Saturday, November 23, 2024
Homeসাম্যবাদবাণিজ্যিকীকরণের আগ্রাসনে বিপন্ন চিকিৎসার অধিকার

বাণিজ্যিকীকরণের আগ্রাসনে বিপন্ন চিকিৎসার অধিকার

সাম্যবাদ প্রতিবেদক
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন আপাদমস্তক সংকটে জর্জরিত। সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন এখানে অসম্ভব। এমনকি মৃত্যুও এখানে অস্বাভাবিক, ভয়াল, বিভৎস যার নজির আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি। মানুষ অসুস্থ হয়ে ডাক্তার-হাসপাতালের শরণাপন্ন হয় সুস্থতার আশায় – সেখানেও পদে পদে বিঘ্ন-ভোগান্তি। এই ভোগান্তি এতই চরম যে মানুষ ভাবে, এর চেয়ে মৃত্যুই ভালো! সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা পর পর এমনভাবে ঘটেছে যে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ভঙ্গুর-জীর্ণ চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর একদিকে আছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণের সর্বগ্রাসী থাবা, আর অন্যদিকে আছে আস্থা-ভরসার প্রবল সংকট।
একের পর এক বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে ডাক্তার-রোগী-সাংবাদিকদের মধ্যকার সংঘর্ষের ঘটনা সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। এ তালিকায় আছে দেশের প্রধান হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বারডেম, মিটফোর্ড, ময়মনসিংহ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এছাড়া ঢাকার শিকদার মেডিকেল কলেজে একজন ডাক্তারের নেতৃত্বে একজন একজন সাংবাদিককে পিটিয়ে আহত করার খবর এসেছে। এসব ঘটনার জের ধরে চিকিৎসক-সাংবাদিক সমাজ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছেন। একে অপরকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচার দাবি করছেন। চিকিৎসকরা হামলার বিচারের দাবিতে প্রতিবাদে নেমেছেন, তারা কর্মবিরতি পালন করছেন। আর মাঝখান থেকে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ।
এর পাশাপাশি চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে পিজি হাসপাতাল বলে পরিচিত সরকারি হাসপাতালকে বঙ্গবন্ধুর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে দেশের শীর্ষ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। সেখানকার শিক্ষার্থী-কর্মচারী এবং বামপন্থীসহ সচেতন মহলের প্রতিবাদের মুখে সরকার সে পরিকল্পনা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে। প্রতিবাদ চলছে চট্টগ্রামেও। সেখানে বামপন্থীদের নেতৃত্বে সচেতন নাগরিকদের নিয়ে গড়ে ওঠেছে ‘চট্টগ্রাম জনস্বাস্থ্য অধিকার রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ’।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এই দুটি চিত্র আপাত ভিন্ন মনে হতে পারে। কিন্তু আমরা মনে করি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই বিপন্ন বেহাল দশার উৎস মূলত এক জায়গায় – সেটি হল বাণিজ্যিকীকরণের আগ্রাসন। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সমস্ত ধরনের সেবামূলক খাতগুলোকে বাণিজ্যিকীকরণের হাতে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এর পরিণতিতে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিকার জনগণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব খাতে ব্যাপক হারে ব্যবসায়ী পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটায় শিক্ষক, চিকিৎসকের মতো শ্রদ্ধা ও সম্মানের পেশাগুলোও আর আগের জায়গায় থাকতে পারছে না। পাশাপাশি, এসব পেশায় নিয়োজিত কিছু কিছু মানুষের আচরণ গোটা পেশাকেই কলঙ্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে।
সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসমূহকে পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জনগণের প্রতিবাদ সত্ত্বেও চট্টগ্রাম ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর পূর্বে ২০১১ সালে একইভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু কলেজের ছাত্র-কর্মকর্তা-কর্মচারি ও বামপন্থীদের প্রতিবাদের মুখে তা বাতিল করতে সরকার বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু জনগনের স্বাস্থ্য অধিকার হরণের এ চক্রান্ত বন্ধ হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জনগণের চিকিৎসা সেবা উন্নত করার স্বার্থে মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসমূহকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হচ্ছে। এতে কেউ কেউ বিভ্রান্তও হচ্ছেন। কিন্তু সত্য হচ্ছে বিপরীত। কারণ বাস্তবে সরকার ব্যবসায়ীদের স্বার্থে স্বাস্থ্যখাতকে বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণ করার জন্যই এ পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এ বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। গত শতকের ৮০-এর দশক থেকে নয়া উদারনীতিবাদ, বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি ইত্যাদি নীতির কথা বিশ্বজুড়ে বেশ জোরেশোরে শোনা যেতে থাকে। বাংলাদেশেও এসব কথা অত্যন্ত মুখরোচক ভঙ্গিতে প্রচার করা হয়। এসব নীতির মূল কথা কি? এগুলো মূল কথা হল, এতদিন রাষ্ট্র জনগণের যেসব অধিকারের সুরক্ষা দিত, দায়িত্ব নিত, এখন আর রাষ্ট্র সে দায়িত্ব পালন করবে না। সব তুলে দেয়া হবে পুঁজির হাতে, ব্যবসায়ীদের হাতে। এ কাজটি তো আর এক ধাক্কায় করা যাবে না, তাহলে সমাজে এর প্রতিক্রিয়া হবে তীব্র। তাই ধীরে ধীরে বিষয়টিকে সহনীয় ও গ্রহণীয় করার মাধ্যমে এই বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণ প্রক্রিয়া চালু করা হয়। এ উদ্দেশ্য থেকেই একদিকে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পরিবহন ইত্যাদি জনসেবামূলক খাতে সরকারগুলো বাজেট কমাতে শুরু করে। এর সাথে শুরু হয় নানা ধরনের চক্রান্ত — যার ফলে সরকারি হাসপাতাল-স্কুল-কলেজগুলোতে সেবার মান পড়তে থাকে। মানুষ সরকারি হাসপাতাল-স্কুল-কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। নিতান্ত গরিব না হলে আর কেউ সরকারি হাসপাতালে যায় না। নিতান্ত বাধ্য না হলে আর কেউ ছেলেমেয়েদের সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পাঠায় না। এই বহুমুখি আক্রমণে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব খাতগুলো বিশেষত শিল্প-কারখানা ইত্যাদি ধ্বংস হয়ে গেছে। এ প্রক্রিয়ার পরের ধাপে শুরু হয় এসব রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে কথিত আধুনিকায়ন ও উন্নত করা এবং সেবার মান বাড়ানোর উদ্যোগ। নতুন করে নানা ধরনের ফি আরোপ, পুরনো নামমাত্র ফি-গুলোকে বাড়ানোর মাধ্যমে এসব সেবাকে ব্যয়বহুল করে তোলা হতে থাকে। বর্তমানে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয় করার যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে, এটা ওই প্রক্রিয়ারই অংশ।
পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব এই তথাকথিত উদারীকরণ-মুক্তবাজারের নীতি কেন চালু করেছে সেটা আমরা জানি। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বব্যাপী যে স্থায়ী অর্থনৈতিক মন্দা চলছে তাতে এসব দেশে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমাগত কমছে, বেকারত্ব বাড়ছে। মানুষের যেহেতু ক্রয় ক্ষমতা নেই তাই বাজার সংকুচিত। ফলে পুঁজিপতিদের কাছে যে বিপুল পরিমাণ পুঁজি সঞ্চিত হয়ে আছে সেগুলো শিল্প-কারখানা স্থাপনে ও উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ করতে পারছে না, কারণ এতে মুনাফা অনিশ্চিত। কিন্তু এ পুঁজি অলস পড়ে থাকলেও চলছে না। তাই তারা পুঁজি বিনিয়োগের নানা রাস্তা বের করেছে — কখনো মাইক্রো ক্রেডিটের নামে, কখনো উদারীকরণের নামে, কখনো মুক্তবাজারের নামে।
আমাদের দেশটিও তো এই বিশ্ব পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থারই অভিন্ন অংশ। এখানকার শাসকগোষ্ঠীও এই একই কারণে তথাকথিত মুক্তবাজার-নয়া উদারীকরণ ইত্যাদি নীতি অনুসরণ করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কল-কারখানা, ব্যাংক-বীমা-পরিবহন, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সবই এই নীতির আওতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে ও সহায়তায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রায় ৬০০০ শিল্প-কারখানাকে ধাপে ধাপে বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণের বিনিময়ে ৩০ হাজার শ্রমিককে বেকার করে, পাটচাষীদের গলায় ফাঁস দিয়ে আদমজী পাটকল বন্ধ করা হয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে যেটুকু বাকি আছে, সেটাকেও গ্রাস করার পরিকল্পনাই এখন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় একেবারে প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সর্বত্র বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণের নানা পরিকল্পনা-প্রকল্প বাস্তবায়ন চলছে।
বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ হ্রাসের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসমূহকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ নিয়েছে। গত ৫ বছরে জাতীয় বাজেটে ধারাবাহিকভাবে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ কমেছে : ২০০৯-’১০ সালে ৬.৩৩%, ২০১০-’১১ সালে ৬.১৯%, ২০১১-’১২ সালে ৫.৬৪%, ২০১২-’১৩ সালে ৫.৫১%, ২০১৩-’১৪ সালে ৪.২৭% বরাদ্দ ছিল স্বাস্থ্যখাতের জন্য। দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য চিকিৎসক আছে মাত্র ৬১,৫১২ জন অর্থাৎ ২,৬৫৯ জনের জন্য ১ জন্য মাত্র চিকিৎসক! দেশে বেসরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ২,৯৬৬টি এবং সরকারি হাসপাতালে সংখ্যা মাত্র ৫৭৮টি! সরকারি হাসপাতালে শয্যা রয়েছে ৬৫,৪৭০টি আর বেসরকারি হাসপাতলে শয্যা রয়েছে ৫৩,৪৪৮টি। দেশে স্বাস্থ্যসেবার সংকট কাটাতে সরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন হাসপাতাল স্থাপন করা হচ্ছে না কিন্তু তার বিপরীতে গড়ে উঠছে শত শত প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতাল। দেশে সরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ২২টি কিন্তু বেসরকারি মেডিকেল কলেজ আছে ৫৪টি। এভাবে স্বাস্থ্যখাতে ক্রমাগত সরকারি উদ্যোগ কমিয়ে দেয়ার মাধ্যমে দেশের ধনীক গোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে বাণিজ্য করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫(ক) অনুসারে চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এবং অনুচ্ছেদ ১৮(১) অনুযায়ী জনগণের পুষ্টির মান উন্ন্য়ন ও জনস্বাস্থের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মৌলিক কর্তব্য। কিন্তু রাষ্ট্র এ দায়িত্ব পালন না করে বরং স্বাস্থ্যখাতকে বেসরকারিকরণের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। চিকিৎসা এখন আর সেবা নয়, পণ্যে পরিণত হয়েছে — ফেল কড়ি, মাখো তেল।
সম্প্রতি মহাজোট সরকার কর্তৃক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষরেরও অন্যতম বিষয় হচ্ছে শিক্ষা-স্বাস্থ্য সহ সেবাখাতগুলো থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া। বিশেষ করে টিকফা চুক্তির মেধাস্বত্ত্ব সংরক্ষণ আইন সংক্রান্ত ধারাটি সরাসরি দেশের ঔষধ শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ঔষধের দাম বহুগুণে বেড়ে যাবে। দেশে তৈরী হওয়া প্রায় সব ঔষধের প্রস্তুতপ্রণালীর মালিকানা বা পেটেন্ট অন্য দেশের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের। বর্তমানে প্রায় ৩০০টি ঔষধ প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান দেশের প্রায় ৯৭% ঔষধ তৈরী করছে। টিকফা চুক্তির ফলে মেধাস্বত্ত্ব আইনের প্রয়োগ হলে বাংলাদেশ আর পেটেন্টেড ঔষধগুলো তৈরী করতে পারবে না। ফলে বিদেশ থেকে আমদানীকৃত ঔষধ চড়া দামে দেশের মানুষকে কিনতে হবে। দেশে ঔষধ উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও ঔষধ শিল্পের মালিকরা সিন্ডিকেট করে প্রতিনিয়ত ঔষধের দাম বাড়িয়ে চলেছে। আর টিকফা চুক্তির ফলে বিদেশ থেকে আমদানী করতে হলে গরিব মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থাকলেও ঔষধের দাম তারা নির্ধারণ করে না, করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে ঔষধ কোম্পানিগুলো প্রতিযোগিতা করে ঔষধের দাম বাড়াচ্ছে।
দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতারা, মন্ত্রী-এমপি-আমলা-ব্যবসায়ীরা সামান্য সর্দি-জ্বর হলেই আমেরিকা-সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক ছুটে যায়। কিন্তু জনগণের বৃহত্তম অংশ গরিব-সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল সরকারি হাসপাতালগুলো। যেখানে একজন শ্রমিককে মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে পরিবার নিয়ে গোটা মাস চলতে হয়, সেখানে প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে হাজার হাজার টাকা খরচ করে তার পক্ষে চিকিৎসা নেয়া আকাশকুসুম কল্পনা। তাই গরিব মানুষেরা একেবারে মরনাপন্ন না হলে চিকিৎসকের কাছে যান না। ২০০৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হতো। কিন্তু ২০১০ সালে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালগুলোতে ২৩টি ক্যাটাগরিতে ৪৭০টি আইটেমের উপর ‘ইউজার ফি’-এর নামে চিকিৎসা সেবার মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রস্তাবনায় যা বলা হয়েছে তা হলো, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে বিভিন্ন টেস্টের মূল্য ধার্য করতে হবে। এতে প্রতিটি টেস্টের মূল্য বাড়বে, ক্ষেত্র বিশেষে তিন থেকে চারগুণ বাড়বে। বলা হয়েছে, বিনামূল্যের বা নামমাত্র মূল্যের আইসিইউ সেবা এবং রেডিওথেরাপি, এক্সচেঞ্জ ব্লাড ট্রান্সফিউসন সেবাসহ স্বল্পমূল্যের বা বিনামূল্যের সব সেবা বন্ধ করে দিয়ে সেবা ফি নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে করা হলে আইসিইউ-তে থাকার জন্য রোগীদের প্রতিদিন একশত টাকার বদলে এগার হাজার টাকা দিতে হবে, প্রতিটি অপারেশনের জন্য দিতে হবে আট হাজার টাকা যা এখন বিনামূল্যে করা হয়। প্রতি ক্ষেত্রেই রোগীদের উচ্চমূল্য দিতে হবে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে মেডিকেল কলেজ ও চমেক হাসপাতালের আয় বছরে সাড়ে চার কোটি টাকা। সরকার দেয় প্রায় ৫৪ কোটি টাকা (২০১০-’১১ সালের হিসাব অনুযায়ী)। মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করলে এই আয় দাঁড়াবে ৬০ কোটি টাকা। ফলে সরকারকে আর টাকা দিতে হবে না। বলা নিস্প্রেয়োজন, এই আয় হবে রোগীদের কাছ থেকে। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হবে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো করতে গেলে এখানে ইমারজেন্সি থাকবে না, ১৩০০ বেডের বিপরীতে ২২০০-২৩০০ রোগী ভর্তি করা যাবে না। যেমনটি হয়েছে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। চট্টগ্রাম বা রাজশাহী মেডিকেল কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা হলে একই পরিণতি হবে। এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে বিপদে পড়বে ওই অঞ্চলের লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষ।
চিকিৎসা, শিক্ষকতা এগুলো মহৎ পেশা হিসাবেই বহু কাল ধরে স্বীকৃত। কিন্তু এসব পেশার মানুষেরা ক্রমাগত বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনটি হারিয়ে ফেলতে বসেছেন। সমাজের প্রতি, রোগীর প্রতি যে দায়িত্ব ও দরদ একসময় চিকিৎসকরা অনুভব করতেন, বাণিজ্যিকীকরণ ও মুনাফাবৃত্তির কবলে সে-সব আজ বিলুপ্তির পথে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে দলবাজী। বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ এ দলবাজীর চ্যাম্পিয়ান। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় এসব দলবাজ চিকিৎসকদের ভূমিকাই দেখা গেছে। এই অল্প কিছু দলবাজ চিকিৎসক এবং তাদের গুন্ডামী মাস্তানীর জন্য গোটা চিকিৎসক সমাজই কালিমালিপ্ত হচ্ছেন।
আজ চিকিৎসা সেবা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার যে ভঙ্গুর ও নাজুক চিত্র প্রকট হয়ে উঠেছে তাতে চিকিৎসক সমাজ, সাধারণ মানুষ সকলেই উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগকে যথাযথ সম্মান দিয়েই আমরা বলতে চাই, এ অবস্থার পেছনের কারণগুলো বোঝার চেষ্টা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। প্রতিকারের যথার্থ পথ অনুসন্ধানের চেষ্টা করাও আমাদের কর্তব্য। দিনের পর দিন আমাদের চোখের সামনেই শিক্ষা-চিকিৎসা সেবাকে মুনাফাবৃত্তির হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আমরা নিরবে এটা দেখেছি, মেনে নিয়েছি। আর আজ যখন সেই মুনাফাবৃত্তির কলুষিত কদর্য চেহারা প্রকাশিত হচ্ছে, তখন কখনো বিক্ষুব্ধ হচ্ছি, কখনো অসহায়ের মতো আক্ষেপ করছি। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে ব্যবসায়ীদের মুনাফাবৃত্তির যে পরিকল্পনা শাসকগোষ্ঠী এবং সরকার বাস্তবায়ন করতে চাইছে, সেটা রুখে না দাঁড়ালে চিকিৎসক সমাজও মর্যাদা ও সম্মানের আসন ফিরে পাবেন না। এ কথাটা সমাজের অপরাপর সকল অংশের মানুষ, বিশেষত গরিব সাধারণ মানুষকেও ভাবতে হবে। স্বাস্থ্যখাতসহ সব ধরনের সেবাখাতকে বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণের কবল থেকে রক্ষার লক্ষ্যে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়া নিজেদের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যাবে কি?

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments