– সাম্যবাদ প্রতিবেদন –
ফুটবলটা আগে ছিল শিল্পের, সৌন্দর্যের। এক পা থেকে আরেক পা, কখনও পেছনে, কখনও সামনে – প্রতিপক্ষকে কাটিয়ে, ড্রিবলিং করে, বোকা বানিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছেন খেলোয়াড়েরা। কিংবা ম্যারাডোনা বল নিয়ে যাচ্ছেন; একজন, দুজন, তিনজন পরাস্ত। চতুর্থজন পরিষ্কার মাঠেই খেলেন আছাড়, ড্রিবলিং ট্যাকল করতে গিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। স্নায়ু যেন মুহূর্তের জন্য স্থির হতে চায়না। কি ঘটতে যাচ্ছে এর পর মুহূর্তে? কি হবে শেষ পর্যন্ত?
শেষে কি হতো তখন? দল জিতুক আর হারুক, তৃপ্তি নিয়ে মাঠ থেকে বের হতেন দর্শকেরা। ড্রিবলিং, ট্যাকল, পাস – এই সবের যে দক্ষতা, যে ছন্দ, যে পরিপাট্য, যে ক্ষিপ্রতা তা বহু সময় পর্যন্ত মনে গেঁথে থাকত। মাথা থেকে সরতে চাইতো না। যেন এক গানের আসর থেকে উঠে এলেন – সুরের, ভাবের তন্ময়তা এখনও কাটেনি।
এখন ফুটবলটা কেমন? কিংবদন্তি ফুটবলার ম্যারাডোনা বলেছেন, “ফিফা আসলে বলটা গিলে খাচ্ছে।” তিনি একথা বলেছেন এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেখিয়ে। দক্ষিণ আমেরিকার টেলিভিশন চ্যানেল টেলেসারের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে ম্যারাডোনা বলেছেন, “ফিফা সম্পূর্ণরূপেই একটি নৈতিকতা বিরোধী প্রতিষ্ঠান। এবারের বিশ্বকাপ থেকে তারা আয় করবে ৩০০ কোটি ইউরো, আর তারা চ্যাম্পিয়ন দলকে দেবে ২ কোটি ৬০ লাখ ইউরো। অর্থের এই বিশাল ব্যবধানটা কারোরই বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। আর ফিফা এই অর্থগুলো নিচ্ছে কোনকিছু না করেই।” বলে রাখা ভাল, এই খেলোয়াড় তার খেলোয়াড়ি জীবনে ফিফার এ ধরনের অপকর্মের বিরুদ্ধে লড়েছেন। খেলোয়াড়দের অ্যাসোসিয়েশনও তৈরি করেছিলেন।
ব্রাজিল বিশ্বকাপে ফিফা আয় করেছে ৪ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ডলার। অংশগ্রহণকারী সবগুলো দেশের মোট প্রাইজমানির পরিমাণ ৪০০ মিলিয়ন ডলার। বাকি টাকা পুরোটাই চলে গেছে ফিফার তহবিলে। এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপে খরচ হবে ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেখানে গত তিন বিশ্বকাপ আয়োজনে খরচ হয়েছিল মোট ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ব্রাজিল সরকার এই টাকা যোগাতে জনগণের উপর আলাদা কর আরোপ করেছে। বেড়েছে বাসের ভাড়া, জিনিসপত্রের দাম। ব্রাজিলের ফুটবলপ্রিয় জনতা বিশ্বকাপের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। মনে রাখা দরকার এটা সেই দেশ যেখানে একটা ছোট বাচ্চাও পেলে কিংবা গারিঞ্চা হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
এই বিশাল খরচে ব্রাজিল সরকারের সহযোগী ফিফা, জার্মান বহুজাতিক কোম্পানি এডিডাস ও আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানি নাইকি। বলাবাহুল্য এরা বিশাল লাভের সম্ভাবনা না দেখলে এত টাকা বিনিয়োগ করতো না।
শুধু টিকেট বিক্রিই এই বিশ্বকাপের আয় নয়। মাঠের চারপাশে বিজ্ঞাপন, জার্সিতে বিজ্ঞাপন, সম্প্রচার সত্ত্ব বিক্রি এরকম অসংখ্য রাস্তা আছে অর্থ উপার্জনের। এমনকি বিশ্বকাপ চলাকালে কে কি ব্র্যান্ডের ইলেক্ট্রিক্যাল সামগ্রী ব্যবহার করবে তাও ছিল নির্ধারিত। নির্ধারিত ব্র্যান্ডের বাইরে হেডফোন ব্যবহার করায় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার নেইমারকে জরিমানা করা হয়েছে।
প্রতিটি ম্যাচকে কেন্দ্র করে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের জুয়া হয়েছে। কালো বাজারে টিকেট বিক্রির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। তিনটি দেশের ফুটবল ফেডারেশনের এতে জড়িত থাকার সন্দেহ করা হচ্ছে। ফিফা নিজেও দুর্নীতিগ্রস্ত। ২০১৮-এর বিশ্বকাপ কাতারে অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে কাতারের তেল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বড় অংকের ঘুষ নেয়ার অভিযোগ এসেছে ফিফার বিরুদ্ধে।
খেলোয়াড়েরাও এখন ব্যবসার কাছে বন্দি। বড় বড় খেলোয়াড়রা বড় বড় ক্লাবের কাছে চুক্তিবদ্ধ। পুরো কর্পোরেট ওয়ার্ল্ড তাদের কেনে-বেচে, মানুষের কাছে আইকন করে তুলে Ñ সবই তাদের ব্যবসা। আজ সারা দুনিয়ায় ব্যবসায় মন্দা। বড় বড় কোম্পানিগুলো ধুঁকছে, কখন বন্ধ হয়। তাই নতুন নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করা তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম। যেখানেই মানুষ জড়ো হয় সেখানেই টাকা খাটাও। খেলাকেও তারা তাই ব্যবসার হাতিয়ার করেছে। আর তাই খেলা থেকে সৌন্দর্য্য বিদায় নিচ্ছে। কারণ ব্যবসার মূল লক্ষ্য সৌন্দর্য্য নয়। তার লক্ষ্য লাভ। শিল্পীর লক্ষ্য সৌন্দর্য্য। খেলা যদি ব্যবসার জন্য হয় তাহলে লাভের উদ্দেশ্যেই খেলা হবে। ব্যবসা সৌন্দর্য্যকে বিকশিত হতে দেবেনা। আর তখন যারা এর সাথে যুক্ত হবে প্রত্যেকেই নিজের ব্যক্তিগত লাভের চিন্তাই করবে।
এককালে খেলাধুলা এসেছিল ক্লান্তি থেকে মানুষকে বিরাম দেয়ার জন্য, অবসাদ দূর করার জন্য। এটা সৃষ্টিশীলতা বাড়ায়, দেহ ও মনকে প্রফুল্ল রাখে। নতুন কর্মোদ্দীপনা তৈরি করে। এখনও মানুষ আনন্দের জন্যই খেলা দেখতে চায়। কিন্তু কর্পোরেটদের হাতে পড়ে খেলা হয়ে গেছে ‘শো বিসনেস’, ‘এন্টারটেইনমেন্ট প্যাকেজ’। যে উদ্দেশ্যে খেলাধুলা সৃষ্টি হয়েছিল তাকেই তারা মেরে দিয়েছে।
শুধু ফুটবল নয়, সব খেলারই আজ একই দশা। আমাদের ছোট দেশটাতেও ক্রিকেট নিয়ে যা হয়ে গেল তা ভীষণ লজ্জার। এরপরও কোন খেলা পূর্ণ বিশ্বাসে দেখা যাবে কি? সবকিছুকেই কি আজ সন্দেহ করতে হবে? টাকা পেলে মানুষ কি সব করতে পারে?
পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মৃত্যুর দরজায়। সে মরছে, সাথে সাথে মারছে বিবেক, মনুষ্যত্ব; মারছে মননজগতের বিকাশের সকল ক্ষেত্র Ñ সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাটক, সিনেমা, গান, এমনকি খেলাকেও।
[ভারতের এসইউসিআই(কমিউনিস্ট) পার্টির ইংরেজী মুখপত্র ‘প্রলেতারিয়ান এরা’র একটি লেখা অবলম্বনে রচিত]