Wednesday, December 25, 2024
Homeসংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিপার্টি ও সংগঠন সংবাদসাম্রাজ্যবাদী শকুনের চোখ এখন আফ্রিকার দিকে

সাম্রাজ্যবাদী শকুনের চোখ এখন আফ্রিকার দিকে

US Imperialismআফ্রিকা মানেই অগুনতি গৃহযুদ্ধের আগুন। আফ্রিকা মানেই দুর্ভিক্ষ আর ত্রাণশিবিরের সামনে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকা কঙ্কালসার মানুষের সারি। প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে আমাদের মাথায় আফ্রিকার এই ছবিই গেঁথে আছে। আমাদের বোঝানো হয়, ইউরোপ-আমেরিকার অঢেল দয়া-দাক্ষিণ্যই টিকিয়ে রেখেছে আফ্রিকাকে। কিন্তু আসল ঘটনা ঠিক এর উল্টো। বরং আফ্রিকা মহাদেশেরই বিপুল দানের ওপর নির্ভর করে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো। নানা চেহারায় দানের এই স্রোত আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে চলে যায়। এর একটা রূপ হল, এখানকার শিল্পপতিদের মুনাফার অর্থ। কর ফাঁকি দেওয়ার মতলবে এই অর্থ বেআইনি পথে সাম্রাজ্যবাদী দেশের ব্যাঙ্কে চলে যায়। দ্বিতীয় রূপ হল, সুদ বাবদ বেরিয়ে যাওয়া বিপুল টাকা।  এই টাকা আফ্রিকা থেকে ওইসব দেশের দেনার সুদ মেটাতে বেরিয়ে চলে যায়। আফ্রিকার বহু দেশের সামরিক শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর ব্যাঙ্ক বিরাট অংকের টাকা ঋণ দেয়। অনেক সময় এই শাসকরা সেই টাকা ব্যাঙ্কে নিজের অ্যাকাউন্টেই জমা রাখে। অথচ সে টাকার বিপুল সুদ গুনে চলতে হয় দেশের মানুষকে বছরের পর বছর ধরে। দুই গবেষকের সাম্প্রতিক এক গবেষণার রিপোর্টে জানা গেছে, ঋণ নেওয়া মোট অর্থের ৮০ শতাংশই এক বছরের মধ্যে ফিরে চলে যায় ঋণদাতা দেশে। লোকঠকানো এই ঋণের একটা পয়সাও আফ্রিকার সাধারণ মানুষের কল্যাণে বিনিয়োগ হয় না, অথচ বছরে গড়ে ২ হাজার কোটি ডলার সুদ হিসেবে বের হয়ে যায়।

আফ্রিকার মূল্যবান খনিজ সম্পদ থেকেও দেদার টাকা লোটে ইউরোপ-আমেরিকা। যেমন ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো। প্রতিবেশী উগান্ডা, রোয়ান্ডা ও বুরুন্ডি থেকে আসা সশস্ত্র গুণ্ডাবাহিনী কঙ্গো দাপিয়ে বেড়ায়, লুট করে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ এবং পশ্চিমি দেশের বিভিন্ন কোম্পানির কাছে কম দামে সে সব বেচে দেয়। এইসব দুষ্কৃতীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা-ইউরোপই যে মদত দেয়, রাষ্ট্রসংঘও সে কথা স্বীকার না করে পারেনি। এছাড়াও আফ্রিকার খনি-শ্রমিকদের অসম্ভব কম মজুরি দিয়ে এবং নিতান্ত সস্তায় সেখান থেকে কাঁচামাল ও প্রাকৃতিক সম্পদ কিনে নিয়ে আরেকভাবে আফ্রিকা মহাদেশকে লুটে নেয় সাম্রাজ্যবাদীরা, ফুলে-ফেঁপে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কারবারিদের মুনাফা।

সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে তাই আফ্রিকা হল সস্তা প্রাকৃতিক সম্পদ আর সস্তা শ্রমের লোভনীয় ভাণ্ডার। এবং তারা জানে, যতদিন এই মহাদেশ আর্থিকভাবে অনুন্নত আর দুর্দশাগ্রস্ত থাকবে, যতদিন হাতের মুঠোয় পুরে রেখে তার স্বনির্ভর বিকাশ আটকে রাখা যাবে, ততদিনই সস্তা দরে এসব মিলবে। ফলে লাগিয়ে দাও দেশে দেশে দ্বন্দ্ব এবং এই পথে দুর্বল করে রাখো তাদের। সেই কারণেই কঙ্গোতে ভাড়াটে গুণ্ডাদের দিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগিয়ে রেখেছে সাম্রাজ্যবাদীরা, যাতে সেই অবকাশে লুটেপুটে নেওয়া যায় সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই যে কঙ্গো প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার অর্থমূল্যের খনিজ সম্পদ উৎপাদন করে, সাম্রাজ্যবাদীদের লাগিয়ে দেওয়া যুদ্ধ-পরিস্থিতির কারণে কয়েক বছর আগে সেই সম্পদ থেকে কর বাবদ তার আয় হয়েছে মাত্র ৩ কোটি ২০ লক্ষ ডলার।

Punch_Rhodes_Colossusএই বিরামহীন শোষণ আর লুট রুখতে আফ্রিকার দেশগুলি ঐক্যব্ধ হয়ে তৈরি করেছিল ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন’ — আফ্রিকার দেশগুলির জোট, ২০০২ সালে। কপালে ভাঁজ পড়েছিল সাম্রাজ্যবাদীদের। বিশেষ করে, ‘আফ্রিকান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক স্থাপন ও গোটা মহাদেশ জুড়ে একটি সাধারণ মুদ্রা (দিনার) চালু করার পরিকল্পনা — যার পিছনে থাকবে সমমূল্যের সোনা — আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের অবাধ শোষণ-লুন্ঠনের পথে বাধা হিসেবে দেখা দিয়েছিল। কারণ দিনার চালু হলে সাম্রাজ্যবাদীদের বেচাকেনা করতে হবে সোনা দিয়ে, কাগজে ছাপা নিজের দেশের নোট আর চলবে না। ‘আফ্রিকান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্ক’ ও ‘আফ্রিকান মানিটারি ফান্ড’ নামে দুটি আর্থিক সংস্থা স্থাপন করারও পরিকল্পনা ছিল, যা বাস্তবায়িত হলে ইউরোপ-আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রীতিমতো চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ত। কারণ, মাত্র আড়াই কোটি ডলার বিনিয়োগ নিয়ে গোটা আফ্রিকার ওপর ছড়ি ঘোরায় যে সাম্রাজ্যবাদী আর্থিক সংস্থা আইএমএফ, তাকে হঠিয়ে দেওয়া অসম্ভব হত না প্রস্তাবিত আফ্রিকান মানিটারি ফান্ডের, যার পরিকল্পনা ছিল ৪ কোটি ২০ লক্ষ ডলার পুঁজি নিয়ে কাজ শুরু করা।

আর্থিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি সামরিক ক্ষেত্রেও সাম্রাজ্যবাদের খবরদারি প্রশ্নের মুখে পড়তে চলেছিল আফ্রিকায়। ২০০৪ সালে লিবিয়ায় আফ্রিকান ইউনিয়নের শীর্ষবৈঠকে আফ্রিকার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটি সাধারণ সনদ তৈরি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। সেই সনদের একটি আলাদা পরিচ্ছেদে এ কথাও বলা হয়েছিল যে, আফ্রিকার যে কোনও দেশে যে কোনও ধরনের আক্রমণকেই গোটা মহাদেশের ওপর আক্রমণ বলে গণ্য করা হবে। প্রসঙ্গত, মার্কিন যুদ্ধজোট ‘ন্যাটো’র সনদেও এমন কথাই বলা আছে। এরপর, ঐ সনদ কার্যকরী করার উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১০ সালে তৈরি হয়েছিল ‘আফ্রিকান স্ট্যান্ডবাই ফোর্স’। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, গায়ের জোরে আফ্রিকার ঐক্য ধ্বংস করতে হলে ন্যাটোর হাতে সময় আর বেশি নেই।

তবে এই আফ্রিকান স্ট্যান্ডবাই ফোর্স বা প্রয়োজনে কাজে নামার জন্য প্রস্তুত অপেক্ষারত সেনাবাহিনী সাম্রাজ্যবাদীদের সামনে একদিকে যেমন বিপদ হিসেবে দেখা দিল, তেমনি অন্য দিকে এটা তাদের জন্য একটা সুযোগও তৈরি করে দিল। কারণ, আফ্রিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন রুখে এই মহাদেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করার জন্য তৈরি হলেও এই বাহিনীকে যদি কোনওভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের কবজায় নিয়ে আসা যায়, তাহলে একে কাজে লাগিয়েই আফ্রিকাকে পদানত করে রাখা যাবে।

Mali_Nigerএদিকে, নিজেদের অর্থনৈতিক দুর্দশা ও আফ্রিকায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলে আফ্রিকাকে পদানত ও দুর্বল করে রাখতে, বিশেষত সেখানে নিজেদের পুঁজি বিনিয়োগকে সুরক্ষিত রাখতে নিজস্ব একটি সামরিক বাহিনী দাঁড় করানো সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজন হিসেবে দেখা দিল। সেই উদ্দেশ্যেই ২০০৮ সালে তৈরি করা হল ‘আফ্রিকম’ — আফ্রিকার সেনাদের নিয়ে তৈরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন একটি বাহিনী। কিন্তু বাধা হিসেবে দাঁড়াল আফ্রিকান ইউনিয়ন। আফ্রিকার মাটিতে মার্কিন সামরিক বাহিনীকে ঘাঁটি গাড়তে দিতে তারা অস্বীকার করায় সাম্রাজ্যবাদীরা বাধ্য হল জার্মানির স্টুটগার্টে আফ্রিকমের সদর দপ্তর স্থাপন করতে। পিছু হঠতে হল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশকে, তিনি আফ্রিকার বুকেই আফ্রিকমের সদর দপ্তর স্থাপন করার ইচ্ছার কথা আগেই ঘোষণা করেছিলেন।

পরের বছর ২০০৯ সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য আরও দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে এল যখন লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল গদ্দাফি আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। আফ্রিকা মহাদেশে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতির সবচেয়ে জোরালো প্রবক্তা এই গদ্দাফি লিবিয়াই আফ্রিকান ইউনিয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি অর্থসাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছিল আগেই। এবার সেই গদ্দাফিই নতুন উদ্যমে আফ্রিকার দেশগুলির ঐক্য গড়ে তোলার কাজে এগিয়ে এলেন, উদ্যোগ নিলেন একটি ঐক্যবদ্ধ সামরিক বাহিনী, মুদ্রা ও গোটা মহাদেশ জুড়ে একক পাসপোর্ট তৈরি করতে। এর পরিণতি কি হয়েছিল, তা সবারই জানা। মিথ্যা অভিযোগ সাজিয়ে লিবিয়া আক্রমণ করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধজোট ন্যাটো গোটা দেশকে ছারখার করে দিল, কর্নেল গদ্দাফিকে হত্যা করল। আফ্রিকান ইউনিয়নকে বশে আনা গিয়েছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সাম্রাজ্যবাদীরা। সেই মুহুর্তে অন্তত সেরকমই মনে হয়েছিল। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে লিবিয়ায় সামরিক হানাদারির পক্ষে ভোট দিল ইউনিয়নের তিন সদস্য দেশ – নাইজেরিয়া, গ্যাবন ও দক্ষিণ আফ্রিকা। এমনকী আফ্রিকান ইউনিয়নের নতুন চেয়ারম্যান জাঁ পিং ন্যাটোর বানিয়ে দেওয়া লিবিয়ার পুতুল সরকারকে দ্রুত স্বীকৃতিও দিয়ে ফেললেন। ইউনিয়নের সভায় নিহত চেয়ারম্যান কর্নেল গদ্দাফির স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনেও তিনি এমনকী রাজি হলেন না।

IMF-Banner-550কিন্তু অচিরেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হল। এই ঘটনার কয়েক মাস পরেই, লিবিয়ায় ন্যাটোর হানাদারিকে সমর্থন জানানোর জন্য বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশ করা হল। বলা হল, আফ্রিকান ইউনিয়নের আনা যুদ্ধবিরতি ও দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনার যে প্রস্তাবে প্রেসিডেন্ট গদ্দাফি সম্মত হয়েছিলেন, তা অগ্রাহ্য করে হামলা চালিয়ে ন্যাটো বেআইনি কাজ করেছে। আরও বলা হল, পশ্চিমী সাম্রাজবাদীরা এই হামলা চালিয়েছে আফ্রিকার জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। দক্ষিণ আফ্রিকার বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তাব্যক্তি মন্তব্য করেন, ‘সাউথ আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট কমিউনিটি’ (এসএডিসি)-র সদস্য দেশগুলির অধিকাংশ, বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবোয়ে, অ্যাঙ্গোলা, তানজানিয়া, নামিবিয়া ও জামবিয়া, যারা দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিসংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিল, লিবিয়ায় ন্যাটোর বোমাবাজিকে জাঁ পিং যে দৃষ্টিতে দেখেছেন, তারা তা পছন্দ করেনি। ২০১২-র জুলাই মাসে পিং-কে পদচ্যুত করে ৩৭টি দেশের সমর্থনে আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রখ্যাত মহিলা নেত্রী ডঃ কোসাজানা জুমা। জুমা তাঁর পূর্বসূরী পিং-এর আপসকামী শিবিরের লোক না হওয়ার কারণে আফ্রিকান ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণ আবার ফিরে এল সেই শক্তির হাতে যারা স্বনির্ভর বিকাশের জন্য লড়াইয়ে প্রস্তুত।

gaddafi_0202গদ্দাফির মৃত্যুর ফলে আফ্রিকান ইউনিয়ন শুধু এক শক্তিশালী সদস্যকে হারাল তাই নয়, আফ্রিকার সাহেল-সাহারা অঞ্চল (সুদান, মালি, নাইজার, লিবিয়া সহ উত্তর আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে নিয়ে গঠিত একটি অবাধ বানিজ্য অঞ্চল)-এর নিরাপত্তাও বিপন্ন হল। গদ্দাফি সামরিক শক্তি প্রয়োগের সাথে সাথে মৌলবাদী চিন্তাভাবনা থেকে মানুষকে মুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে এবং আপস-মীমাংসার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী সশস্ত্র বাহিনী ‘সালাফি’-দের বাড়বাড়ন্তকে রুখে দিতে পেরেছিলেন। এ কথা অস্বীকার করতে পারেনি স্বয়ং লিবিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টোফার স্টিভেন্স। ১৯৯৮ সালে গদ্দাফি সাহেল-সাহেরা অঞ্চলের  রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন একটি সংগঠন, যেটি পরিচিত ‘সিইএন-এসএডি’ বা ‘সাহেল-সাহেরা অঞ্চল’ নামে। এই সংগঠনের অন্তর্ভূক্ত ২৩টি দেশের মধ্যে অবাধ বাণিজ্য ও অবাধ চলাচলের প্রসার ও উন্নয়ন ঘটানোর পিছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল গোটা এলাকায় শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। এই সংগঠনের মূল কেন্দ্র ছিল লিবিয়ার ত্রিপোলিতে এবং গদ্দাফিই ছিলেন এর পিছনকার মূল শক্তি। প্রধানত এই দেশগুলির সমর্থনেই ২০০৯ সালে গদ্দাফি আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

যথারীতি এই সিইএন-এসএডি সংগঠন আফ্রিকায় সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্য বিস্তারের বাধা হয়ে দাঁড়াল। কেননা, এর ফলে আফ্রিকায় শান্তি ফিরে আসার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সাথে সাথে স্বনির্ভর বিকাশের একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। ফলে, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার নাম করে তৎক্ষণাৎ তৈরি করল ‘ট্রান্স-সাহারা কাউন্টার টেররিজম পার্টনারশিপ’।

গদ্দাফি যতদিন জীবিত ছিলেন, সালাফি সন্ত্রাসবাদীদের দিকে আঙুল দেখিয়ে, তাদের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করার অজুহাত তুলে আফ্রিকায় আগ্রাসন চালানো পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে মুশকিল ছিল। পরদেশে আগ্রাসন চালানোর আগে সবসময়ই ‘ইসলামি সন্ত্রাসবাদে’র হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়ার এই ধুয়োই তোলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। গদ্দাফির নেতৃত্বাধীন লিবিয়া সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে আফ্রিকায় আগ্রাসন চালানোর এই অজুহাতটা কেড়ে নিয়েছিল এবং তার পাশাপাশি আফ্রিকার দেশগুলির সুস্থিতি নষ্ট করতে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতের পুতুল হিসেবে এইসব  সন্ত্রাসবাদীদের ব্যবহৃত হওয়াটাও লিবিয়া আটকেছিল।

ForFreedom76AP739947911229HiRezকিন্তু গদ্দাফির মৃত্যুর পর পরিস্থিতি আবার পাল্টে গেল। ন্যাটো বাহিনী লিবিয়াকে ছারখার করে দেওয়ার পর এখন সে দেশ হয়েছে সালাফি সন্ত্রাসীদের লুণ্ঠনক্ষেত্র। সন্ত্রাসীরা সরকারি অস্ত্রাগার তো লুঠ করছেই, আবার ন্যাটো তাদের উন্নত, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের নানা উপকরণ সরবরাহ করছে, লিবিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে ন্যাটোর যোগসাজসে সীমান্ত এলাকাগুলি অসুরক্ষিত করে রাখা হয়েছে যাতে অবাধে পাচার করা যায় লিবিয়ার অস্ত্রশস্ত্র। বস্তুত অস্ত্র বিক্রি এখন এই অঞ্চলে একটা বিরাট ব্যবসা। প্রতিবেশী দেশ মালিতে হামলা চালিয়েছে সালাফি সন্ত্রাসীরা। আলজেরিয়াও সালাফি সন্ত্রাসীদের শিকার হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস আছে আলজেরিয়ার। আফ্রিকা ও ইউরোপের প্রতি আলজেরিয়ার আজকের মনোভাবেও তার এই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনচেতা সত্তা কিছুটা এখনও টের পাওয়া যায়। আলজেরিয়া হল আফ্রিকান ইউনিয়নের দৃঢ় সমর্থক। ইউনিয়নের বাজেটের ১৫ শতাংশ এই দেশই বহন করে, আফ্রিকান মনিটারি ফান্ডেও আলজেরিয়া ১৬০০ কোটি ডলার অর্থসাহায্য দেবে বলেছে। লিবিয়া ও সিরিয়ায় ন্যাটোর বোমাবর্ষণের প্রতিবাদ জানিয়েছিল আরব লিগের অন্তর্ভুক্ত যে দুটি দেশ, আলজেরিয়া তাদের অন্যতম। শুধু তাই নয়, ন্যাটোর হানাদারিতে দেশছাড়া গদ্দাফি পরিবারের সদস্যদের আশ্রয়ও দিয়েছিল আলজেরিয়া।

কিন্তু আলজেরিয়াকে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্বেগের কারণ  ভিন্ন। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষেত্রে আলজেরিয়া সরকার সংরক্ষণমূলক নীতি নিয়ে চলে। ফলে যথেষ্ট দর-কষাকষি করার পরেই সেখান থেকে প্রকৃতিক সম্পদ কিনতে হয় সাম্রাজ্যবাদীদের। ২০১৩ সালে ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’ পত্রিকা লিখেছে,‘আলজেরিয়ার কড়া প্রশাসন, কঠিন কর-নীতি এবং জ্বালানি-শক্তির রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ‘সোনট্র্যাক’-এর নীতির কারণে সে দেশে বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে…।’ আলজেরিয়ার অধিকাংশ তেল ও গ্যাস সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে সোনাট্র্যাক নামে সরকারি এই সংস্থা। এ হেন আলজেরিয়া যে সাম্র্রাজ্যবাদী লুঠেরাদের চক্ষুশূল হবে, তাতে আর আশ্চার্য কী!

imperialists-out-of-africaআন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘স্ট্রাটফর’-এর রিপোর্টেও আলজেরিয়াকে ঘিরে উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। তারা লিখছে, আলজেরিয়ার উগ্র জাতীয়তাবাদী সামরিক সরকারের সংরক্ষণমূলক নীতির কারণে বিদেশের সঙ্গে তার ব্যবসায়িক লেনদেন ব্যাপকভাবে মার খাচ্ছে। তাদের মতে এটা ইউরোপের পক্ষে খুব উদ্বেগজনক, কারণ উত্তর সাগরে প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার ফুরিয়ে আসার কারণে খুব শিগগিরই আলজেরিয়ার ওপর অনেক বেশি করে নির্ভর করতে হবে ইউরোপকে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এই দশকের শেষের দিকে উত্তর সাগরে অবস্থিত ব্রিটেন ও হল্যান্ডের প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার ফুরিয়ে আসবে। ২০১৫ সালের পর নরওয়ের ভাণ্ডারেরও একই দশা হবে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। ফলে রাশিয়া ও এশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস ভাণ্ডারের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আশঙ্কায় ইউরোপকে তাকাতে হচ্ছে আলজেরিয়ার দিকে, বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী যেখানে সঞ্চিত রয়েছে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ১৭ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার শেল গ্যাস। আলজেরিয়ার এই বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদে থাবা বসানোর ক্ষেত্রে ইউরোপের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হল আলজেরিয়া সরকারের সংরক্ষণমূলক নীতি। স্ট্রাটফরের রিপোর্ট এমনকী এ মন্তব্যও করা হয়েচে যে, আলজেরিয়ায় একটা শক্তিশালী স্বাধীন সরকার না থেকে দেশটা যদি কোনও নড়বড়ে সরকারের অধীনে থাকত এবঙ কোনওভাবে তার সুস্তিতি নষ্ট করে দেওয়া যেত, তাহলেই ইউরোপের পক্ষে তা সুবিধাজনক হত। কারণ, তারা লক্ষ করেছে, নাইজিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকের মতো অশান্ত ও অনিরাপদ দেশগুলি থেকে ইউরোপের বড় বড় তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানিগুলোর মুনাফা লুটতে কোরওরকম অসুবিধা হচ্ছে না। অর্থাৎ, আজকের যুগে বৃহৎ তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোর পুঁজি বিনিয়োগ করার জন্য দেশের সুস্থিতি কিংবা রাষ্ট্রের সুরক্ষার প্রয়োজন নেই। মুনাফা লোটার জন্য অশান্তি-বিক্ষুব্ধ, অস্থির দেশই বরং সুবিধাজনক, শক্তিশালী স্বাধীন মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্র হলে চলবে না।

সুতরাং বোঝাই যাচ্চে, নিজের নিজের দেশের বৃহৎ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবসায়ীদের মুনাফার স্বার্থেই পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদীরা ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ার মতো আলজেরিয়াকেও ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে চায়। এই কথাটা পরিষ্কার বুঝলেই ধরতে অসুবিধা হয় না যে, সাম্রাজ্যবাদীরা লিবিয়ায় সালাফি সন্ত্রাসীদের মুধু অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তাই নয়, তাণ্ডব চালাবার জন্য এলাকাও বেছে দিচ্ছে। মাফিয়ারা যেমন করে সন্ত্রাস চালিয়ে এলাকার মানুষকে প্রথমে আতংকিত ও সন্ত্রস্ত করে তোলে এবং পরে নিজেরই আবার তেদেরই ত্রাণকর্তা সাজে, সাম্রাজ্যবাদীরাও ঠিক তেমন করেই নিজেদের ছক সাজিয়েছে। সেই ছকে পা দিয়ে আফ্রিকার কিছু দেশ সন্ত্রাসীদের হাত থেকে বাঁচতে এই পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদীদের কাছেই সাহায্য চাইতে বাধ্য হচ্ছে, যে সাম্রাজ্যবাদীরাই নিজেরাই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির মদতদাতা। সেই অজুহাতেই ফ্রান্স মালি দখল করেছে, নাইজারে আমেরিকা ড্রোন বিমানঘাঁটি স্থাপন করেছে আর ব্রিটেন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ তারা কতখানি দায়বদ্ধ, তাই নিয়ে নতুন করে ঢাক পেটাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদীদের শকুনের চোখের একাগ্র লক্ষ এখন আফিকা মহাদেশ।

[গণদাবী, ৬৭ বর্ষ ১০ সংখ্যা ১৭ – ২৩ অক্টোবর, ২০১৪]

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments