Saturday, April 27, 2024
Homeসাম্যবাদসাম্যবাদ - জানুয়ারি ২০১৫লেনিন স্মৃতি - ম্যাক্সিম গোর্কি

লেনিন স্মৃতি – ম্যাক্সিম গোর্কি

[রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নির্মাতা, দুনিয়ার প্রথম শ্রমিকরাজের স্থপতি সর্বহারাশ্রেণীর মহান নেতা কমরেড লেনিনের মৃত্যুর (১৯২৪) কিছুদিন পর সর্বহারাশ্রেণীর আরেক অকৃত্রিম বন্ধু খ্যাতনামা সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কি এই স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি লিখেছিলেন। দু’জনের মধ্যে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। লেনিনকে গোর্কি দেখেছিলেন অত্যন্ত কাছ থেকে।  আগামী ২১ জানুয়ারি কমরেড লেনিনের শততম মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বন্ধু গোর্কির লেখার নির্বাচিত অংশ তুলে ধরে আমরা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।]

ভ্লাদিমির লেনিন আর নেই।

তাঁর শত্রু শিবিরেও কেউ কেউ অকপটে স্বীকার করেন: ‘তাঁর মাঝে প্রতিভা মূর্ত হয়েছিল তাঁর আমলের সমস্ত মহামানবের চেয়ে বেশি হৃদয়গ্রাহীভাবে’। সেই লেনিনকে হারাল পৃথিবী।

… এই মানুষটি ছিলেন দূরদর্শী এবং বিজ্ঞ, কিন্তু, ‘মহা প্রজ্ঞার মাঝে থাকে আবার মহতী বেদনা’।

বহু দূর আগে অবধি তিনি দেখতে পেতেন। ১৯১৯ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে তিনি যাঁদের কথা ভাবতেন, যাঁদের কথা বলতেন, তাঁরা কয়েক বছরের মধ্যে কি হবেন সেটা তিনি প্রায়ই নির্ভুলভাবেই বলেছিলেন। তাঁর এইসব ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে সবসময়ে একমত হওয়া যেত না, কেননা, কোন কোনটা হত নিরুৎসাহজনক, কিন্তু, দুঃখের কথা, অনেককেই যথাসময়ে তাঁর সংশয়গ্রস্ত চরিত্রায়ণের সঙ্গে মিলে যেতে দেখা যেত। … লন্ডন কংগ্রেসের [১৯০৭] দিনগুলিতে যখন কারও কারও সংশয় আর অবিশ্বাস এবং আরও কারও প্রকাশ্য শত্রুতা, এমনকি বিদ্বেষের হাওয়ার ভিতর ভ্লাদিমির ইলিচকে আমি দেখতে পেলাম, তখন থেকেই আমার আরম্ভ করা উচিত ছিল।

সে-বছরের আগে লেনিনের সঙ্গে আমার কখনও দেখাও হয় নি, [আসলে তাঁদের প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯০৫ সালে] তাঁর লেখা যত পড়া উচিত ছিল ততটা পড়িও নি। তবে, তাঁর লেখা অল্পস্বল্প যা পড়েছিলাম তাতেই এবং বিশেষত তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত বন্ধুবান্ধবের কাছে বিভিন্ন উচ্ছ্বসিত বিবরণ শুনে তাঁর প্রতি আমি প্রবল আকর্ষণ বোধ করেছিলাম। আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে তিনি বেশ জোরে আমার হাত চেপে ধরে সন্ধানী দৃষ্টি ফেলে আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে পুরনো বন্ধুর মতো কৌতুকের সুরে বললেন : ‘আপনি এসেছেন, খুব ভাল হয়েছে! আপনি তো লড়াই ভালবাসেন – তাই না ? তা, এখানে একটা বড় রকমের সংঘর্ষই হবে।’

… তাঁকে দেখলাম বড্ড সাদাসিধে – ‘নেতা’-ভাব একটুও দেখতে পেলাম না। আমি লেখক; সব খুঁটিনাটি লক্ষ্য করা আমার কাজই। এটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে; অভ্যাসটা এক-এক সময়ে বিরক্তিকরই।

… টাক-মাথা, ‘র’-কাঁপানো, বলিষ্ঠ, গাঁট্টগোঁট্টা সেই মানুষটি কিন্তু জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে এক হাতে নিজের সক্রেটিস-ধাঁচের কপাল মুছতে মুছতে আর অন্য হাতে আমার হাতে ঝাঁকুনি লাগাতে লাগাতে একেবারে সঙ্গে সঙ্গেই আমার ‘মা’ বইখানায় ত্রুটিবিচ্যুতির কথা বলতে আরম্ভ করলেন – বুঝলাম ই. প. লাদিজনিকভের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে তিনি বইখানার পাণ্ডুলিপি পড়েছিলেন। বললাম বইখানা লিখেছিলাম খুব তাড়াতাড়ি করে, কিন্তু কেন, সেটা আমি বলে উঠতে পারবার আগেই তিনি ঘাড় নেড়ে বোঝালেন তিনি সেটা বোঝেন এবং নিজেই বললেন কারণটা : ভালই করেছি তাড়াতাড়ি করে – কেননা, বইখানা ছিল জরুরি : শ্রমিকদের অনেকেই বৈপ্লবিক আন্দোলনের ভিতরে এসে পড়েছে সচেতনভাবে নয়, স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এখন ‘মা’ পড়ে তাদের খুব উপকার হবে।
‘খুবই সময়োপযোগী হয়েছে বইখানি!’ এই হল তাঁর একমাত্র, কিন্তু খুবই মূল্যবান সাধুবাদ। তার পরে অল্প অল্প কথায় কাজের কথায় এসে তিনি জানতে চাইলেন কোনও বিদেশী ভাষায় ‘মা’-র তরজমা হয়েছে কিনা, রুশ আর মার্কিন সেনসরের কলমে বইখানা কি পরিমাণে খর্ব হয়েছে। বইয়ের লেখককে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, কথাটা জানাতে তিনি বেঁকিয়ে ভ্রুকুটি করলেন, মাথাটা পিছনে হেলিয়ে চোখ বুঁজে হো হো করে হাসলেন এক অসাধারণ হাসি; সেটা শ্রমিকদের মনোযোগ আকর্ষণ করল …

ভ্লাদিমির ইলিচ তাড়াতাড়ি করে বক্তৃতামঞ্চে উঠলেন। তাঁর সেই কাঁপানো ‘র’টার জন্যে মনে হয় তিনি বক্তা হিসেবে তেমন সুবিধের নন, কিন্তু এক মিনিটের মধ্যেই আমি আর সবারই মতো সম্পূর্ণ নিমগ্ন হয়ে গেলাম। অতি জটিল সব রাজনীতিক প্রশ্ন নিয়ে এত সহজ-সরলভাবে কেউ বলতে পারে তা আমি কখনও শুনি নি। এই বক্তা সুন্দর সুন্দর কথা তৈরি করেন না, কিন্তু প্রত্যেকটি শব্দকে যেন নিজের হাতের তালুতে রেখে আশ্চর্য অনায়াসে তার সঠিক অর্থটিকে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি যে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করলেন তার বর্ণনা দেওয়া কঠিন।

হাতটা ছড়িয়ে এবং একটু তুলে তিনি প্রতিপক্ষের কথাগুলো বেছে বেছে যেন প্রত্যেকটা শব্দের ওজন বুঝে নিচ্ছিলেন, কথাগুলোর বিরুদ্ধে সারবান যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করছিলেন যে, উদারনীতিক বুর্জোয়াদের পিছনে পিছনে নয়, এমনকি তাদের পাশাপাশিও নয় – নিজস্ব পথ ধরে চলাই শ্রমিকশ্রেণীর অধিকারের বিষয় এবং কর্তব্য। সর্বৈব অতি অসাধারণ; তিনি সব ঢেলে দিচ্ছিলেন ততটা নিজের ভিতর থেকে নয় – ইতিহাসেরই মূল উৎস থেকে। তাঁর বক্তব্যের সততা-অখ-তা, মার্জিত রূপ, অকপটতা আর শক্তি – বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়ানো এই মানুষটির সবকিছু মিলে-মিশে হয়ে উঠল একটি শিল্পকর্ম। সবকিছু ঠিক-জায়গামতো। কোথাও একটু কিছুও অপ্রয়োজনীয় নয়, কোন রঙ-চড়ানো নয়, কিংবা তেমন কিছু থাকলেও সেটা নজরে পড়ে না, কেননা তাঁর বাক্-অলঙ্কার যেন মুখে দুটো চোখের মতো কিংবা হাতের পাঁচটা আঙুলেরই মতো অপরিহার্য।

আগে যাঁরা বলে গেছেন তাঁদের চেয়ে তিনি বললেন কমই, কিন্তু যে ছাপটা তিনি লাগিয়ে দিলেন সেটা ঢের বেশি। এটা মনে হল শুধু আমার নয়- আমার পিছন থেকে কাউকে কাউকে ফিসফিস করে বলতে শুনলাম : ‘এই তো কথা বটে!’ ঠিক তাইই বটে – কেননা, তাঁর প্রত্যেকটি যুক্তি নিজ আভ্যন্তরিক বলেই উদ্ঘাটিত হচ্ছিল, প্রকটিত হচ্ছিল।

মেনশেভিকদের মতে লেনিনের বক্তৃতাটা জঘন্য, লেনিন ব্যক্তিটি আরও জঘন্য; তারা একটুও না রেখে ঢেকেই সেটা প্রকাশও করল। পার্টির কাজের সমস্ত দিক পরখ করে নেবার জন্যে বৈপ্লবিক তত্ত্বের শিখরে শিখরে উঠবার জন্যে পার্টির প্রয়োজনটাকে তিনি যত প্রখরভাবে দেখাতে থাকলেন ততই বেশি বেশি শয়তানী ব্যাঘাত আসতে থাকল – ‘এ কংগ্রেস দর্শনশাস্ত্রের জায়গা নয়!’ ‘আমাদের শেখাতে হবে না! ইস্কুলের ছাত্র পেয়েছ সব ?’

… বিরক্তি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর বিদ্বেষের উত্তপ্ত ক্রুদ্ধ ঝাপটা লাগল হল ঘরটায়। শত শত চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ লেনিনের উপর – তাঁকে তারা দেখছিল ভিন্ন-ভিন্ন চোখে। বিরুদ্ধ আক্রমণগুলোয় তিনি একটুও বিচলিত হচ্ছিলেন বলে মনে হল না। তাঁর বক্তৃতায় উত্তেজনা ছিল, কিন্তু কথা বলছিলেন ওজন করে করে, একটুও অস্থিরতা ছিল না। বাইরে এই প্রশান্ত ভাব বজায় রাখবার জন্যে তাঁকে যে কি দিতে হয় সেটা আমি জানতে পেরেছিলাম কয়েক দিন পরে। কেবল তত্ত্বের সমুন্নত অবস্থান থেকেই পার্টি তার পার্থক্যগুলিকে দেখতে পায়, এই স্বতঃপ্রতীয়মান সত্য থেকেই আসছিল ঐ বিরুদ্ধাচরণ, এটা যেমন অদ্ভুত, তেমনি বেদনাদায়ক। আমার এই ধারণাই ক্রমাগত প্রবলতর হয়ে উঠছিল যে, কংগ্রেসে যত দিন যাচ্ছিল ততই ভ্লাদিমির ইলিচের জোর বাড়ছিল, তাঁর তেজ বাড়ছিল, তিনি ক্রমাগত বেশি নিশ্চিত হয়ে উঠছিলেন; দিন দিন তাঁর বক্তৃতাগুলি আরও দৃঢ় হয়ে উঠতে থাকল, সঙ্গে সঙ্গে, কংগ্রেসে গোটা বলশেভিক অংশটা হয়ে উঠছিল আরও মজবুত, আরও দৃঢ়সংকল্প। তাঁর বক্তৃতাগুলির উপর, মেনশেভিকদের বিরুদ্ধে রোজা লুক্সেমবুর্গের চমৎকার কড়া-লড়াকু বক্তৃতাটাও আমার মনে প্রায় অতখানি নাড়া দিয়েছিল।

কয়েক ঘণ্টার, এমনকি মুহূর্তের ফুরসতেও তিনি থাকতেন শ্রমিকদের মধ্যে – তাঁদের জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খুঁটিনাটি সম্বন্ধে তাঁদের কাছে প্রশ্ন করে করে জানতেন : ‘মেয়েদের অবস্থা কি? গৃহস্থালির কাজ তাঁদের পক্ষে বড় কষ্টকর – নয় কি? তাঁদের পড়াশুনা করবার কিংবা বই-কাগজ পড়ার সময় হয়?’

কংগ্রেসে লেনিন কার মনে কেমন রেখাপাত করেছেন তাই নিয়ে কয়েক জন শ্রমিক হাইড পার্কে বলাবলি করছিলেন; তাঁরা লেনিনকে আগে কখনও দেখেন নি। একজন শ্রমিকের মন্তব্যে তাঁদের মনোভাবের ধরনধারণ ফুটে উঠল : ‘জানি নে … ইউরোপে শ্রমিকদেরও হয়ত তাঁর মতো বিচক্ষণ কেউ রয়েছেন – হয়ত বেবেল, কিংবা অমনি আর কেউ। কিন্তু, এঁকে একেবারে প্রথম বার দেখতেই যা ভাল লাগল এমন আর কেউ থাকতে পারেন বলে মনে হয় না!’
আর একজন মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তার উপর বললেন : ‘উনি আমাদেরই একজন।’

‘তেমনি প্লেখানভ!’ বলল আর একজন।

উত্তর হল : ‘প্লেখানভ হলেন মাস্টার-মশাই, কর্তা, আর লেনিন হলেন কমরেড আর নেতা!’

… একবার ভ্লাদিমির ইলিচ রেস্তরাঁয় যাবার পথে একজন মেনশেভিক শ্রমিক এগিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে কথা বলে। এই তরুণটি তাঁকে কি যেন জিজ্ঞাসা করল; লেনিন আস্তে আস্তে চলতে চলতে আর সবার পিছনে পড়ে গেলেন। মিনিট পাঁচেক পরে রেস্তরাঁয় পৌঁছে তিনি একটু ভ্রু কুঁচকে বললেন : ‘এমন অতি-সরল ছেলে একেবারে পার্টি কংগ্রেস অবধি পৌঁছে গেল – অদ্ভুত বটে! আমাদের মতভেদের আসল কারণটা সে জানতে চাইল। ‘তা’ আমি বললাম, ‘আপনারা কমরেডরা পার্লামেন্টে গিয়ে বসতে চান, আর আমরা নিশ্চিত যে, শ্রমিকশ্রেণীর তৈরি হওয়া চাই লড়াইয়ের জন্যে।’ বুঝল বোধহয় আমার কথাটা …’

আমরা অল্প কয়েকজন সব সময়েই এই ছোট সস্তার রেস্তরাঁটায় খেতাম। আমি লক্ষ করেছিলাম ভ্লাদিমির ইলিচ খেতেন কম : একটা অমলেট, এক টুকরো বেকন, আর তার সঙ্গে এক পাত্র ঘোর রঙের ঘন বীয়ার। স্পষ্টতই নিজের কথা তিনি ভাবতেন না একটুও – যদিও শ্রমিকদের জন্যে তাঁর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল আশ্চর্য। শ্রমিকদের খাবার ব্যবস্থা করবার ভার ছিল ম. ফ. আন্দ্রেয়েভার উপর – তাঁর কাছে তিনি বারবার জানতে চাইতেন : ‘আমাদের কমরেডদের খাবার যথেষ্ট হচ্ছে তো? পেট ভরছে তো সবার? হুঁ … দেখবেন, স্যান্ডউইচ আরও কিছু বেশি করলে বোধহয় ভাল হয়?’

… ১৯১৮ সালের শরৎকালে সরমভোর শ্রমিক দ্মিত্রি পাভলভের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর মতে লেনিনের কোন বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে।
‘সরলতা! তিনি একেবারে সত্যেরই মতো সহজ-সরল’, এতটুকু ইতস্তত না করে তিনি এই উত্তর দিলেন – যেন দীর্ঘকাল যাবৎ সুপ্রতিষ্ঠিত একটা বাস্তব উপাদানের পুনরুক্তি করলেন মাত্র।

… তাঁর মনে যাকিছু ছাপ পড়ত সেগুলি যে কী স্বাভাবিকভাবে, কী অনায়াসে মিলিত হয়ে একটিমাত্র চিন্তাধারায় পরিণত হত তার বর্ণনা দেওয়া বড় শক্ত।
কম্পাসের কাঁটার মতো তাঁর চিন্তা সব সময়েই ঘুরে দাঁড়াত মেহনতী মানুষের শ্রেণী-স্বার্থের দিকে। … পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনে বিশৃঙ্খলার কথা তিনি বললেন, বললেন কী বিরাট পরিমাণ কাঁচামালের অপচয় হয়, এবং এ বিষয়ে বই লেখার কথা কেউ এখনও ভাবে নি বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন। কথাটা আমার কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হল না, – কিছু প্রশ্ন করব, কিন্তু ইতোমধ্যেই দেখি বিশেষ ধরনের নাট্যশিল্প রূপ হিসেবে ‘খামখেয়ালীপনা’ সম্বন্ধে তিনি রীতিমতো চিত্তাকর্ষক কথা জুড়ে দিয়েছেন।
‘এ হল যা প্রচলিত তার প্রতি ব্যঙ্গ কিংবা সংশয়ের মনোভাব, সেটাকে ভিতর-বার উল্টো করে দেখাবার প্রবল তাগিদ, সেটাকে একটু বিকৃত করে, যাকিছু প্রচলিত তার মধ্যেকার অযৌক্তিক উপাদানটাকে খুলে ধরবার ব্যাপার। বেশ জটিল – আর চিত্তাকর্ষক।’

দু’ বছর পরে কাপ্রিতে কাল্পনিক উপন্যাস নিয়ে আ. আ. বগ্দানভ-মালিনভ্স্কির সঙ্গে আলোচনায় তিনি বলেছিলেন : ‘সমস্ত তৈল, লোহা, কাঠ, আর কয়লার অপচয় করে পুঁজিবাদী লুটেরারা কিভাবে পৃথিবীটাকে ছারখার করেছে তাই নিয়ে শ্রমিকদের জন্যে একখানা উপন্যাস আপনার লেখা উচিত ছিল। বইখানা কাজের হত, শ্রীমান মাখপন্থী!’

… প্যারিসে একটি ছাত্রের ছোট দু’-কামরা ফ্ল্যাটে তাঁর সাথে আমার আবার দেখা হয়েছিল …। চা দিয়ে নাদেজদা কনস্তান্তিনোভনাক্রুপস্কায়া কোথায় যেন গেলেন – শুধু আমরা দুজনে রইলাম। …

নিজস্ব আশ্চর্য সতেজ ভঙ্গিতে আর স্বচ্ছ করে তিনি বলতে আরম্ভ করলেন … কতকগুলো প্রমাণ দেখিয়ে বললেন, যুদ্ধ আসতে দেরি নেই – এবং বোধহয় একটা নয়, একটার পর একটা করে কয়েকটা যুদ্ধ।’ এই ভবিষ্যদ্বাণী অনতিবিলম্বেই খেটে গেল বলকানে।

… ‘যুদ্ধ আসছে। এটা অনিবার্য। পুঁজিবাদী দুনিয়াটা পঁচে-গলে গেঁজে উঠেছে, লোকে শোভিনিজম আর জাতীয়তাবাদের বিষ গিলতে আরম্ভ করেছে। আমার মনে হয় একটা সারা ইউরোপ-জোড়া যুদ্ধই আসছে। প্রলেতারিয়েত? রক্তস্নান রোধ করবার শক্তি প্রলেতারিয়েতের হবে বলে তেমন মনে করতে পারছি নে। কি করে সম্ভব? সারা ইউরোপ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘট? শ্রমিকরা সে জন্যে যথেষ্ট সংগঠিতও নয়, যথেষ্ট শ্রেণীসচেতনও নয়। এমন ধর্মঘট হবে গৃহযুদ্ধের সূচনা, কিন্তু বাস্তববাদী রাজনীতিক হিসেবে আমরা তেমন কিছুর উপর নির্ভর করতে পারি নে।’

একটু থেমে ভাবতে ভাবতে জুতোর তলা দিয়ে মেঝেয় ঠোকা দিতে দিতে বিষণ্ন গলায় বললেন : ‘স্বভাবতই, প্রলেতারিয়েতের ক্ষতি হবে ভয়ানক, – আপাতত প্রলেতারিয়েতের কপালে তাইই আছে। তবে, প্রলেতারিয়েতের শত্রুরাও পরস্পরকে দুর্বল করে দেবে; সেটাও অবশ্যম্ভাবী।’

উনি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। বিস্ময়ের সুরে, জোর দিয়ে, কিন্তু শান্তভাবে বললেন, ‘ভাবুন তো একবার ব্যাপারটা! ভুরিভোজে পরিতৃপ্ত যারা তারা খেতে-না-পাওয়া মানুষগুলোকে কাটাকাটির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে কিসের জন্যে – ভাবুন একবার! ভাবতে পারেন, এর চেয়ে নির্বোধ, এর চেয়ে জঘন্য পাপাচার আর কিছু হতে পারে? এর জন্যে শ্রমিককে ভয়াবহ মূল্য দিতে হবে, কিন্তু শেষপর্যন্ত জয়ী হবে শ্রমিক; সেটাই ইতিহাসের অনুজ্ঞা।’

ইতিহাসের কথা তিনি বলতেন প্রায়ই, কিন্তু ইতিহাসের অনুজ্ঞা আর ক্ষমতা যেন নিয়তির মতো বলে সেটা মাথা পেতে মেনে নেবার মতো কোনো কথা তাঁর মুখে কখনও শুনিনি।

… তবে, কাপ্রিতে দেখেছিলাম আরও এক লেনিনকে : অতি চমৎকার কমরেড, হাসিখুশি মানুষটি – দুনিয়ায় সবকিছুর প্রতি তাঁর অখর্ব আগ্রহ, মানুষের প্রতি আশ্চর্য সহৃদয় তাঁর ব্যবহার।

… ১৯১৯-এর নিদারুণ, ভুখা বছরটায় কমরেডরা এবং বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সৈনিক আর কৃষকেরা লেনিনকে যে খাবার পাঠাতেন সেগুলো খেতে তিনি লজ্জা পেতেন। তাঁর ফ্ল্যাটটা মোটেই আরামের ছিল না – সেখানে সব পার্সেল এলে তিনি ভ্রুকুটি করতেন, বিব্রত বোধ করতেন, তারপরে, যাঁরা অসুস্থ কিংবা তাঁর কমরেডদের মধ্যে যাঁরা পুষ্টির অভাবে দুর্বল তাঁদের মধ্যে ময়দা, চিনি আর মাখন ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিতেন। আমাকে তাঁর সঙ্গে খেতে ডেকে বললেন : ‘আস্ত্রাখান থেকে কিছু ধূম-শুঁটকি মাছ – খাওয়াতে পারি আপনাকে।’

সক্রেটিস-ধাঁচের ভ্রুজোড়া কুঁচকে তেরচা প্রখর দৃষ্টি ফেলে তিনি আরও বললেন : ‘সবাই জিনিসপত্র পাঠিয়ে চলেছে – যেন আমি তাদের মালিক! কিন্তু এটা ঠেকাই বা কেমন করে? নিতে অস্বীকার করলে কেউ দুঃখিত হবে। অথচ, সর্বত্র সবাইই তো না-খেতে-পাওয়া।’

তাঁর কোনো বিশেষ চাহিদা ছিল না, মদ্যপান আর ধূমপান বিষয়টাই তাঁর জানা ছিল না, সকাল থেকে রাত অবধি ব্যস্ত থাকতেন কঠিন আর জটিল সব কাজে, নিজের প্রয়োজনের দিকে নজর দিতে তিনি একেবারেই জানতেন না, তবু, নিজের কমরেডদের জীবনযাত্রার উপর কিন্তু প্রখর নজর রাখতেন। একদিন ডেস্কে বসে কি যেন লিখছিলেন।

‘এই যে, কেমন আছেন?’ কাগজ থেকে কলম একটি বারও না তুলেই তিনি বললেন, ‘এক মিনিট শেষ করছি। এক প্রদেশে একজন কমরেড একেবারে তিক্ত-বিরক্ত হয়ে গেছেন – স্পষ্টতই তিনি ক্লান্ত। তাঁর মন ভাল করবার চেষ্টা করা দরকার। মানুষের মেজাজ দরকারী জিনিস!’

… নিজের সম্বন্ধে তিনি এত উদাসীন ছিলেন যে, এমন সব বিষয় নিয়ে কখনও কারও সঙ্গে কথা বলেন নি, তেমনি, নিজের অন্তরে কোনো ঝড় বইতে থাকলে সেটা গোপন রাখতে লেনিনের চেয়ে ভাল আর কেউ পারতেন না। একবার মাত্র, গোরকি-তে যেন কার ছেলেমেয়েদের আদর করতে করতে বলেছিলেন : ‘এরা আমাদের চেয়ে ভাল থাকবে; আমাদের যা-কিছুর ভিতর দিয়ে আসতে হয়েছে তার অনেককিছু এদের অজ্ঞাতই থেকে যাবে। এদের জীবন অত কঠোর হবে না।’
পাহাড়ের গায়ে শান্ত-স্নিগ্ধ হয়ে রয়েছে গ্রামখানি – সেদিকে তাকিয়ে কিন্তু তিনি বিষণ্ন সুরে বললেন : ‘তবে, যা-ই হোক না কেন, ওদের আমি হিংসে করি নে। আমাদের প্রজন্ম আশ্চর্য ঐতিহাসিক তাৎপর্যসম্পন্ন একটা কাজ করতে পেরেছে। যে-অবস্থা আমাদের বরদাস্ত করতে হয়েছে, যা কঠোর ছিল আমাদের জীবন, সেটা সবাই বুঝবে এবং সেটার যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন হবে। এটা সবাই বুঝবে – সবটাই বুঝবে!’

… তখন তিনি অসুখের মুখে এবং একেবারে ক্লান্ত-অবসন্ন, তবু ১৯২১ সালের ৯ আগস্ট তারিখে তিনি আমাকে এই সংক্ষিপ্ত পত্র লিখেছিলেন : ‘আ. ম.!’ ‘আপনার চিঠিখানা ল. ব. কামেনেভের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি বড় ক্লান্ত – কিছু করতে পারছি নে। এখনও আপনার রক্ত-ওঠা রোগ হচ্ছে, তবু আপনি যাবেন না! এটা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি অবিবেচনার কাজ। ইউরোপের কোনো ভাল স্বাস্থ্যনিবাসে গেলে আপনি ভাল হয়ে যাবেন এবং তিন-গুণ বেশি কাজ করতে পারবেন। আমাকে বিশ্বাস করুন, এখানে কোনো সুচিকিৎসা হবে না, এখানে শুধু বাহ্যাড়ম্বর আর হয়রানি, নিরর্থক বাহ্যাড়ম্বর আর হয়রানি, কিন্তু বিশেষ কিছু হবার নয়। এখনই চলে যান – ভাল হয়ে ওঠুন। আমি মিনতি করে বলছি, অমন একগুঁয়ে হবেন না! – ‘আপনার লেনিন’

আশ্চর্যভাবে লেগে থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে তিনি আমাকে রাশিয়ার বাইরে যেতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে চলেছিলেন, আর ঠিক ভেবে পেতাম না যে, নিজের কাজে একেবারে নিমগ্ন থেকেও কী করে তাঁর মনে থাকত কোথায় কে অসুস্থ, তার বিশ্রাম দরকার।
এ রকমের চিঠি তিনি লিখতেন বিভিন্ন লোকের কাছে – বোধহয় এমন কুড়ি-কুড়ি লোকের কাছে। …

… তিনি এমন একজন রাশিয়ান যিনি দীর্ঘকাল যাবত রাশিয়ার বাইরে থেকে দেশকে মনোযোগ দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, তাতে তাঁর মনে হয়েছে, দূর থেকে দেখতে দেশ আরও বেশি প্রাণবন্ত, আরও বেশি বর্ণাঢ্য। দেশের নিহিত সুপ্ত শক্তি – জনগণের অসাধারণ প্রতিভা, তখনও যার প্রকাশ হয়েছে ক্ষীণ, যাকে ইতিহাস জাগিয়ে তোলে নি, যা তখনও চলছিল খুঁড়িয়ে, তখনও নিরানন্দ, তার নির্ভুল মূল্যায়ন তিনি করেছিলেন: তিনি দেখেছিলেন, দেশের সর্বত্র রয়েছে প্রতিভা এবং সবকিছু সত্ত্বেও, সেই প্রতিভা রাশিয়ার অদ্ভুত জীবনের বিষণ্ন পটভূমিটাকে ছেয়ে রয়েছে সোনালী তারার মতো।

এই দুনিয়ার মানুষের মতো মানুষ ভ্লাদিমির লেনিন চলে গেছেন। যাঁরা তাঁকে জানতেন তাঁদের উপর বেদনাদায়ক আঘাত হয়ে এসেছে এই মৃত্যু – অতি বেদনাদায়ক এ আঘাত!

কিন্তু মৃত্যুর কালো রেখাটা তাঁর গুরুত্বটিকে – পৃথিবীর মেহনতী মানুষের এই নেতার গুরুত্বটিকে সারা পৃথিবীর দৃৃষ্টিতে আরও বিশিষ্ট করেই তুলবে।

তাঁর বিরুদ্ধে সৃষ্টি করা বিদ্বেষের মেঘ, তাঁকে ঘিরে ছড়ানো মিথ্যা আর কুৎসার মেঘ যদি আরও ঘনও হত, তবু, উন্মত্ত পৃথিবীর দমবন্ধ করা অন্ধকারের মধ্যে তিনি যে আলোকবর্তিকা তুলে ধরেছিলেন সেটা একটুও নিষ্প্রভ হত না।

সারা পৃথিবীরই কাছে এতখানি স্মরণীয় মানুষ আর কেউ নন। …

সাম্যবাদ জানুয়ারি ২০১৫

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments