Thursday, March 28, 2024
Homeফিচারঅবরুদ্ধ গাজায় আবারো ইজরাইলের নির্বিচার গণহত্যা

অবরুদ্ধ গাজায় আবারো ইজরাইলের নির্বিচার গণহত্যা

সাম্রাজ্যবাদী শিবির ও বশংবদ আরব শাসকদের মদত

Toba_SPB_12.07.14প্যালেস্টাইনের গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলী সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র সারা দুনিয়ার ন্যূনতম মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষকে প্রচণ্ডভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। মাসাধিককালের এই হামলায় মারা গেছে দুই সহস্রাধিক গাজাবাসী, জাতিসংঘের হিসাবেই যার ৮০% নিরীহ বেসামরিক জনসাধারণ এবং ৪৫০-এর বেশি নিরপরাধ শিশু। আহত হয়েছে অন্তত ১০ হাজার, ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে ৬৫ হাজারের বেশি। ইসরাইল দাবি করেছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘আত্মরক্ষামূলক হামলা’ করা হয়েছে এবং এর লক্ষ্য তাদের ভাষায় ফিলিস্তিনের সন্ত্রাসী সংগঠন (ফিলিস্তিনীদের দৃষ্টিতে প্রতিরোধ যোদ্ধা) হামাস-এর রকেট ও সুড়ঙ্গ ‘সন্ত্রাস’ বন্ধ করা। কিন্তু বাস্তবে বিশ্ববাসী দেখেছে ইসরাইল হামলা চালিয়েছে আবাসিক ভবন, স্কুল, হাসপাতাল, জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্র, জনবহুল বাজার এলাকা, সমুদ্রতট, প্রতিবন্ধী শিক্ষাকেন্দ্র, মসজিদ, কল-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, পানি সরবরাহ স্থাপনা ইত্যাদি সবখানেই। ইসরাইল ফিলিস্তিনীদের দেশ দখল করেছে, লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তনীদের তাদের ভিটে-মাটি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ইসরাইলী শাসকরা চায় ফিলিস্তিনীরা নীরবে দখলদারিত্ব মেনে নিক, তা না করে কেন তারা প্রতিরোধ সংগ্রাম চালাচ্ছে Ñ এই ‘অপরাধে’ গাজার জনসাধারণকে শাস্তি দিতেই এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। ইসরাইল চায় ফিলিস্তিনীরা যাতে এই এলাকা ছেড়ে চলে যায় অথবা থাকলেও তাদের দুর্দশার জন্য হামাসকে যাতে তারা দায়ী করে। কিন্তু অনেক ক্ষয়-ক্ষতির পরেও গাজার মানুষের অনমনীয় দৃঢ়তার কারণে ইসরাইলী পরিকল্পনা ব্যর্থ হতে চলেছে। প্রশ্ন হলো, ‘জোর যার মুল্লুক তার’ Ñ এই জঙ্গলের আইনের মত ইসরাইলের এত বড় অন্যায় কি বারে বারে চলতেই থাকবে?
গাজার ওপর এই হামলা নতুন নয়। ২০০৮ ও ২০১২ সালে গাজায় একইধরণের হামলা চালানো হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ২০০৬ সাল থেকেই ইসরাইল মিশরের সহযোগিতায় গাজা ভূ-খণ্ডের ওপর কঠোর অবরোধ আরোপ করে রেখেছে। গাজার দুদিকে ইসরাইল, একদিকে মিশর, অন্যদিকে ভূমধ্যসাগর যা ইসরাইলী নৌ-বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। ইসরাইলী অবরোধ এবং মিশরও সীমান্ত বন্ধ করে রাখায় গাজায় ঢোকা-বের হওয়া অসম্ভব, আমদানি-রপ্তানি প্রায় বন্ধ, সমুদ্রতীর থেকে ৩ কিলোমিটারের বেশি যাওয়ার অনুমতি নেই। ৩৬৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই ছোট্ট জায়গায় ১৮ লক্ষের বেশি ফিলিস্তিনী গাদাগাদি করে থাকে, এদের বেশিরভাগই ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার সময় উচ্ছেদ হওয়া উদ্বাস্তু। গাজায় আবাদি জমি খুব অল্প, সম্পদও সীমিত। ইসরাইলে ও মিশরে কাজ করতে যেতে না পারায় বেকারত্ব তীব্র। এমনকি ইসরাইল গাজার জনগণের জন্য ত্রাণবাহী জাহাজ ও ট্রাকও ঢুকতে দিচ্ছে না। বাস্তবে গাজা এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ কারাগারে পরিণত হয়েছে। এইভাবে অর্থনৈতিক চাপ ও দফায় দফায় হামলার পরেও হামাস ও গাজার জনগণের প্রতিরোধস্পৃহাকে নির্মূল করতে না পারায় আবারো হামলা চালানো হলো। এইবারের হামলা আগের চাইতে অনেক রক্তক্ষয়ী ও বিধ্বংসী। একইসাথে লক্ষ্যণীয় যে, ইসরাইলী সৈন্য নিহতের পরিমাণও আগেরবারের হামলার চাইতে কয়েকগুণ বেশি। ইসরাইলের গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে এবং নিজেদের পক্ষে অতিরিক্ত হতাহতের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে ইসরাইল গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে যুদ্ধবিরতি আলোচনা চালাচ্ছে। যদিও তাদের পূর্ব ঘোষণা ছিল হামাস নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে।
গাজায় নৃশংস গণহত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তাকারীর ভূমিকা পালন করে নিজেদের কপটতার স্বরূপ উন্মোচন করে দিয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শিবির, আরব দেশগুলোর দালাল শাসকবর্গ, জাতিসংঘ ও ‘মুক্ত দুনিয়া’র তথাকথিত স্বাধীন কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমগুলো। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা সম্প্রতি ইরাকের পার্বত্য এলাকায় অবরুদ্ধ কয়েক হাজার ইয়াজিদী সম্প্রদায়ের মানুষকে কথিত গণহত্যার হাত থেকে রক্ষার অজুহাতে সেখানে জঙ্গিদের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। এর আগে বেসামরিক জনগণকে রক্ষার কথা বলে লিবিয়া দখল ও সিরিয়ায় হামলার উদ্যোগ নেয়া হয়। অথচ গাজায় বেসামরিক জনগণকে রক্ষায় পদক্ষেপ নেয়া দূরের কথা, বরং ‘ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারের’ প্রতি বারবার সমর্থন দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইসরাইলে সংরক্ষিত গোপন মার্কিন অস্ত্রভাণ্ডার থেকে গোলা-বারুদ সরবরাহ করা হয়েছে হামলা চলাকালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের জোরেই ইসরাইল আন্তর্জাতিক সকল আইন ও বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে যুদ্ধাপরাধ ও দখলদারিত্ব চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে ফিলিস্তিনী শিশুদের রক্তে মার্কিন শাসকদেরও হাত রঞ্জিত, নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই কেবল তারা ‘মানবাধিকার রক্ষা’র ধুয়ো তোলে। প্যালেস্টাইনীদের রক্ষায় জাতিসংঘ কোন কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারেনি, মহাসচিব কড়া ভাষায় ইসরাইলের আগ্রাসনের নিন্দা করতেও ব্যর্থ হয়েছেন, বরং তিনি ইসরাইলের আত্মরক্ষার যুক্তি মেনে নিয়ে সুকৌশলে আক্রমণকারী ও আক্রান্ত উভয়পক্ষকে একাকার করে উপস্থাপন করেছেন। গাজায় আগ্রাসনের প্রতিবাদে ভেনেজুয়েলা, চিলি, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া প্রভৃতি ল্যাটিন আমেরিকান দেশ ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। অথচ, আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মিশরে ক্ষমতাদখলকারী সেনাপ্রধান জেনারেল সিসি-র সরকার সীমান্ত বন্ধ করে রেখে এবং পণ্য আনা-নেওয়ার জন্য প্যালেস্টাইনীদের খোড়া সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে ইসরাইলকে সহযোগিতা করে চলেছেন। সৌদি আরব, কুয়েত, আরব আমিরাত, জর্দান এরা সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তি হামাসের ধ্বংস কামনা করে। এসব দেশের প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো দেশে জনগণের সংগ্রামী শক্তির উত্থানকে নিজেদের মসনদের জন্য হুমকি মনে করে। অন্যদিকে, সিএনএন-বিবিসিসহ কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে ব্রিটেন-আমেরিকায় মানুষ বিক্ষোভ করেছে। এসব মিডিয়া ইসরাইলের সুরে সুর মিলিয়ে ফিলিস্তিনীদের মরিয়া প্রতিরোধ সংগ্রামকে সন্ত্রাস হিসেবে চিহ্নিত করে এবং প্যালেস্টাইনীদের মানবিক বিপর্যয় যথাসম্ভব আড়াল করে বা লঘু করে দেখায়। এদের অবিশ্রাম পক্ষপাতদুষ্ট প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, হামাস রকেট ছোঁড়ার কারণেই ইসরাইল হামলা চালাতে বাধ্য হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, হামাসের রকেট হামলায় কয়জন ইসরাইলী মরেছে, আর ইসরায়েলের হামলায় কত ফিলিস্তিনী শিশু-নারী নিহত হয়েছে? একটি পুরো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে তাদের ভিটেমাটি দখল করার পর আক্রান্তরা যদি আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে লড়াই করে তা কি অন্যায়? যারা ইসরায়েলের দখলদারিত্ব, উপনিবেশিকীকরণ, অবরোধ, নির্যাতনের অবসান দাবি না করে ফিলিস্তিনীদের সশস্ত্র প্রতিরোধের নিন্দা জানায় তারা সাম্রাজ্যবাদের সুবিধাভোগী ও চূড়ান্ত নীতিহীন।
ইসরাইল ও তাদের মুরুব্বী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা গণতন্ত্রের কথা বলে মুখে ফেনা তোলে। অথচ হামাস ফিলিস্তিনীদের নির্বাচিত প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও বলপ্রয়োগে তাকে উচ্ছেদের চেষ্টা করছে। পশ্চিম তীর ও গাজাকে যুক্ত করে ফিলিস্তিনীদের স্বশাসিত সংস্থা ‘প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষ’-এর নির্বাচনে ২০০৬ সালে হামাস বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়। ইয়াসির আরাফাত ছিলেন ফিলিস্তিনীদের অবিসংবাদিত নেতা, তাঁর নেতৃত্বাধীন ফাতাহ-সহ অন্যান্য সংগঠন মিলে গঠিত হয়েছিল প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও। তিনি ১৯৮৭ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধ করে মার্কিন উদ্যোগে ইসরাইলের সাথে আলোচনায় যোগ দেন যার ফলে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে আরাফাত ইসরাইল রাষ্ট্র্রকে মেনে নেন, বিনিময়ে ইসরাইল ধাপে ধাপে পশ্চিম তীর ও গাজার সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেয়। অর্থাৎ, ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের ২২% ভূমি নিয়ে ভবিষ্যৎ প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র গঠনের কথা বলা হয়। এই চুক্তিতে বলা হয় Ñ প্রথম ধাপে দখলকৃত এলাকা থেকে ইসরাইলী সেনা ও ইহুদি বসতি প্রত্যাহার করা হবে এবং প্যালেস্টাইনী কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গাজা ও পশ্চিম তীরে আধা-স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে। আরাফাত পুরো প্যালেস্টাইনের দাবি ছেড়ে দিয়ে ‘দুই রাষ্ট্র তত্ত্ব’ মেনে নিয়ে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিলেও ইসরাইল নানা কৌশলে ভূমি দখল ও নিরাপত্তার নামে প্যালেস্টাইনীদের ওপর দমন-নির্যাতন চালাতে থাকে। পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে অবৈধ বসতি প্রত্যাহারের পরিবর্তে সে নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণ করে যেতে লাগল। বিতাড়ন করতে থাকল ফিলিস্তিনিদের। বহু বসতিকে তারা সামরিক ক্যাম্পে পরিণত করে যুক্ত করেছে মূল ইসরাইল সড়কের সাথে। বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ফিলিস্তিন অঞ্চলকে। দখল করেছে উর্বর জমি আর বাগান। পানির উৎস নিয়ন্ত্রণ করে ফিলিস্তিনিদের বঞ্চিত করেছে পানির অধিকার থেকে। গাজা আর পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন অঞ্চলের অধিবাসীদের যাতায়াতের ওপর আরোপ করেছে কড়াকড়ি। ফিলিস্তিনের আকাশ এবং জলভাগও কার্যত ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। ২০০৪ সালে ইসরাইল ও পশ্চিম তীরের মাঝে ২৫ ফুট দেয়াল তুলে পশ্চিম তীরের অর্ধেক কেটে ফেলা হল এবং ইসরাইল তার অঞ্চল আরো ৫৮% বাড়িয়ে নিল। আকস্মিকভাবে এ অঞ্চলের ফিলিস্তিনিদের ভিটে, জমি আর বাগান থেকে উচ্ছেদ করা হল। ইসরাইলি দেয়াল পাশাপাশি গ্রামগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাওয়ার অনুমতি নেই। অন্যদিকে, ৫০ লক্ষ ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কোন সুযোগ রাখা হয়নি চুক্তিতে। আরাফাতও অসলো চুক্তির কয়েকবছর পর ইসরায়েলের প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। একারণে মৃত্যুর আগে দুই বছর তাকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখে ইসরাইলী সেনাবাহিনী। ফিলিস্তিনীদের আশাভঙ্গের প্রেক্ষাপটে হামাসের লড়াকু ভূমিকার প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকে। হামাস ইসরাইলকে স্বীকার করে না এবং ইসরাইলী দখলদারিত্ব উচ্ছেদের লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম তারা অব্যাহত রেখেছে। ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের ক্ষমতায় আসীন হয়ে পিএলও নেতৃত্বের দুর্নীতি ও আখের গোছানোর বিপরীতে হামাসের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিও তাদের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। সর্বশেষ ২০০৬ সালের নির্বাচনে ফিলিস্তিনী জনগণ মাতৃভূমির প্রশ্নে আপোষহীন হামাসকে নির্বাচিত করে। কিন্তু ইসরাইল ও তার মুরুব্বী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হামাসকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। ওয়েস্ট ব্যাংকের রাজধানী রামাল্লায় ক্ষমতা হস্তান্তর বাধাপ্রাপ্ত হয় ও নেতৃত্ব ফাতাহ’র হাতেই থেকে যায়। কিন্তু গাজার কর্তৃত্ব হামাসের হাতে চলে আসে। ফলে তারপর থেকেই ক্ষিপ্ত ইসরাইল গাজার উপর তার আক্রমণের তীব্রতা বাড়ায়, অবরোধ তৈরি করে যাতে অনাহার ও মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে মানুষ হামাসের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু গত ৮ বছর ধরে কঠোর অবরোধের ফলে চূড়ান্ত দুর্দশা সত্ত্বেও গাজার জনগণকে নতিস্বীকার করানো যায়নি, হামাস এখনো প্রতিরোধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। এবারের যুদ্ধবিরতির আলোচনায় তাই হামাস প্রধান শর্ত হিসেবে অবরোধ প্রত্যাহারের দাবি করেছে।
প্যালেস্টাইন-ইসরাইল সংঘাতকে মুসলমান ও ইহুদিদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ হিসেবে দেখার প্রবণতা আমাদের দেশে ব্যাপকভাবেই আছে। আমেরিকা যখন ইরাকে বা আফগানিস্তানে হামলা চালায় তখন মোৗলবাদীরা একে মুসলিমদের ওপর খ্রিস্টানদের হামলা হিসেবে দেখায়। এই দৃষ্টিভঙ্গী একেবারেই ভুল। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের ওপর দখল প্রতিষ্ঠা ও এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই ইরাকে হামলা, একই উদ্দেশ্যে ইসরাইলকে সমর্থন। রোমান সাম্রাজ্যের স্থানীয় শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অপরাধে ইহুদি জনগোষ্ঠী প্রায় ২০০০ বছর আগে ফিলিস্তিন এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে ইউরোপ ও দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শতশত বছর ধরে তারা ধর্মীয় বিদ্বেষ ও অত্যাচারের শিকার হয়েছে। ১৮৯০-এর দশকে একদল ইহুদি জায়নবাদী আন্দোলন শুরু করেন যার মূল লক্ষ্য নিপীড়িত ইহুদিদের জন্য নিজস্ব একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এইজন্য তারা প্রথমে আর্জেন্টিনা, সাইপ্রাস, উগাণ্ডা ইত্যাদি দেশের কথা ভাবলেও পরে ধর্মীয় মিথ অনুসারে প্যালেস্টাইনকেই এই রাষ্ট্রের উপযুক্ত স্থান হিসেবে নির্ধারণ করেন। এই লক্ষ্যে তারা সেখানে জমি কিনে বসতি স্থাপন শুরু করেন এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর সমর্থন লাভের চেষ্টা করেন। ১৯১৭ সালে ‘বেলফোর ঘোষণা’য় এ অঞ্চলের উপনিবেশিক শাসক ব্রিটেন প্যালেস্টাইনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্র“তি ঘোষণা করে। ১৯৩০-এর দশকে জার্মানিতে হিটলারের আমলে ইহুদিদের ওপর অত্যাচার চরমে পৌঁছে। প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি গণহত্যার শিকার হয়, ইতিহাসে যা ‘হলোকাস্ট’ নামে কুখ্যাত। এই ঘটনায় বিশ্বব্যাপী ইহুদিদের প্রতি যে সহানুভূতি সৃষ্টি হয় তাকে কাজে লাগিয়ে এবং নিজস্ব একটি রাষ্ট্রের জন্য ইহুদিদের একাংশের জায়নবাদী আন্দোলনকে সহযোগিতা করে ফিলিস্তিনী ভূমিতে কৃত্রিমভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টিতে ব্রিটেন ও আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ফিলিস্তিনীদের সম্মতি না নিয়েই ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের ৫৬% ভূমিতে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা ও ৪৪% এলাকা ফিলিস্তিনীদের বরাদ্দ দিয়ে একটি প্রস্তাব পাশ করে। এই প্রস্তাবের পক্ষে প্রয়োজনীয় ভোট যোগাড় করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশকে চাপ দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসরাইল বাস্তবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি হিসেবে ভূমিকা রাখছে। আমেরিকার সর্বাধিক সামরিক সাহায্যপ্রাপ্ত দেশ ইসরাইল, বছরে এর পরিমাণ ৩ বিলিয়ন ডলার। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণার সময় বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ করা সাড়ে ৭ লক্ষ ফিলিস্তিনীর নিজ ভূমিতে ফেরার অধিকারকে সমর্থন করে সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাশ হয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকে ইসরাইল কর্তৃক অধিকৃত এলাকা থেকে ইসরাইলী সেনা প্রত্যাহারের আহ্বানসম্বলিত প্রস্তাব পাশ হয়। কিন্তু এর কোনটিই মানতে ইসরাইলকে বাধ্য করা যায়নি মার্কিন সমর্থনের কারণে। নিরাপত্তা পরিষদে ইসরাইলের বিরুদ্ধে আনা অনেক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো দিয়েছে আমেরিকা। ফলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী শিবির মধ্যপ্রাচ্যে তার নিজের প্রয়োজনেই ইসরাইলকে মদত দিয়ে চলেছে এবং ফিলিস্তিনীদের দমনে সহযোগিতা করছে। অন্যদিকে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সারা দুনিয়ার বিবেকবান মানুষ ফিলিস্তিনীদের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করছে এবং ইসরাইলী বর্বরতা ও দখলদারিত্বের প্রতিবাদে রাস্তায় নামছে। সংখ্যায় কম হলেও খোদ ইসরাইলে গাজায় পরিচালিত গণহত্যার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে, বরং তথাকথিত ‘মুসলিম উম্মাহ’ এক্ষেত্রে প্রায় নীরব। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসরাইলের নিন্দা করেছেন, কিন্তু ইসরাইলকে মদত দিচ্ছে যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলেননি, বরং নানাভাবে তাদের আশীর্বাদ লাভের প্রতিযোগিতা করছেন।
পশ্চিমা বিশ্ব ইসরাইলকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে দাবি করে, অথচ কার্যত তা অঘোষিত এক ধর্মীয় ও বর্ণবাদী রাষ্ট্র। দুনিয়ার যেকোন প্রান্তের ইহুদিরা ইসরাইলের নাগরিকত্ব পেতে পারে, কিন্তু ১৯৪৮ সালে সেখান থেকে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনীদের নিজ বাসভূমে ফেরার ও ইসরায়েলে প্রবেশের অধিকার নেই। ইসরাইলের অভ্যন্তরে এখনো যেসব ফিলিস্তিনী বসবাস করে তারা ইহুদিদের সমান নাগরিক অধিকার পায় না। ধর্মের ভিত্তিতে কোন আধুনিক রাষ্ট্র হতে পারে না। অথচ এহেন বর্ণবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ইসরাইলী শাসকগোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে চলেছে গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী তথাকথিত মুক্ত বিশ্ব। তবে সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোর সমর্থনপুষ্ট এবং জ্ঞানবিজ্ঞান-অর্থনীতি-সামরিক শক্তিতে অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়ার পরও একটি ক্ষেত্রে ইসরাইল সহায়-সম্বলহীন ফিলিস্তিনীদের কাছে পরাজিত হয়েছে। শত অত্যাচার করেও ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার স্পৃহা ও প্রতিরোধের মনোবলকে তারা নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। ফিলিস্তিনী ভূমির জবরদখল বিশ্ববাসীর কাছে এখনো নৈতিক বৈধতা পায়নি। বিশ্বের যেখানে যারা অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে ফিলিস্তিনী জনগণের অদম্য সংগ্রাম তাদের প্রেরণা।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments