Tuesday, April 23, 2024
HomeUncategorizedজলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি এবং সিলেটের বন্যা

জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি এবং সিলেটের বন্যা

সিলেট অঞ্চলে এবারের বন্যার তান্ডব অতীতের সমস্ত রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। মূলত জুন মাসের মাঝামাঝি সময়েই সিলেটের ৮০ শতাংশ অঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। শুধু সিলেট অঞ্চল নয়; ময়মনসিংহ, কুড়িগ্রামসহ দেশের প্রায় ১৪টি জেলার মানুষ এবারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে সিলেট অঞ্চল সবচেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

সরকারের তরফে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী জনগণকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে–বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার প্রস্তুত! কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রস্তুতির নামে আমরা দেখলাম বন্যার্ত মানুষদের প্রতি  উদাসীনতা এবং বহু ক্ষেত্রে নির্মমতা।

 

ডুবলো বাড়িঘর, ভাসলো মানুষ

শুরুতেই বন্যার পানিতে ঘর-বাড়ি ডুবে যায়। যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অসহায় মানুষ আশ্রয় নেয় টিনের চালে, গাছের ডালে। কেউ কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে, স্কুল বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে। মায়ের কোল থেকে সন্তান বানের পানিতে ভেসে গেছে। অনেকেরই আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়ার মতো বাস্তব অবস্থাই ছিল না। মানবিক বিপর্যয় চরম আকার ধারণ করে। এসময় প্রাথমিক কাজ ছিল উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করা। কিন্তু ছিল না যথেষ্ট জলযান, নৌকা কিংবা স্পিডবোট। সেনাবাহিনী উদ্ধার তৎপরতায় স্থানীয় মানুষকে যুক্ত করেনি। এটা জনবিচ্ছিন্নতাকেই নির্দেশ করে। আমাদের দেশে বন্যা পরিস্থিতি বিরলও নয়, অস্বাভাবিক নয়। তাহলে বিভিন্ন বাহিনীর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি এবং জলযানের অভাব কেন? সে প্রশ্ন রয়েই যায়।

 

আশ্রয় কেন্দ্রের সংখা খুব কম। বেশিরভাগেরই ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ছিলো মানুষে—পশুতে একাকার অবস্থা। খাদ্য নেই–সুপেয় পানি নেই। চারিদিকে শুধু হাহাকার। দূর থেকে কোনো নৌকা দেখলেই একটু খাবারের জন্য মানুষ হুড়োহুড়ি করেছে। ছোট-ছোট বাচ্চাদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়! সরকার মানুষের জীবনের সামান্যটুকু মূল্য দিলে আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে বিপর্যয়ের ধাক্কা অনেকটা কমাতে পারত।

 

জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি এবং সিলেটের বন্যা

এবারের বন্যা পুরোটাই প্রাকৃতিক নয়; অনেকটা মনুষ্যসৃষ্ট। একথা ঠিক, বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরায় এবার প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। ঢলের এই বিপুল পরিমাণ পানি ভাটি অঞ্চল অর্থাৎ সিলেট এবং এর পাশ্ববর্তী অঞ্চলের ছড়া, নদী, হাওর হয়ে সমুদ্রে পড়বে, তাই স্বাভাবিক। এখানেই সমস্যা। সিলেটের সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীর তলদেশ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ভরাট হয়ে গেছে নদীর উৎসমুখ; সেখানে ৩২ কিলোমিটারে জেগেছে ৩৫টি চর। নদীগুলো তাদের নাব্যতা হারিয়েছে অথচ খননের উদ্যোগ নেই।

 

সিলেটের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছিল ২৫-৩০টি প্রাকৃতিক খাল যা ছড়া নামে পরিচিত। এগুলো পানি নিষ্কাশনে ভূমিকা রাখত। বর্তমানে প্রায় সবগুলো ছড়া দখল হয়ে গেছে। একসময় এ এলাকায়  পুকুর-দীঘি মিলিয়ে প্রায় তিন শতাধিক জলাশয় ছিল। এখন টিকে আছে মাত্র ১০-১২টি। বাকীগুলো দখল করা হয়েছে। একথা বুঝতে কষ্ট হয় না; এই দখলদাররা বেশ প্রভাবশালী এবং ক্ষমতার আশেপাশে থাকা শ্রেণী।

 

হাওরগুলোও দখল আর ভরাট হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, গত ৩২ বছরে হাওর অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ৮৬ শতাংশ ভরাট হয়ে গেছে। এসব ভরাট এবং দখলের সাথে সরকারও জড়িত। সেখানে তৈরি করা হয়েছে স্থাপনা, সরকারি অফিস এবং ক্যান্টনমেন্ট। ফসল রক্ষার নামে হাওড়গুলোতে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ দেয়া হচ্ছে। এই বাঁধগুলো ‘ফলস সেন্স অব সিকিউরিটি’ তৈরি করলেও তা ফসল রক্ষায় কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না। বরং বর্ষা মৌসুমে পানির স্বাভাবিক  প্রবাহকে বিঘ্নিত করে মারাত্মক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করছে। কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামে তৈরি করা হয়েছে ‘অল ওয়েদার সড়ক’। যা হাওড়ের বৈশিষ্ট্য এবং স্থানীয় ভূপ্রকৃতিকে বিবেচনা করে তৈরি হয়নি। রাস্তা নির্মাণের আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষাও চালানো হয়নি।

 

বৃষ্টি বা বন্যার পানি সাথে সাথেই নেমে যায় না। কিছু সময় প্লাবনভূমি, হাওড় ও নদী অববাহিকায় অবস্থান করে। ভারতের মেঘালয় ও আসাম থেকে নেমে আসা ঢলের পানি সিলেট অঞ্চলের নদী ও হাওড় হয়ে কিশোরগঞ্জের মেঘনা নদীতে মেশে। এ সড়ক পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে রোধ করে এবার মারাত্মক বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং উষ্ণায়ন গোটা পৃথিবীকেই ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের কোন স্থান পুড়ে যাচ্ছে খরায়, জ্বলে যাচ্ছে দাবানলে। আবার কোন অঞ্চল ভাসছে অতিবৃষ্টি ও বন্যায়।

 

পুঁজিবাদী মুনাফাকেন্দ্রিক ব্যবস্থা উদগ্র লালসায় শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতিকেও শোষণ করছে। মানুষ আর প্রকৃতিকে  সহাবস্থানে নয়, দাঁড় করাচ্ছে মুখোমুখি। পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে চলছে অধিক কার্বন নিঃসরণ, বনভূমি ধ্বংস, পাহাড় দখল আর হাজারও প্রকৃতি বিধ্বংসী কাণ্ড। পরিবেশগত সংকট প্রত্যক্ষ করে ২৩ বছর বয়সে ১৮৪৩ সালে মার্কস লিখেছিলেন–‘পৃথিবীকে ফেরি করার বস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে; যে পৃথিবী আমাদের জন্য রয়েছে কেবল একটাই, আমাদের বেঁচে থাকার যে শর্ত, তাকে ব্যবসার পণ্য করে তুললে আমরা নিজেদের ধ্বংস করার শেষ ধাপে পৌঁছে যাব।’

 

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতও বেশি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ বন্যা, পাকিস্তান এবং সাউথ আফ্রিকার অতিবৃষ্টি এর বড় উদাহরণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলেট অঞ্চলের এবারের বন্যার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অতিবৃষ্টি। বাংলাদেশের উজানে ভারতের আসামে এবং সিলেট অঞ্চলে ব্যাপকভাবে গাছ এবং পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড়গুলোর পানি শোষণ করতে পারত। পাহাড় কাটার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। আবার ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানির সাথে প্রচুর মাটি আর বালি আসছে। এটা ঘটছে মেঘালয়ে বৃক্ষনিধনের ফলে ভূমিক্ষয় থেকে। এ প্রক্রিয়ায় সিলেট অঞ্চলের নদীগুলোতে পলি জমছে এবং নাব্যতা হারাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অভিঘাতে সামনের বছরগুলোতে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অতিবৃষ্টি এবং বন্যার মাত্রা বাড়বে। কিন্তু সরকারের পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতির উদ্যোগ কোথায়?

 

বন্যার পানি নেই, দুর্ভোগ আছে

 বন্যার পানি নেমে গেছে। কিন্তু মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে গেছে। অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরতে পারছে না। বাড়ি-ঘর যা ছিল তা বন্যায় ভেসে গেছে। ঘরে খাবার নেই। কোনো কাজও হাতে নেই। অথচ জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বেড়েই চলেছে। সরকারের বিন্দুমাত্র ভ্রম্নক্ষেপ নেই এই মানুষগুলোকে বাঁচানোর। গৃহপালিত পশু মারা গেছে; ক্ষেতের ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে। বানভাসী এ সমস্ত মানুষের কাছে এখন সমস্যা আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘর তৈরি বা সংস্কারে এখন তাদের নাভিশ্বাস। এরই মধ্যে এনজিওগুলোর উপদ্রব বেড়েছে; তারা কিস্তির জন্য চাপ দিচ্ছে। এরকম একজন ভুক্তভোগীর ভাষ্য–‘খাইয়া বাঁচমু না, কিস্তির টাকা দিমু?”

 

ভাসছে মানুষ, সরকার ব্যস্ত আলোকসজ্জায়

গত ২২ জুন ডেইলি স্টার তাদের এক রিপোর্ট বলছে, সিলেট বিভাগে এখন পর্যন্ত বরাদ্দ হয়েছে ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ১ হাজার ৯৫২ টন চাল এবং ৩০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৪৪ লাখ মানুষের বিপরীতে বরাদ্দ জনপ্রতি ৬ টাকা ৫৫ পয়সা ও ৪৪০ গ্রাম চাল। দিনের পর দিন মানুষ অনাহারে কিংবা শুধু শুকনো খাবার খেয়ে বেঁচে থেকেছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে একেবারেই ত্রাণ পৌঁছেনি।

 

সরকারী বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণ নিক্ষেপ করে একজনকে নিহত, ১০-১২ জনকে আহত করল। প্রধানমন্ত্রী হেলিকপ্টার থেকে একবেলা বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে তার দায়িত্ব সারলেন। এবং পুরো সময় ব্যস্ত থাকলেন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে। স্থানীয় মন্ত্রী-এমপিরাও মানুষের পাশে দাঁড়াননি। যেটুকু সহযোগিতা তাও নামকাওয়াস্তে। আমরা দেখলাম, দুর্যোগে মানুষ দাঁড়িয়েছে, মানুষের পাশে; সরকার-রাষ্ট্র নয়।

 

দু’সপ্তাহ আগেই বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সরকারী উদ্যোগে তা ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রস্তুতির অভাব ছিল। সরকারের ‘বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র’সহ ১৭টি মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর বন্যা ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত। এদের ভূমিকা ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’-এর।

 

বন্যা কবলিত মানুষের অসহায়ত্ব ও সরকারের নির্বিকারত্ব দেখে এ প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক দেশে কোনো দুর্যোগ ঘটলেই সাধারণ জনগণের কাছে হাত পাততে হয় কেন? জনগণ ট্যাক্স দেয় না? ভ্যাট দেয় না? তাহলে জনগণের টাকা যায় কোথায়?

সাম্যবাদ-আগস্ট ২০২২

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments