উত্তরবঙ্গের জনবসতি-পরিবেশ-পানিসম্পদ ধ্বংস করে উন্মুক্ত কয়লা খনি করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) আগামী ২৭ ডিসেম্বর তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আহুত ফুলবাড়ী মহাসমাবেশ সফল করার ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষ ভাবে উত্তরবঙ্গের সর্বত্র চালানো হচ্ছে বিভিন্ন জনসংযোগ কার্যক্রম।
জনসংযোগ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাসদ (মার্কসবাদী) পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে এক প্রচারপত্র। এই প্রচারপত্রে ফুলবাড়ী মহাসমাবেশের পটভূমি ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ডাকে ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলায় হাজার হাজার মানুষ এশিয়া এনার্জি কোম্পানির অফিস ঘেরাও করেছিল। তৎকালীন বিএনপি সরকারের পুলিশ-বিডিআর বাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে সেদিন শহীদ হন আমিনুল, সালেকিন ও তরিকুল, আহত হন দুই শতাধিক। এর প্রতিক্রিয়ায় ফুঁসে ওঠা ফুলবাড়ীর সাহসী জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে এলাকা ছেড়ে পালায় বিদেশী কোম্পানি ও প্রশাসনের লোকজন, সরকার বাধ্য হয় ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ করতে। সেই চুক্তিতে ছিল সারা দেশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন নিষিদ্ধ ও দেশ থেকে এশিয়া এনার্জিকে বহিষ্কারসহ ৬ দফা। তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন ক্ষমতায় গেলে তারা চুক্তি বাস্তবায়ন করবেন। অথচ, সরকার সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে পার্শ্ববর্তী বড়পুকুরিয়া উপজেলার কয়লাক্ষেত্রের একাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে। অন্যদিকে সরকারের প্রশ্রয়ে এশিয়া এনার্জি কোম্পানি এখনো ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লাখনি করার তৎপরতা চালাচ্ছে ‘গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট’ (জিসিএম) নাম নিয়ে। সরকার ও এশিয়া এনার্জির এসব অপতৎপরতায় ক্ষুব্ধ ফুলবাড়ীবাসীর ক্ষোভের সর্বশেষ বিস্ফোরণ ঘটে গত ২৬ নভেম্বর। গোপনে ফুলবাড়ী সফরে গিয়ে জনতার তাড়ার মুখে পালাতে বাধ্য হয় কোম্পানির বাংলাদেশের বড়কর্তা গ্যারি লাই। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় কমিটি আগামী ২৭ ডিসেম্বর ফুলবাড়ীতে মহাসমাবেশ ডাক দিয়েছে এশিয়া এনার্জিকে দেশ থেকে বহিস্কার, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন নিষিদ্ধসহ ফুলবাড়ী চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে।
এই আন্দোলনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুধুমাত্র ফুলবাড়ীর জনগণের বিষয় নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে বিশেষ করে উত্তরবঙ্গসহ সারাদেশের মানুষের স্বার্থ। কারণ ফুলবাড়ীতে আছে দেশের সবচেয়ে উন্নতমানের কয়লা, অথচ এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ী কয়লাক্ষেত্র থেকে কয়লা উত্তোলন করলে তারা পাবে ৯৪%, আর বাংলাদেশ পাবে মাত্র ৬%। তাদের ভাগের কয়লা তারা বেশি দামে রপ্তানি করতে চায়, ফলে তা এদেশের জ্বালানি সংকট মেটাতে কাজে লাগবে না। তারা কয়লা তুলতে চায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে, অর্থাৎ কয়লাক্ষেত্র এলাকার ওপরের মাটি খুঁড়ে গর্ত করে। এতে বেশি পরিমাণ কয়লা তোলা যাবে কিন্তু পুরো এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে, বিপুল জনবসতি ও কৃষিজমি ধ্বংস হবে। ফুলবাড়ীর ক্ষেত্রে এশিয়া এনার্জির পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩৫ বর্গ কিলোমিটার খনি এলাকাসহ আশপাশের ৬৫৬ বর্গ কিমি এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার পুরোটাই ঘনবসতিপূর্ণ ও উর্বর তিনফসলি কৃষিজমি। উচ্ছেদ হবে বিপুলসংখ্যক আদিবাসী জনগোষ্ঠীসহ অন্ততঃ ৫০ হাজার মানুষ। এই এলাকার মাটির নীচে কয়লার স্তরের ওপর আছে বিরাট পানিবাহী ভূ-স্তর। ফলে প্রতি সেকেন্ডে ৫০,০০০ লিটার পানি নিষ্কাশন করে খনিকে শুষ্ক রাখতে হবে। এই বিপুল পরিমাণ কয়লা-মিশ্রিত পানি আশেপাশে ছড়িয়ে পড়বে। জালের মতো বিস্তৃত নদী-নালা-খাল দ্বারা এ পানি গোটা উত্তরাঞ্চলকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। খনি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা হবে পানি শূন্য আর বিস্তীর্ণ এলাকা বিষাক্ত পানিতে সয়লাব। নষ্ট হবে কৃষি, ধ্বংস হবে মৎস্য সম্পদ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও মানুষের জীবন।
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় ভূ-গর্ভস্থ বা সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে মাটিতে সুড়ঙ্গ বা কুয়া করে কয়লার স্তরে পৌছে কয়লা তোলা হয়, উপরের জমি ঠিক থাকে। কয়লা তোলার পর ফাঁকা জায়গা বালি দিয়ে ভরাট করতে হয়, নইলে মাটি ডেবে যায়। বড়পুকুরিয়াতে বালি দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে না তাই মাঝে মাঝেই জমি ডেবে যাচ্ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনির ৬০-৭০% কয়লা তোলা যায়, ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে তোলা যায় ২০-৩০%। অল্প গভীরতায় কয়লা থাকলে উন্মুক্ত পদ্ধতি লাভজনক, কিন্তু তা পরিবেশের জন্য বেশি ক্ষতিকারক। এই কারণে অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জার্মানিসহ যেসব দেশে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নেয়া হয়েছে তার সবগুলোই পাহাড়ি এলাকায় বা মরুভূমিতে। তাদের জাতীয়ভিত্তিক জনসংখ্যার ঘনত্বও বাংলাদেশের চাইতে অনেক কম। যেমন, প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব অস্ট্রেলিয়ায় ৩, ইন্দোনেশিয়ায় ১২১, জার্মানিতে ২২৯, ভারতে ৩৬১, আর বাংলাদেশে ১১২৬ জন। ফুলবাড়ীর মতো এত ঘনবসতিপূর্ণ ও উর্বর আবাদি জায়গায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে মাইনিং করার উদাহরণ পৃথিবীর কোনো দেশেই সম্ভবত নেই। এছাড়া বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির মালিকানা রাষ্ট্রীয়, চীনা কোম্পানি সিএমসি কন্ট্রাকটর হিসেবে কাজ করে। পক্ষান্তরে ফুলবাড়ী কয়লাক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানির কাছে লীজ দেয়ার চক্রান্ত করা হয়েছিল যা বাস্তবায়িত হলে সিংহভাগ কয়লা তারা পেত। এইসব কারণে জাতীয় কমিটি শ্লোগান তুলেছিল Ñ কয়লা উত্তোলনে ‘উন্মুক্ত না, বিদেশি না , রপ্তানি না’।
দেশবাসীকে উদ্দেশ্য করে প্রচারপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের নিজস্ব জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ অল্প, আমদানি করা তেলের দাম চড়া। নবায়নযোগ্য জ্বালানি যেমন পারমাণবিক শক্তি বা সৌরশক্তির লাভজনক ব্যবহারও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি মানুষের আয়ত্তে আসেনি। বিনিয়োগকারীদের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বর্তমান সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ওপর জোর দিচ্ছে। এ জন্য আমদানির পাশাপাশি তারা যেকোন মূল্যে দেশের কয়লা তুলতে চায়। পুঁজিপতি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের স্বাথ রক্ষাই শাসকগোষ্ঠীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ, কয়লা তুলতে গিয়ে কত সাধারণ মানুষ উচ্ছেদ হবে বা পরিবেশের কতটা ক্ষতি হবে তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। হাজার হাজার মানুষকে পথে বসিয়ে কয়েকশো মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোকে তারা ‘উন্নয়ন’ বলে আখ্যায়িত করে। অথচ, ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা তুলে বা ইদানীং শুরু হওয়া ‘কোল গ্যাসিফিকেশন’ পদ্ধতিতে ভূ-গর্ভেই কয়লা পুড়িয়ে উৎপাদিত গ্যাস ব্যবহার করে আপাতত প্রয়োজন মেটানো যায়। সেদিকে শাসকদের নজর নেই। একই কায়দায় বর্তমান সরকার সুন্দরবনের পাশেই পরিবেশবিধ্বংসী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে, রুপপুরে বিপজ্জনক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বসাচ্ছে। তারা জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সমুদ্রের গ্যাসব্লক বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বরাদ্দ দিচ্ছে। স্থলভাগে দ্রুত গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মার্কিন শেভরন কোম্পানিকে অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে যার ফলে দেশের সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলে সরকার লুটপাটের রেন্টাল-কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের মেয়াদ বাড়িয়েছে। ফলে বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ছে, অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানির সাথে অসম উৎপাদন বণ্টন চুক্তি অনুসারে তাদের কাছ থেকে বেশি দামে কেনার কারণে গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এমনকি এ খাতে দুর্নীতি-লুটপাটের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে যাতে কোন ব্যবস্থা নেয়া না যায় সে জন্য আইন প্রণীত হয়েছে। গ্যাস-কয়লাসহ দেশের সম্পদ নিয়ে শাসক দলগুলোর লুটপাট-দুর্নীতি ও গণবিরোধী এইসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আজ সচেতন ও সোচ্চার হওয়া দরকার। সেই লক্ষ্যে গণআন্দোলন গড়ে তোলার অংশ হিসেবে আগামী ২৭ ডিসেম্বর শনিবার বিকাল ৩টায় তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি আহুত ফুলবাড়ীর নিমতলীতে মহাসমাবেশে যোগ দেবার জন্য বাসদ (মার্কসবাদী)’র পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাসদ (মার্কসবাদী) প্রচারিত প্রচারপত্রে নিম্নোক্ত দাবিসমূহ উত্থাপন করা হয়েছে:
- জাতীয় কমিটির সাথে সম্পাদিত ৬ দফা ফুলবাড়ী চুক্তি বাস্তবায়ন কর।
- এশিয়া এনার্জি কোম্পানিকে অবিলম্বে দেশ থেকে বহিষ্কার কর।
- বড় পুকুরিয়া পুনর্বাসনের নামে জনগণকে অন্যত্র সরিয়ে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি করার চক্রান্ত বন্ধ কর।
- গ্যাস-বিদ্যুৎসহ জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো চলবে না।
- ‘উন্মুক্ত না, বিদেশি না, রপ্তানি না’ – এই নীতির ভিত্তিতে কয়লা উত্তোলন কর।
- জাতীয় সক্ষমতা বাড়াও, দেশের সম্পদ জনগণের স্বার্থে ব্যবহার কর।
- গ্যাস লুন্ঠনের অসম ‘উৎপাদন বণ্টন চুক্তি’(পিএসসি) বাতিল কর।
- জাতীয় স্বার্থবিরোধী পিএসসি ২০১৫ প্রণয়নের অপচেষ্টা বন্ধ কর।