Wednesday, May 1, 2024
Homeফিচারভারতের লোকসভা নির্বাচন : বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মহিমা অপার!

ভারতের লোকসভা নির্বাচন : বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মহিমা অপার!

সাম্যবাদ প্রতিবেদন
Godhra-Riots-Narendra-Modi-and-Manish-Tiwari-1গণতন্ত্র – বর্তমান বিশ্বের এক সুমহান বচন, এক মহিমান্বিত জপমালা, অতি পবিত্র স্লোগান। উন্নত ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুরু করে দরিদ্রতম আফ্রিকা – সর্বত্রই গণতন্ত্রের জয় জয়কার। কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে আছে, পেটে ভাত নেই – তাতে কি? গণতন্ত্র আছে। কোটি কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই, বাসস্থান নেই, রোগে-শোকে মরে গেলেও চিকিৎসা নেই, শিক্ষা নেই – তাতে কি? গণতন্ত্র তো আছে। মানুষের জীবনে চূড়ান্ত অপমান-অসম্মান-লাঞ্ছনা, সম্পদের বৈষম্য, অভাব-দারিদ্র্য – কুছ পরোয়া নেই, গণতন্ত্র তো আছে। পৃথিবীর অর্ধেক জনগোষ্ঠী, সাড়ে তিনশ কোটি মানুষের যা সম্পদ, তার সমপরিমাণ সম্পদ ৮৫ জন ধনকুবেরের হাতে জমা হয়েছে। হোক না! মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, ভোট দেয়ার স্বাধীনতা আছে। আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব! অবশ্য মানুষ ভোট দিতে না পারলেও গণতন্ত্র থাকে, যেমন আছে বাংলাদেশে। গণতন্ত্রকে ঘায়েল করা অত সহজ নয়! আর সর্বোপরি, দুনিয়ায় কখন কার কতটুকু গণতন্ত্র দরকার সেটা দেখভাল করার জন্য গণতন্ত্রের মোড়লেরা সারাক্ষণ ওঁৎ পেতে বসে আছেন। প্রয়োজন মনে হলেই বোমারু বিমান, মিসাইল, বন্দুক-কামান-ট্যাংক, গোলা-বারুদ সব নিয়ে হাজির হয়ে যান। তাদের এই গণতন্ত্র কায়েমের বিষম ঘায়ে ইরাকে মানুষ মরছে, লিবিয়াতে মরছে, আফগানিস্তানে মরছে। মানুষ মরুক, সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাক, কিন্তু গণতন্ত্র চাই-ই।
এই গণতন্ত্রের নাম বুর্জোয়া গণতন্ত্র। বর্তমান দুনিয়ার বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মহিমা এখানে ওখানে নানা চেহারায় প্রস্ফুটিত হচ্ছে, সুবাস ছড়াচ্ছে। বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের মহিমা উদ্ভাসিত – জনগণ ভোট না দিলেও শাসকরা নির্বাচিত এবং গণতান্ত্রিক! বুর্জোয়া গণতন্ত্রেরই আরেক মহিমা কীর্তন চলছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে খ্যাত আমাদের প্রতিবেশী ভারতে। সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের সর্ববৃহৎ মহিমা – তার নাম মোদি!
নরেন্দ্র মোদির নামে জানে না এমন শিক্ষিত মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ভারতের আরো আরো রাজ্য আছে, গুজরাটের চেয়ে শিক্ষা-দীক্ষায়-সংস্কৃতিতে উন্নত, অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর রাজ্য আছে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী নাম জানেন? কিংবা কর্ণাটকের? বাংলাদেশের গায়ে লেগে থাকা ত্রিপুরা কিংবা বিহারের? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আপনি জানেন না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির নাম আপনি জানেন। এই মোদি যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, সেই ২০০২ সাল থেকেই তার নাম শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সমস্ত দেশের শিক্ষিত সচেতন লোকেরা জানেন। কেন তার এই পরিচিতি? তার পরিচিতি ঘটেছিল খুনি হিসাবে! ২০০২ সালে তার নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল এই উপমহাদেশের ইতিহাসের এক বর্বরতম সাম্প্রদায়িক গণহত্যা। এই গণহত্যার নায়ক হিসাবেই মোদি মহোদয় সারা দুনিয়া জুড়ে পরিচিতি পেয়েছিলেন। গোধরা হত্যাকাণ্ডের সেই কসাই মোদিই আজ বাদে কাল বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন। সুতরাং. তার প্রচার-পরিচিতি কি আর সবার মতো হবে নাকি! ভারতের পত্র-পত্রিকা দরকার নেই, বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা খুলে দেখুন না, মোদির নাম পাবেনই। আর যদি একটু কষ্ট করে ভারতের পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে চোখ রাখতে পারেন তাহলে তো কথাই নেই। নরেন্দ্র মোদিকে চিনতে আপনাকে আর একটুও বেগ পেতে হবে না। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন। তিনি ভারতের চলমান ১৬তম লোকসভা নির্বাচনের একজন প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের তকমা আঁটা ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোতে চোখ বুলান, এদের অনেকেই মোদিকে ইতোমধ্যে ‘গণতান্ত্রিক’ ভারতের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আখ্যায়িত করছেন!
পাঠক বুঝতেই পারছেন, গণতন্ত্রের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক হিসাবে মোদির এত প্রচার-প্রতিপত্তি, এত রমরমা নয়। চার্লি চ্যাপলিনের মসিয়ে ভের্দু সিনেমাটি দেখেছেন? ওই সিনেমায় বেশ কয়েকটি হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ভের্দু বলছে : “Wars, conflict, it’s all business. One murder makes a villain. Millions a hero. Numbers sanctify.” মানে হল, যুদ্ধ-সংঘাত সবই ব্যবসা। একটা খুন কাউকে খলনায়ক বানায়, লক্ষ লক্ষ মানুষের খুনিরা হয় বীর এবং নায়ক – সংখ্যাই নির্ধারক। এই সংখ্যাই মোদিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে – খুনের সংখ্যা।

240212satishনরেন্দ্র মোদির দলের নাম ভারতীয় জনতা পার্টি, সংক্ষেপে বিজেপি। এই দলটি একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক দল। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মোদির দল ছিল গুজরাট রাজ্যের ক্ষমতায়, মোদি মহোদয় ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মোদি সরকার এবং তার দলের নেতৃত্বে গুজরাটে স্মরণকালের ইতিহাসের ভয়াবহ এবং বর্বরতম সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। নারীদের ওপর চালানো হয়েছিল নৃশংস অত্যাচার। গর্ভবতী নারীর পেট চিরে গর্ভের শিশুকে ত্রিশূলের মাথায় বিদ্ধ করে সেই ত্রিশূল নিয়ে প্রদর্শন করে বেড়িয়েছে মোদির অনুচরেরা। ওই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসে খুন হয়েছিল দুই হাজারের বেশি মানুষ। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি গুজরাটের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নৃশংস আক্রমণ চালিয়েছে। তার পর থেকেই ভারত ও ভারতের বাইরে মোদি একজন ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক চরিত্র, এক বর্বর কসাই, নৃশংস খুনি হিসেবে পরিচিত হয়েছে। ওই গণহত্যাই তাকে ‘গণতান্ত্রিক’ ভারতের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। বিজেপির হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িকতা সভ্যতা, প্রগতি, মানবতা সমস্ত কিছুর চরম শত্রু হলেও ‘মহিমান্বিত’ গণতন্ত্রের স্বার্থে, বুর্জোয়া রাজনীতির বিরোধের স্বার্থে মোদির মতো কসাইদেরও গুরুত্ব তৈরি হয়। বুর্জোয়া গণতন্ত্র কি সুমহান বস্তু দেখুন – কয়েক হাজার মানুষের খুনিকেও সে সাদরে বরণ করে নিতে প্রস্তুত!

চমকে উঠছেন কেন? বুর্জোয়া গণতন্ত্র এত সংকীর্ণমনা নয়, সে অনেক উদার। বুর্জোয়া গণতন্ত্র তার তরীতে সবাইকে ঠাঁই দেয়, সাম্প্রদায়িক শক্তিকেও, গণহত্যাকারীকেও – যেমন দিয়েছে বাংলাদেশে জামাতে ইসলামীকে। মাত্র দুদিন আগে যে দলটির বিরুদ্ধে সারাদেশের লক্ষ কোটি মানুষ প্রবল ধিক্কার ও বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল, যে দলটিকে সঙ্গ দিতে গিয়ে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জনগণ কর্তৃক ধিক্কৃত হয়েছিল, গত উপজেলা নির্বাচনে তাদেরকেই আবার কেমন করে পুনর্বাসিত করা হল। কারা করেছে? কি অদ্ভুত প্রশ্ন করছেন। স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়ন কারী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার, যাতে শরিক আছে বেশ কয়েকজন পাকা বাম! সারাদেশে প্রকাশ্যে গোপনে তারা জামাতের সাথে আপস-আঁতাত করেছে, সে খবর পত্রপত্রিকার মাধ্যমে সারা দেশ জেনেছে।
সারা দুনিয়ায় গণতন্ত্রের এমন উদাহরণ আরো পাবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই তাকিয়ে দেখুন না কেন? বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সর্বোন্নত মডেল সে। গণতন্ত্র-প্রেমীদের কামনা-বাসনার ধন, তাদের স্বপ্ন-সাধনা! তেমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যই তো আমাদের দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, সমাজের বিবেক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবীর দল, সুশীলরা তারস্বরে চিৎকার করে চলেছেন। নিজের দেশের মাটিতে ভোটচুরি, ভোট জালিয়াতি তো আছেই, সারা দুনিয়ায় তাদের গুন্ডামির খবর কে না জানে? তবুও আমরা তাদের মতো গণতান্ত্রিক হতে চাই। বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মডেল গ্রেট ব্রিটেনের দিকে তাকিয়ে দেখুন। দুনিয়া জুড়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দস্যুতার বিশ্বস্ত সহচর সে। আরো দেখতে চান? দুনিয়ার দিকে চোখ মেলে তাকান। এখন তো সমাজতন্ত্র ‘মৃত’! সোস্যালিজম-কমিউনিজম এসব ‘অচল মাল’! সমাজতন্ত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই, ব্যক্তি স্বাধীনতা নেই, এবং আরো কি কি সব নেই! সমাজতন্ত্রের অনেক বদনাম। সমাজতন্ত্রের কথা ছাড়ুন, ওসব কথা যারা বলে তারা নিতান্ত মূর্খ! গণতন্ত্রই ধন্বন্তরী – জয় গণতন্ত্র! আর গণতন্ত্র মানেই ভোট – আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব, খুনিকেও দেব, মোদির মতো কসাইকেও দেব – ইত্যাদি ইত্যাদি।
জনসংখ্যার কল্যাণে ভারত এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দাবিদার। সেই সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে এখন কসাই মোদির জয়জয়কার চলছে। মোদির উত্থানে গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক স্যেকুলার মানুষেরা হায় হায় করছেন। কিন্তু হায়! হায় হায় করে যদি বিপদ কাটতো তাহলো তো খুবই ভালো হত। শুকনো কথায় তো চিড়ে ভিজে না। আজ যারা হায় হায় করছেন, তারা কি একবারও ভেবেছেন, তারা নিজেরা কি করেছেন? শাসক দল কংগ্রেস দুর্নীতি-লুটপাটের পঙ্কে নিমজ্জিত। জনগণের ওপর এরা দুঃশাসন চাপিয়ে দিয়েছে। শাসকদের দুর্নীতি আর দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী অসাম্প্রদায়িক মানুষেরা কি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন? গণআন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন? আন্দোলনকারী শক্তিগুলোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন? তা তো তারা করেন নি। তারা বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনেছেন। কবে ভোট আসবে, ভোটের বাক্সে তারা পরিবর্তন ঘটাবেন। ভারতের বামপন্থী দলগুলোর জোট হিসাবে পরিচিত বাম ফ্রন্টও জনগণকে গণআন্দোলনে সামিল করার পরিবর্তে ভোটের রাজনীতিতে টেনে নিয়ে যেতে ভূমিকা রেখেছে। এই পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে পরিবর্তন তো বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নিয়মেই হবে, তাই নয় কি? আমজনতা কি চাইল তাতে কি আসে যায়? বুড়ো আঙুল দিয়ে ব্যবস্থার পরিবর্তন হয় কি? উল্টো, ব্যবস্থাই আপনাকে বুড়ো আঙুল দেখায়।
ভোটের রাস্তায় জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়? দুনিয়ার কোথাও হয়েছে এমন নজির কেউ দেখাতে পারবেন? বুর্জোয়া গণতন্ত্রের নিয়মই এই। বুর্জোয়াদের এক শক্তি জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত-ধিকৃত হলে তারা অন্য শক্তিকে সামনে এনে হাজির করে। ‘বিকল্প’ হাজির করে। বুর্জোয়াদের সৃষ্টি করা ওই ‘বিকল্প’কেই মানুষের মনে-মগজে গেঁথে দেয়ার জন্য মিডিয়াগুলোও উঠে-পড়ে লাগে। বুর্জোয়াদেরই কোনো না কোনো অংশ ‘বিকল্প’ হয়ে ওঠার জন্যে তক্কে তক্কে থাকে।
ভারতে যা হচ্ছে, বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম হবে এমনটা যদি কেউ মনে করেন, তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। (যদি বোকাদের জন্য স্বর্গ বলে সত্যি কিছু থাকে!) আমাদের এখানেও দুদিন পর পর ‘বিকল্প চাই’, ‘বিকল্প চাই’ রব ওঠে। কেউ কেউ ‘বিকল্প’ হওয়ার দাবি নিয়ে ঢোল-সহরৎ পেটাতে থাকেন। অনেকেই আশায় বুক বাঁধেন। কিন্তু বুর্জোয়া গণতন্ত্রে বিকল্প যে বুর্জোয়ারাই হয়, এ কথাটাই তারা ভুলে যান। শুধু তারা ভুলে গেলেও বাঁচা যেত। আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে এনারা জনগণকেও অনেক কিছু ভুলিয়ে দেন। শুধু বুর্জোয়া গণতন্ত্রের অপার মহিমাটাই ভুলতে দেন না। এই বুর্জোয়া গণতন্ত্রে আজ ভারতে মোদি’দের মহিমাকীর্তণ চলছে, কাল বাংলাদেশে জামাতের মহিকীর্তণও শুরু হতে পারে। এটাকে অসম্ভব ভাববেন না। বুর্জোয়া গণতন্ত্রে সবই সম্ভব, সে মোটেই সংকীর্ণ-চিত্ত নয়, অনেক অনেক উদার।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments