শোষণ-বঞ্চনা দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষ পীড়িত ভারতবর্ষের বুকে চেপে আছে অত্যাচারী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশমাতাকে মুক্ত করতে দাঁনা বেঁধে উঠছে আপোষহীন ধারার স্বদেশী আন্দোলন। ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ফাঁসির মঞ্চে বিপ্লবী ক্ষুদিরামের নির্ভীক আত্মদান নাড়া দিয়েছিল এদেশের তরুণ-যুবকদের। সেই মন্ত্রণায় উজ্জীবিত এক স্কুল ছাত্র ধীরে ধীরে নিজেই হয়ে উঠলেন এক মহান বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামের এক মহানায়ক – আমাদের প্রিয় মাস্টারদা সূর্যসেন।
মাস্টারদা’র জন্ম ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামে। ছোটবেলায় বাবাকে হারান; পড়াশোনা চালান টিউশন করে। বড় হয়ে স্কুলের অংকের শিক্ষক হিসেবে যেমন সুনাম তেমনি দেশের মানুষের প্রতি প্রবল ভালবাসা, চরিত্রের বলিষ্ঠতায় ক্রমে আকর্ষণ করে তরুণদের। ক্লাসের ছাত্রদের বলতেন দেশের দুরাবস্থার কথা, দেশপ্রেমের কথা, স্বাধীনতার কথা। সূর্যসেন গোপনে স্বাধীনতা সংগ্রামের জমি তৈরি করছিলেন।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সূর্যসেনের গড়া ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’ চট্টগ্রামকে স্বাধীন করার লড়াই শুরু করে। বিপ্লবীরা রেললাইন উপড়ে ফেলে, টেলিগ্রাফ-টেলিফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। একদল বিপ্লবী অক্সিলারী অস্ত্রাগার দখল করেন। সূর্যসেন ও অন্যান্য বিপ্লবীরা আক্রমণ করেন সরকারি অস্ত্রাগার। অস্ত্রাগারের রক্ষীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধরাশায়ী হল। অত্যাচারী ইংরেজরা পালাল গভীর সমুদ্রে। অধিকৃত হল সে অস্ত্রাগার। ব্রিটিশ দাম্ভিকতা, অত্যাচার-নিপীড়নের প্রতীক ‘ইউনিয়ন জ্যাক’কে বিপ্লবীরা ভূলুণ্ঠিত করে উড়িয়ে দেয় স্বাধীনতার পতাকা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রথম স্বাধীন হলো চট্টগ্রাম।
মাস্টারদা জানতেন এ স্বাধীনতা সাময়িক। ব্রিটিশ শক্তি চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে বিপ্লবীদের। মাস্টারদার নেতৃত্বে বিপ্লবীরা আশ্রয় নিলেন জালালাবাদ পাহাড়ে। ২২ এপ্রিল বিপ্লবীরা পরিকল্পনা করলেন শহরে ঢোকার। হঠাৎ দেখা গেল দু’দিক থেকে আসছে ইংরেজ সৈন্য। পালাবার পথ নেই। সম্মুখ লড়াই শুরু হল। শহীদ হলেন অনেক বিপ্লবী বীর। কিন্ত দেশপ্রেমে বলিয়ান বিপ্লবীদের প্রাণপন লড়াইয়ের কাছে হার মানলো আধুনিক অস্ত্রে সাজানো প্রশিক্ষিত ইংরেজ সৈন্য। বীর শহীদদের প্রতি শেষ অভিবাদন জানিয়ে পাহাড় ত্যাগ করলেন বিপ্লবীরা।
পরবর্তী অপারেশন ইউরোপীয়ান ক্লাব। ক্লাবের বাইরে লেখা ছিল ‘ফড়মং ধহফ হধঃরাবং ধৎব হড়ঃ ধষষড়বিফ’ ,ভিতরে চলত মদ, নৃত্য আর বিপ্লবীদের ধরার পরিকল্পনা। মাস্টার দা’র আর এক সহযোদ্ধা প্রীতিলতার নেতৃত্বে ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ক্লাব আক্রমণ করা হয়। অপারেশন শেষে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পটাশিয়াম সায়ানাইড পান করে আত্মাহুতি দেন বীরকন্যা প্রীতিলতা।
১৯৩২ হতে ১৯৩৩ সালের পুরো শীতকাল সূর্যসেন ও তাঁর সহযোদ্ধারা কঠিন সময় পার করেন। ১৯৩৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি গৈড়লা নামক গ্রামে আশ্রয় নেন সূর্যসেন ও বিপ্লবীরা। কিন্তু নেত্র সেন নামে এক কুলাঙ্গার অর্থের লোভে সূর্যসেনকে ধরিয়ে দেন। ধরা পড়েন আরো কয়েকজন বিপ্লবী। ১৪ আগস্ট বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এক প্রহসনের বিচারে সূর্যসেনের মৃত্যুদ- প্রদান করে।
১২ জানুয়ারি ১৯৩৪ সাল। গভীর রাতে সূর্যসেনকে ফাঁসির জন্য ডেকে তোলা হয়। তিনি উচ্চকণ্ঠে ‘বন্দে মাতরম’ স্লোগান তোলেন। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পিটিয়ে সূর্যসেনকে সংজ্ঞাহীন করা হয়। এরপর নিথর দেহ ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এতেই ক্ষান্ত হয়নি ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। তাঁর লাশ পাথরে বেঁধে জাহাজে করে চট্টগ্রাম থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরে সাগরে নিক্ষেপ করা হয়। ব্রিটিশরা জীবিত সূর্যসেনকে যতটা ভয় পেত, তার থেকে মৃত সূর্যসেনকে বেশি ভয় পেয়েছে।
আজকের দিনে ভোগবাদী পশ্চিমা সংস্কৃতি, নোংরা আত্মকেন্দ্রিক বাজারী সিনেমার চরিত্রের মোহে আচ্ছন্ন চারদিক। মূল্যবোধ ধ্বংসের বিপুল রাষ্ট্রীয় আয়োজন। এর বিপরীতে ছাত্রযুব-সমাজকে দেশপ্রেম, উন্নত নৈতিক চরিত্র নিয়ে দাঁড়াতে হলে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল, মাস্টার দা সূর্যসেন, সুভাষ বসু, ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, রোকেয়া, ভাসানী-সহ বড় বড় মানুষের চরিত্র থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ ও মানুষকে ভালবাসার দীক্ষায় গড়ে উঠতে হবে।
মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসি দিবস পালিত
চট্টগ্রাম : ১২ জানুয়ারি মাস্টারদা সূর্যসেনের ৮১তম ফাঁসি দিবসে বাসদ (মার্কসবাদী) চট্টগ্রাম জেলা শাখার উদ্যোগে শহরের জে এম সেন হলস্থ সূর্যসেনের ভাষ্কর্যে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাসদ নেতা অপু দাশ গুপ্ত, শফিউদ্দীন কবির আবিদ, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য সোমা প্রমুখ। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
মাস্টারদার ফাঁসি দিবস স্মরণে ১২ জানুয়ারি বিকালে চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চট্টগ্রাম শহরের টি.আই.সি অডিটোরিয়ামে মঞ্চায়ন করে নাটক ‘প্রীতিলতা’। তাপস চক্রবর্তী রচিত নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন আবির মন্ডল। সঙ্গীত পরিকল্পনায় ছিলেন ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য সোমা। নাটকটিতে ভগৎ সিং, সূর্য সেন ও প্রীতিলতা চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুমেল বড়য়া, ইমরান হোসেন ও নিশিগন্ধা দাশগুপ্তা। এতে অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মামুনুল হক, নাজমুল হুদা, প্রবাল মজুমদার, মেজবাহ্ উদ্দীন, রিষিকা আদিল, লিটু দেব নাথ, শারাবান তাহুরা কুমকুম, তাপস চক্রবর্তী, অশোক সুমন ও রাজীব মজুমদার। নাটকটির দু’টি মঞ্চায়ন অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা : শিশু কিশোর মেলা মীরপুর আঞ্চলিক শাখার উদ্যোগে ১২ জানুয়ারি সূর্য সেন-এর প্রতিকৃতি সম্বলিত ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি আয়োজন করা হয়। সকাল ১০টায় শিশু কিশোর মেলার আঞ্চলিক কার্যালয়ে আলোচনা সভা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। সাইফুল হাসান মুনাকাত-এর সভাপতিত্বে ও জ্যোতির্ময় চক্রবর্ত্তীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন সংগঠনের উপদেষ্টা ডা. মুজিবুল হক আরজু, শিক্ষক কাজী সালামতউল্লাহ, নাঈমা খালেদ মনিকা, আমিনুল ইসলাম, তৌহিদ হোসেন সাগর। আবৃত্তি করেন গোলাম রাব্বানী প্লাবন।
বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র শেখ বোরহানুদ্দীন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কলেজ শাখার উদ্যোগে মাস্টারদার প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন ও আলোচনা সভা কলেজ শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ জনাব আব্দুর রহমান, মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান জনাব মনিরুজ্জোহা, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবু নাঈম রাফি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রী চক্রবর্ত্তী রিন্টু। সভা পরিচালনা করেন বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্রের সংগঠক ছায়েদুল হক নিশান।
ঢাবি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলে ১৩ জানুয়ারি রাত সাড়ে আটটায় ছাত্র সংসদ কক্ষে আলোচনা সভা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। হলের সংগঠক সাদিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও মাসুদ আল মাহাদি অপুর পরিচালনায় আলোচনা করেন বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সদস্য ফকরুদ্দিন কবির আতিক, ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক স্নেহাদ্রী চক্রবর্তী রিন্টু, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রাশেদ শাহরিয়ার। আলোচনা শেষে ‘লিজেন্ড অব ভগৎ সিং’ সিনেমাটি প্রদর্শিত হয়।
চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে ১৪ জানুয়ারি দুপুর দেড়টায় মাস্টারদা সূর্যসেন ও চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের উপর নির্মিত ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এর আগে সকাল থেকে ফ্যাকাল্টি প্রাঙ্গণে মাস্টারদার জীবনের উপর আলোকচিত্র ও তথ্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
খুলনা : ১২ জানুয়ারি কুয়েটে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের উদ্যোগে মাস্টারদা সূর্যসেনের অস্থায়ী বেদীতে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন ছাত্র ফ্রন্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রুহুল আমিন।