Saturday, November 23, 2024
Homeফিচারতোবা গার্মেন্ট শ্রমিকদের সাহসী লড়াইয়ের পথে এগিয়ে আসুন

তোবা গার্মেন্ট শ্রমিকদের সাহসী লড়াইয়ের পথে এগিয়ে আসুন

Toba_DLA

– সাম্যবাদ প্রতিবেদক –
[dropcap]অ[/dropcap]বশেষে তোবা গ্রুপের তোবা ফ্যাশন, বুকশান গার্মেন্টস, তাইফ ফ্যাশন, তোবা টেক্সটাইল ও মিতা ডিজাইনের ঈদের দিনসহ এগারো দিন ধরে অনশনকারী শ্রমিকরা লাঠিচার্জ-পিপার স্প্রে-টিয়ারশেল (ট্রেডইউনিয়ন এবং বাম নেতাদের ওপর পুলিশি আক্রমণ-গ্রেফতারের ঘটনাও ঘটেছে) অশ্লীল অশ্রাব্য গালিগালাজসহ ১৪৯৫ জন শ্রমিক বেতন পেল।
এই পরিস্থিতিকেই দেশের সরকার ও তার মন্ত্রী পরিষদ শ্রমিক-বান্ধব পরিবেশ ঘোষণা করে ইউরোপ ও আমেরিকার কাছে গার্মেন্ট সেক্টরে জিএসপি সুবিধা দাবি করে আসছে।
এবার দেখা যাক শ্রমিকরা কি করেছিল। শ্রমিকরা বকেয়া বেতন-ভাতা দাবি করেছিল। গত চার মাস ধরে তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে না। বোনাস এবং ওভারটাইম দেয়া হচ্ছে না। এ শ্রমিকরা গত দুই মাসে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের জার্সি তৈরি করেই মালিকের জন্য ষোল কোটি টাকা আয় করেছে। অথচ কারখানার সমস্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি সাড়ে চার কোটি টাকার বেশি নয়। ফলে যথাসময়ে শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধে মালিক পক্ষের বাস্তবতার দোহাই কুযুক্তির অবতারণা, নিছক ছল-চাতুরী ছাড়া আর কিছু নয়। এটা শুধু বিশেষ কারখানার বিশেষ মালিকের বেলায় ঘটছে কি? সুযোগ পেলে শ্রমিকের পাওনা টাকা মেরে দিতে কোনো মালিকই কসুর করে না। এক্ষেত্রে প্রচলিত আইন-কানুন বিধি-বিধানের তারা ধার ধারে না। আইনের রক্ষাকর্তা সেজে যারা বসে আছেন সরকারের সমস্ত নীতিশাস্ত্রের গুরুঠাকুরেরা মালিকের পিছু পিছুই চলেন।
আমাদের খেয়াল করতে হবে, শ্রমিকের পাওনা পরিশোধে প্রতারণা-গড়িমসি শুধু একটা মালিকের বিষয় নয়। এবারের ঈদেও কালিয়াকৈরের বাড়ইপাড়াতে শ্রমিক বেতন পায়নি, চন্দ্রাতে বেতন পায়নি, জয়দেবপুরের বাসন সড়কের এক কারখানায় পুরনো মেশিন বিক্রি করে বেতন দিতে মালিককে বাধ্য করা হয়েছে। এই কারখানাতেও কথিত যে, তাজরিন ফ্যাশনের ইনস্যুরেন্সের টাকা তুলে মালিক আত্মসাৎ করেছে। একজন মানুষকে হত্যা করলে আইনে তার মৃত্যুদ- প্রাপ্য হয়, অথচ এই দেলোয়ারই ১১১ জন শ্রমিককে তাজরিনে পুড়িয়ে মারার পর বহাল তবিয়তে ঘুরছিল। এবং সে সময় দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের হাইকোর্টে মামলা করার প্রেক্ষিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল বটে কিন্তু অল্প দিনেই বের হয়ে সরকারের দুই শীর্ষ মন্ত্রীর সঙ্গে দেশের সেরা হোটেলে বসে মিটিং করেছে। এটাকে কি আইনের শাসন বলা যাবে? আর এবার তোবা শ্রমিকদের জিম্মি করে তাকে জেল থেকে বের করে নিয়ে আসা হল।
বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস এম মান্নান কচি ঈদের এক পক্ষ কাল পূর্বেই অঙ্গীকার করেছিলেন যে এক সপ্তাহের মধ্যেই তোবার শ্রমিকদের বকেয়া পাওনার আংশিক তারা পরিশোধ করবেন। এরও আগে বিজিএমইএ ও মালিকপক্ষ বার বার বেতন বোনাস পরিশোধ করার লিখিত ও মৌখিক অঙ্গীকার করে তা ভঙ্গ করেছে। শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমে ইতোপূর্বে রাস্তায় মার খেয়েছে, রাবার বুলেট খেয়েছে। বিজিএমইএ-তে গিয়েছে, শ্রম মন্ত্রণালয়ে গিয়েছে, অতঃপর ২৬ জুন ’১৪-তে তোবা গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার মিতা, বিজিএমইএ-র প্রতিনিধি ফয়েজ আহমেদ, রফিকুল ইসলাম-এর উপস্থিতিতে বিজিএমইএ-র নেতা আব্দুল আহাদ আনসারী লিখিত অঙ্গীকার করেছিল যে মে মাসের মজুরি ৩ জুলাইয়ের মধ্যে, জুন মাসের মজুরি ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে এবং ঈদ বোনাস ও জুলাই মাসের ১৫ দিনের মজুরি ২৬ জুলাইয়ের প্রদান করা হবে। কিন্তু এরা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ঈদের পূর্ব দিন পর্যন্ত শ্রমিকদের কাজ করিয়ে কোন টাকা পয়সা না দিয়ে এক নিদারুণ অমানবিক পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। যে শ্রমিক স্বপ্ন দেখেছিল ঈদে বাচ্চাকে একটা লাল জামা কিনে দেবে, স্বামী-সন্তান-বাবা-মাসহ সেমাই-চিনি কিনে ঈদ করবে, চাঁদ রাতে তাদের সামান্য স্বপ্নসাধ ধুলিস্যাৎ হবার প্রেক্ষাপটে তাৎক্ষণিকভাবে তিনশতাধিক শ্রমিক গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের নেত্রী মোশরেফা মিশু-র নেতৃত্বে গণঅনশন শুরু করেন। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের ফেডারেশনসহ আরও তেরটি ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন এই আন্দোলন সমর্থন করার ফলে পরবর্তী দিন ১৫টি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন নিয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্ল্যাটফরম গড়ে ওঠে যার নাম তোবা গার্মেন্টস শ্রমিক সংগ্রাম কমিটি। তারা মোট পাঁচটি দাবি উত্থাপন করে : (১) অবিলম্বে তোবা গ্রুপের সকল শ্রমিকদের বেতন, ওভারটাইম, বোনাস সম্পূর্ণ পরিশোধ করতে হবে। (২) তোবা গ্রুপের সকল কারখানা সচল কর, শ্রমিকদের নিয়মিত কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। (৩) খুনি মালিক দেলোয়ারের জামিন বাতিল ও সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। (৪) তাজরিন গার্মেন্টস এর নিহত আহত শ্রমিকদের চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। (৫) আন্দোলনরত শ্রমিকদের শারিরীক-মানসিক-আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
এই পাঁচটি দফার মধ্যে নানা নাটকীয়তার শেষে তোবা গ্রুপের শ্রমিকরা এক নম্বর দাবিটি মাত্র আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। বাকি দাবিগুলো আদায় করার সংগ্রাম এখনো জারি আছে।
রানা প্লাজা ভবন ধসে বারোশত শ্রমিকের মৃত্যুর পর এখনও হাজারো শ্রমিক রাষ্ট্রের কিংবা বিজিএমইএ-র কিংবা ক্রেতা প্রতিষ্ঠান কিংবা বিদেশি মালিকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পেল না। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা হলো ১২৭ কোটি টাকা। অত্যন্ত অস্বচ্ছ এবং বিশৃঙ্খলভাবে মুখ চিনে ৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। আরো ১২২ কোটি টাকা বরাদ্দের জন্য থাকলেও আজো কাউকে না দেওয়ায় রানা প্লাজার আহত, পঙ্গু, কর্মহীন শ্রমিকরা এবং তাদের নিহত শ্রমিকদের এতিম সন্তানরা ঈদ করতে পারল না। অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রী এতিমদের নিয়ে ইফতার করার ছবি টিভিতে দেখালেন। শুধু রানা প্লাজা নয় অনেক কারখানাতে ভবন ধসে শ্রমিক মরে শ্রমিকের নিরাপত্তা কর্মস্থলে নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আজকে ভবন ধসে শ্রমিক মারা যাওয়া, কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা না থাকায় এবং কারখানা এমন জায়গায় করা হয় যেখানে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি পর্যন্ত যেতে পারে না, ফলে শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যায়, এই কর্মস্থলে শ্রমিক পুড়ে কয়লা হতে পারবে না Ñ এগুলো শুধু ট্রেড ইউনিয়ন দাবিই নয়। মানবিক প্রশ্নও বটে। এই প্রশ্নে প্রতিবাদ করার জন্য শুধু শ্রমিক/ট্রেডইউনিয়ন সংগঠন নয় দেশের সকল বিবেকবান মানুষকেই রাস্তায় নামতে হবে। আর তা নামলে পড়ে যদি কেউ বলে শ্রমিকদের নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে, জাতীয় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তা কতটুকু গ্রহণযোগ্য কথা হতে পারে?
Toba_BSKFআমাদের দেশের গার্মেন্টগুলো ক্রমাগত তাদের ব্যবসার পসার বাড়াতে যে পারছে সে কথা মালিকরাও স্বীকার করে। তারা অনেকেই আজ কম্পোজিট ধরনের কারখানায় পরিণত হয়েছে। সেখানে কটন কাপড়ের বাইরেও নাইলন-এক্রোলিকের মতো উন্নত মাত্রার দাহ্য ফেব্রিক্স নিয়ে কাজ হচ্ছে। নানা প্রকার এসিড, ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে রঙ করা হচ্ছে। অথচ কোথাও অগ্নি নির্বাপণের মহড়া নেই, বিপদ সাইরেন নেই, মেটেরিয়াল সেফটি ডাটাশিট নেই, নাকের নিরাপত্তা মাস্ক নেই, কার্বন-ডাই-অক্সাইড সিলিন্ডার নেই বা থাকলেও তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। জেনারেটর ইত্যাদি শব্দবহুল জায়গায় যারা কাজ করে তাদের কানের সুরক্ষার জন্য ফোম পর্যন্ত নেই। যার দাম টাকা নয় কয়েক পয়সা মাত্র। এসিড ডাই নাড়াচাড়া করা শ্রমিকের হ্যান্ড গ্লাভস পর্যন্ত নেই। উৎপাদন লাইনগুলোতে এমনভাবে মেশিন বসানো হয় যাতে চলাচলের সুপরিসর করিডোর থাকে না, হয়ত দুশ জন শ্রমিকের জন্য দুইটা বাথরুম-টয়লেট। সুপারভাইজাররা টয়লেটে যেতে পর্যন্ত বাধা দিচ্ছে।
শ্রমিকরা কাজ করতে চায়। শ্রমিকদের নিরাপদে কাজ করতে দিতে হবে Ñ এমন দাবি তোলাকে যদি মালিকরা জাতীয় আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মনে করে তাহলে কি বলা যায়! সেটা যদি তারা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মনে করে তাহলে আমরা কি বলতে পারি? শ্রমিকরা সারা দিন কাজ করে বিকালে মালিকের দেয়া টিফিন খেয়ে একযোগে শত শ্রমিক অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, কারণ টিফিনে খাবার অযোগ্য পঁচা কলা-পাউরুটি দিয়েছে, পানি খেয়ে অসুস্থ হয়েছে শ্রমিক কারণ গত পাঁচ বছরে একবারও হয়ত পানির ট্যাংকি পরিষ্কার করা হয়নি। (খবরের কাগজে এসেছে পানি খেয়ে উসুক কারখানায় ১৫০ জন অসুস্থ হয়েছে)। শ্রমিকের স্বাস্থ্যকর টাটকা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি খেতে দিতে হবে Ñ এসব অতি সাধারণ দাবি নিয়েই আজ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন করতে হচ্ছে। শ্রমিকরা এখনো বর্ধিত সুযোগ সুবিধার দাবির পর্যায়ে যেতেই পারেনি। এখনো তাদের জীবিকার দাবি প্রধান হবার বদলে জীবন বাঁচানোর দাবিই প্রধান হয়ে আছে।
এদেশে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন বিগত দিনে অনেক রক্তঝরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এত আত্মত্যাগের লড়াকু আন্দোলন বারে বারেই আপস-সমঝোতার চোরাগলিতে পথ হারিয়েছে। অনৈক্য-বিভেদ ধ্বংস করেছে ঐক্যের চেতনা। আপসকামীতা ও সুবিধাবাদীতার ধারা ক্রমেই প্রাধান্য বিস্তার করেছে। শ্রমিক আন্দোলনে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নেতৃত্বের ধারণা এখনও গড়ে ওঠেনি। ফলে, এখনো শ্রমিক আন্দোলনে চার ধারার ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন বিরাজমান। এর একটি ধারা হলো যারা মনে করেন যারা দাবি দেবেন তাদের সাথে গলাগলি করে তাদের নিকট থেকে আর্থিক সুবিধাসহ নানা ধরনের সুবিধা নেওয়ার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়াই ভাল। এদের রাষ্ট্র শাসকদেরও পৃষ্ঠপোষকতা থাকে। শাসকরা যেমন দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে অনুগত পোষ্য বিরোধী দল নিয়ে চলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন তারই ছায়া অবলম্বনে শ্রমিক আন্দোলনেও শাসকরাই অনুগত ট্রেডইউনিয়নের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এই ধারার ট্রেডইউনিয়ন দিয়ে আর যাই হোক কার্যকর শ্রমিক আন্দোলন সম্ভব নয় এই সত্য আজ বোঝার সময় এসেছে। দ্বিতীয় ধারার ট্রেড ইউনিয়ন হল যারা মনে করেন ট্রেড ইউনিয়ন অরাজনৈতিক। তার দৃষ্টিভঙ্গী থাকবে শুধুই শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সুবিধাবলী অর্জন। তারা নিজের চোখে দেখেও বুঝতে চান না যে তোবায় শ্রমিকদের কাজ করা বেতন পাবার মতো মানবিক দাবিও শুধু মালিক দিয়ে নিষ্পত্তি হয় নি, মালিকদের সংস্থা বিজিএমইএ-র তো বটেই, সরকারের পৌণে এক হালি মন্ত্রীর জড়িয়ে পড়া লাগে। তাই রাষ্ট্র রাজনীতির বিবেচনার বাইরে থেকে আজ আর স্বাধীনভাবে শুধু বিশুদ্ধ মালিক আর বিশুদ্ধ শ্রমিক থেকে কোনো সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়। তাই আজ ট্রেড ইউনিয়নকে নিরপেক্ষ করা আর তাকে নিরস্ত্র করা, বন্ধুহীন করা একই কথা যা প্রকারান্তরে মালিকদের মালিকদের এবং শাসকদের হাতকেই শক্তিশালী করবে। এই নিরপেক্ষ ট্রেড ইউনিয়নবাদী ধারাও ক্ষীণ হলেও একটা ধারা হিসাবে আজো ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের সামনে একটা বিভ্রান্তি আকারে রয়ে গেছে।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের তৃতীয় ধারা হল আপসকামীতার ধারা। তারা প্রথম ধারার মতো বিজিএমইএ-র পকেট ট্রেড ইউনিয়ন নয় তা হয়ত ঠিক কিন্তু যতটা মাঠে সংগ্রাম প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি মালিক সরকারের সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন তারা অনুভব করেন। এক্ষেত্রে তাদের সততা নিয়ে হয়ত কোনো প্রশ্ন নেই, কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতা এবং বিভ্রান্তি কালক্রমে তাদেরকেও সরকারমুখী, মালিকমুখী, বিজিএমইএ-মুখী করে তোলে। কিন্তু আপসের জন্যও আপসের অনুকূল সংগ্রাম গড়ে তোলার পূর্বেই সরকার-বিজিএমইএ-র সাথে আন্দোলনের মূল নেত্রীকে বাদ রেখে নানাবিধ যোগাযোগ আন্দোলনের দুর্বলতাকে প্রকাশ করে Ñ দরকষাকষির সুযোগ কমায়, একথাটি মনে রাখতেই হবে। আমরা সেসব আচরণ যথাযথভাবে করতে পারলে আজ শ্রমিকদের বেতন-বোনাস-ওভারটাইম পাওয়ার আন্দোলনকে শ্রমিকদের পুনর্বাসনের আন্দোলনে রূপান্তরিত করা যেত। দরকষাকষির নামে আন্দোলনকে কখনো নতি স্বীকারের পর্যায়ে নামিয়ে আনা যাবে না। আন্দোলন করতে গিয়ে পরাজয়ও আসতে পারে। কিন্তু প্রত্যেক আন্দোলনই যেন শ্রমিকদের সংগ্রামী চেতনাকে শাণিত করে পরবর্তী আন্দোলনের বৃহত্তর ক্ষেত্র রচনা করে।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ৪র্থ ধারা হলো বৈপ্লবিক সংগ্রামের পরিপূরক ট্রেডইউনিয়ন আন্দোলনের ধারা। এ ধারা ক্রমাগত বিকাশমান একটা ধারা, তারা ট্রেড ইউনিয়নকে রাষ্ট্র এবং সরকারের যোগসূত্র দেখে। ফলে এটা শুধু মালিক শ্রমিকের বিষয় মনে করে না। তারা সর্বত্র রাষ্ট্রের একটা যোগসূত্র দেখতে পায়। রাষ্ট্র শিল্পাঞ্চলে মালিকের স্বার্থে শিল্প পুলিশ গড়ে তোলে তা তারা দেখতে পায়। আজকের ধনিক-মালিক-বড়লোক শ্রেণীর যে কোনো দেশপ্রেম মানবিক গুণাবলী মানবতাবোধ এবং সর্বোপরি সাম্রাজ্যবাদ বা বিদেশী শোষণবিরোধী কোনো ভূমিকা নেই তা দেখতে পায়। রানা প্লাজায় যেসব বিশ্ববিখ্যাত বিদেশী ব্রান্ড কাজ করেছিল তার মধ্যে ওয়াল মার্ট, জে. সি. পোনি, এইচ এন্ড এম ইত্যাদি কোম্পানিগুলো উল্লেখ করার মতো ক্ষতিপূরণ সরকার আদায় করেনি। শ্রমিকদের তৈরি পণ্য বিক্রি করে যারা মুনাফা করে তারা কোনো দায় নেবে না তা কি করে সম্ভব? তাই আজ শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের বিরুদ্ধে মালিক-বিজিএমইএ-সরকার সব কিছুর বিরুদ্ধেই শ্রমিককে সংগ্রাম ধারাবাহিক ও সচেতনভাবে অগ্রসর করে নিতে হবে।
এবারের তোবা শ্রমিকদের আন্দোলন দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির সমর্থন পেয়েছে। বাম রাজনৈতিক দলসমূহ এ আন্দোলনের সমর্থনে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করেছে। পাশাপাশি দেশের বিবকবান শিক্ষক-সাংবাদিক-চিকিৎসক-আইনজীবীসহ সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ ও শ্রমজীবী সাধারণ জনগণ এ আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ফলে গার্মেন্ট শ্রমিকদের উপর মালিকশ্রেণীর দীর্ঘদিনের নির্মম নির্যাতন-নিপীড়নের পটভূমিতে দেশব্যাপী মানুষের সহানুভূতি অর্জন করেছে। এ সমস্ত সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে সকল প্রকার আপসকামী-সুবিধাবাদী ও হঠকারীতা পরিহার করে শ্রমিকদের সঠিক বিপ্লবী ধারার রাজনীতি সচেতন শ্রমিক আন্দোলনকে জোরদার করে তুলতে হবে। কারণ আজকের যুগে এটাই শ্রমিক আন্দোলনের একমাত্র পথ।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments