[অজয় দত্ত। প্রাক্তন ছাত্র ফ্রন্ট নেতা, চট্টগ্রাম জেলা শাখা। শিক্ষক, নোয়াখালী জেলা স্কুল। বাসদ (মার্কসবাদী)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এদেশের অনন্যসাধারণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী গত ৬ জুলাই ২০২১ তারিখে প্রয়াণের পর ২৪ জুলাই ২০২১ চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র-এর উদ্যোগে অনলাইনে আয়োজিত ‘সংশপ্তক বহমান’ শীর্ষক স্মরণসভায় অজয় দত্ত বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যটি পরবর্তীতে সম্পাদিতরূপে ‘কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ’-এ সংকলিত হয়। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরা হলো]
মানুষের যে বয়সটি শেখার বয়স কিংবা হৃদয়ঙ্গম করার বয়স, সে সময়টাতে আমি হায়দার ভাইকে পাইনি। আমি ’৯০-’৯১ পর্যন্ত হায়দার ভাইকে পেয়েছি। তখন ছাত্র ফ্রন্ট শেষ করে চারণের কিছু কাজ করি। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম। চারুকলা বিভাগের ছাত্র হওয়াতে সেখানের কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলাম। আমাদের আর্ট কলেজের একটা গ্রুপ ছিল, সেই গ্রুপের অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত। আমাদের এই গ্রুপের সাথে হায়দার ভাই প্রায়ই বসতেন। সবাই মিলে দোস্ত বিল্ডিংয়ে যেতাম, আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য। তিনি আলোচনা করতেন, আমরা হা-করে শুনতাম। আমরা চারুকলা বিভাগের ছাত্র ছিলাম, ফলে আমাদের অ্যাকাডেমিক বিষয়ও ছিল এগুলো। আমাদের শিক্ষকরাও এসব বিষয়ে বলতেন। কিন্তু হায়দার ভাই আমাদের শিক্ষকদের চেয়েও স্পষ্টভাবে এসব বিষয়ের উদ্দেশ্যগত দিক, দর্শনগত দিকগুলো আলোচনা করতেন। আসলে হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে হিমালয়কে দেখা যেমন, ঠিক সেভাবেই হায়দার ভাইকে দেখেছি। বিশেষত ওঁনার সার্বিক কর্মকাণ্ড যখন দেখতাম–যা বলতেন, তার সাথে নিজেকে একাত্ম করতেন।
আসলে এসময় হায়দার ভাইকে যদি আরও কিছুদিন কাছে পেতাম, তাহলে আমার জীবন হয়তো আরও অন্যরকম হতো। জীবনকে হয়তো অন্যভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম। কম বয়সের চঞ্চলতার কারণে তখন ওঁনাকে ঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি। হয়তো উঁনি বলে গেছেন, কিন্তু আমি শুধু শুনে গেছি। তখন সবকিছু উপলব্ধিতে নেওয়ার ক্ষমতাও হয়তো ছিল না।
আমরা তো অনেকেই আঁকি কিংবা দেশে এখন অনেকেই আঁকছেন, কিন্তু হায়দার ভাইয়ের সাথে কথা বলতে গিয়ে যেটা দেখলাম, তা হলো–শিল্পের যে একটা সামাজিক উদ্দেশ্য আছে, একটা দায়বদ্ধতা আছে, উঁনি সেটাকে বড় করে দেখতেন। শিল্পের সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারটা ওঁনার কাছ থেকে শিখেছি। আগে ভাবতাম, আর্টিস্ট আঁকা শিখছেন ছবি আঁকতে, কী আঁকবে, কেন আঁকবে–এসব বিষয় নিয়ে কোনো ভাবনা তেমন কাজ করত না। হায়দার ভাইয়ের সান্নিধ্যে আসার পর আমার জগতে একটা পরিবর্তন চলে এলো। একটা দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড়িয়ে গেল।
উঁনি জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এস এম সুলতান–বাংলাদেশের এসব বড় শিল্পীদের উদাহরণ দিতেন। তাঁদের কাজ বলতেন। জয়নুল আবেদিন এত যুদ্ধের স্কেচ করেছেন, ওঁনার স্কেচের মধ্যে বিশেষ একটা ব্যাপার আছে। এগুলি যেমন, স্কেচের মধ্যেও সেই ভাবটা আছে। এস এম সুলতান নিয়ে বলেছেন–জমি যতই অনুর্বর হোক, সেটাকে উর্বর করে এস এম সুলতানের কৃষকরা জমি কর্ষণ করছে। এটা এদের পেশি দেখলেই বোঝা যায়।
আসলে চিত্রকলা যে খুঁটিয়ে দেখার ব্যাপার এই বিষয়টা আমরা তখন ওঁনার কাছ থেকে পেয়েছি। আমি তো পেশাদার আর্টিস্ট না, যদিও সঞ্চালক আমাকে পরিচয় করিয়েছে চিত্রকলা প্রশিক্ষক হিসাবে। আমি পরবর্তীতে শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত হই। কিন্তু আমার বন্ধুরা যারা আঁকে তারা মাঝে মাঝে তাদের বিভিন্ন কাজ পাঠায়, ইনবক্স করে, একটু মূল্যায়ন করতে বলে, তো আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি যা হায়দার ভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছি এগুলিকে তারা খুব সম্মানের চোখে দেখে।
চট্টগ্রাম শহরের রাস্তায় আমরা প্রচুর চিকা মারতাম। হায়দার ভাই আমাদের বলতেন–ছবি এঁকে চিকা মার, যা দেয়ালে লিখতে চাও, তার ছবি আঁক দেয়ালে। কোনো ছবি, কোনো ভাস্কর্য দেয়ালে এঁকে তোমার বক্তব্য ফুটিয়ে তোল, এটা মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দেয়। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা আমরা হায়দার ভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছি।
ওঁনার ভ্যান গগের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। আমি ওঁনাকে অনেকবার দেখেছি হয়তো কোথাও যাচ্ছেন, হাতে ভ্যান গগের জীবনীর উপর লেখা কোনো বই। তিনি শরৎসাহিত্য নিয়ে খুব বলতেন। শরৎসাহিত্যের মধ্যে যে একটা দায়বদ্ধতার কথা আছে, এটা আমরা হায়দার ভাইয়ের কাছে এসেই বুঝতে পেরেছি।
আরও একটা বিশেষ দিক হলো–যেকোনো সৃষ্টিরই একটা সার্বজনীন দিক আছে। একা ক্রেডিট নেওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। এটা আমরা হায়দার ভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছি। তিনি বলতেন, সৃষ্টির যেহেতু একটা সার্বজনীন দিক আছে, কাজেই এটার আউটপুটও সার্বজনীন হওয়া উচিত। ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপার নেই, যা সার্বজনীনভাবে সৃষ্টি, তার প্রয়োগটাও সার্বজনীন হতে হবে। কারও ব্যক্তিগতভাবে কুক্ষিগত করার অধিকার নেই। ওঁনার এ ব্যাপারটা আমাদের অনেক উৎসাহ দিত।
বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে বলতেন, এটা শুধুমাত্র দু’জন পাত্র-পাত্রীর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এটা তো হতে পারে না, সমাজে এর বাইরেও অনেককিছু আছে। তিনি বলতেন যে, তবুও সাধারণ মানুষ এসব নাটক দেখে, কারণ নাটকে এরা একটু গুছিয়ে সুন্দর করে শুদ্ধ কথাবার্তা বলে, সাধারণ মানুষের কাছে এটাই অনেক ভালো মনে হয়, কারণ সাধারণ মানুষ তো শুদ্ধ ভাষায় কথাই বলতে পারে না। সাধারণ মানুষকে শাসকশ্রেণি এত নিচু স্তরে আটকে রেখেছে। এ ব্যাপারগুলো তিনি আমাদের সূক্ষ্মভাবে ধরাতেন, ভেতরের দিকটা দেখার চোখটা উঁনি তৈরি করতেন, এটা তিনি সবসময় করতেন। ওঁনার সংস্পর্শে একটা দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়ে যেত।
মানুষের সত্যিকারের শিক্ষক কে?–যে পথ দেখায়। শুধু শিখিয়ে দেওয়ার কাজ শিক্ষকের নয়, শিক্ষকের কাজ হচ্ছে পথ দেখানো। হায়দার সেই কাজটা অত্যন্ত সার্থকভাবে শেষ পর্যন্ত করে গেছেন। শিখিয়ে মুখস্থ করিয়ে দেওয়া শিক্ষকের কাজ না। শিক্ষকতা জীবনে এসে হায়দার ভাইয়ের এই শিক্ষাটা আমি বারবার অনুভব করেছি। তাঁর এই শিক্ষাটা অনুসরণ করার মতো। আমি আমার সহকর্মী বন্ধুদের শেখানোর কৌশলটা বিভিন্ন সময় আলোচনা করি।
যাই হোক, আগে বলেছি, আমাদের বোঝানোর ক্ষেত্রে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ওঁনার সংস্পর্শ, ওঁনার চলাফেরা, ওঁনার বিচারধারা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এখনও কোনো বিষয়ে ভাবতে গেলে, বলতে গেলে, ওঁনাকে এবং ওঁনার কথাগুলো খুব মনে পড়ে। ওঁনার থেকে যে দৃষ্টিভঙ্গি পেয়েছি, তার আলোকেই বলার চেষ্টা করি।
চট্টগ্রাম থেকে চলে আসার পর যোগাযোগ কম হতো। হয়তো প্রোগ্রামে দেখা হতো, মাঝে মাঝে ঢাকায় দেখা করতে যেতাম। ওঁনার সংস্পর্শের সব কথা এখন মনে নেই। ওঁনার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। এখানেই শেষ করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।