[dropcap]“[/dropcap]বিজ্ঞানের যে শিক্ষায় মানুষ যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠে, তার আত্মসম্মান জাগ্রত হয়ে দাঁড়ায়, সে উপলব্ধি করে সেও মানুষ, অতএব স্বদেশের দায়িত্ব শুধু তারই, আর কারও নয় – পরাজিতের জন্য এমনি শিক্ষার ব্যবস্থা বিজেতা কি কখনও করতে পারে?” পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের উদ্দেশ্য করে কথাটা শরৎচন্দ্র বলেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তানি উপনিবেশিক সরকারও বাংলাদেশের জনগণের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে চায় নি। সেদিন এদেশের ছাত্রসমাজ সর্বজনীন শিক্ষার দাবি অর্থাৎ মনুষ্যত্ব অর্জনের দাবি উচ্চকিত করেছিল। স্বাধীনতা ছাড়া, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া গণতান্ত্রিক অধিকারের স্বীকৃতি মিলবে না, মনুষ্যত্বেরও বিকাশ সাধিত হবে না – এই সত্য বুঝতে পেরেই, পরাধীনতার যন্ত্রণাকে বুকে ধারণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেছিল লক্ষ যুবক-তরুণ। স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাপ থেকে জন্ম লাভ করেছিল মুক্ত বিকশিত আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতীয় জীবনের স্বপ্ন।
শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ মানুষের মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি মিলবে। এই ভিতের উপর গড়ে উঠবে মানবিক সমাজ। কিন্তু স্বাধীনতার পর গঠিত হওয়া কুদরত-ই-খুদার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে প্রকাশ পেল শিক্ষা সম্পর্কিত এ দেশের শাসকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি। অনেক বড় বড় কথা থাকলেও আড়াল হলো না শিক্ষা সংকোচনের নানা প্রস্তাবনা। অর্থাৎ দেশ স্বাধীন হল ঠিকই কিন্তু মানুষের স্বপ্ন পরাজিত হল, গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি পরাজিত হল। শুধু গণতান্ত্রিক অধিকারই নয়, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও এ সময় বারে বারে বিপন্ন হয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির বদলে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এরকমই এক প্রেক্ষাপটে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রচিত হয়েছিল স্বাধীনতা উত্তরকালে উত্তাল তারুণ্যের এক অগ্নিঝরা দিন। কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে সেদিন প্রাণ দিয়েছিল জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালী সাহা, মোজাম্মেল সহ আরও অনেক তাজা প্রাণ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই গৌরবময় দিনটি যেখানে হতে পারত গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সমুন্নত করা, বৈষম্যের শিক্ষানীতিকে রুখে দেবার প্রেরণা কিন্তু তা না হয়ে ভোগবাদী সংস্কৃতির কদর্যতায় এই দিনটিকে ঢেকে দেয়া হচ্ছে। তথাকথিত ‘ভালোবাসা দিবসের’ জোয়ারে মধ্য ফেব্রুয়ারির ভালোবাসার মানুষগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
কি ছিল মজিদ খানের শিক্ষানীতিতে?
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতারোহণ করে। স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় শাসকের বর্বর চেহারা প্রকট হয়ে উঠে। সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত সকল গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে। সবচেয়ে বেশি আক্রমণ নেমে আসে শিক্ষার উপর। কারণ শাসকশ্রেণী জানে শিক্ষা মানুষের স্বাধীন চিন্তাশক্তির উদ্বোধন ঘটায়, বিচার-বিশ্লেষণের সক্ষমতা অর্জন করে, ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ বুঝতে শেখায় সর্বোপরি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মানসিকতা জাগিয়ে তুলে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে বিকাশের রাস্তা প্রশস্ত করে। তাই যুগে যুগে শাসকশ্রেণী তাদের বর্বরতাকে আড়াল করতে শিক্ষার অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করতে চেয়েছে। সামরিক শাসক এরশাদও সেই পথ ধরে প্রণয়ন করেছে মজিদ খান শিক্ষানীতি।
ড: মজিদ খানের শিক্ষানীতিতে সাধারণ ও উচ্চশিক্ষা সংকোচনের ও ব্যয় বহুল করার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছিল। সংক্ষেপে-
- শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে কর্মমুখী-উৎপাদনমুখী শিক্ষার উপর বিশেষভাবে গুরুত্বের কথা উল্লেখ করা হলো।
- প্রথম শ্রেণী থেকে আরবি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলো। মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারের প্রস্তাবনা হাজির করা হলো। এর উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটানো।
- শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ত্বরান্বিত করতে সুপারিশ করা হলো “….. অর্থাৎ শিক্ষার বেতনের ৫০ ভাগ শিক্ষার্থীদের থেকে আদায় করা হবে।” রেজাল্ট খারাপ হলেও ৫০ শতাংশ বেতন দিলে উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হলো।
- বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে টুঁটি চেপে ধরতে বলা হল, “বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে রাষ্ট্রের মতই স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়েছে। ফলে গবেষণা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনার কেন্দ্র হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত ভূমিকা থেকে সরে গেছে।” অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন রাষ্ট্রের অধীনেই চলতে হবে।
স্বাভাবিকভাবেই গণবিরোধী এ শিক্ষানীতি এদেশের সংগ্রামী ছাত্র সমাজ মেনে নেয় নি। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে রাজনৈতিক আন্দোলন তথা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে।
শিক্ষানীতিবিরোধী উত্তাল ছাত্র আন্দোলন
১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ, এরশাদ সরকার গঠনের দুদিন পরই ছাত্ররা সাভারে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করতে গিয়ে সামরিক স্বৈরতন্ত্র বিরোধী স্লোগান দেয়। এর প্রেক্ষিতে সেনানিবাস থেকে সৈন্যবাহিনী ছুটে এসে ছাত্রদের উপর নির্মম নির্যাতন চালায়। ৮ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ নির্বিচার লাঠিচার্জ করে। এর প্রতিবাদে ১৪ টি ছাত্র সংগঠন মিলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে আন্দোলনের দৃঢ় শপথ নেয়। এই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারেই ১৪ ফেব্র“য়ারি কুখ্যাত মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে কলাভবনে বিশাল ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে সচিবালয় অভিমুখে মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি কার্জন হল ও শিক্ষাভবনের সামনে পৌঁছানো মাত্রই পুলিশ গুলি ছোঁড়ে। গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে জাফর-জয়নাল-দিপালী সাহা। সর্বমোট ১১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। যদিও সরকারি হিসেবে বলা হয় মৃতের সংখ্যা মাত্র ১ জন। গ্রেফতার-নির্যাতন সীমা ছাড়িয়ে যায়। সরকারি হিসেবেই গ্রেফতারের সংখ্যা ছিল ১৩৩১ জন। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়াবহ। ১৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ ছাত্রদের মরদেহ জানাজার জন্য অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে রাখা হলে সেখানেও হামলা চালায় পুলিশ। ছত্রভঙ্গ হয়ে ছুটে যায় ছাত্ররা। প্রাণহীন শহীদদের লাশ সূর্যসেন হল পর্যন্ত বয়ে নিয়ে গেলে হলের গেট ভেঙ্গে যৌথবাহিনী ছিনিয়ে নেয় লাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র কর্মচারীদের রুমে ঢুকে তাদের ওপর নিপীড়ন চালায় যৌথবাহিনী।
এ খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে পরদিন বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এ আন্দোলনে যোগ দেয়। তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিল করতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী সামরিক সরকার।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের আত্মপ্রকাশ
তারপর থেকে প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি আসে স্বৈরাচার প্রতিরোধের ডাক নিয়ে। ছাত্র আন্দোলনের এই ভিতের উপর দাড়িয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শুরু হয় তীব্র রাজনৈতিক আন্দোলন। আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকেই পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে এদেশে ছাত্র আন্দোলনের ধারায় গুণগত পরিবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে ‘সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার একই পদ্ধতির গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আত্মপ্রকাশ করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। ছাত্র আন্দোলনে গুণগত পরিবর্তন এই কারণে যে, এর আগে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে উৎপাদনমুখী-কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা হত। আজও অনেক প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন এই দাবি তোলে।
সেদিন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এ যুগের বিশিষ্ট মার্কসবাদী চিন্তানায়ক ও ভারতের এস ইউ সি আই (সি) দলের প্রতিষ্ঠাতা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে এটা স্পষ্ট দেখিয়েছিল যে, “শিক্ষাব্যবস্থা যেহেতু একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ভিত্তির উপরিকাঠামো সেহেতু একটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজে এর ভূমিকা কখনই শ্রেণী নিরপেক্ষ বা শ্রেণী ঊর্ধ্ব হতে পারে না। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত যে শ্রেণী প্রকৃতপক্ষে সমাজের বস্তুগত ও ভাবগত উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে-অর্থনৈতিক ভিত-এর উপরিকাঠামো হিসাবে শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষমতাসীন সেই শ্রেণীর স্বার্থকেই পরিপূরণ না করে পারে না।” আর আমাদের সমাজ যেহেতু শ্রেণীবিভক্ত পুঁজিবাদী সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদন যন্ত্রের মালিক সংখ্যালঘিষ্ঠ পুঁজিপতিশ্রেণী। তাই উৎপাদন ব্যবস্থাও তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে সাধারণ ও সমন্বিত শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা সম্পর্কে ধারণা গড়ে না তুলে প্রাথমিক স্তরের পরই হাতে-কলমে কাজের শিক্ষার মধ্যে ঠেলে দিলে, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-দর্শন-অর্থনীতি-ইতিহাস না জানলে মানবিকবোধসম্পœ মানুষ তৈরি হবে না। একদল দক্ষ টেকনিশিয়ান তৈরি হবে। যারা পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনার প্রয়োজনই পূরণ করবে। কাজেই আজকে উৎপাদনমুখী শিক্ষার মানে দাঁড়াচ্ছে পুঁজিপতিশ্রেণীর স্বার্থে পরিচালিত শিক্ষা। ছাত্র আন্দোলনকে, ছাত্রসমাজকে বিভ্রান্তির চোরাবালি থেকে মুক্ত করতেই ছাত্র ফ্রন্ট ছাত্রসমাজের সামনে তুলে ধরেছিল বিজ্ঞানভিত্তিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থার দাবি। কেননা শিক্ষা যদি বিজ্ঞানসম্মত না হয়, ইহজাগতিক চেতনা সমৃদ্ধ না হয় তাহলে একজন শিক্ষার্থী কখনোই জীবন সম্পর্কে, সমাজ সম্পর্কে, বস্তুজগত সম্পকে সঠিক ধারণা অর্জনে সক্ষম হবে না। বরং অন্ধবিশ্বাস ও মনগড়া ধারণার দ্বারা পরিচালিত হয়ে অজ্ঞতার অন্ধকার গহ্বরে নিমজ্জিত হবে। সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হবে না। সমাজজীবনে এর ফলাফল হবে ভয়াবহ। শাসকশ্রেণী এটাই চায়।
ছাত্র সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা ও শাসকশ্রেণীর স্বার্থ -এই দু’য়ের দ্বন্দের মধ্যে সেদিন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যও ছাত্র ফ্রন্ট ঊত্থাপিত এই দাবিকে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে নি। তাই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রচিত ঐতিহাসিক দশ দফার প্রথমেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, “শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক কর্মী ও অভিভাবকদের মতামত নিয়ে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ও শোষণ মুক্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখে অবিলম্বে একটি সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষাকে সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।” কথা ছিল এরশাদের পতনের পর আন্দোলনের জোট থেকে যারাই ক্ষমতায় যাবে তারা ছাত্রসমাজের ১০ দফা দাবি বাস্তবায়ন করবে।
কিন্তু মর্মান্তিক সত্য হল, স্বৈরাচারের পতনের পর গত ২৪ বছরে তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের কেউই এই প্রতিশ্র“তি রক্ষা করেনি। বরং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে উত্থাপিত দাবি উপেক্ষিত করে ছাত্রস্বার্থের পরিপন্থী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেছে। শিক্ষার দুয়ার আজো সবার জন্য উন্মুক্ত হয় নি। অর্থের নিক্তিতে মেপে শিক্ষা দেয়ার নীতি নিয়েই পথ চলছে।
মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল হয়েছে কিন্তু বদলায়নি শিক্ষা সম্পর্কিত শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি
ড: মজিদ খান কমিশনে প্রাথমিকে আরবী ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করা হয়েছিল। বর্তমানেও বিএনপি’র নেতৃত্বে ৪ দলীয় জোটের সময়কালে মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশন এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের সময়কালে কবীর চৌধুরীর শিক্ষা কমিশনেও কূপমণ্ডূক-সাম্প্রদায়িক শিক্ষা বিস্তারের সুপারিশ করা হয়েছে। একইভাবে বিজ্ঞান শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষানুসারে আমরা জানি, ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ আত্মরক্ষার্থে বিজ্ঞানের কারিগরি দিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার সংমিশ্রণে সংস্কৃতিগত ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদী মনন কাঠামো গড়ে তোলে। এর মাধ্যমে মানুষের যুক্তিশীলতা, মননশীলতাকে ধ্বংস করে। এভাবে জনগণের চিন্তাকাঠামোকে গড়ে তুলতে পারলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা ও শাসন-শোষণ করা সহজ। এ হলো ভয়ঙ্কর সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে এই সংকট আজ মারাত্মক রূপ নিয়েছে। বুয়েট, মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আজ মৌলবাদী চিন্তার বিস্তৃতি ঘটছে।
ফেব্রুয়ারির চেতনা ভুলিয়ে দিতে আমদানি করা হয়েছে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’
১৪ ফেব্রুয়ারি এদেশের ছাত্র-জনতার লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবোজ্জল এক অধ্যায়। ১৯৮৩ সালের ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলন এগিয়ে দিয়েছিল স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নির্মাণের সংগ্রামকে। কিন্তু মধ্য ফেব্র“য়ারির সেই ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে আমদানি করা হয়েছে ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবসের মতো আয়োজন। বিশ্বব্যাপী সা¤্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানি এই দিনকে কেন্দ্র করে ফুল, কার্ড, গিফটের যে ব্যবসা করে তা বাংলাদেশেও ছড়িয়ে দিতে চায়। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ দেশেরও একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী দিনটিকে জনপ্রিয় করতে নানাভাবে প্রচার-প্রচারণা করছে। প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও এ নিয়ে চলছে ব্যাপক মাতামাতি। এর মাধ্যমে একদিকে মানুষের সহজাত øেহ-ভালবাসা প্রেমের আবেগকে পুঁজি করে ব্যবসার ফন্দি করছে অন্যদিকে ভালোবাসার সামাজিক চরিত্রকে নষ্ট করে দিয়ে ক্রমেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী করছে।
অথচ শুরুতে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ ছিল আত্মত্যাগের মহিমা উদযাপনের দিবস। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায়, ভালোবাসার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে গিয়ে খ্রিস্টধর্ম প্রচারক সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের খুন হবার ঘটনাকে স্মরণ করা হতো ১৪ ফেব্র“য়ারিতে। এটা ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর বিখ্যাত ‘হ্যামলেট’ নাটকে ভ্যালেন্টাইন দিবসকে সুনির্দিষ্টভাবে প্রণয়ের দিন হিসেবে চিহ্নিত করে বললেন, To-morrow is Saint Valentine’s day/ All in the morning betime,/ And I a maid at your window/ To be your Valentine.. এ ঘটনাগুলো সামন্ত যুগের যখন নর-নারীরা তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের অধিকারের স্বীকৃতিটুকুও পায়নি। ধর্মীয় প্রভু, গোষ্ঠী প্রধানদের মাধ্যমেই তরুণ-তরুণীদের আশা-আকাক্সক্ষা-ভালোবাসা নিয়ন্ত্রিত হত। সেই বন্ধ্যা সমাজে ভালোবাসার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের চরিত্র ছিল তাই সামাজিক। কিন্তু আজ যারা এই দিনটিকে ঘিরে উন্মাদনা সৃষ্টি করছেন তাদের উদ্দেশ্য কতটুকু সামাজিক? বেশিরভাগক্ষেত্রে প্রবৃত্তিবোধকে জাগিয়ে দিয়ে ‘আমি-তুমি’র মধ্যেই তরুণদের ফাঁসিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে বাজার সংকটের কারণে পুঁজিবাদী-সা¤্রাজ্যবাদী দেশগুলোর পণ্য বিক্রির জোয়ার তৈরি করার জন্য এরকম কিছু উপলক্ষের প্রয়োজন হয়। যেমন ভ্যালেন্টাইন ডে-কে কেন্দ্র করে হলমার্ক, আর্চিস কোম্পানি বিশ্বব্যাপী লক্ষ-লক্ষ ডলার উপার্জন করে। এক হিসেবে দেখা যাচ্ছে, এবছর ১৪ ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্টে কার্ড, ফুল, গিফট সামগ্রী কেনা বেচা হয়েছে প্রায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার কোটি টাকার। বাংলাদেশেও এর হাওয়া লেগেছে। ১লা ফাল্গুন (অর্থাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি) ও ১৪ ফেব্রুয়ারির জন্য যশোর থেকে প্রায় ৫ কোটি টাকার ফুল ঢাকা শহরে এসেছে। একেকটি গোলাপ বিক্রি হয়েছে ৯ থেকে ১০ টাকায়। অথচ সেই সময়ে উত্তরবঙ্গের আলু চাষীরা ১.৫০ টাকা কেজিতে আলু বিক্রি করছে! বিঘা প্রতি ১০ হাজার টাকা লোকসান দিয়ে রাস্তায় আলু ফেলে দিচ্ছে। এ হলো পুঁজিবাদী সমাজে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে প্রচুর মুনাফা লাভের উপায় বের করার উদাহরণ।
শুধু ব্যবসাই নয়, এই মুনাফালোভী প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের চেতনার মানকেও নামিয়ে দেয়। লড়াইয়ের স্পৃহাকে দমিয়ে দিয়ে ভোগবাদিতায় আচ্ছন্ন করে। যেমন বিভিন্ন জায়গায় আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্পন্সর হচ্ছে ইউনিলিভার কোম্পানি। অথচ ৮ মার্চ নারী দিবস অনেক সংগ্রামে-আত্মত্যাগে অর্জিত একটি দিন। বহু অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে নারীদের কাজের অধিকার, সম্মান প্রতিষ্ঠার দিন হিসেবে এই দিবসটি নারী জাতির কাছে উজ্জ্বল হয়ে আছে। কিন্তু সেটিও আজ সা¤্রাজ্যবাদী ব্যবসায়ীদের দখলে। ইউনিভার কোম্পানির পণ্য লাক্স, ফেয়ার এন্ড লাভলি যা বিশ্বব্যাপী সাদা চামড়ার সৌন্দর্যের প্রচার করে। মেয়েদের বাহ্যিক সৌন্দর্যকে তারা পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে। এভাবে সংগ্রামের একেকটি অর্জন নিয়ে তারা ব্যবসা করে। আমাদের দেশেও জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দিপালী সাহাদের ভুলিয়ে দিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে প্রেম-প্রণয়ের দিন হিসেবে তারা প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। কিন্তু ছাত্রসমাজের তেজোদীপ্ত, আত্মত্যাগের এই অত্যুজ্জল ইতিহাস কোন ব্যবসায়িক প্রচারণার চোরাবালিতে হারিয়ে যাবে না।