Monday, April 29, 2024
Homeছাত্র ফ্রন্টনারী নির্যাতন — প্রতিরোধে চাই গণতান্ত্রিক - সাংস্কৃতিক আন্দোলন

নারী নির্যাতন — প্রতিরোধে চাই গণতান্ত্রিক – সাংস্কৃতিক আন্দোলন

11335670_10153304661764004_238403957_o [dropcap]সি[/dropcap]মির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের। নারায়ণগঞ্জের চারুকলার মেধাবী ছাত্রী। পত্রিকার পাতায় বড় করে ছবি এসেছিল তার। কিংবা গাইবান্ধার স্কুলছাত্রী তৃষার কথা। ছবি দেখলে অবশ্যই আপনাদের মনে পড়বে। অথবা ইলোরা, রেশমা, পিংকীর কথা। কিংবা দিনাজপুরের সেই মেয়েটি – ইয়াসমিনের কথা। না, রেজাল্ট ভালো করায় কৃতি ছাত্রী হিসেবে এদের ছবি পত্রিকায় আসেনি। কিংবা কোনো বিশেষ কৃতিত্বের জন্য এই নামগুলো শিরোনাম হয়নি। শুধুমাত্র নারী হবার কারণে এদের সবাইকে আত্মহত্যা কিংবা হত্যার শিকার হতে হয়েছে। এক একটা নারী নির্যাতনের নৃশংস ঘটনা ঘটে আর পুরোনো একটি নাম ভুলে গিয়ে সামনে আসে নতুন আরেকটা নাম। প্রথম দিকে এ ধরনের খবরগুলো পড়ে আমরা আঁৎকে উঠি। কিন্তু একের পর এক ঘটনা শুনতে শুনতে আমাদের সংবেদনশীলতাও কমে যায়।

পহেলা বৈশাখ ১৪২২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি প্রাঙ্গণে বর্ষবরণ উৎসবে এসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছিলেন অনেক নারী। ৩০-৩৫ জনের সংঘবদ্ধ চক্র সেদিন লাঞ্ছিত ও বিবস্ত্র করেছিল নারীদের। ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা লিটন নন্দীসহ কয়েকজন প্রতিহত করার চেষ্টা না করলে পুরো ব্যাপারটা আড়ালেই থেকে যেত। ঘটনাস্থল থেকে হাতেনাতে দুজনকে ধরে তারা পুলিশে সোপর্দ করেছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়! বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানালে তিনিও ছিলেন নির্বিকার। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে দোষীদের চেহারা ধরা পড়েছিল। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অপরাধীদের চিহ্নিত করেছে। কিন্তু খুঁজে পায়নি কেবল পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একই দিনে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়েছিলেন এক ছাত্রী। প্রায় একই সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে আরেকটি ঘটনা। এ্যাকাউন্টিং বিভাগের শিক্ষক ড. সাখাওয়াত হোসেন অনেকদিন ধরেই এক ছাত্রীকে অশ্লীল প্রস্তাব দিয়ে আসছিল। পরবর্তীতে ছাত্রীকে শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনার প্রতিবাদ চলাকালীন সময়ে লোক প্রশাসন বিভাগের একজন শিক্ষিকা লুবনা জেবিনকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতা আরজ মিয়া। লুবনা জেবিন সাহসিকতার সাথে আরজ মিয়াকে ধরে ফেলেন ও তাকে প্রক্টরের কাছে সোপর্দ করেন। সেখান থেকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হলে পরবর্তীতে পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়। অভিযোগ এসেছে, ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আরজ মিয়াকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে এনেছিল। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ছাত্রলীগ নেতা আরজ মিয়াকে আজীবন বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু অভিযুক্ত শিক্ষক সাখাওয়াৎ হোসেনের বিরদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক বিষয় হলো, বর্ষবরণে নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা। এক মাসেও অভিযুুক্তদের গ্রেপ্তার করতে না পারার ব্যর্থতার দায় স্বীকার তো দূরের কথা, উল্টো গত ১০ মে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে পুলিশ বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে আহত করেছে ৩৪ জনকে। প্রগতিশীল ছাত্র জোট ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ছাত্র ঐক্যের প্রায় এক মাস ধরে ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে সম্প্রতি পুলিশ বর্ষবরণের ঘটনায় ৮ জন যৌন নিপীড়ককে চিহ্নিত করেছে এবং ধরিয়ে দিতে পারলে এক লক্ষ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। প্রথমদিকে এমন ঘটনা ঘটেনি বলে ধামাচাপা দিতে চাইলেও আজ আন্দোলনের চাপে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দোষীদের ধরবার কথা বলতে হচ্ছে।

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে নারীর নিরাপত্তার হাল যখন এই, তখন দেশের নগরে-গ্রামে নারীর অবস্থা কি — তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর ইন্টারনেটে ভিডিও ছেড়ে দেয়া, হত্যা করা-এমন কোনো বীভৎসতা নেই, যা এদেশে ঘটছে না। যেকোন পুরুষের দিকেই আজ তাই সন্দেহের দৃষ্টি। অবয়বের ভিতরের মানুষটি বেঁচে আছে তো? পুরোনো মূল্যবোধের এক একটা ইট যেন সমাজদেহ থেকে খসে পড়ছে বহু বছরের পুরোনো অট্টালিকার মতো।

ঘটনাগুলো প্রকাশিত হবার পর বিভিন্ন স্তরের মানুষের প্রতিক্রিয়ার ধরন বিভিন্ন রকম। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা এই ঘটনার নিন্দা করেছেন। আবার অনেকে মনে করছেন যে, মেয়েরা উৎসবে না গেলেই তো পারে। বেশি ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের না যাওয়াই শ্রেয়। অনেকে বলেছেন, মেয়েদেরও হয়তো কোনো দোষ ছিল। প্রশ্ন তুলেছেন, মেয়েদের পোশাক পরিচ্ছদ ঠিক ছিলো তো? বুঝে হোক না বুঝে হোক, নির্যাতকদের রক্ষাকারী এমন যুক্তির আড়ালে আমরা ভুলে যাই, এই ঘটনাগুলোর মূল কারণ কি। প্রতিকারের দায়িত্ব যাদের, তাদের ভূমিকা মূল কারণকে যেমন আড়াল করে, তেমনি অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়।

এরা রক্ষক নাকি ভক্ষক?

দায়িত্বশীল (!) ব্যক্তিবর্গের কিছু ভাষ্য শুনুন—

ঊর্ধ্বতন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘বিবস্ত্র করার ঘটনা জানা নেই।’ তদন্তের আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলেছেন, ‘ঘটনার সাথে বহিরাগতরা জড়িত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ যুক্ত নয়।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বলেছেন, ‘ঘটনার মাত্রা কতটুকু তা আমাদের দেখতে হবে।’ কোষাধ্যক্ষ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘রাত ৯টার পর মেয়েদের বাইরে বেড়ানোর দরকার কি?’ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বরাবরের মতো বলেছেন, ‘এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। পুরোপুরি বিবস্ত্র করার ঘটনা ঘটেনি। এই অবস্থায় পুলিশ ব্যবস্থা নিলে নিরাপরাধ মানুষও ভিক্টিম হতে পারে।’ সর্বশেষ পুলিশের আইজিপি বলেছেন, ‘পহেলা বৈশাখের ঘটনা কয়েকটি ছেলের দুষ্টমি!’

সারাদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে যে ঘটনা এমন ধিক্কারযোগ্য, দায়িত্বশীলদের (!) সংবেদনে তার কোনো প্রকাশ আছে কি? কিংবা দায়িত্বপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ? এভাবে দায়হীন ভাষ্য এবং এর পেছনের মানসিকতা অপরাধ নির্মূলের পরিবর্তে বারবার ঘটনার প্রেক্ষাপট তৈরি করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সব ঘটনার মতো এটিও একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা! নিরাপরাধ ব্যক্তি ভিক্টিম হবে — সেজন্য পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে না? রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা দিয়ে পালিত পুলিশের অপরাধী সনাক্ত করার সামান্য মুরোদও নেই? কোষাধ্যক্ষের ভাষ্য বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায় তা হলো, সন্ধ্যেয় বের হওয়াটাই মস্ত অপরাধ! নিপীড়নটা তাই ন্যায্য ও যৌক্তিক! ফলে বিচার করার কি আছে? পুলিশের আইজিপি উষ্মা প্রকাশ করলেন এ জন্য যে, ঘটনাস্থলের আর কেউ এগিয়ে এলো না কেন! তার উষ্মা এজন্য নয় যে, পুলিশে সোপর্দ করা দুই জনকে ছেড়ে দেয়া হলো কেন? এ ঘটনাসহ সাম্প্রতিকসময়ে সংঘটিত অভিজিৎ হত্যাকা- এবং এর পূর্বাপর আলোচিত ঘটনাসমূহে দোষীদের খুঁজে বের করার অক্ষমতার প্রকৃত কারণ সন্ধান করা জরুরি।

দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি ধর্ষক-নির্যাতকদের মদদদাতা

আজ যে সমাজে প্রতিদিন ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তা কি এমনি এমনি ঘটছে? স্বাধীনতার আগে তো এমন পরিস্থিতি ছিল না। এ ধর্ষকরা কারা? তিন বছরের শিশু কন্যা থেকে ৬০ বছরের বৃদ্ধা নারী যে কাউকে ধর্ষণে তাদের বিবেক এতটুকু কেঁপে ওঠে না কেন? এরা কি জন্ম থেকেই ধর্ষক? এদের তৈরি করছে কে? যাদের হাতে সমাজের ভার, শাসনের ভার তারা কি দায়ী নয়? তা না হলে মন্ত্রী, পুলিশ কর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-প্রক্টর সবাই মিলে একই কোরাসে গাইবেন কেন? ‘এ আর এমন কিছু নয়’, ‘সামান্য দুষ্টমি’ এভাবে বলে ঘটনাকে গুরুত্বহীন করে তুলতে চাইবেন কেন? দায়িত্ব অস্বীকারের এ প্রবণতাই বা সাধারণ চিত্র হয়ে উঠছে কেন? আসলে এই ব্যবস্থার চালকের আসনে আজ যারা বসে আছে তারা জানে, যুবকদের মনুষ্যত্ব ধ্বংস করতে না পারলে, বিবেকহীন অমানুষ বানাতে না পারলে শোষণ-লুটপাটের এ ব্যবস্থার ভিত্তি টিকবে না। তারা চায় যুবকরা মদ-গাঁজায় ডুবে থাকুক, বিবেকবর্জিত নোংরা আনন্দে মেতে থাকুক। কেননা কোটি কোটি বেকার যুবকের যদি নৈতিক মেরুদ- থাকে, আদর্শ থাকে, সংবেদনশীল মন থাকে, মানবিক মূল্যবোধ থাকে, তাহলে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। যুবকরা নোংরা পর্নো সিনেমা দেখুক, প্রবৃত্তিতাড়িত বিকারে ডুবে যাক—এটাই তাদের চাওয়া। শরৎচন্দ্র বলেছিলেন, মানুষকে পশুর স্তরে না নামালে তাকে দিয়ে পশুর কাজ করানো যায় না।’ এভাবে এই অধঃপতিত রাজনীতি সমাজে প্রতিনিয়ত ক্রিমিনালের জন্ম দিচ্ছে। যুক্তিবাদী মননের বদলে এই সমাজ মানুষকে বানাচ্ছে মেশিন। বেকার যুবকদের নিয়ে বিবেকহীন বাহিনী তৈরি করছে। এদের দিয়ে চাঁদাবাজি-খুনখারাবি করিয়ে, বিরোধী পক্ষকে দমন করে কর্তৃত্ব আর কায়েমী স্বার্থকে বজায় রাখছে।

একদিন নারী স্বাধীনতার কথা বলেছিল পুঁজিবাদ
আজ নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে

আমরা জানি, একদিন নারীরা ছিল গৃহবন্দি। তাদের স্বাধীন ইচ্ছার কোনো মর্যাদা ছিল না। ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তা তাদের পদে পদে শৃঙ্খলিত করে রেখেছিল। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পত্তনের কালে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার স্লোগান উচ্চারিত হলো। নারীদের সম্পর্কে পুরোনো অনেক ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ঘটতে লাগল। বিজ্ঞান ও যন্ত্রের ব্যাপক বিকাশের ফলে নারীদের ঘর থেকে বের করতে হলো, ধর্মের বিধি-নিষেধ অনেক আলগা হয়ে গেল। নারী শ্রমিকরা লড়াই করে অর্জন করেছিল তাদের ভোটাধিকার, সমকাজে সম-মজুরির দাবি তুলেছিল। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এই অবস্থা বজায় রাখতে পারল না। ক্রমে একচেটিয়া পুঁজির সৃষ্টি হলো, ব্যক্তিমালিকানা ও মুনাফা নিশ্চিত করতে গিয়ে সামাজিক উদ্দেশ্য ও স্বার্থকে ক্ষুন্ন করে জন্ম দিল নিকৃষ্ট ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। এখন পুঁজিবাদের আদর্শ হয়েছে ‘খাও দাও স্ফূর্তি কর।’ নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে এমনকি সাহিত্যে সর্বত্র ভোগবাদের জয়গান। নারীকে নগ্ন, অর্ধনগ্ন হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের বইয়ে এটা এখন স্বীকৃত তত্ত্ব যে, পণ্য বিক্রির জন্য সবচেয়ে কার্যকরী ও অব্যর্থ সধৎশবঃরহম ঢ়ড়ষরপু হলো যদি পণ্যের সাথে ংবী ধঢ়ঢ়বধষ ভোক্তার সামনে রাখা যায়। তাই সাবান, তেল, শেভিং ক্রীম বা পারফিউম যাই হোক না কেন, সেটি বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপনে তার সাথে উপস্থাপিত হয় আরেকটি পণ্য — নারীদেহ। খেলার সৌন্দর্য্য আজ তাই আর যথেষ্ট নয়, দর্শক মাতাতে আমদানি করা হয়েছে স্বল্পবসনা চিয়ার্স গার্লদের। এভাবে দেখতে দেখতে মানুষ হিসেবে নারীর প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ থাকে না।

এ সমাজে যুবক-তরুণদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার সুযোগ নেই

জন্মের পর থেকে পদে পদে একজন মেয়েকে যেমন সবকিছু মানিয়ে চলতে শেখানো হয়, ঠিক তেমনি একজন পুরুষকেও প্রচ- পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় গড়ে তোলা হয়। দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাতেও একজন মানুষকে কূপমন্ডুক-পশ্চাৎপদ চিন্তা ও বৈষম্যের মানসিকতা থেকে বের করার আয়োজন নেই। তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থায় (মাদ্রাসা, বাংলা, ইংরেজি) বৈষম্যকে স্থায়ী রূপ দেয়া হয়েছে। মাদ্রাসা আর ইংরেজি মাধ্যমের একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে মানসিকতা-সংস্কৃতি-আর্থিক সামর্থ্যরে বিশাল পার্থক্য তৈরি হয়ে আছে। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত একজন ছাত্রের কোনো সুযোগই থাকে না গণতান্ত্রিক দৃষ্টিতে নারীকে দেখার। বাচ্চাদের শেখানো হয়, পুরুষের প্রয়োজনেই নারীর সৃষ্টি, স্ত্রী হলো স্বামীর শস্যক্ষেত্র, স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত, নারীর কাজ ঘর সামলানো-সন্তান উৎপাদন করা, নারী-পুরুষের একসাথে মেলামেশা-চলাফেরা করা উচিৎ নয় তাতে ব্যভিচার জন্ম নিতে পারে, নারী নেতৃত্ব হারাম ইত্যাদি। মূলধারার শিক্ষাতেও আমরা অংক করতে করতে বড় হই — ‘একটি কাজ দুইজন পুরুষ করে চার দিনে, আর চারজন নারী করে চার দিনে। কাজেই একজন পুরুষ = দুইজন নারী।’ মেয়েদেরকে অধিকাংশ স্কুলে পড়ানো হয় গার্হস্থ্য অর্থনীতি আর ছেলেদের কৃষিশিক্ষা। ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়, মেয়েদের কাজ কোনটা আর ছেলেদের কোনটা।

পড়াশুনার ধরন এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছে যে, খেলাধুলাসহ নানা বিষয়ের উপর বইপড়া এসব অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার। খেলার মাঠ বেদখলে। গানের নামে চলছে উচ্চলয় আর যন্ত্রের শব্দের মাঝে প্রবেশ করানো অশ্লীল শব্দ ও হালকা কথাবার্তার পরিবেশনা। শিশু-কিশোররা এগুলোই শুনছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বসানো আছে সাইবার ক্যাফে আর ভিডিও গেমসের দোকান। মোবাইলে পর্নোগ্রাফি এখন হাতের মুঠোয়। একদিকে চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিকতা, অন্যদিকে ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রভাবে বড় হয়ে উঠছে আমাদের ভাই-বোনেরা। মাদকদ্রব্য তো অলি-গলিতেই মেলে। খোদ ঢাকা শহরে দৈনিক ১২ কোটি টাকার ইয়াবার ব্যবসা হয়। এসব জিনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতেও পাওয়া যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একমাত্র কার্যকারিতা হচ্ছে চাকুরি পাবার এবং এই ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য উপযুক্ত করা। নীতি-আদর্শ এগুলো আজ সব কেতাবি বিষয়।

ফলে নিজের স্বার্থসুবিধা, ভোগ আকাক্সক্ষাই যেখানে সর্বাগ্রে—সেখানে সুযোগ পেলে নারীকে নিপীড়ন করার মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পাওয়া যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। পুঁজিপতিতরাও চাইছে, পণ্য বিক্রি করো, দরকার হলে প্রবৃত্তিকে উসকে দাও, অমানুষ করো, তাও পণ্য কেনাও। নারীর প্রতি বিকৃত রুচিহীন ভোগলিপ্সা এই আয়োজনগুলিরই ফলাফল। ফলে কোনো একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার বিচার ও শাস্তি যেমন আমরা চাইবো, তেমনি রাষ্ট্রীয় মদদে তরুণদের চরিত্র নষ্ট করার এ সর্বগ্রাসী আয়োজনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।

পরিবার ও প্রথাগত নিয়ম-কানুনের মধ্যেও নারীর সমান অধিকার নেই

নারীকে সমমর্যাদায় দেখার দৃষ্টিভঙ্গিতে বড় হয়ে উঠার শিক্ষা এমনকি আমরা পরিবার থেকেও পাইনা। কেননা পরিবারও দেশের প্রচলিত ব্যবস্থার সাথে যুক্ত হয়ে পরিচালিত হয়। দেশের প্রচলিত ব্যবস্থা যেহেতু শোষণমূলক, দুর্বলের উপর সবলের নিয়ন্ত্রণ Ñ পরিবারেও তেমনি পুরুষের দ্বারা নারীরা নিয়ন্ত্রিত হয়। ধর্মীয় ও প্রচলিত নিয়ম-কানুনে সম্পদ ও সম্পত্তির মালিকানা প্রধানত পুরুষের হাতে থাকে, নারীদের তাতে অধিকার নেই। ‘নারী পুরুষের অর্ধেক’ এই নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হয় বলে পরিবারগুলোতে খুব ছোটকাল থেকেই একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মধ্যে সূক্ষ্মভাবে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ক্রিয়া করতে থাকে। নারীরা পুরুষের অধঃস্তন – এই বোধ পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্রে কাজ করে। সুতরাং পরিবারও নারীকে সমান মর্যাদা দেয়া কিংবা শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সাথে নারীকে গ্রহণ করার শিক্ষা আমাদের দেয় না। তাই পরিবারে নারীরা নানাভাবে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। সভ্যতা পত্তনের পর থেকে মানুষের সমাজব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন এসেছে সত্যি কিন্তু শোষণমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি। নারীর প্রতি সাম্যের দৃষ্টিভঙ্গি আসেনি যদিও সাম্যের কথা স্লোগানের অর্থে উচ্চারিত হয়েছে। ফলে সমাজের দুর্বল অংশ হিসেবে নারীরা সবসময়ই এই শোষণের শিকার হয়েছে।

ভোগবাদী সংস্কৃতির প্রভাব নারীদের মধ্যেও পড়ছে

প্রচলিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি মেয়েদের মানবিক গুণাবলীর পরিবর্তে দৈহিক সৌন্দর্য্যরে যে দিকটিকে তুলে ধরতে চায়, বুঝে হোক না বুঝে হোক মেয়েরাও এর দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। এর কারণ ছোটবেলা থেকেই পরিবার ও চারপাশের পরিবেশে এ শিক্ষা তাকে দেয়া হয় না — মানুষ হিসেবে মনুষ্যত্বের সাধনাই তার কর্তব্য; সকল সংস্কার ও সামাজিক অবিচার-বৈষম্যের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোতেই তার মর্যাদার আসন। উল্টো বিজ্ঞাপন, সিনেমা, নাটকে প্রতিমুহূর্তেই শেখাচ্ছে— কিভাবে সিল্কি চুলে, রঙ্গিন সাজ পোশাকে, ত্বক ফর্সা করার প্রচেষ্টার মধ্যেই স্মার্ট হওয়ার রহস্য লুকিয়ে আছে। শিক্ষিত মেয়েরাও এই সংস্কৃতির শিকার। জীবনাদর্শে, মহত্ত্বে, মানবিক সৌন্দর্য্যে মডেল বা আদর্শ হবার উৎসাহ তাদের দেয়া হয় না বরং দেহের সৌন্দর্য্যে তাক লাগিয়ে ক্রেতাকে পণ্য ক্রয়ে উৎসাহিত করার জন্যই যতসব আয়োজন। এভাবে পুঁজিবাদ আজ নারীর মর্যাদাকে ভোগসর্বস্বতায় ভাসিয়ে দিয়ে বর্বর যৌন আক্রমণ নামিয়ে আনছে। আবার রক্ষণশীলরা এসব দেখিয়ে নারীকে ঘরে বন্দী রাখার চিরাচরিত ধ্বনি তুলছে।

ধর্মের নামে মৌলবাদীরা মেয়েদের ঘরে বন্দী রাখতে চায়

নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে ধর্ম ব্যবসায়ীরা ব্যাখ্যা করেন ভিন্নভাবে। তারা বলেন, নারীরা ধর্ম মেনে চললে, পর্দা করলে এ পরিস্থিতি তৈরি হত না। আল্লামা শফী নারীদের নিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘নারীরা তেতুলের মতো। নারীরা সামনে আসলে তো পুরুষদের লালা ঝরবেই।’ যারা এমন যুক্তি করেন তারা কেউই নির্যাতকদের বা অপরাধীদের শাস্তির কথা বলেন না। মনোভাব এমন যে, নারীরা ঘরের বাইরে বেড়িয়েছে , তাই লাঞ্ছিত হলে দোষ তো তাদেরই। পুরুষের আবার দোষ কি? এ মতানুযায়ী, ২৩ মাসের শিশু ধর্ষণের কারণও শিশুটি নিজে! সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের প্রিপারেটরি বালিকা উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের প্রথম ও পঞ্চম শ্রেণীর দুই শিশুকে যৌন নির্যাতন করে স্কুলের কয়েকজন কর্মচারি। ধর্মব্যবসায়ীরা কি বলবেন এটাকে? অবুঝ ওই শিশুগুলো পর্দা করেনি বলে তাদের এই পরিণতি? প্রবৃত্তির উপর মানুষ যৌক্তিক-নৈতিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বলেই অন্য প্রাণী থেকে সে আলাদা। মানুষের সমাজে যৌন সম্পর্ক ছাড়াও নারী-পুরুষের নানা-বৈচিত্র্যপূর্ণ মানবিক সম্পর্ক থাকে। স্নেহ-ভালোবাসা-শ্রদ্ধার উপর ভিত্তি করে এই সম্পর্কগুলোর কথা যারা ভাবতে পারে না, কেবল যৌনতাকেই প্রধান মনে করে, তাদের রুচি-সংস্কৃতিবোধ আদিম এবং স্থুল। তাই বলা যায়, নারী নির্যাতনের কারণ কখনই পর্দা বা পোষাক নয়, এর কারণ পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। নারীকে দেখলে যার ‘লালা ঝরে’ সেটা তার মানসিক বিকৃতি। সেক্ষেত্রে সে কতটুকু স্বাভাবিকভাবে সমাজে চলবে, তা আমাদের নির্ধারণ করতে হবে। বহু বছর আগে বেগম রেকেয়া এ প্রশ্নটি তুলেছিলেন যে, কোনো পশু যদি লোকালয়ে তা-ব করে তাহলে করণীয় কি? মানুষদের বলা হবে ঘরে বন্দি থাকতে নাকি পশুকে খাঁচায় বন্দি করা হবে? নারী-পুরুষের সহাবস্থান, নারীকে কর্মক্ষেত্রে অধিকার দেয়া — সমাজের বিকাশের জন্যই প্রয়োজন। যারা নারীকে উল্টো অবরুদ্ধ করার কথা বলেন, প্রকৃতপক্ষে তারা সমস্যার সমাধান না করে সভ্যতার চাকাকে পিছনে ঘোরাতে চান। যা কখনই কাম্য হতে পারে না।

অথচ ইতিহাস বলে নারী চিরকাল অবরুদ্ধ ছিল না

ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখি যে, নারী ও পুরুষ সমান নয়। একথা সত্য যে, বর্তমানে বড় অংশের নারীরা পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে। কিন্তু যে সত্য প্রতিমূহুর্তে আড়াল করা হয় তা হলো, মানব সভ্যতার শুরুতে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্যই ছিল না। সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণায় এটা আজ প্রমাণিত সত্য। গুহা মানব-মানবীর প্রায় কাছাকাছি শারীরিক কাঠামো কিংবা শিকারে নর-নারীর সহাবস্থানের ছবি সেই প্রমাণই দেয়। নারীর সন্তান ধারণের ক্ষমতার কারণে নারীদেরই বরং সেই সময় এগিয়ে রাখা হত। আদিম সমাজে কৃষি, পশু পালন, পোষাক বুনন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নারীদেরই ছিল অগ্রগণ্য ভূমিকা। মহান দার্শনিক ফ্রেডারিক এঙ্গেলস দেখান যে, শুরুতে মানবসমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কিন্তু সমাজে যখন স্থায়ী সম্পত্তি ও তার মালিকানা তৈরি হলো তখনই মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ল। সম্পত্তিতে ব্যক্তি মালিকানা আসার পর পরিবার ও সম্পদের কর্তৃত্ব চলে গেল পুরুষের হাতে। সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রয়োজনে বংশধারা নিশ্চিত করতেই ‘সতীত্ব’ রক্ষার নামে নারীকে গৃহবন্দি করা হলো। পরবর্তীতে ধর্মীয় ও নানা সামাজিক বিধি-নিষেধের রূপে নারীদের উপর নানা নিয়মের শৃঙ্খল আরোপিত হয়েছিল।

হাজার হাজার বছরের পিছিয়ে পড়া অবস্থান নারীদের শারীরিক-মানসিক দিক থেকে সীমাবদ্ধতা তৈরি করেছে। নারীদের আজ শারীরিকভাবে খর্বাকৃতির বা দুর্বল ভাবা হয়। প্রাণীজগতের অন্যান্য অংশের মধ্যে লিঙ্গভেদে এতটা পার্থক্য হয় না, যতটা মানুষের সমাজে হয়েছে। জীববিজ্ঞানের গবেষণায় দেখা গেছে, বহুবছর ধরে নারীদের অবরুদ্ধ করে রাখাই নর-নারীর শক্তির পার্থক্যের কারণ। তবে সমাজের সকল বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান, বিজ্ঞান, গণিতসহ সকল ক্ষেত্রে নারীদের এখন অগ্রণী অবস্থান তৈরি হয়েছে। এভারেস্ট জয় করেছে নারী। নানা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আজ একথা বলার আর উপায় নেই যে, নারীদের মস্তিষ্ক অপেক্ষাকৃত ছোট হবার কারণে পুরুষের তুলনায় তাদের বুদ্ধি কম। এটা বিজ্ঞানে ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং বলা যায়, সমাজে বৈষম্য যত কমবে, নারী-পুরুষের এই পার্থক্যও তত কমতে থাকবে।

একের পর এক নারী নিগ্রহের ঘটনা :
সরকার বা প্রশাসনের ভূমিকা সবক্ষেত্রে প্রশ্রয়মূলক

দেশে যত আলোচিত নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে, তার বিচার তো হয়ই নি উল্টো সরকার বা পুলিশ প্রশাসনের কর্মকা- প্রকারান্তরে নারী নিগ্রহকারীদেরই উৎসাহিত করছে। ত্বরিৎ ভূমিকা পালন না করে দীর্ঘসূত্রিতায় ফেলে মানুষের সংবেদনকে নিস্তেজ করতে পারলে যেকোন অন্যায়ের বিরদ্ধে অকপট লড়বার মনোভাব দুর্বল হয়ে পড়ে। শাসকরা এটা জেনেই কালক্ষেপণ করে, অপরাধীদের আড়াল করে। আবার বেশিরভাগক্ষেত্রে দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনা যেসব দুর্বৃত্তরা ঘটায় তারা ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির সাথে যুক্ত। অতীতেও আমরা দেখেছি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৮ সালে শত ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েও তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা জসীম উদ্দিন মানিক প্রশাসন ও সরকারের সহযোগিতায় দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল। দিনাজপুরে পুলিশ কর্তৃক ধর্ষিতা ও খুন হওয়া ইয়াসমিন হত্যাকা-ের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সাত জনকে জীবন দিতে হয়েছিল। কিন্তু জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ওইসকল পুলিশ সদস্যদের বিচারের মুখোমুখি করতে বাধ্য করে।

এভাবেই কি চলতে থাকবে?

বহু বছর আগে নারীজাতির দুর্দশা দেখে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘যে দেশের পুরুষজাতির দয়া নাই, ধর্ম নাই, ন্যায়-অন্যায় বিচার নাই, হিতাহিত বোধ নাই, সদ্বিবেচনা নাই, কেবল লৌকিকতা রক্ষাই প্রধান কর্ম ও পরম ধর্ম, আর যেন সে দেশে হতভাগা অবলা জাতি জন্মগ্রহণ না করে।’ সামন্ত সমাজে যে কষ্ট নিয়ে বিদ্যাসাগর একথাগুলো বলেছিলেন আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে তার তীব্রতা কতটুকু কমেছে? আমাদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা বলে, ঘরে-বাইরে কোথাও নারী নিরাপদ নয়। সামাজিক বৈষম্য যত বৃদ্ধি পেয়েছে, নারীর প্রতি নির্যাতন-নিপীড়ন তত বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং একটি সাম্যের সমাজ নির্মাণ করা ছাড়া এই গ্লানিকর অবস্থার বিলোপ ঘটবে না।কিন্তু ততদিন পর্যন্ত কি আমরা নীরবে সবকিছু মেনে নেব? একবার কল্পনা করি তো — বর্ষবরণ উৎসবে কিংবা যে কোন জায়গায় লাঞ্ছিতা নারীটি আমারই বোন বা স্ত্রী বা কন্যা অথবা আত্মীয়া! অথবা সেই নারীটি একজন স্বাধীন মানুষ, যার নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী চলবার অধিকার আছে? আমার-আপনার বোন-কন্যার এরকম দুঃসহ পরিণতি আমরা কি ভাবতে পারব? ভাবতে পারা যায় না। কিন্তু এরকমই তো হচ্ছে! ফলে আজ যদি আমরা নিষ্ক্রিয় থাকি, শত-সহস্র লাঞ্ছিতার আর্তচিৎকার যদি আমাদের বিবেকে এসে না বাজে মানুষ হিসেবে আমাদের পরিচয়ই বা থাকে কি? সমস্ত বড় মানুষেরা মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণাকে অন্তরে ধারণ করে বড় হয়েছেন, স্বেছায় সামাজিক দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আমরা কি সেই মানুষদের উত্তরসূরী নই, যারা মায়ের ভাষার মান বাঁচাতে জীবন দিয়েছিল? কোটি কোটি মানুষের বেদনার দুঃসহ ভার নামাতে ’৭১ এ যারা শহীদ হয়েছিল? এদেরই রক্ত ধোয়া স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে আমরা কি বলতে পারি— ‘আমার কি আসে যায়?’ শহীদ রুমির কথা স্মরণ করুন। ’৭১ এ যার আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার কথা ছিল। রুমি মা-কে বলেছিল, তুমি যদি বল, আমি পড়তে যাব। কিন্তু সারাটা জীবন নিজে বিবেকের ভ্রুকুটির কাছে মাথা নীচু করে থাকব। তুমি কি তাই চাও মা? মা জাহানারা ইমাম জবাব দিতে পারেননি। আমরা নিজেদের কি জবাব দেব? আমরা কি আমাদের বিবেকের কাছে মাথা নীচু করে থাকব?আসুন, কেবল ধিক্কার নয়, ঘৃণা নয়, আমাদের সক্রিয়তা দিয়ে সভ্যতার এ লাঞ্ছনা রুখে দাঁড়াই। পাড়া-মহল্লা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীনিগ্রহবিরোধী গণকমিটি গড়ে তুলি। আমাদের শিশু-কিশোর-তরুণ-যুবকদের মধ্যে বড় মানুষদের জীবন সংগ্রাম ও চরিত্রের শিক্ষা নিয়ে যাই, পরিবার থেকে কর্মক্ষেত্র সব জায়গায় নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হই। এই উন্নত সাংস্কৃতিক ও গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের মধ্য থেকে জন্ম নেবে আগামীর মানবিক সভ্যতা।

[divider]

সমাজতান্ত্র্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র, কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক ২২/১ তোপখানা রোড (৬ষ্ঠ তলা), ঢাকা -১০০০ থেকে প্রকাশিত।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments