সাম্যবাদ প্রতিবেদন
অবশেষে সমাপ্ত হল উপজেলা নির্বাচন পর্ব। পাঁচটি পর্বে প্রায় মাসব্যাপী চলা এই নির্বাচনে ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, নৈশ ভোট অর্থাৎ রাতেই ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়াসহ যতরকম অর্থ, অস্ত্র ও পেশীশক্তির মহড়া দেয়া যায় তার সর্বোচ্চ ঘটেছে। পত্র-পত্রিকায় বলা হচ্ছে, স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার পতনের পর এত ব্যাপক মাত্রায় রিগিং আর কোনো নির্বাচনে হয়নি। পাঁচটি পর্বে বিভক্ত এ নির্বাচনের প্রথম পর্ব খানিকটা শান্তিপূর্ণ হলেও ক্রমেই সংঘাত, সহিংসতা, রিগিং বাড়তে থাকে এবং শেষ পর্বে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। সরকারি ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ও দলীয় সন্ত্রাসীদের একসাথে একটি বাহিনীর মতো কাজে লাগিয়ে নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে এসেছে। তৃপ্ত আওয়ামী লীগ নেতা, এবারে উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ওবায়দুল কাদের বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠ হয়েছে।
অথচ ২৯টি পর্যবেক্ষণ সংস্থার সংগঠন Election working group-এর মতামত, “উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা ছিল জাতির জন্য লজ্জার। প্রশাসন এই ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে জাতি দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখিন হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরাও চূড়ান্ত অপেশাদারির পরিচয় দিয়েছেন।” এ খবরগুলো দৈনিক পত্রিকার পাতায় বহুবার এসেছে। এসেছে ভোট ডাকাতি, জাল ভোট মারা, বিরোধী পক্ষের ওপর সশস্ত্র হামলা ইত্যাদি ঘটনার বহু সচিত্র প্রতিবেদন। এসব দেখে জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
এই কারচুপি কিংবা সহিংসতা না হলেই কি নির্বাচন সুষ্ঠু হত? বিগত যে সকল নির্বাচন ঠিকভাবে হয়েছে বলে আমরা সবাই মনে করি সেগুলোতে কি জনগণের মতামতের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল? কোনো একটা নির্বাচনে ভোট দেবার পর কি ব্যাপক জনগণের ভাগ্য সামান্যতম পরিবর্তিত হয়েছে?
বুর্জোয়া ব্যবস্থায় ভোট মানেই মানি, মিডিয়া আর মাসল পাওয়ারের খেলা। জাতীয় নির্বাচনে বড় বড় পুঁজিপতিরা ঠিক করেন এবার কে যাবে। সে অনুযায়ী প্রচার হয়। সারাদেশে মাতম তৈরি করা হয়। বড় দুই দল এবং তাদের সহযোগীরা ছাড়া যে দেশে আর কেউ আছে তা তাদের ভুলিয়ে দেয়া হয়। একদিকে টিভি-মিডিয়ায় অবিশ্রান্ত প্রচার, অন্যদিকে মাঠ পর্যায়ে চলে টাকার খেলা, শক্তির খেলা। স্থানীয় নির্বাচনগুলোও তাই। বড় দলগুলোর প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা তাদের মনোনীতরা হন এ নির্বাচনের প্রধান কুশীলব। তারা হন সমস্ত নির্বাচনী ডামাডোলের কেন্দ্র। যথারীতি চলে টাকা, পেশীশক্তি কিংবা সামাজিক প্রভাব বিস্তারের খেলা।
ফলে এ বুর্জোয়া ব্যবস্থায় অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে কিছু নেই। সমস্ত রকমের প্রভাব খাটিয়ে জনগণকে তাদের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য করার আনুষ্ঠানিকতাটুকু নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারলেই তারা বলেন যে নির্বাচন সুষ্ঠ হয়েছে, শান্তিপূর্র্ণ হয়েছে। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হলেই ন্যায়সঙ্গত হয় না। কিন্তু এখন আর এতটুকুও বজায় রাখা বুর্জোয়া ব্যবস্থায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তারই প্রতিফলন দেখা গেল এই উপজেলা নির্বাচনে।
এইবারের উপজেলা নির্বাচনের দিকে একবার তাকানো যাক। আওয়ামী লীগ এবার আর কোনো আব্রু রাখেনি। বেপরোয়া রিগিং হয়েছে। বহু জায়গায় চেয়ারম্যান প্রার্থী কেন্দ্রের অবস্থা দেখে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন। কিন্তু সরকার নির্বিকার। এই ফ্যাসিস্ট সরকার আগামীতে যে-কোনো কিছুই গায়ের জোরে করতে তিল পরিমাণ দ্বিধা করবেনা, তারই মহড়া হয়ে গেল এই উপজেলা নির্বাচনে।
তাহলে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি কেন? এ নির্বাচন বুর্জোয়াদের লোকদেখানো মতামত নেয়া। প্রকৃত জনমত এর মাধ্যমে উঠে আসেনা, আসবেওনা। কমরেড লেনিন বলেছিলেন, এটা জনপ্রতিনিধি ঠিক করা নয়, ৫ বছর পরপর জনগণের উপর বুর্জোয়াদের কোনো অংশ শোষণ করবে তাই ঠিক করা। আর এটি ঠিক করে বুর্জোয়ারাই। জনগণকে দিয়ে তা পাশ করিয়ে নেয়। এটি স্বাভাবিকভাবে তারা যদি করতে পারে তবে ভাল, তা না হলে ভোটারবিহীন নির্বাচন করতেও তাদের বাধেনা। যেমন হয়েছে এবারের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে। এ বুর্জোয়া ব্যবস্থার মধ্যে যতবার নির্বাচন হবে ততবারই বিভিন্ন রূপে এই একই কাণ্ড ঘটবে, এর ব্যত্যয় হবেনা। এর কারণ পার্লামেন্টারি রাজনীতির ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা। তার উৎপত্তি ও বিকাশের আলোচনা করলে দেখা যাবে এই পরিণতি তার অবশ্যম্ভাবী। এর বাইরে বুর্জোয়া গণতন্ত্র যেতে পারেনা। প্রশ্ন ওঠে, এসব জেনেও আমরা, বিপ্লবী কমিউনিস্টরা কেন এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি?
এই নির্বাচন দিয়ে কিছু হবেনা, সেটা আমরা যেভাবে বুঝি, মানুষ সেভাবে বোঝেনা। কারণ আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে বুর্জোয়ারা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়েছে। তারা যেভাবে দেশ চালাতে চায় সেভাবে তারা দেশের সংবিধান, আইন-কানুন গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্রের নিয়ম-নীতি ও রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করেছে। জনগণ বুঝুক আর নাই বুঝুক তা অনুসরণ করেছে। মেনে এসেছে। রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা পরিবর্তনের জন্য ৫ বছর পরপর নির্বাচনের ব্যবস্থা জনগণ গ্রহণ করেছে। যদি কমিউনিস্টরা স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব করত তবে এই বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি ফর্মের প্রশ্নই আসতনা। তখন সর্বহারা গণতন্ত্র চালু হত যা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে, রাশিয়ায়। আমাদের দেশে তাই বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা ঐতিহাসিকভাবেই আমাদের উপর আরোপিত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না জনগণের আন্দোলন সংগঠিত করতে করতে তাদেরকে বুর্জোয়া রাজনীতি ও নির্বাচনের ফাঁকিটা কি তা ধরানো যাচ্ছে, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে বিপ্লবের মাধ্যমে এ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা উৎখাত করা যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের নির্বাচনে থাকতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও আমাদের তুলে ধরতে হবে যে, এ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বহাল রেখে শুধুমাত্র নির্বাচন করে, সরকার বদলে জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হবেনা। ভাগ্যের পরিববর্তন ঘটাতে গেলে বদলাতে হবে এ পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকেই। কিন্তু এটা যতক্ষণ না জনগণ বুঝতে পারছে, ততক্ষণ নির্বাচন নিয়ে তার মোহ কাটবেনা। প্রতিবার ব্যাপক সংখ্যায় সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। আর এসময় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ ব্যবস্থার অসারতা প্রমাণ করা যাবেনা। এ ব্যবস্থার মধ্যে জনগণের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি নির্বাচনকেও জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার, তাদের সাথে যুক্তি করার একটা পথ হিসেবে নিতে হবে। এভাবে চলতে গিয়ে কোনো জায়গায় দীর্ঘদিন গণআন্দোলনে থাকা ও জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করতে করতে দলের বিপুল গ্রহণযোগ্যতার কারণে সেখানে নির্বাচনে যদি আমাদের দল জয়লাভ করেও তবে সেই জনপ্রতিনিধি জনগণকে কিছুটা রিলিফ দিতে পারে, তাদের জন্য মূর্ত কিছু জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড করতে পারে। যেটা পারবেনা সেটা আদায়ের জন্য জনগণকে সাথে নিয়ে লড়তে পারে এবং লড়তে লড়তে প্রয়োজন হলে ঐ পদ পর্যন্ত ত্যাগ করতে পারে। জনপ্রতিনিধি হয়ে, সকল হিসাব-নিকাশ জনগণের কাছে পরিষ্কার রেখে, তাদের নিয়েই উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে। সাথে সাথে এ ব্যবস্থার অসারতাও প্রমাণ করতে পারে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টিকে আমরা এভাবেই দেখি, সারা দুনিয়ার বিপ্লবী কমিউনিস্টরা এভাবেই দেখে।
আবার আসি উপজেলা নির্বাচনে। এই আওয়ামী লীগ কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলে। অথচ উপজেলা নির্বাচনে বিভিন্ন জায়াগায় জামায়াতের সাথে গোপন সমঝোতা হয়েছে তাদের ব্যাপক মাত্রায়। সারাদেশে যেখানে যে মাত্রায় সমঝোতা সম্ভব সেখানে তারা তাই করেছে। জনগণের কাছে এসব এখন স্পষ্ট। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায় তাহের-পুত্রের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে জামায়াত সেখানে প্রার্থী দেয়নি। ভাইস চেয়ারম্যান পদে দিয়েছে। সেখানে বিএনপি নেতারা তাহেরের প্রতাপে ঘর ছাড়া হলেও জামায়াত নিশ্চিন্তে নির্বাচন করেছে, প্রার্থীকে নিয়ে ঘরে ঘরে গিয়েছে। প্রশ্ন ওঠে, এই জামায়াতকে নিরাপত্তা দিচ্ছে কারা? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনের পর তো জামায়াত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাদেরকে আবার রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব নিয়েছে কে? বিএনপি’র সাথে তো তার জোটই আছে, তাদের কথা বাদ। স্থানে স্থানে জেতার জন্য, সুবিধার জন্য আওয়ামী লীগ তাদের সাথে যেভাবে গলা মিলিয়েছে, আজ সেই শক্তির বলে জামায়াত দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছে। এই এককভাবে ক্রেডিট আওয়ামী লীগের।
৫ জানুয়ারির একটা পাতানো নির্বাচনের পর দিনে দুপুরে সবার চোখের সামনে ডাকাতি করার মতো একটা উপজেলা নির্বাচন হয়ে গেল। এও যদি আমাদের মৌন সমর্থন পেয়ে যায়, দুর্নীতি-দুঃশাসন-অভাব-বেকারত্ব-মূল্যবৃদ্ধির টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত মানুষ যদি এও মেনে নেয়, তবে এর ভবিষ্যৎ কি? বিরক্তি কিংবা রাজনীতির প্রতি ঘৃণা কি এর সমাধান দিতে পারে? এসবই যদি চলতে থাকে তাহলে আজ হয়তো ঠিক আমার গায়ে লাগছে না কিন্তু কাল কি আমি রক্ষা পাব? আমার শরীরে আঘাত না লাগা পর্যন্ত কি আমি জাগব না? আমাদের নিজেদের মা-বোন রাস্তায় বেইজ্জত না হওয়া পর্যন্ত কি আমদের চেতনা ফিরবে না?
আমরা জানি, এরপরও এই দু’দলের মিটিংয়ে লাখো লোকের সমাগম হবে। মুহুর্মুহু তালিতে দুই নেত্রীর জয়ডঙ্কা নিনাদ করে উঠবে, আর তার নিচে চাপা পড়বে সাধারণ মানুষের অন্নের জ্বালা, বস্ত্রের লজ্জা, জীবনে পরাজয়ের গ্লানি। দেশের শিল্পপতিরা একদলের উপর মানুষ ক্ষেপে গেলে আরেক দলকে ক্ষমতায় আনবে। টিভিতে, পত্রিকায় কখনও শেখ হাসিনা, কখনও খালেদা জিয়ার গুণকীর্তি নানা রূপে নানা ব্যঞ্জনায় পরিবেশিত হবে। আর সাধারণ মানুষ এ দুয়ের মধ্যেই পাক খেতে থাকবে উপায়হীন হয়ে। রাজনীতি সক্রিয়ভাবে করুন আর নাই করুন, বুঝুন আর নাই বুঝুন, মানুন আর নাই মানুন – এ বঙ্গভূমির উপর যে দাঁড়িয়ে আছে তার এ চক্র থেকে মুক্তি নেই; যতদিন না আপনি একটি যথার্থ আন্দোলনের রাজনৈতিক শক্তি নির্মাণ করতে পারছেন।
তাই আজ পাড়ায়-মহল্লায় শিক্ষিত সচেতন মানুষেরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মেয়েদের উপর বর্বরতা-নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে গণকমিটি গড়ে তুলুন। এ অন্যায় রুখে দাঁড়ান। আজকের দিনে নিরবতা মানে অনৈতিকতা। বিশাল রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া জাতি আমরা – এ অন্যায় আমরা মাথা পেতে মেনে নিতে পারি না।