পরীক্ষা মানে শুধু শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নয়, পুরো শিক্ষাপদ্ধতিরই পরীক্ষা। এর মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী কতটুকু গ্রহণ করতে পারল তা যেমন যাচাই হয়, তেমনি পুরো শিক্ষাব্যবস্থা তাকে কতটুকু শেখাতে পারল তাও যাচাই হয়। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার সাথে যুক্ত শিক্ষক, সিলেবাস-কারিকুলাম, পাঠদান পদ্ধতি, শিক্ষা প্রশাসন, সরকারের শিক্ষানীতিসহ সমগ্র ব্যবস্থার ভূমিকা গৌণ হয়ে গিয়ে শুধু শিক্ষার্থীর মূল্যায়নটি পরীক্ষাপদ্ধতির মূল বিষয় হিসেবে গণ্য হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীর ভালো রেজাল্টই হয়ে উঠেছে শিক্ষার্থীদের ধ্যান-জ্ঞান, জীবনপণ লক্ষ্য। যে শিক্ষকের কাছে ভালো নম্বর পাওয়ার সম্ভব বা যে কোচিং এ পড়লে শতভাগ গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়া যায়, সে প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ বেতন হাঁকাতে শুরু করে। অন্যদিকে স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক চাকুরির পরীক্ষাগুলোতে কোচিং বা গাইড বই লেখকদের শতভাগ নিশ্চয়তাসহ সাজেশনের প্রচার দিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য। এ সমস্ত কোচিং সেন্টার এবং গাইড বই লেখকদের সাথে সরকারের উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অনেক পুরনো। দীর্ঘদিনের প্রশ্রয় এবং এই প্রক্রিয়া চলতে চলতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা মহামারী রূপ নিয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বর্তমান সরকারের দলীয়করণ-দুর্নীতি।
সম্প্রতি প্রশ্নপত্র ফাঁসে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনী পরীক্ষা এমনকি বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্যের খবর পত্রিকায় এসেছে। অতীতেও যখন এই ঘটনা ঘটেছে তখন সরকারের পক্ষ থেকে তা স্বীকার করা হত না। ফলে প্রশ্নপত্র যে একটি গুরুতর শাস্তিযোগ্য অপরাধ এটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, জড়িতদের শাস্তিও হয়নি। এবারও একের পর সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও সরকার প্রথমে এটাকে গুজব বলে চালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় ব্যাপকভাবে খবরটি আসা শুরু করলে শিক্ষামন্ত্রী বলা শুরু করলেন, ‘এটা তাকে সরানোর ষড়যন্ত্র।’ কোচিং ব্যবসায়ীরা নাকি তার বিরুদ্ধে লেগেছে। ফেসবুকে একটি বিশেষ পেজ-এর মাধ্যমে এসব প্রশ্নপত্র কেনা-বেচা খবর ছাত্র-অভিভাবকদের মুখে মুখে। প্রশাসন চাইলেই এসব সাইবার অপরাধীদের ধরতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে সবাই নীরব। এজন্য অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, আসলে কি প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে নাকি প্রশ্ন ফাঁস হতে দেয়া হচ্ছে?
প্রশ্ন ফাঁসের ফলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে ছোট ছোট কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের। অনেকের বাবা-মা কিংবা শিক্ষক পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্নগুলো তাদের হাতে তুলে দিয়ে সেটা পড়াচ্ছেন। পরদিন পরীক্ষায় গিয়ে তারা দেখছে হুবহু সব প্রশ্ন মিলে গেছে। শিশুরা যখন দেখছে যে একটা অপরাধ বা অন্যায়ের সাথে তাদের বাবা-মা-শিক্ষক যুক্ত হয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের মধ্যেও একটা নীরব অবক্ষয়ের বিষ ছড়িয়ে পড়ছে। এর চেয়ে বড় ক্ষতি আর কি হতে পারে? একজন অভিভাবক বলেছেন. ‘আমি যদি আমার সন্তানের জন্য প্রশ্ন যোগাড় না করি, তাহলে তার রেজাল্ট খারাপ হবে। কিন্তু বাকিরা প্রশ্ন পেয়ে রেজাল্ট ভালো করবে। আমি কি আমার সততা রক্ষা করার জন্য ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করব?’ এই অনিশ্চিত সমাজে ভবিষ্যৎ যখন শুধু ভাল রেজাল্ট আর ভাল উপার্জনের উপরই নির্ভর করে, তখন অনৈতিকভাবেই পাস করাটা জায়েজ হয়ে যাচ্ছে। আসলে এভাবে সমস্ত ধরনের অনৈতিকতাই জায়েজ হয়ে যাচ্ছে। যে জাতি এভাবে সমস্ত ধরনের অনৈতিকতাকে জায়েজ করে দিয়ে চলেছে, তার পক্ষে কি নিজেদের ওপর চেপে বসে থাকা অন্যায় শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব?
প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ করার জন্য ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, হয়ত কিছুদিনের জন্য বন্ধও করা যাবে। কিন্তু শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করার লাগামহীন ঘোড়া যেভাবে ছুটছে তাকে থামানো না গেলে বিচ্ছিন্নভাবে প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা যাবে না। আমরা জানি ব্যবসা মানেই মুনাফা। শিক্ষা যখন মুনাফার হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িত উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সকলের মধ্যেই নীতিহীন মুনাফার মনোবৃত্তি ছড়িয়ে পড়ে। তাই বাণিজ্যিকীকরণের সর্বগ্রাসী নীতি থেকে সরে এসে শিক্ষার সর্বজনীন অধিকারের নীতিতে প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া এই নৈতিক অবক্ষয় থেকে জাতিকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বাণিজ্যিকীকরণেরই ফলাফল
RELATED ARTICLES