বাংলাদেশে একটা দুর্যোগ চলছে — দুই দলের ক্ষমতাকেন্দ্রিক হানাহানির রাজনীতির কারণে এ দুর্যোগ সৃষ্টি হয়েছে। গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতার গদি দখলে রাখা আর গদিতে আসীন হওয়ার যুদ্ধে জনগণকে জিম্মি করে এ সংকট তারাই তৈরি করেছে। এখানে জনগণের কোন স্বার্থ নেই। বুর্জোয়া দলগুলো, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাত-জাতীয় পার্টি এবং তাদের সহযোগী অন্য শক্তিগুলো তো আর জনগণের কথা ভাবে না। এরা চূড়ান্ত দুর্নীতি-লুটপাট ও সুবিধাবাদিতার পঙ্কে নিমজ্জিত। তাই তাদের কাছ থেকে দেশের সচেতন মানুষ এখন আর কোনো কিছু আশাও করে না। বামপন্থীরা জনগণের কথা বলে, জনগণের জন্য রাজনীতি করে। তাদের অনেক ত্যাগ আছে, সততা আছে, দেশপ্রেম আছে, অতীতে অনেক লড়াই সংগ্রাম আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার কথা তা তারা করতে পারছেন না কেন?
বামপন্থী বন্ধুরা কি করছেন?
দেশের এই ঘোর দুর্দিনে, জনগণের এই ভয়াবহ বিপদে বামপন্থীরা কি করছেন? সম্ভবত দেশের প্রতিটি বামপন্থী কর্মীকেই এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। বামপন্থী বন্ধুরা নিশ্চয়ই কিছু জবাব দিয়ে থাকেন। নিজেদের নানা কাজকর্মের, উদ্যোগের কথাগুলো তুলে ধরেন। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথম যে কথাটা বলা দরকার তা হল, বাংলাদেশে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ কোনো অবস্থান নেই। এমন কোনো একটি যুক্তফ্রন্ট নেই যেখানে দেশের সক্রিয় সকল বামপন্থী শক্তি ঐক্যবদ্ধভাবে জনজীবনের সংকট নিরসনের দাবিতে গণআন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছেন। বামপন্থীদের একাংশ আছেন সরকারের সাথে। মহাজোট সরকারের গণবিরোধী অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের শরীক হয়ে তারা বামপন্থী চরিত্র হারিয়েছেন। আরেক অংশ দ্বি-দলীয় বৃত্তের বাইরে বিকল্প গড়ার স্লোগান দিলেও ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তাদের জোরালো অবস্থান দেখা যায় না। জনগণের মূল শত্রু ক্ষমতাসীন শাসকদের পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখানোর রণকৌশল তাদের অনেক সময়ই সরকারি পরিকল্পনার সহযোগী ভূমিকায় ঠেলে দেয়। এই দুই অংশের ভূমিকায় বামপন্থীদের অবস্থান নিয়ে জনমনে প্রবল বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এর বাইরে যে বামপন্থীরা তারা সাংগঠনিক শক্তিতে দুর্বল। তাদের মধ্যে অনেকে যুক্ত আন্দোলনে থাকলেও সর্বোচ্চ বোঝাপড়া ও সর্বসম্মত ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলনের পরিকল্পনা নেই।
বামপন্থীদের যে উদ্দেশ্য, সেই উদ্দেশ্যের মধ্যেই তাদের শক্তি নিহিত আছে। কারণ অন্য সমস্ত রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ পুঁজিপতিদের-বড়লোকদের-লুটপাটকারীদের পক্ষের যে রাজনৈতিক দলগুলি, তারা জনগণের প্রতিদিনের যে সমস্যা অর্থাৎ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বেকার সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে কোনো লড়াই করছে না। তারা শুধুমাত্র ক্ষমতা দখল, ক্ষমতার ভাগাভাগি এবং অর্থনীতিতে লুটপাটেরও যে একটা প্রতিযোগিতা চলছে — সেই প্রতিযোগিতার মধ্যেই লিপ্ত একটি রাজনৈতিক দল মাত্র। তাই এ অবস্থা থেকে জনগণকে পথ দেখানোর ক্ষমতা একমাত্র বামপন্থীদেরই আছে। সকল বামপন্থী দলেরই সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, এর মধ্যে একটি ভূমিকা আছে জনগণের পক্ষে। সেটি হলো, যে অধিকারগুলো রাষ্ট্র জনগণকে দেয়নি সেগুলোকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সর্বসম্মত ন্যূনতম কর্মসূচি নির্ধারণ করে আন্দোলন গড়ে তোলা।
কীভাবে বামপন্থীরা সম-স্বার্থবোধ তৈরি করতে পারে, যাকে ভিত্তি করে সম-উদ্দেশ্য নিয়ে ‘বামপন্থী’ হিসাবে সবাই একই লক্ষ্যে কাজ করতে পারে? কীভাবে নিজেদের দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে? সম-স্বার্থ বামপন্থীদের আছে, সেটা জনগণের স্বার্থের মধ্যে। জনগণের স্বার্থ অর্থাৎ জনজীবনের এ মুহূর্তের জ্বলন্ত সমস্যাগুলো নিয়ে পরস্পর আলাপ-আলোচনার ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সর্বসম্মত ন্যূনতম কর্মসূচি নির্ধারণ এবং সে কর্মসূচি অনুযায়ী জনগণকে সংগঠিত করা ও গণআন্দোলন গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে বামপন্থীদের মধ্যে সমস্বার্থবোধ তৈরি হতে পারে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এ বিষয়টিকে যুক্তফ্রন্ট আন্দোলন হিসাবে বিবেচিত হয়। দুনিয়ার ইতিহাসে যেখানেই সফল বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, রাশিয়া কিংবা চীনে, সর্বত্রই কমিউনিস্টদেরকে, বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট আন্দোলনের ভিতর দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
সর্বসম্মত ন্যূনতম কর্মসূচি ও সর্বোচ্চ বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন গড়ে তুলুন
বাংলাদেশের বাম আন্দোলনের ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে এদেশে বামপন্থীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কখনোই গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারেননি। গণআন্দোলন হয়েছে, কিন্তু সেগুলো হয়েছে এখানকার বুর্জোয়াশ্রেণীর আশু উদ্দেশ্য পূরণের প্রয়োজন থেকে, বামপন্থীরা সেগুলোকেই অনুসরণ করেছেন। এসব দাবির মধ্যে জনগণের দাবিও ছিল, কিন্তু সেটাকে বামপন্থীরা স্বাতন্ত্র্য দিতে পারেনি, গণআন্দোলনের ইস্যু হিসাবে প্রাধান্যে আনতে পারেননি। তাই স্বাধীনতার পর আজ অবধি এখানে নাগরিক জীবনের সমস্যা সংকট নিয়ে, কৃষকের দাবি নিয়ে, শ্রমিকের দাবি নিয়ে কোনো দীর্ঘস্থায়ী গণআন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি। বিভিন্ন সমস্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ-প্রতিক্রিয়া জানানো, নিজেদের মধ্যে সংকীর্ণ প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং প্রচার-সর্বস্ব কার্যক্রমের চক্রে বামপন্থী শক্তিগুলো ঘুরপাক খেয়েছেন। এটা বামপন্থীদের চরম ব্যর্থতা ও দুর্বলতা।
গণআন্দোলন দূরে থাক, যতটুকু বিক্ষোভ দেশের মানুষের মনে জমা হয়ে আছে তা বেরুবার রাস্তা পর্যন্ত বামপন্থীরা তৈরি করতে পারছেন না। এত সংকট চারপাশে — ক্ষমতা দখলে রাখার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনৈতিক সন্ত্রাস, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, নারী নির্যাতন, সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সমস্যা। শুধু এক স্কুল শিক্ষায় পরীক্ষা আর প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে যে ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে তার উৎপাতেই তো বাবা-মায়েদেরর জান জেরবার হয়ে গেল। এগুলো নিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করে বামপন্থী শক্তিকে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বলা উচিত — “আসুন, রাস্তায় নামুন। এ অত্যাচার সহ্য করবেন না। নীরবে প্রতিবাদহীনভাবে সহ্য করতে থাকলে আপনাদের উপর আরো দুর্ভোগ-দুর্যোগ নেমে আসবে। আর এভাবে অন্যায় মেনে নিলে, অত্যাচার সহ্য করলে মনুষ্যত্ব থাকবে না।” অথচ দুঃখজনক হলেও সত্য এই প্রাথমিক কাজ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধভাবে বামপন্থীদের দ্বারা হয়নি।
বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মত থাকবে, আলাদা রাজনৈতিক লাইনও থাকবে। কিন্তু জনজীবনের সংকটগুলো নির্দিষ্ট করে বামপন্থীদের ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে নেমে আসা দরকার। গণতান্ত্রিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ যারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছেন তাদেরকে যুক্ত করে দীর্ঘমেয়াদী প্রচার-প্রচারণা-বিক্ষোভ সংগঠিত করা দরকার। সকল রকম দলীয় সংকীর্ণতা পরিত্যাগ করে, জনগণের সমস্যা সংকট নিয়ে সর্বোচ্চ বোঝাপড়া ও সর্বস্মত ন্যূনতম কর্মসূচি-ভিত্তিক ঐক্যের ভিত্তিতে বামপন্থীদের গণআন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। বিভিন্ন দলের বিভিন্ন মত নিয়ে মতবিনিময় হবে, আদর্শগত সংগ্রাম হবে। ‘ঐক্য-সংগ্রাম-ঐক্য’র ভিত্তিতেই তার সমাধান হবে।
জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও শক্তিশালী করা ছাড়া বামপন্থীরা শক্তিশালী হতে পারবেন না
বামপন্থীরা দুর্বল, এটা প্রায়শই শোনা যায়, এবং এটা অনেক দিক থেকেই সত্য। তাহলে বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধির পথ কি? একমাত্র ধারাবাহিক ও দীর্ঘমেয়াদী গণআন্দোলন গণসংগ্রামের পথেই জনগণের শক্তি হিসাবে বামপন্থীরা দাঁড়াতে পারে। এবং এর ভিতর দিয়ে জনগণের অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের নিজস্ব আন্দোলনকারী সংস্থা ও প্রতিরোধের শক্তিও তৈরি হয়। জনগণের দাবি নিয়ে, বুর্জোয়া শাসনের ফলে জনজীবনের উপর চেপে বসা সমস্যাগুলো নিয়ে, বুর্জোয়া শাসনের মাধ্যমে হরণ করা গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারগুলো (সিভিল রাইটস) পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দাবি নিয়ে লড়তে লড়তেই বামপন্থীদের পক্ষে এবং বিশেষভাবে বিপ্লবী শক্তির পক্ষে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো ও গণভিত্তি তৈরি করা সম্ভব। ধারাবাহিক গণআন্দোলনের কষ্টকর পথ এড়িয়ে গিয়ে কোনো দেশেই বামপন্থীরা শক্তি অর্জন করতে পারেনি, এমনকি ভোটের রাজনীতিতেও বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। এ হল ইতিহাসের শিক্ষা।এই গণআন্দোলনের পথে এলাকায় এলাকায় সংগ্রাম কমিটি গঠন করার মধ্য দিয়ে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এই সংগ্রাম কমিটি কিন্তু বামপন্থী দলগুলোর নেতা-কর্মীদের কমিটি নয়। ভুক্তভোগী জনগণের কমিটি, সেখানে বামপন্থীরাও থাকবেন। যেমন, প্রশ্নপত্র ফাঁস ও স্কুল শিক্ষা ধ্বংসের বিরুদ্ধে পাড়ায় মহল্লায় স্কুলে স্কুলে অভিভাবক সংগ্রাম কমিটি বা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ গ্রাহক সংগ্রাম কমিটি। এমনি ভাবে প্রতিটি সমস্যা নিয়ে ভুক্তভোগী জনগণের সংগ্রাম কমিটির জাল সারা দেশে তৈরি করতে হবে।
বুর্জোয়া রাজনীতির সংকটের চক্রে জনগণকে আটকে রাখার চক্রান্ত প্রত্যাখ্যান করে গণআন্দোলনের পথে এগিয়ে আসুন
গরিব-মধ্যবিত্তের জীবনে আর্থিক সংকট যেভাবে বাড়ছে তাতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান ইস্যু হওয়ার কথা ছিল মূল্যবৃদ্ধি-ভাড়াবৃদ্ধি, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, কৃষকের ফসলের দাম না পাওয়া, দারিদ্র্য-বেকারত্ব, গ্রামীণ ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর সারাবছরের কাজ, সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষার ও স্বাস্থ্যের বাণিজ্যিকীকরণ, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ইত্যাদি। কিন্তু বুর্জোয়া দলগুলোর সাংগঠনিক জাল ও প্রচারমাধ্যমের দৌলতে তাদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক কোন্দল এমনভাবে জনমনে প্রভাব বিস্তার করে যাতে জনগণের সমস্যা চাপা পড়ে যায়। এমনকি গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উন্নয়ন ইত্যাদি যেসব কথা বলে শাসকদল আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রশক্তির জোরে ক্ষমতা দখল করে রাখতে চাইছে সেগুলোও যে তারা বিশ্বাস করে না, এটাও দেশবাসী খুব ভালো করেই জানেন। যে বিএনপি-জামাতের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার রক্ষার কথা বলে দিনের পর দিন হরতাল-অবরোধ দিয়ে আন্দোলনের ভান করছে তারাও যে বিন্দুমাত্র গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করে না, সেটাও মানুষ জানে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মননজগতে এমন ধারণা তৈরি করা হয়েছে এই বড় দলগুলো ছাড়া তারা উপায়হীন।
অথচ সারা দুনিয়ার ইতিহাস, বিশেষত আরব বিশ্বের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে যে জনগণ কি বিরাট শক্তি ধরে। যদিও এর দুর্বলতার দিকটাও আমরা বারবার দেখিয়েছি। এই বিশেষ দুর্বলতার পরও জনগণের আন্দোলন, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, গণঅভ্যুত্থানকে বুর্জোয়ারা সাংঘাতিক ভয় পায়। জনগণ রাজপথে নেমে আসুক এটা তারা কোনোভাবেই চায় না। যে কারণে বর্তমানে বাংলাদেশেও আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে নিয়ে কোনো ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার পথে বিএনপি হাঁটছে না। এমনকি বাংলাদেশের গত ৪৩ বছরের ইতিহাস ছেঁকে দেখুন, জনগণের প্রত্যক্ষ সমস্যা ও দাবি-দাওয়া নিয়ে বুর্জোয়া দলগুলোর কোনো ধরনের আন্দোলন সংগ্রামের নজির খুঁজে বের করতে পারবেন না। বরং ক্ষমতাসীন শাসকরা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর উপর যত ধরনের আক্রমণ নামিয়ে আনছে, বিএনপি মুখে মুখে যত কথাই বলুক সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো জানবাজি লড়াই করছে না। কারণ নিপীড়নের এসব স্বৈরতান্ত্রিক হাতিয়ার ভবিষ্যতে প্রয়োগ করবার বাসনা ওরাও পোষণ করে। এরা বড়জোর মাঝে মাঝে বিরাট শো-ডাউন বা জমায়েতের প্রদর্শনী করবে, কিন্তু জনগণকে যুক্ত করে সত্যিকার আন্দোলনের পথে পা ফেলবে না। এই রোগ আমাদের অনেক বামপন্থী বন্ধুর ঘাড়েও ভর করেছে। অথচ বামপন্থীদের করণীয় হওয়া উচিত সরকারের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণআন্দোলন তৈরির মধ্য দিয়ে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে সরকারকে বাধ্য করা।
বামপন্থীদের দুর্বলতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি-বিভক্তি যাই থাকুক, জনগণের একমাত্র মিত্র তারাই। জনগণের ভরসাও তারাই। দুটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক শক্তি এই নিপীড়নমূলক বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার মধ্যে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি দেশে তৈরি করে রেখেছে, তার হাত থেকে মুক্ত হতে গেলে বামপন্থীদের সঠিক চেতনার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সর্বোচ্চ বোঝাপড়া ও সর্বসম্মত ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে এলাকায় এলাকায়, থানায় থানায়, গ্রামে গ্রামে সর্বনি¤œ স্তর থেকে জনগণকে সংগঠিত করে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে হবে। তবেই বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে। এই আবেদনই আমরা বাম আন্দোলনের প্রতিটি নেতাকর্মী এবং দেশবাসীর সামনে রাখছি। তা না হলে ঘুরে ফিরে বুর্জোয়াদের হাতে দলিত-পীড়িত-শোষিত হওয়ার পথ থেকে জনগণের মুক্তি নেই।
[৩১ জানুয়ারি শনিবার বিকালে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত কর্মীসভায় বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় কার্য পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর প্রদত্ত বক্তব্যের একাংশ সম্পাদিত করে এখানে প্রকাশ করা হল।]