বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ-এর বিশেষ কেন্দ্রীয় কনভেনশনের প্রকাশ্য অধিবেশনের সমাবেশে সভাপতির ভাষণে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী বলেন, গত ৪২ বছর ধরে জনগণকে লুটপাট করে দেশে একচেটিয়া পুঁজিপতিগোষ্ঠী-মালিকগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। সমাজে বৈষম্য পাহাড় সমান হয়েছে। এখন এই একচেটিয়া পুঁজির মালিকদের প্রয়োজন দেশে প্রতিরোধহীন-প্রতিবাদহীন পরিবেশ। এদের মদদেই আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো, বিশেষত ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদও এদের মদদ দিচ্ছে। এত আন্দোলন সংগ্রামের দেশে এখন কোনো প্রতিবাদ নেই, আন্দোলন নেই। যে বামপন্থী শক্তির আত্মত্যাগের বিরাট ইতিহাস আছে, তারাও বিভ্রান্ত-উদ্ভ্রান্ত। শাসকদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে তারা বুঝে হোক না বুঝে হোক কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এ অবস্থায় যেসব আন্তরিক বামপন্থী শক্তি দেশে ক্রিয়াশীল, তাদের দায়িত্ব হল গণআন্দোলনের ধারাকে বিকশিত করা। জনগণের সমস্যা নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে ধারাবাহিক গণআন্দোলন গড়ে তোলা। কারণ গণআন্দোলন বিকশিত করা ছাড়া বামপন্থীরা এগোতে পারবে না।
বাম আন্দোলনে সুবিধাবাদ-ব্যক্তিবাদ ও গণবিচ্ছিন্নতা মোকাবেলা করে নীতিনিষ্ঠ ও লড়াকু বিপ্লবী পার্টির শক্তি বৃদ্ধি করা, সংশোধনবাদ-সংস্কারবাদকে পরাস্ত করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার সংগ্রাম শক্তিশালী করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ২০ নভেম্বর শুরু হয়েছে বাসদ-এর চার দিন ব্যাপী বিশেষ কেন্দ্রীয় কনভেনশন। সকাল ১১টায় মহানগর নাট্যমঞ্চ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। কনভেনশনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। এরপর প্রায় ৫ হাজার মানুষের একটি সুসজ্জিত মিছিল মহানগর নাট্যমঞ্চ থেকে বেরিয়ে গুলিস্তান-পল্টন-প্রেসক্লাব-হাইকোর্ট-দৈনিক বাংলা-মতিঝিল হয়ে পুনরায় নাট্যমঞ্চে গিয়ে শেষ হয়।
কনভেনশনে যোগ দিতে ভোর হতেই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দলের নেতাকর্মীরা মহানগর নাট্যমঞ্চে মিছিল নিয়ে সমবেত হতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১০টায় অতিথিদের নিয়ে নেতৃবৃন্দ মঞ্চে আরোহন করেন। এরপর দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী। পতাকা উত্তোলন শেষে সংক্ষিপ্ত ভাষণের মাধ্যমে কনভেনশনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেন, মার্কস-লেনিনের সুযোগ্য ছাত্র, এ যুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তাবিদ কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষাকে পাথেয় করে ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর আমাদের দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ- শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে ভিত্তি করে যে দল গড়ে তোলার সংগ্রাম আমরা পরিচালনা করছি, তাতে অনেক চড়াই-উৎরাই আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে। দলের অভ্যন্তরে শোধনবাদী-সংস্কারবাদী-সুবিধাবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করার মধ্য দিয়েই আমরা আজকের জায়গায় এসেছি। আমাদের সেই সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই এ বিশেষ কনভেনশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, শোষণ-বৈষম্যের এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমস্ত দিক থেকে মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, সমাজ-সভ্যতাকে ধ্বংস করছে। শত অন্যায়-অবিচার করেও এই ব্যবস্থা টিকে আছে। কারণ এই ব্যবস্থা আপনা-আপনি বিলুপ্ত হবে না, উচ্ছেদ হবে না। একে বিপ্লবের আঘাতে উচ্ছেদ করতে হবে। সমাজ পরিবর্তনের এই বিরাট বিপুল সংগ্রামে শোষিত নিপীড়িত মানুষকে নেতৃত্ব দিতে হলে চাই সঠিক বিপ্লবী দল। আর এ কারণেই বিপ্লবী দল গড়ে তোলার সংগ্রাম ব্যতিত গরিব মানুষের মুক্তির পথ নেই। তিনি কনভেনশন সফল করতে দেশবাসীর সহযোগিতার কথা স্মরণ করে তাদের অভিনন্দন জানান।
উদ্বোধনীর পর মঞ্চের পাশে নির্মিত শহীদ বেদীতে দেশে দেশে বিপ্লবী সংগ্রামের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষমাল্য অর্পণ করেন বাসদ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী এবং ভারতের সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাষ ঘোষের পক্ষে এসইউসিআই(সি)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড সি. কে. লুকোস। এ সময় শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। এরপরই মার্কসবাদী অথরিটিদের ছবি, বিভিন্ন দাবি সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন-প্ল্যাকার্ড এবং লাল পতাকা দিয়ে সুসজ্জিত একটি র্যালি নগরীর রাজপথ প্রদক্ষিণ করে।
বিকাল সাড়ে ৩টায় শুরু হয় আলোচনা সভার কর্মসূচি। এতে সভাপতিত্ব করেন কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। আলোচনা করেন কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার সমন্বয়ক অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সোস্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ।
কমরেড প্রভাস ঘোষ তাঁর আলোচনায় বলেন, শোধনবাদের কবলে পড়ে গোটা বিশ্ব সাম্যবাদী শিবির ধসে যাওয়ার পর দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখুন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কি ভয়ংকর তা-ব শুরু হয়েছে। দুনিয়ার দেশে দেশে মার্কিন শিবিরের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো হামলা, আগ্রাসন, আক্রমণ, সম্পদ লুটপাট – কি না করছে। এক সময় আওয়াজ উঠেছিল, সমাজতন্ত্রের দিন শেষ। আমরা বলেছিলাম, সমাজতন্ত্রের দিন শেষ হয়নি। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা থেকে আমরা জানতাম, শোধনবাদ কি ভয়ানকভাবে সাম্যবাদী শিবিরকে ভেতর থেকে গ্রাস করেছে। যে কারণে আমরা হতাশ হইনি। আমরা মাটি কামড়ে জনগণের দাবি নিয়ে লড়াই করে গেছি। আজ দুনিয়ার দিকে তাকালে আরো একটা ভিন্ন চিত্র আপনারা দেখতে পাবেন – আরব বসন্ত, অকুপাই আন্দোলন, উই আর নাইন্টি নাইন (৯৯) এসব আন্দোলন কি বার্তা দিচ্ছে? আসলে জনগণ পুঁজিবাদের অবসান চাইছে। তিনি বলেন, আমাদের মহান নেতা, এ যুগের মহান মার্কসবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষায় আমরা ভারতের মাটিতে সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার সংগ্রাম করে চলেছি। দুনিয়ার অপরাপর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শান্তিকামী শক্তিগুলোকেও সাথে নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী জঙ্গী শান্তি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।
সভাপতির ভাষণে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী বলেন, মহান রুশ নভেম্বর বিপ্লবের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে স্মরণে রেখেই ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর আমাদের দলের প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। দল গড়ে তোলার সংগ্রামে আমাদের পাথেয় ছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং এ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে যখন শোধনবাদের খপ্পরে পড়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটল তখন দুনিয়ার দেশে দেশে পুরনো বনেদী কমিউনিস্ট পার্টিগুলো দিশা হারিয়ে ফেলল। এমনকি দল বিলুপ্তির মতো কা- তারা ঘটিয়েছে। সেই সময়ে কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষার আধারে আমাদের দল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। চলতে চলতে প্রয়োগের ঘাটতি থেকে দলের অভ্যন্তরে একদল নেতার মধ্যে ব্যক্তিবাদী প্রবণতার জন্ম নিল, তারা আদর্শকেই অস্বীকার করে বসল। দলের অভ্যন্তরে আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রাম করতে করতে আমাদের দল আজকের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, এই কনভেনশন থেকে আমরা বিগত দিনের ত্রুটি-দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করে একটা লড়াকু পার্টি হিসাবে আমাদের দলকে দাঁড় করাবার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করব। অপরাপর আন্তরিক বামপন্থীদের সাথে নিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলার কাজে আমাদের সীমিত শক্তি নিয়েও সর্বশক্তি নিয়োগ করব।
কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল পরিবেশনার মধ্য দিয়ে আলোচনা সভার সমাপ্তি হয়। আলোচনা সভার শুরুতে বিভিন্ন জেলার চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সদস্যরা এবং আলোচনা সভার শেষে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় টিম সঙ্গীত আলেখ্য পরিবেশন করে। কনভেনশনের প্রতিনিধি অধিবেশন আগামী ২১-২৩ নভেম্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউট সেমিনার হলে অনুষ্ঠিত হবে।