Friday, November 22, 2024
Homeফিচারহায়দার ভাইকে কোনো অপসংস্কৃতি, কোনো অপচিন্তা ছুঁতে পারেনি

হায়দার ভাইকে কোনো অপসংস্কৃতি, কোনো অপচিন্তা ছুঁতে পারেনি

[এনায়েত উল্লাহ্ কাশেম। প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, জাসদ ঢাকা মহানগর (১৯৭৫-৭৭) এবং প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। বাসদ (মার্কসবাদী)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, এদেশের অনন্যসাধারণ কমিউনিস্ট বিপ্লবী কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী গত ৬ জুলাই ২০২১ তারিখে প্রয়াণের পর ১৪ জুলাই ২০২১ তারিখে দলীয় উদ্যোগে আয়োজিত অনলাইন স্মরণসভায় এনায়েত উল্লাহ্ কাশেম বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যটি পরবর্তীতে লিখিতরূপে ‘কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী স্মারকগ্রন্থ‘-এ সংকলিত হয়। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর ১ম মৃত্যুবার্ষিকীতে বক্তব্যটি এখানে তুলে ধরা হলো।]

 

 

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ৬ জুলাই ২০২১ ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।

 

বাংলাদেশে সমাজ বিপ্লব তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে জাসদ রাজনীতির যে যাত্রা শুরু হয়েছিল একটা পর্যায়ে হায়দার ভাই তার সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। সেই সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। হায়দার ভাইয়ের জীবনাচরণে মার্ক্সবাদী দর্শনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক নেতার প্রতিফলন দেখেছি। মৃত্যুর পর চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণার জন্য দেহ দান তাঁর দৃঢ় আদর্শিক অবস্থানের আরেক দৃষ্টান্ত। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে লড়াইরত একজন নেতার জীবনাবসান ঘটল।

 

কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর রাজনৈতিক জীবন আলোচনা করতে গেলে একটি বিষয় বিশেষ লক্ষ্যণীয়ভাবে আমাদের সামনে এসে যায় যে, মার্ক্সবাদী রাজনীতি অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে তিনি যে অবস্থানে এসে উপনীত হয়েছেন, তা মূলত ভারতের রাজনৈতিক দল SUCI(C)-এর সান্নিধ্যে থেকে কৈশোর জীবনে শুরু করেছিলেন।

 

আমি কথাগুলো বলছি এজন্য যে, পূর্ববঙ্গের চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ডের অধিবাসী মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ১৯৪৬ সালে কিশোর বয়সে কলকাতায় চলে যায়। বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে থেকে স্কুলে অধ্যয়নকালে ভারতের অন্যতম বাম রাজনৈতিক দল SUCI(C)-এর নেতা শিবদাস ঘোষের সান্নিধ্যে এসে মার্ক্সবাদী রাজনীতি চর্চায় হাতেখড়ি হয়। স্মরণসভায় প্রদত্ত বক্তব্যের শুরুতে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের প্রাক্তন সভাপতি মোস্তফা ফারুকও বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। এমনকি SUCI(C)-এর বর্তমান সাধারণ সম্পাদক প্রভাস ঘোষ তাঁর শোকবার্তায় বলেছেন যে, একদম কিশোর বয়সে হায়দার ভাই দলের সান্নিধ্যে আসেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়াও সম্পন্ন করেননি। তবু্ও এই রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে তিনি দীর্ঘ সময় শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও সংগঠন গড়ে তোলা-সহ দলের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন।

 

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান হলো। হায়দার ভাই থেকে গেলেন কলকাতায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশের তরুণদের সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে কীভাবে সঠিক বিপ্লবী ধারায় উন্নীত করা যায়–এই ভাবনা থেকে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। স্বাধীনতার পর যখন হায়দার ভাই আসলেন, এদেশে সম্ভাবনাময় বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তি ছিল জাসদ। আমাদের দেশে অন্যান্য যে বাম দলগুলি আছে তাদের প্রচেষ্টা আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। ১৯৭২ সালে শতভাগ মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সংগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিষ্ঠালগ্নে তাদের লক্ষ্য ও অঙ্গীকার ঘোষণায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে, তারা সমাজ বিপ্লবের মাধ্যমে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। ষাটের দশকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে প্রগতিশীল ছাত্রদের সংগঠিত করে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে একটি নিউক্লিয়াস গঠিত হয়। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, ১৯৭১-এর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে স্বাধীনতার ইশ্তেহার ঘোষণা, জাতীয় সংগীত নির্ধারণসহ অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিউক্লিয়াসের উদ্যোগে ও পরামর্শে সংগঠিত হয়। শুধু তাই নয়, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নিউক্লিয়াসের সঙ্গে সম্পৃক্ত তরুণদের নিয়ে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধারা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠিত শক্তি। ছাত্রলীগের উল্লিখিত প্রগতিশীল অংশের নেতা ও সংগঠকদের নিয়ে জাসদ গঠিত হয়। তাই এই শক্তিকে আমি একটি সম্ভাবনাময় শক্তি হিসাবে আখ্যায়িত করেছি।

 

হায়দার ভাই জাসদ রাজনীতির এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে এসে যুক্ত হলেন। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তিনি জাসদ রাজনীতির মূল কেন্দ্রীয় কাঠামোয় বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতেন। কীভাবে তাঁর সম্পৃক্ততা ঘটেছে এত ডিটেইলস্ এখানে বলার দরকার নেই। অনেকে জানেন, জামান ভাই (খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া) এখানে আছেন, তিনি আরও ভালো বলতে পারবেন, হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। ওঁনারা একসাথে একইভাবে কাজ করেছেন, ওঁনারা ভালো বলতে পারবেন। প্রশ্নটি হচ্ছে যে, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটি বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার জন্য তাঁর যে প্রচেষ্টা এবং সেই প্রচেষ্টা ১৯৮০ সালে এসে একদল প্রফেশনাল বিপ্লবীকে জড়ো করে এককভাবে তাঁর প্রচেষ্টায় একটি আলাদা পার্টি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) দাঁড় করালেন, একটি আলাদা বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তি দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকে আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।

 

আমরা সকলেই জানি, ১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানে জাসদের সংশ্লিষ্টতা ও তৎপরবর্তীকালের বিভিন্ন ঘটনায় জাসদ এক বিপর্যস্ত অবস্থায় নিপতিত হয়। ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে জাসদ রাজনীতির পার্টি প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীয় কাঠামো সিওসি-এর অবলুপ্তি ও সিরাজুল আলম খানের গ্রেপ্তারের পর ১৯৭৭-এর অক্টোবরের শেষদিকে জাসদ রাজনীতি ডান সুবিধাবাদী বিচ্যুতির ধারায় পথ চলা শুরু করে। নিরন্তর মতাদর্শগত সংগ্রামের মাধ্যমে এই বিপর্যয় মোকাবিলা এবং জাসদ রাজনীতিকে বিচ্যুতির পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে একটি মতাদর্শিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে গিয়ে ১৯৮০ সালে খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, আ ফ ম মাহবুবুল হক-গং জাসদ থেকে বেরিয়ে এলে একটি বিপ্লবী পার্টি গঠনের পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। গড়ে তোলা হয় নতুন দল বাসদ। হায়দার ভাই এর কর্ণধার ছিলেন। এই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা হিসাবে প্রকাশ্য রাজনৈতিক ভূমিকায় হায়দার ভাইকে আমরা দেখতে পাই। সেই থেকে আজকের এই পর্যায়ে অর্থাৎ মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-এর সাধারণ সম্পাদক।

 

বর্তমানে বাসদের যতগুলি ফ্র্যাকশন থাকুক না কেন, আমরা একথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি বাসদ (মার্কসবাদী)’সহ বাসদ নামের অন্যান্য দলগুলো একটি বিপ্লবী পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাহির থেকে দেখে আমাদের এমনটাই মনে হয়। আমরা জানি যে, বাসদ নামের সব ফ্র্যাকশনগুলিকে যদি একত্র করা হয়, তাহলেও আমরা দেখব এদেশে বাসদ বা বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল নামে এবং সর্বশেষ বাসদ (মার্কসবাদী) অর্থাৎ সবগুলোকে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এটি প্রগতিশীল বাম ঘরানার এক উল্লেখযোগ্য শক্তি। এই শক্তির নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রগতিশীল আন্দোলন গড়ে উঠুক, এদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হোক–এই যে আকাঙ্ক্ষা, এই যে দৃঢ়তা, হায়দার ভাই একদম শূন্য হাতে এই কাজটি করেছেন। এইভাবে একজন মানুষের এই যোগ্যতা কীভাবে অর্জিত হয়, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। নিশ্চয়ই এমন কোনো প্রক্রিয়ার মধ্যে তিনি ছিলেন, যেটা এভাবে তাঁকে গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে।

 

হায়দার ভাই একজন মহান ব্যক্তি। এদেশের বিপ্লবী আন্দোলন সবসময় তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে। হায়দার ভাই তাঁর রাজনীতির শেষ অবস্থানে এসেও নিজের দেহ চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণার জন্য দান করে গেছেন। যারা তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন দেখেছেন, যারা তাঁর দল করেছেন তারা তো দেখেছেনই, যারা তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা প্রত্যক্ষভাবে দেখেছেন তাঁকে। আমাদের দেশের অনেকের সম্পর্কে কিছু নেগেটিভ কথা বলা যায়; ধর্মীয় দিক বলি, সাংস্কৃতিক দিক বলি, ব্যক্তি জীবনকে কেন্দ্র করে অন্যান্য দিকের কথাই বলি না কেন, হায়দার ভাইকে এই ধরনের কোনো অপসংস্কৃতি, কোনো অপচিন্তা ছুঁতে পারেনি। আমি অন্তত দেখিনি।

 

তাঁর সঙ্গে আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। আমরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আমি মনে করি আজকে তাঁর দল যে অঙ্গীকারের কথা বলে সূচনা বক্তব্যটি উপস্থাপন করেছেন, তার যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটলে হায়দার ভাইয়ের স্মৃতির প্রতি সত্যিকার অর্থে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। মাতৃভূমিতে ফিরে এসে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে হায়দার ভাইয়ের প্রচেষ্টা, তাঁর এই অবস্থান, তাঁর চিন্তা, তাঁর ভাবনা, তাঁর জীবন চলার পথকে যদি যথাযথভাবে অনুসরণ করা যায়, তাহলেই একমাত্র তাঁর প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।

 

হায়দার ভাইয়ের স্মৃতি তর্পণের জন্য এদেশের বাম ঘরানার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিত্বরা স্মরণ সভায় উপস্থিত হয়েছেন। আমি সবার বক্তব্য শুনতে আগ্রহী, সবার বক্তব্য শোনার জন্য এসেছি। আমি সময় নষ্ট করব না। তাদের পার্টির এবং বাম ঘরানার যারা আছেন তাদেরকে শুধু এটুকু বলব যে, এদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বাম ঘরানা ছাড়া আর অন্য রাজনীতির উপর আস্থা নেই। বরং বলা যায় অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। তাই মানুষ একদম মুখে কুলুপ এটে বসে আছে। মানুষ কোনো কিছুতেই প্রতিবাদমুখর নয়। মানুষ আশা করে–সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা সম্পন্ন একটি ঐক্যবদ্ধ বাম ঘরানার উন্মেষ ঘটলে এবং এই প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি যদি মানুষের সামনে আসে, মানুষকে নেতৃত্ব দেয়, মানুষের সমস্যা বুঝে সমাধানের পথে এগিয়ে যায়, তারা যদি সংগ্রামের ডাক দেয়, তাহলে এই মানুষ হুড়হুড় করে রাস্তায় নেমে আসবে, তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। একদিন এদেশে বিপ্লবের যে আকাঙ্ক্ষা মানুষের সামনে উদিত হয়েছে, মেহনতি মানুষ সার্বিক মুক্তির যে স্বপ্ন দেখেছে, সে স্বপ্ন পূরণ হবে। এটা যদি করতে পারা যায়, তাহলেই হায়দার ভাইয়ের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। আমি সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে হায়দার ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি।

 

কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী লাল সালাম!

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments