Thursday, March 28, 2024
Homeফিচারসবকিছু দিয়ে কীভাবে লড়তে হয়, সেটা হায়দার ভাইয়ের কাছ থেকে শিখতে হবে

সবকিছু দিয়ে কীভাবে লড়তে হয়, সেটা হায়দার ভাইয়ের কাছ থেকে শিখতে হবে

[সাইফুল হক অমি। আলোকচিত্র শিল্পী। ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ‘কাউন্টার ফটো’। বাসদ (মার্কসবাদী)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এদেশের অনন্যসাধারণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী গত ৬ জুলাই ২০২১ তারিখে প্রয়াণের পর ২৪ জুলাই ২০২১ চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র-এর উদ্যোগে অনলাইনে আয়োজিত ‘সংশপ্তক বহমান’ শীর্ষক স্মরণসভায় সাইফুল হক অমি বক্তব্য রাখেন। তাঁর বক্তব্যটি পরবর্তীতে সম্পাদিতরূপে ‘কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ’-এ সংকলিত হয়। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরা হলো]

 

আমি সোমার (ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য) কাছ থেকে ফোন পাই বোধহয় ৩-৪ দিন আগে, যতটুকু মনে আছে। ফোনটা পাওয়ার পরে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। এই জন্যে যে, আমার একটা পরিচিতি আছে যে, আমি সমালোচনা করি। এবং পার্টির-দলের সাথে নানারকম সমালোচনার একটা অভিজ্ঞতা আমার আছে। ফোনটা পাওয়ার পর থেকে আমি এ আলোচনাসভার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তার একটা প্রধান কারণ বোধ হয়, আমার একটা শিক্ষা হয়েছে। শিক্ষাটা এরকম যে, হায়দার ভাইয়ের শক্তিটা …

 

আমি হায়দার ভাইকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। কারণ হায়দার ভাইয়ের সাথে ‘চারণ’ সামান্য সময়ের জন্য করেছি। আমি আসলে ছাত্ররাজনীতি করতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যতটুকু মনে পড়ে ১৯/২০ বছর বয়সে আমরা একসাথে দলে যুক্ত হই। তার পরের ১০ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ অ্যাক্টিভ ছিলাম। শেষদিকটায় চারণের সাথে খানিকটা যোগাযোগ হয়েছিল। পেশাগতভাবে শিল্পচর্চা করি, সেই অর্থেই বোধ হয়। তো এই ফোনটা পাওয়ার পর থেকে আমার মনে হলো যে, হায়দার ভাই সম্বন্ধে আমার একটা  unconditional respect এবং unconditional love আছে, সেটার উৎসটা আমি হয়তো নিজে কখনও ভাবিনি। তো আমার মনে হলো যে, আমি বোধহয় আমার উত্তর পেলাম। সেটা হচ্ছে, হায়দার ভাইয়ের সাথে আমার যতগুলো সহমতের গল্প আছে, তার থেকে হাজারগুণ বেশি বিরোধের গল্প আছে। অসম্ভব রকম তর্ক হতো হায়দার ভাইয়ের সাথে। কিন্তু হায়দার ভাই যাদেরকে রেখে গেছেন, তারা যে আমার মতো তর্ক করা লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন এবং বললেন যে, আপনি একটু আসবেন। এইখানেই সম্ভবত হায়দার ভাই সকলের চেয়ে আলাদা।

 

হায়দার ভাই এমন একজন মানুষ। আমি মনে করি যে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, একেবারে literally until his last breathe, he was a revolutionary! হায়দার ভাইকে আমার সবসময় মনে হয়, হায়দার ভাই হচ্ছেন তাঁর প্রজন্মের, তাঁর ধরনের, তাঁর চিন্তার শেষ মানুষ। আমি মনে করি, সামনের দিনের রাজনীতি হায়দার ভাই এবং তাঁর জেনারেশন যেভাবে দেখতেন সেইরকম শুদ্ধতা নিয়ে, পবিত্রতা নিয়ে (পবিত্রতা শব্দটা প্রব্লেমেটিক), শুদ্ধতা ও নৈতিকতা নিয়ে হয়তো আর কেউ করবেন না। ২০২১-এর রাজনীতি আলাদা রকম হবে, সেটা ভালো হোক-মন্দ হোক আরেক গল্প। কিন্তু হায়দার ভাইকে আমার একটা monumental figure মনে হয়। আমরা যারা সংস্কৃতিক্ষেত্রে কাজ করি, প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, তারা প্রতিদিন হায়দার ভাই যেসব প্রশ্নের মুখে আমাদের ফেলেছিলেন, ব্যক্তি হিসাবে, রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে, খানিকটা সংস্কৃতিকর্মী হিসাবে সেগুলোর মুখে আমি প্রতিদিন পড়ি।

 

তো হায়দার ভাইয়ের এই আলোচনা করতে হবে বলে একটা বইয়ের কাছে ফেরত গেলাম। আমার এক বন্ধু যিনি খুব পড়ালেখা জানা লোক, তাকে আমি বললাম যে, হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে যখন আমি বিরোধ করি, তখন তো আমার ২৪/২৫ বছর বয়স। খুব রাগী ছিলাম, সেটা একটা সমস্যা। এখন ১৫ বছর পরে এসে আমি দেখি যে, তাকে আমি read করতে পারছি। এবং হায়দার ভাই একটা ধারার মানুষ, একটা মতবাদের মানুষ। সত্যি করে যদি আমি বুকে হাত দিয়ে বলতে চাই তাহলে বলব, হায়দার ভাইয়ের মতো সৎ মানুষ আমি সম্ভবত কখনও দেখিনি। আমি খুব পারিবারিকভাবে সৎ পরিবারের সন্তান বলে মনে করি। কিন্তু হায়দার ভাইয়ের মতো সৎ মানুষ হয় না।

 

এইটুকু আমি মনে করি যে, হায়দার ভাইয়ের সততা দিয়ে হয়তো উঁনি যে লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোটা হয়তো re-read করার জায়গা আছে। যেমন আমরা ইলিয়াস নিয়ে অনেক আলোচনা করতাম। আমরা সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতাম। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন শরৎ (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) নিয়ে কথা বলেছি। চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলেছি। তীব্র রকম আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে অশ্লীলতাবিরোধী মুভমেন্ট নিয়ে। কিন্তু হায়দার ভাইয়ের মধ্যে যে vigorous ফাইট করা, আত্মার যতোটুকু দম আছে ততটুকু পর্যন্ত তিনি লড়তেন। আমার মতো একটা বাচ্চা ছেলের সাথে বা আমাদের মতো যারা কথা বলতেন। সেই শক্তি আছে এরকম কাউকে আমি অন্তত চিনি না।

 

অনেকবছর পর ওঁনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ওঁনার দলের অনেকের সঙ্গেই আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব আছে। বোধ হয় বছর দেড়েক আগে আমি পার্টি অফিসে মাঝেমাঝে আড্ডা দিতে যেতাম। তো হায়দার ভাইকে আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে যেমন দেখেছিলাম, সেরকমই। শারীরিক এবং মানসিকভাবে। হায়দার ভাইকে দেখলে আমি একটু খোঁচা-টোচা দিতাম। একটা গ্রেটম্যান-এর যা হয় আর কি, উঁনি হাসিমুখেই সেটা নিতেন এবং আমি বুঝতাম যে, উঁনি খানিকটা বিরক্তও হন। কিন্তু এখন এসে আমাকে যখন সোমা ফোন করল, সোমা এবং অন্য বন্ধুরা যারা দল করেন, আমার অনেক বন্ধু আছেন এখানে। তাদের সকলের সাথেই আমার সম্পর্ক বেশ ভালো। তো আমার মনে হয় হায়দার ভাই left a legacy that will go back through. কারণ ওরকম মানুষ আমি অন্তত চিনি না। বাংলাদেশের বামপন্থী অনেক নেতারা আমার বন্ধু। তাদের অনেকের সাথে আমি কাজ করেছি, করি। মুবিনুল হায়দারের মতো কেউ না। He is one man that cannot be replaced.

 

আমি থিওরিটিক্যালি হায়দার ভাইকে ফ্রেইম করার চেষ্টা করেছি, ইন্টেলেকচুয়ালি বোঝার চেষ্টা করেছি। ১৯৩০-এর দশকে গোর্কির হাত ধরে যে সোশ্যাল রিয়েলিজমের জন্ম, পরবর্তী পৃথিবী যখন বদলেছে যেমন ধরেন থিওরিটিক্যালি গ্রামসি, আলথুসার, ফুকো, দেরিদা যাদেরকে আমরা চিনি, পোস্টমডার্ন বা পোস্টস্ট্রাকচারের দুনিয়ায় যারা অপারেট করেন, তাদের অনেকের প্রশ্নে হায়দার ভাইকে আমি পেয়েছি। আমার মনে হয়েছে, He is not encountering those things. কিন্তু এটা হয় না যে আমরা হয়তো আরেকটা জেনারেশনের লোক। কিন্তু আমি মনে করি যে, হায়দার ভাইয়ের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি যেটা শেখার ছিল, যেটা আরেকটু ভালো শিখতে পারলে ভালো হতো, আজকে সত্যি আমি যখন শুনছি, এটা খুশি করার জন্য বলছি না, আমার আফসোসই লাগছে যে, হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে আমার আরও দীর্ঘদিন থাকার কথা ছিল। থাকা উচিত ছিল। ব্যক্তি হায়দার ভাইয়ের সাথে, দলের সাথে না থাকলেও। সত্যিকার অর্থে, একটা লক্ষ্যে একটা মানুষ কতটা স্থির হতে পারে! আমি হায়দার ভাইকে নিয়ে যে লেখাটা লিখেছে তাঁর দল সেটা পড়ছিলাম এবং আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল, হায়দার ভাই ৮৪ বছর বয়সে নতুন করে শুরু করলেন। মানে একটা মানুষ তাঁর বিশ্বাসে কত শক্ত হলে এবং কতটা কমিটেড হলে এটা সম্ভব!

 

তো হায়দার ভাই যেদিন মারা গেছেন, সেদিন অবশ্যই তাঁর নতুন জন্ম হয়েছে আমি মনে করি। তাঁর শুদ্ধতা নিয়েই তো আমরা কথা বলব। হায়দার ভাইয়ের ভুল নিয়েও আমরা কথা বলব। কিন্তু আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, হায়দার ভাইয়ের ভুলকে আমি অন্তত কোনোদিন অপরাধ মনে করব না। লড়তে লড়তে মানুষ পড়ে যায়, আবার উঠে দাঁড়ায়, আবার ভুল করে এবং এটাই একজন মার্ক্সিস্ট, একজন বিপ্লবীর সবচেয়ে প্রধান শক্তি। মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর সেই শক্তি ছিল। এবং সেই শক্তির সামনে আর কারোরই দাঁড়ানোর ক্ষমতা আছে বলে মনে করি না। হায়দার ভাইকে নিয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। দল ভেঙেছে, দলের ভাঙা শরীর কাছ থেকে দেখতে হয়েছে নানা কারণে। কিন্তু হায়দার ভাই তাঁর ভুলগুলোকে শুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন কি না আমি জানি না। কিন্তু হায়দার ভাই যা করেছেন, সেটা সবসময় তাঁর বিশ্বাস থেকে করেছেন। একদম সাচ্চা বিপ্লবী বলতে যেটা বোঝায় সেটা। এবং আরেকজন মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকে হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতি পাবে না, এটা আমার ধারণা। যেভাবে, যে জায়গায় এসে আমরা দাঁড়িয়েছি, আরেকজন মুবিনুল হায়দার চৌধুরীকে আমরা পাব না। সেটা আমি নিশ্চিত। তাঁর থেকে radical, তাঁর থেকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে উন্নত, তাঁর থেকে বেশি প্রজ্ঞার অনেক মানুষ হয়তো আমরা পাব। কিন্তু হায়দার ভাইয়ের কাছে আমরা ফিরব।

 

শরীরের সমস্ত রোমকূপ দিয়ে, সবকিছু দিয়ে কীভাবে লড়তে হয়, সেটা যদি কারও কাছ থেকে শিখতে হয়, সেটা হায়দার ভাইয়ের কাছ থেকে শিখতে হবে। আমি ২০/২২টা দেশে কাজ করি। সারা দুনিয়ার অনেক মানুষ আমাকে কাজের সূত্রে চেনে। আমি সবার কাছে যখন যাই, দেশে-বিদেশে আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমি বলি, বাংলাদেশে একটা ছোট দল আছে, ‘এরকম’ একটা দল, সে দলটা আমি করতাম। তো এখন ১৬ বছর পরে, দল ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন, মনে হয় দলটা যাঁকে দেখে করতাম, তিনি সম্ভবত মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। ভুল হোক শুদ্ধ হোক, তাঁকে দেখেই দল করতাম। তাঁর সাথে যত ঝগড়া করা যেত, আলোচনা বা তর্ক করা যেত; এরকম লোক, এই বয়সের, এই ক্ষমতার, এইরকম কমিটমেন্টের, ত্যাগের একটা মানুষ আমার সঙ্গে কথা না বললেও কিছু এসে যেত না। আমার মনে হয়, সামনের দিনগুলোতে হায়দার ভাই অনেক বড় হয়ে উঠবেন। ইলিয়াস যখন মারা যান (তিনি যেহেতু সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন), ওঁনার ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ বিক্রি হয়েছিল ২৮৯ কপি। উঁনি নিজেই আমাকে বলেছিলেন। আপনারা দেখেন, ইলিয়াস কত বড় হয়ে উঠেছেন। ভবিষ্যতে আরও বড় হয়ে উঠবেন।

 

আমার ধারণা–মুবিনুল হায়দার চৌধুরী নামের বটবৃক্ষ আমাদের বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলে প্রসারিত হবে। বাম রাজনীতি বলতে কী বোঝায়, সেটা কী করে করতে হয় এবং কী করলে কী হয় সেটা বোঝার জন্য হায়দার ভাই এবং তাঁর জীবনের কাছে আমাদের ফিরতে হবে। ধন্যবাদ।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments