স্বাধীনতা মানে কি? —পণ্ডিতমশায় জিজ্ঞাসা করলেন সুবলকে।
সুবল উত্তর দিলে — নিজের অধীনতা। নিজের অধীনতা বলতে কি বোঝ তুমি?
ঈষৎ মাথা চুলকে সুবল বলল, — মানে, নিজে আমি যা খুশি করব তারই অধিকার।
তোমার নিজের যদি খুশি হয় চুরি করব, ডাকাতি করব, মাস্টার ঠ্যাঙাব, পড়াশুনা করব না, সকলের অবাধ্য হব, তাহলে এইসব করবার অধিকার তোমাকে দেওয়ার নামই স্বাধীনতা?
না স্যার!
তাহলে?
সুবল চুপ করে রইল। পণ্ডিতমশায় একে একে সব ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন। কেউ সদুত্তর দিতে পারলে না। সুবলই ক্লাসের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ছেলে, সেই যখন পারলে না তখন আর কে পারবে?
পণ্ডিতমশায় বললেন, “এখন আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, এখন আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে কথাটার মানে কি! সুবল, তুমি ঠিকই বলেছ, কথায় কথায় মানে করলে স্বাধীনতা মানে নিজের অধীনতা বোঝায়। কিন্তু ‘নিজের’ কথাটার বিশেষ অর্থ আছে একটা। নিজের বলতে কি বোঝায়? তোমাকে যদি দুটো আম দেয়া হয়, একটা পচা আরেকটা ভালো, আর যদি বলা হয় ওর মধ্যে একটা তুমি নিজের করে নাও, তাহলে কোনটা তুমি নিজের করে নেবে? ভালোটাই নেবে নিশ্চয়ই! পশুরাও চায় যেটা ভালো সেটা নিজের হোক। মানুষ পশুর চেয়ে অনেক বড়, তাই সে শুধু নিজের ভালো চায় না, নিজেদের ভালো চায়। সকলের ভালো হোক এইটাই সভ্য মানুষের কাম্য এবং সকলের ভালো করবার অধিকারকেই স্বাধীনতা বলে।
যারা পরাধীন জাতি, তারা এ অধিকার থেকে বঞ্চিত। তারা সাহস করে একটা ভালো কথা পর্যন্ত বলতে পারে না, যদি সেটা শাসক জাতির স্বার্থবিরোধী হয়। তাই স্বাধীনতা যাদের থাকে না, ভালো হবার অধিকারই তাদের থাকে না; কারণ সকলের ভালো হোক কোনও বিদেশী শাসক-সম্প্রদায়ের এই অভিপ্রায় কখনো হতে পারে না। দেশের ভালো হোক, দশের ভালো হোক, সকলের ভালো হোক, এই-ই হলো স্বাধীনতার লক্ষ্য। যখন তোমরা আরেকটু বড় হবে তখন বুঝতে পারবে আমাদের সকলের মধ্যেই ভগবান আছে, স্ব নামে ভগবান, তাই স্বাধীনতা মানে ভগবানের অধীনতা, যা মঙ্গলময় তার-ই অধীনতা।”
পণ্ডিত মশায়ের কথা সবাই মন দিয়ে শুনল। কিন্তু তার কথার সমস্তটা বুঝতে পারল না সবাই। স্কুলের ছুটি হয়ে গেল। সুবল পণ্ডিত মশায়ের কথাগুলোই ভাবতে ভাবতে বাড়ি যাচ্ছিল। পণ্ডিত মশায় যা বললেন, তা যেন বড্ড বেশি ঘোরালো গোছের। ভগবান-টগবান এনে এমন একটা ব্যাপার করলেন যে ঠিক বোঝা গেল না সবটা। সে স্বাধীনতার সোজা মানে খুঁজছিল মনে মনে। একটু পরেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে। যা খুঁজছিল পেয়ে গেল।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা সুবলের মা বেড়াতে যাচ্ছিলেন একজনের বাড়িতে। দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন তাঁরা, তাঁদের বাড়িতে কার যেন অসুখ করেছে! বেরোবার আগে মা সুবলকে বললে, “ওরে ভাঁড়ার ঘরের তাকে দুটো আম আছে। যদি ক্ষিধে পায় তো তুই একটা নিস আর মনুকে একটা দিস।”
মনুও তাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয়— মা-মরা ছেলে— তাদেরই আশ্রিত। মা চলে গেলে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষিধে পেয়ে গেল সুবলের। পড়ছিল, তড়াক করে উঠে ভাঁড়ার ঘরে চলে গেল সে। গিয়ে দেখলে দুটো আম রয়েছে বটে, কিন্তু একটা ভালো আরেকটা একটু পচা। পণ্ডিতমশায়ের কথা মনে পড়ল। তিনি এই আমেরই উদাহরণ দিয়েছিলেন। যা ভালো সেটাকেই নিজের করে নেয়া উচিত এবং সেইটে নেবার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে। ভ্রু কুঞ্চিত করে দাঁড়িয়ে রইল সে খানিকক্ষণ। পচা আমটা মনুকে দিতে কিছুতেই মন সরছিল না তার। ওকে দিলে ও নেবে; কারণ, ও আশ্রিত। কিন্তু সেটা দেওয়া কি উচিত? পচা আমটাই নিজে নিলে সে, ভালোটা মনুকে দিলে।
একটা অদ্ভুত আনন্দে সমস্ত মনটা ভরে উঠল সুবলের। পণ্ডিতমশায়ের বাড়ি সুবলদের বাড়ির কাছেই। এক ছুটে সে চলে গেল পণ্ডিতমশায়ের বাড়ি। পণ্ডিতমশায় শোওয়ার আয়োজন করছিলেন।
পণ্ডিতমশায়, স্বাধীনতার আরেকটা মানে আমি খুঁজে পেয়েছি। যা করলে সত্যিকার আনন্দ পাওয়া যায় তাই করার অধিকারকে স্বাধীনতা বলে।
পণ্ডিতমশায় হেসে বললেন, — ঠিক বলেছ।
সূত্র: বনফুল রচনাবলী, সাহিত্য মালা, ঢাকা