংগঠক হিসেবে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণ নিয়ে আমাদের একটা পরিষ্কার দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, সেক্যুলার, গণতান্ত্রিক এবং এর সাথে যুক্ত করে একই ধারার, একই সিলেবাস ও পাঠ্যক্রমে যাতে দেশের সমস্ত ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে তাই আমরা চাই। কারণ বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বিভিন্ন রকম হতে পারে না। কিন্তু শিক্ষার এই মূল ভিত্তির উপর আলোচনা করার আগে দেশের সামাজিক ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে হবে।

. . .পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যেহেতু গড়ে উঠেছিল মানুষের ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে, তার কূপমন্ডুকতাকে উস্কে দিয়ে – তাই পত্তনের পর ধর্ম ও তার নীতি নৈতিকতাকে পরিচালনার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রাষ্ট্রটি চলতে থাকে। এই পরিকল্পনার অযৌক্তিক-অনৈতিক প্রভাব, উপরন্তু পাকিস্তানি বর্বরতা – এসব কারণে এদেশের মানুষ ধীরে ধীরে আন্দোলন শুরু করে। কোনো দেশেই, প্রথমেই সমগ্র সমস্যা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয় না। আমাদের দেশেও হয়নি। এখানে লড়াই শুরু হয় ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। বাঙলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের মানবিক বিকাশের প্রয়োজনের জন্যই এই ভাষা। তাই ভাষার উপর আক্রমণে এদেশের লোক প্রতিবাদ করেছে, রুখে দাঁড়িয়েছে। আবার ভাষা নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রশ্নটিও এসেছে। আমরা জানি, অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর অন্য সমস্ত কিছু আবর্তিত হয়। ফলে পাকিস্তানি শাসকদের সাথে যে অর্থনৈতিক বিরোধ তাই চিন্তা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বিরোধ তৈরি করলো, এটি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি রচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

…ফলে ঐতিহাসিকভাবেই পাকিস্তান সৃষ্টির অসারতা প্রমাণিত হলো। প্রমাণিত হলো যে শুধু ধর্মের মিল থাকলেই জাতি গঠিত হয়না। তাই ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তী সমস্ত অন্দোলন ধীরে ধীরে পাকিস্তান বাতিল করার দিকে নিয়ে গেল। এই লড়াইয়ের শেষ পর্যায়ে কী ভয়ঙ্কর-ভয়াবহ-মর্মান্তিক পরিণতির মধ্য দিয়ে এদেশ বিদেশি পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত হলো! এভাবে আরও একবার মুক্ত হয়েছিল বৃটিশদের কাছ থেকে। যদিও বৃটিশদের হাত থেকে মুক্তির সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল না। কারণ স্বাধীনতার সংগ্রাম যেসব উপাদানগুলিকে নিয়ে হয়, সেটা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত থাকার সময় ছিল না। রাষ্ট্রক্ষমতায় বসার জন্য নানা ধরনের যে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হয়েছে সেগুলিরই outcome হিসেবে পাকিস্তান তৈরি হয়েছে। পাকিস্তান যখন তৈরি হলো এবং সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে আমাদের এখানে যে আন্দোলন গড়ে উঠল, সে আন্দোলনই স্বাভাবিকভাবে সেক্যুলার-গণতান্ত্রিক চিন্তা নিয়ে এলো। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল তারা এই চিন্তাগুলোকে ধারণ করতে পারেনি। এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বকারী রাজনৈতিক নেতারা জনগণের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া গণতান্ত্রিক, সেক্যুলার চিন্তাকে ধারণ করতে পারেননি। এর কারণ কী? রাজনৈতিক সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী লোকেরা সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঝান্ডাটা কেন ফেলে দিলেন?

…একটা বিষয় বোঝা দরকার, সেক্যুলার-গণতান্ত্রিক এই চিন্তাগুলোর যে শ্রেণীগত প্রয়োজন, সেটা আজকের যুগে কেবল সর্বহারা শ্রেণীই ধারণ করে। বুর্জোয়া শ্রেণী যে আশা-আকাক্সক্ষাগুলোকে ধারণ করতে পারেনি তার জন্য আমি তখনকার প্রভাবশালী কিছু মানুষকে mean করছি না। যে শ্রেণীটি স্বাধীনতা আন্দোলনের পরবর্তীকালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এলো, তাকেই বোঝাতে চাইছি। ওই মানুষগুলো ছিলেন সেই শ্রেণীরই প্রতিনিধি। আজও তারাই continue করছে, শুধুমাত্র পরিচালকদের পরিবর্তন হয়েছে। ফলে স্বাধীনতার পর এতগুলো বছরেও শাসকদের সেক্যুলার-গণতান্ত্রিক-বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়ানো কোনোভাবেই সম্ভব হল না। শুধু তাই নয়, এরকম একটি শোষণ-বৈষম্যের সমাজকে টিকিয়ে রাখার জন্য পিছিয়ে পড়া-কুসংস্কারগ্রস্ত-কূপমন্ডূক চিন্তার ব্যাপক বিস্তার শাসকদের প্রয়োজন ছিল। তাই তারা এসবকে উৎসাহিত করেছে। এখনো সেই প্রয়োজন। এই বিষয়গুলো আমাদের ছাত্র-যুবকদের ভাবতে হবে।

লেখাপড়া কিসের জন্য শেখা? দেশের কোন না কোন ক্রিয়া, তার সামাজিক অবস্থানকে সহায়তা করার জন্য। কিন্তু দেশের অবস্থাই যদি সঠিকভাবে না জানি তাকে আমি service দেব কীভাবে? আমরা এমনভাবে শিক্ষিত হচ্ছি যেন শিক্ষার্জনটাই হলো ব্যক্তিগত বিষয়। শিক্ষা অর্জন আবার ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে হতে পারে নাকি? এর কোনো উপায়ই নেই। একজন ব্যক্তি যখন যেকোন ক্ষেত্রে দক্ষ হয় তখন তার প্রয়োগ হয় কোথায়? সমাজেই তো হয়। তাহলে সামাজিক প্রয়োজনের জন্যই ত শিক্ষা। সামাজিক প্রয়োজনের জন্য যদি শিক্ষা হয়, তাহলে একজন শিক্ষিত মানুষের কিভাবে গড়ে ওঠা উচিত? সমাজের প্রয়োজনকে ধারণ করা ব্যতিরেকে শিক্ষিত মানুষ হওয়াই মুশকিল।

…এখন শিক্ষার বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণের প্রসঙ্গে আসি। আমরা এমন একটা সময়ে এসেছি যখন একজন সহায়-সম্বলহীন মানুষও তার সন্তানের লেখাপড়ার কথা ভাবে। আবার জীবন ধারণ করতে গেলে কিছু লেখাপড়া করতেই হবে। কেননা কোনো না কোনো দক্ষতা অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষকে জীবন পরিচালনা করতে হয়। সমাজ তো দায়িত্ব নেয় না, নিজেরটা কোনোমতে চালিয়ে নেয়ার জন্য হলেও পড়াশুনা শিখতে হয়। আবার ফাটকা কারবারি, এটা-ওটা করার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে যতটুকু প্রসার ঘটেছে, তারাও শিক্ষা গ্রহণ করতে আসছে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে ভীষণ প্রতিযোগিতা। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর জন্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষকে ঠকিয়ে পুঁজিপতিদের হাতে অঢেল টাকা জমেছে। আরও বেশি মুনাফা করতে তারা এই টাকা কোথায় বিনিয়োগ করবে? এজন্য তারা শিক্ষাখাতকে বেছে নিয়েছে। লুটপাটকারী, দুর্নীতিবাজরা নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শপিং মলের মতো। এখান থেকে যারা বের হচ্ছে তারা কিভাবে শিক্ষিত হচ্ছে? তাদেরকে শিক্ষিত করা হচ্ছে ‘কর্মমুখী’, ‘উৎপাদনমুখী’ এসব শিক্ষার কথা বলে। কারিগরি শিক্ষার সাথে মানবিক শিক্ষা না দেয়ার কারণে সাহিত্য শেখা, ভাষা আয়ত্ব করা, শেক্সপিয়ার থেকে রবীন্দ্রনাথ বা বার্নাড শ থেকে শরৎচন্দ্র পর্যন্ত সবকিছু জানবার যে প্রবল আগ্রহ যৌবনে তৈরি হয়, যাকে কাজে লাগিয়ে যৌবনের শক্তি-সামর্থ্যকে নৈতিকভাবে প্রবাহিত করা যায়, তাকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে।

আবার কারিগরি শিক্ষার সাথে technical অর্থে বিজ্ঞানের কিছু কাজ আছে। কিন্তু তাতে বিজ্ঞান শিক্ষা হচ্ছে না। জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় গড়ে উঠেছিল বৈজ্ঞানিক নির্ভরশীলতা ও আন্তঃসম্পর্কের ভিত্তিতে। পদার্থবিদ্যা, গণিত, রসায়ন কিংবা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস ইত্যাদির সমন্বয়ও বিষয়গুলির আন্তঃসম্পর্কের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে।  জ্ঞানচর্চা যেহেতু সমগ্র মানব সমাজের স্বার্থে ব্যক্তির সাধনা, আবার ব্যক্তি তার জ্ঞানচর্চাসহ সমগ্র অস্তিত্বের জন্য সমাজের উপর নির্ভরশীল তাই মূল্যবোধ মানবিকতা সবসময়েই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা সাহিত্যের উপর সে কারণেই শিক্ষার একটি বিশেষ স্তর পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হত। বর্তমানে শিক্ষায় বাণিজ্যিকীকরণের দিকে লক্ষ্য রেখে রচিত সিলেবাসে এই সমন্বয়কে গুরুত্বহীন করে দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে তথাকথিত স্পেশালাইজেশনের কথা। যে ছাত্র বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তি অধ্যয়ন করবে এমনকি বাণিজ্যের কোন বিষয় পড়বে, তার সাহিত্য পড়ে কী হবে? ভাষার ক্ষেত্রেও তাদের নীতি এরকম। অর্থাৎ ব্যবসা সংক্রান্ত কাজের জন্য বাণিজ্যিক ইংরেজী, প্রযুক্তির জন্য প্রযুক্তিগত ইংরেজী শিখলেই হলো। অর্থাৎ জ্ঞান বিকাশের সুসংহত প্রক্রিয়াটিই ভীষণভাবে মার খাবে।

এই co-ordinated knowldge, যেটা এককালে বিজ্ঞান চর্চার মধ্যে ছিল – জগদীশ বসু, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহার মতো বড় বড় বিজ্ঞানী তৈরি হয়েছিল, দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে দেশের মানুষ সেরকম নাম আজ আর বলতে পারছে না। এই স্ট্র্যাচারের মানুষ দেশে নেই। বলতে চাইলেও হাতড়ে হাতড়ে পাই না কিছুতেই। তাঁরা কিন্তু ভাঙাচোরা ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞান চর্চা করতে করতে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হয়েছিলেন। আইনস্টাইন সত্যেন বোসকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার উপযুক্ত মনে করতেন। সত্যেন বোস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। গৌরববোধ থাকতে হবে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। জগদীশ বোস আমাদের বিক্রমপুরে জন্মেছিলেন। অথচ কতজন জানে এই কথা? কোনো চর্চা আছে এদেশে? পাকিস্তান আমাদের কত ক্ষতি করে দিয়েছে, আপনারা বুঝতে পারছেন? সাম্প্রদায়িক চিন্তা যদি আমাদের মাথাকে এভাবে চেপে ধরে রাখে তাহলে আমরা কি এসব বড় মানুষকে, বড় চরিত্রকে বুঝতে পারব? দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বিক্রমপুরে, আজকের মুন্সিগঞ্জে জন্মেছিলেন। কোনো গৌরববোধ আছে? কিছু শিক্ষিত লোক হয়ত কষ্ট পায়, মনে করে থাকলে ভালো হত, ঠিক হত। কিন্তু নেই তো। কেন নেই? আসলে সেক্যুলার-গণতান্ত্রিক চিন্তা আনবার জন্য যে প্রবল সাংস্কৃতিক আন্দোলন সেটা হয়নি। সেটা না করলে এই পরিবেশ পাল্টাবে না। একটু সেক্যুলার, একটু গণতান্ত্রিক, খানিকটা ধর্মীয় কূপমন্ডুকতায় আচ্ছন্ন এরকম জগাখিচুড়ি হয়ে কি বড় কোনকিছুকে ধারণ করতে পারবেন? পারবেন না, পারবেন না। আমার উপর ক্ষেপে যাবেন না। আমি বোঝার জন্য বলছি। মনের মধ্যে হচপচ নিয়ে, পাঁচমিশালী মন নিয়ে কোনদিনই গৌরববোধ দাঁড়াবে না।

এখন আমি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলব। ১৯৮৪ সালে ছাত্রলীগের ধারা থেকে ব্রেক করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট গড়ে উঠে। তখন এই সর্বজনীন-বিজ্ঞানভিত্তিক-সেক্যুলার-একইপদ্ধতির-গণতান্ত্রিক শিক্ষার শ্লোগান নিয়ে আসে। এই যে আনলো, এগুলো কথার অর্থে, শব্দের অর্থে কেউ কিছু শোনেনি একথা আমি বলছি না। কিন্তু এভাবে articulate করে, সুন্দরভাবে গুছিয়ে শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্র ফ্রন্ট-ই এনেছে। এটা আমরা কমরেড শিবদাস ঘোষের বিপ্লবী চিন্তা থেকে পেয়েছি। কমরেড শিবদাস ঘোষ মার্কসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের একজন বিপ্লবী, ভারতের সোশালিস্ট ইউনিটি সেন্টার-এর প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অনেক সংকট-সমস্যা নিয়ে পর্যালোচনা করে আজকের বিপ্লবী সংগ্রামের পথনির্দেশ করেছেন। তাঁরই শিক্ষা থেকে আমরা এই কথাগুলি নিয়েছিলাম।

…পুঁজিবাদ তার বাঁচার স্বার্থে সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার ও আন্দোলনের উপর আক্রমণ-দমনপীড়ণ নামিয়ে আনছে। কিন্তু তা দিয়ে মানুষের লড়াইকে ঠেকানো যায় না। মানুষ বার বার বিদ্রোহ করে। মানুষের বাঁচতে চাওয়াকে তো কেউ আটকে রাখতে পারবে না। ফলে একসময় দম বন্ধ হবার উপক্রম হলে আবার লড়াই করবে মানুষ। এই অন্তরঙ্গ মুক্তির আকুতি নিয়ে মানুষ লড়ে। এই মানুষকে অমানুষ, হৃদয়কে অনুভূতিহীন করার সর্বাত্মক চেষ্টা করে পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের এই সর্বাত্মক আগ্রাসী বিকৃত রূপটিকে বলা হয় ফ্যাসিবাদ। এটি মনুষ্যত্বকে একদম গোড়া থেকে নষ্ট করে দিতে চায়। এখানেই নিহিত আছে সবচেয়ে ভয়াবহ সর্বনাশের আশঙ্কা। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-শিক্ষা-সংস্কৃতি সংক্রান্ত নানা পরিকল্পনা-পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করে এ যুগের অন্যতম মহান মার্কসবাদী দার্শনিক ও চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ মানবতার চরম শত্রু হিসেবে ফ্যাসিবাদকে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “একদল লোক আছেন যারা প্রশাসনের উগ্র মূর্তিটাকেই ফ্যাসিবাদ বলেন। একনায়কত্বকেই ফ্যাসিবাদ বলেন। মনে রাখা দরকার, একনায়কত্ব – মিলিটারি একনায়কত্ব হয়। একনায়কত্ব ক্যু এর দ্বারাও তৈরি হয়। অত্যাচার সমস্ত জনস্বার্থবিরোধী প্রশাসন ব্যবস্থাতেই হয়। ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে সা¤্রাজ্যবাদীরা করে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ তার চেয়েও দুর্ধর্ষ। শুধু অত্যাচার একটা দেশের এত ক্ষতি করতে পারেনা। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে একটি সর্বাত্মক প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান। একদিকে সে মানুষের চিন্তাভাবনাগুলিকে মেরে দিয়ে তাকে আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে। অর্থাৎ দেশে একদল টেকনোক্র্যাট (শিক্ষিত কারিগর) সৃষ্টি করে যারা মানবিক লক্ষ্য থেকে সম্পূর্ণ বিচ্যুত। মানুষের প্রতি এবং সমাজের প্রতি যাদের কোন দায়বোধ নেই। তারা চাকুরিকে এবং গোলামীকেই সর্বস্ব বলে মনে করে। পয়সার বিনিময়ে যারা যা কিছু করতে পারে এবং এইভাবে বিজ্ঞানের চর্চা ও বিদ্যাকে তারা প্রবাহিত করে। অপরদিকে আধ্যাত্মবাদ সেকেলে যতরকম কুসংস্কার, যত যুক্তিহীন মানসিকতা ও অন্ধতাকে গড়ে তোলে। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে আধ্যাত্মবাদ – তমসাচ্ছন্ন ভাবনা ধারণা এবং যুক্তিহীনতার সাথে কারিগরী বৈজ্ঞানিক বিদ্যার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ। . . . .মনে রাখবেন, একটা জাতি না খেতে পেরেও উঠে দাঁড়ায়, না খেয়েও লড়ে যদি মনুষ্যত্ব থাকে। কিন্তু ফ্যাসিবাদ গড়ে উঠলে মানুষ বলতে দেশে বিশেষ কেউ থাকবেনা। কারণ মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সে বাঁধা সৃষ্টি করে।”

বন্ধুগণ, আপনাদের প্রতি আবেদন করছি, ভবিষ্যতে আপনারাই দেশের দায়িত্ব নেবেন। এই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার সমস্ত ষড়যন্ত্রকে বুঝবার জ্ঞান দরকার। …এটা বুঝতে হবে বিশ্বে পুঁজিবাদ বিকশিত হবার আর কোনো রাস্তা নেই। মনুষ্য বিধ্বংসী এই সামাজিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য সঠিক বিপ্লবী রাজনীতি, সঠিক রাজনৈতিক লাইন আয়ত্ত্ব করার জন্য আমি সমস্ত যুবক-ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অনুরোধ করে আমার বক্তব্য শেষ করছি। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

[বাসদ (মার্কসবাদী)-এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী গত ২৩ সেপ্টেম্বর ১৪ সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট আয়োজিত শিক্ষা কনভেনশনে বক্তব্য রাখেন যা ‘অনুশীলন’ ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।  সেই বক্তব্যটি কিছুটা সংক্ষিপ্ত করে এখানে প্রকাশ করা হলো।]

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের চতুর্থ কেন্দ্রীয় সম্মেলনের স্মরণিকা

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments