Sunday, April 28, 2024
Homeসংবাদ ও প্রেস বিজ্ঞপ্তিপার্টি সংবাদসুন্দরবনে তেল দুষণের উপর ড.আব্দুল্লাহ হারুণের গবেষণার প্রাথমিক রিপোর্ট

সুন্দরবনে তেল দুষণের উপর ড.আব্দুল্লাহ হারুণের গবেষণার প্রাথমিক রিপোর্ট

Sundarban-today2গত ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটার ফার্নেস তেল নি:সরণের পর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল গত ১১ ডিসেম্বর থেকে সুন্দরবনের বাস্ততন্ত্রের উপর তেল নি:সরণের প্রভাব নিয়ে বছর ব্যাপি এক গবেষণা শুরু করেন।গত ২৬ ডিসেম্বর গবেষণাটির প্রাথমিক খসড়া ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এই কিস্তিতে গত ১১ ডিসেম্বর থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি ৪৮ ঘন্টা পর পর পূর্ব সুন্দরবনে তেল নি:সরণ হয়েছে এরকম মোট ১৫ টি ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে নেয়া মাটি, পানি ও বিভিন্ন জৈব উপাদানের উপর তেল নি:সরণের প্রভাব নিরুপন করা হয়েছে। পার্থক্য বোঝার জন্য পশ্চিম সুন্দরবনে তেল নি:সরণ হয়নি এমন তিনটি স্থান- ঘড়িলাল, জোরসিং ও কলাগাছিয়া থেকে সংগৃহীত উপাদন থেকে প্রাপ্ত ফলাফল এবং তেল নি:সরণ ঘটার আগের তথ্য উপাত্তের সাথে বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের তুলনা করা হয়েছে।

মূল গবেষণা রিপোর্টটি পাওয়া যাবে এখানে

এখানে সুন্দরবনের পানি ও মাটির ভৌত-রাসায়নিক গুনাগুন ও জৈব বৈচিত্রের উপর তেল দূষণের প্রভাব সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো:

১) তেল দূষিত অঞ্চলে পানিতে ভাসমান কঠিন উপাদানের পরিমাণ(TSS- Total Suspened Solids)প্রতি লিটার পানিতে ৩১৭ থেকে ১৬৮১ মিলিগ্রাম যা দূষণ বিহীন অঞ্চলে মাত্র ৮.৯ মিগ্রা/লিটার থেকে ১৫.৮ মিগ্রা/লিটার। অর্থাৎ তেল-দূষিত অঞ্চলের পানিতে দূষণ উপাদানের পরিমাণ বেশি, ফলে পানি বেশি ঘোলা হবে, সূর্য্যের আলোও পানির কম গভীরে প্রবেশ করতে পারবে। পরীক্ষায় তেল দূষিত অঞ্চলে পানির স্বচ্ছতা(Transparency) অর্থাৎ সূর্য্যের আলোর প্রবেশ যোগ্যতা পাওয়া গেছে ৯-১৭ সেন্টিমিটার অথচ দূষণ বিহীন অঞ্চলে তা আরো বেশি- ১৯ থেকে ৩৩ সেন্টিমিটার।

sundarbon8২) দূষিত অঞ্চলের পানিতে প্রথম ১৫ দিনে ভাসমান তেলের পরিমাণ গড়ে প্রতি লিটারে ২৯৫ থেকে ১৬৫০ মিলিগ্রাম পাওয়া গেছে আর দূষণবিহীন অঞ্চলে তেলের পরিমাণ ৬.৬৮ থেকে ‌১১.৩৮ মি:গ্রা/লিটার পাওয়া গেছে। সাধারণত  জলজ পরিবেশে প্রতি লিটারে ১০ মিলিগ্রাম পযন্ত তেলের উপস্থিতি আন্তজাতিক মানদণ্ডে সহনীয় হিসেবে ধরা হয়, প্রতি লিটারে ১০ মিলিগ্রামের বেশি পরিমাণ তেলের উপস্থিতি জলজ পরিবেশ জন্য মারাত্নক বলে বিবেচিত।

অন্যদিকে দূষিত অঞ্চলে ২ ইঞ্চি পর্যন্ত গভীর মাটির স্তর থেকে সংগৃহীত প্রতি কেজি মাটিতে তেল পাওয়া গেছে ৩৭০ থেকে ১৬৯০ মি:গ্রা অথচ দূষণ বিহীন অঞ্চলের মাটিতে তেলের পরিমাণ মাত্র ৪ থেকে ৮ মি:গ্রা:/কেজি।

৩) পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের(DO) পরিমাণ দূষণ অঞ্চলে প্রতি লিটারে ৪.১ থেকে ৬.১ মি:গ্রা: যা দূষণ বিহীন অঞ্চলে ৬.৩ থেকে ৮। অন্যদিকে তেল দূষণ অঞ্চলে অক্সিজেন ও শর্করাজাতীয় খাদ্য উৎপাদনশীলতা(Productivity) প্রতি লিটারে ১.৭ মি:গ্রা: থেকে ৩.১ এবং দূষণ বিহীন অঞ্চলে প্রতি লিটারে ১২.৫ থেকে ১৬.৯ মি:গ্রা:।

৪) তেল দূষিত অঞ্চলে জলজ বাস্তুসংস্থানের গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক ফাইটোপ্ল্যাংকটন বা উদ্ভিদকণার পরিমাণ প্রতি লিটারে ২৪ থেকে ৬৭ টি পাওয়া গেছে যা দূষণ বিহীন অঞ্চলে আরো বেশি- প্রতি লিটারে ১৭১ থেকে ৩৪৯ টি। আবার প্রাপ্ত ফাইটোপ্ল্যাংকটনের প্রজাতি বৈচিত্রও দূষণমুক্ত অঞ্চলের তুলনায় অনেক কম- দূষণমুক্ত অঞ্চলে যেখানে ৪৭টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ফাইটোপ্ল্যাংকটন পাওয়া যায়, তেল দূষণের শিকার এলাকায় সেখানে মাত্র ১৮টি প্রজাতির ফাইটোপ্ল্যাংকটনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

৫) তেল দূষিত অঞ্চলে  জুয়োপ্ল্যাংকটন বা প্রাণী কণার পরিমাণ প্রতি লিটারে পাওয়া গেছে ৬ থেকে ১০ টি, যা দূষণ বিহীন অঞ্চলে আরো বেশি- প্রতি লিটারে ৪৫ থেকে ৭১ টি। ফাইটোপ্ল্যাংকটনের মতো জুয়োপ্ল্যাংকটনের প্রজাতি বৈচিত্রও ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দূষণমুক্ত অঞ্চলে যেখানে ৮টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির জুয়োপ্ল্যাংকটন পাওয়া যায়, তেল দূষণের শিকার এলাকায় সেখানে মাত্র ২টি প্রজাতির জুয়োপ্ল্যাংকটনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

images-3৬) তেল দুষিত অঞ্চলে বেনথোস (পানির তলদেশে কাদার উপরিভাগে বা কাদার মধ্যে বসবাসকারী জীব যেমন: ছোট কাকড়া-শামুক-কেচো জাতীয় প্রাণী ইত্যাদি)প্রজাতির সংখ্যা মাত্র ৭টি পাওয়া গেছে যেখানে দূষণমুক্ত অঞ্চলে ৪৭টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতীর সন্ধান পাওয়া যায়।

৭) সুন্দরী, গরান, কেওড়া, গোলপাতা ইত্যাদি বহু শ্বাসমূলীয় গাছের শ্বামূল তেলে আবৃত হয়ে গেছে ফলে এসব গাছের শারীর বৃত্তীয় কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। জোয়ার ভাটা প্লাবিত অঞ্চলে(ইন্টার টাইডাল জোন) এসব গাছের চারা নষ্ট হতে দেখা গেছে। সুন্দরী গাছের বীজ তেলে আবৃত হযে নষ্ট হচ্ছে। লাল শৈবাল(Catenella sp)ও বাদামী শৈবাল(Colpomenia sp)মরে গেছে।

৮)পারশে, খুরশুলা, বাগদা ও হরিণা চিংড়ীর প্রজনন মৌসুম হওয়া স্বত্ত্বেও  পানিতে এসবের ডিম দেখা যায় নি যদিও দুষণ বিহীন অঞ্চলে প্রতি লিটারে ১৫০০ থেকে ২০০০ টি করে ডিম/পোণা পাওয়া গেছে। শ্যালা নদী ও আশপাশের আক্রান্ত অঞ্চলে ৩১ থেকে ৪৩ ধরনের মাছ পাওয়া যেতো। তেল নি:সরনের পর এই অঞ্চলের উপর গবেষণায় পাওয়া গেছে ১০ থেকে ১৪ ধরনের মাছ।

৯) তেল দূষিত অঞ্চলে প্রতি বর্গমিটারে কাকড়া, শামুক ও মাডস্কিপারের সংখ্যা ছিল শুন্য যেখানে দূষণ বিহীন অঞ্চলে এগুলোর সংখ্যা ২ থেকে ৪টি(কাকড়া, মাডস্কিপার) এবং ৮-১৪টি(শামুক)।

দূষণের শিকার অংশে ব্যাঙ, সাপ, মাস্কড ফিনফুট, সাধারণ পাখি, বনমোরগ, পরিযায়ী পাখি, উদবিড়াল, ভোদর, ডলফিন, কুমির, হরিণ, বণ্যশুকুর ইত্যাদি তেমন চোখে পড়েনি যদিও দূষণ বিহীন অংশে বিভিন্ন সংখ্যায় এসব প্রাণীর উপস্থিতি দেখা গেছে।নদী ও খালের তীরে জোয়ার ভাটা প্লাবিত অঞ্চলের মাটিতে তেল থাকায় আগামী এপ্রিল-মে মওসুমে এখানে কুমিরের ডিম ফোটানো সম্ভব হবে না।

১০) গবেষণাকালীন সময়ে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে পাওয়া পানিতে ও মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত তেলের উপস্থিতি, পানির অস্বচ্ছতা, কম উৎপাদনশীলতা, ফাইটোপ্লাংকটন এবং জুয়োপ্লাংটন’এর আশঙ্কাজনকভাবে কম উপস্থিতি ও বৈচিত্র হীনতা ইত্যাদি লক্ষণ নির্দেশ করছে যে সুন্দরবনের ঐ অঞ্চলটি মারাত্মক তেল দূষণের শিকার হয়েছে।সর্বমোট ১২০০ বর্গ কিমি গবেষণা এলাকার মধ্যে ৫০০ বর্গ কিমি এর বেশি এলাকা তেল দূষণের শিকার হয়েছে বলে দেখা গেছে। ০৯ ডিসেম্বরের এই দূষণের ফলে সুন্দরী গাছের পুর্নজন্ম বা রিজেনারেশান, মাডস্কিপার-কাকড়া-শামুক-গুইশাপ, জোয়ার ভাটি প্লাবিত অঞ্চলের পাখি(বিপন্ন প্রজাতির মাস্ক ফিন ফুট), বক-মাছরাঙা ইত্যাদি পাখি, উদবিড়াল, ভোদড়, ডলফিন ও কুমিড়ের বসতি, সংখ্যা ও প্রজাতি বৈচিত্র নানা মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

সূত্রঃ Kallol Mustafa http://ncbd.org/?p=1338

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments