সকল ধরনের শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলুন
উন্নত নৈতিকতা ও মূল্যবোধের ঝান্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরুন
বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ১০৫তম আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী দিবসের ইতিহাস নারীমুক্তির মতাদর্শ ও লড়াইয়ের সাথে মানবমুক্তির এক বিশাল স্বপ্নের সম্পর্কের ইতিহাস। সে সম্পর্ককে ভুলিয়ে দিতে চায় শাসকগোষ্ঠী। বাহারি বিজ্ঞাপন, পণ্য বিক্রির তৎপরতা, দিবস পালনের নামে অনুষ্ঠান সর্বস্বতা নারী দিবসের অন্তর্গত চেতনা ও শোষণমুক্তির সংগ্রামকে গ্রাস করছে। নারীমুক্তির লড়াই শ্রেণীগত, জাতিগত, বর্ণগত, ধর্মীয়, ভাষাগত, আঞ্চলিক সবরকম বৈষম্য ও নিপীড়ন এবং একই সঙ্গে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, ধ্বংস ও আধিপত্য বিরোধী লড়াইয়ের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। প্রতারণা, প্রহসন, বাগড়ম্বর আর বিজ্ঞাপনের জমকালো আবর্জনার স্তূপের নীচে চাপা পড়েও এই দিবসের অন্তর্গত শক্তি নারীদের সকল ধরনের শোষণ, বৈষম্য, নির্যাতন, নিপীড়ন হতে মুক্তির পথ দেখায়।
নারী দিবসের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
১৯০৭ সালে স্টুটগার্ডে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৫টি দেশ থেকে প্রতিনিধি দল এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক উইমেন ব্যুরো সংগঠিত হয় যার সম্পাদক নির্বাচিত হন ক্লারা জেটকিন। ৩ বছর পর ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও ক্লারা জেটকিন সম্পাদক হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন। এই দ্বিতীয় সম্মেলনেই ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বে নারী শ্রমিকদের যে বিরাট সফল বিক্ষোভ সমাবেশ হয় তার অনুপ্রেরণায় ৮ মার্চকে ‘আান্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালনের প্রস্তাব দেন ক্লারা জেটকিন সে প্রস্তাব অনুযায়ী এর পর থেকে প্রতি বছর এই দিবসটি পালিত হচ্ছে।
নারী শ্রমিকদের উদ্ভব ও বিস্তার শ্রমিক আন্দোলন ও নারী আন্দোলনকে একসূত্রে গ্রথিত করে দেয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যে নামটি উজ্জ্বল তিনি হলেন জার্মান কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিন। আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলন ও সম্মেলনের ইতিহাস প্রচারকারী জাতিসংঘের দলিলপত্রে এই নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ এই নামটির সাথে সাম্যবাদী আন্দোলন ও নারী আন্দোলনের অপরিহার্য ঐক্যসূত্রকে তারা আড়াল করতে চায়, সর্ম্পকচ্ছেদ করতে চায়।
কেমন আছেন নারীরা?
যে সময় নারী দিবস পালিত হচ্ছে সে সময় গোটা বিশ্বজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। মানুষ বেকার হচ্ছে, খাদ্যের অভাবে মানুষ মরছে, শ্রমিক ছাঁটাই চলছে, কৃষক আত্মহত্যা করছে, বেশিরভাগ মানুষ সম্পদহারা হচ্ছে অন্যদিকে বেশিরভাগ সম্পদের মালিক হচ্ছে এক ভাগ মানুষ। যারা গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে করছে নিয়ন্ত্রণ। যুদ্ধ বাধিয়ে নারী শিশু হত্যা চলছে, চলছে অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা। মুনাফার পাহাড় গড়ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠীর চরিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। দুটি দলের নেতৃত্বে নারী থাকলেও তারা এদেশের বেশিরভাগ খেটে খাওয়া মানুষের এবং নারীদের প্রতিনিধিত্ব তো করেই না বরং দেশীয় মালিকগোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদীদের মদদে শ্রমিক শোষণ, কৃষককে সর্বস্বান্ত করে গুটি কয়েক পুঁজিপতির মুনাফার পাহাড় গড়তে বিশ্বস্ত! ভূমিকা পালন করে চলেছে। তাদের চরিত্র আরো বেশি উন্মুত্ত হয়ে যায় যখন মানুষ দেখে তাজরীন ফ্যাশনের ১১৭ জন শ্রমিকসহ অসংখ্য শ্রমিক আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়, রানা প্লাজা ধসে ১১৩৭ শ্রমিক মরে অথচ একজন মালিকের বিচার হয় না, ফাঁসি নিশ্চিত করে না। রাষ্ট্রীয় এই ব্যবস্থায় নারীদেও দুর্দশা যায় আরো বেড়ে। ৮০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী গার্মেন্ট শ্রমিকদের সিংহভাগ নারী। তাদেও নেই নূন্যতম মজুরি, নেই নিরাপদ কর্মপরিবেশ, নেই মাতৃত্বকালীন ছুটি। প্রায় ১১ লক্ষ গৃহপরিচারিকা বাসা-বাড়িতে ১২-১৬ ঘণ্টা শ্রম দেয়। তাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি নেই, শ্রম ঘণ্টা নেই, নেই কোনো নিরাপত্তা, সপ্তাহের একটি দিনও নেই কোনো ছুটি। তাদের নেই শ্রমিকের স্বীকৃতি, নেই কর্মঘণ্টা, নেই সাপ্তাহিক ছুটি। চা শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক পুরুষ-নারীতে রয়েছ মুজুরি বৈষম্য। সম্পত্তিতে নারীদের সমঅধিকার নিশ্চিত হয়নি। গার্হস্থ্য শ্রমকে এখনো জিডিপিতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়নি। নারী নির্যাতন, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌতুকের কারণে হত্যা, অশ্লীল ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে ব্ল্যাকমেইল এরূপ অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিদিন। প্রতিবছর এদেশ থেকে ৪০/৫০ হাজার নারী ও শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে। নারীরা আজ হাসফাঁস করছে, নারী জীবনের এই শোষণ বঞ্চনা অপমানের কি কোনো অবসান নেই?
নারী দিবসের চেতনাই নারীমুক্তির একমাত্র পথ
নারী দিবসের চেতনা মধ্যে নীহিত রয়েছে নারীর সকল ধরনের শোষণ নীপিড়ন হতে মুক্তির পথ। নারীরা সেদিন শ্রমঘণ্টা কমানো, কর্মপরিবেশ, অভীবাসী নারীদের অধিকার ও ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। এই সকল কর্মসূচি পরিচালিত হয় সমাজতান্ত্রিক সংগঠনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বির্নিমাণের স্বপ্নকে সামনে রেখে। সকল ধরণের শোষণ থেকে মুক্তির সাথে নারীমুক্তির প্রশ্নটি ছিল সম্পর্কিত। কিছু দাবি-দাওয়া পূরণ হলেই নারীর সত্যিকার মুক্তি আসবে না। সমাজতান্ত্রিক নেত্রী আলেকজান্দ্রা কোলোনতাই বলেন, ‘আইনের মাধ্যমে মা ও শিশুর অধিকার রক্ষার জন্য সাংবিধানিক লড়াই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন হল সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন। মা ও শিশু এবং সমাজতন্ত্রের লড়াই অবিচ্ছেদ্য।’ আজ যারা নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলেন, নারীর উন্নয়নের নামে বহুজাতিক কম্পানীর টাকার প্রকল্প চালু করেন, কর্মপরিকল্পনা হাজির করেন তারা এই বৈষম্যমূলক অর্থনীতিকে অক্ষত রেখে আনুষ্ঠানিকতা পালন করেন। বহুজাতিকদের কার্ড, পোষাক, বিভিন্ন ধরনের গিফট বিক্রির বাজারকে প্রসারিত করতে চায়। বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র নারীদিবসের চেতনাকে ধারণ কওে সকল ধরনের শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম জারি রেখেছে।
তাই আসুন নারী দিবসের চেতনাকে ধারণ করে শোষণমুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাই, অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে এগিয়ে আসি, সকল ধরনের শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি।
১০৫তম আন্তর্জাতিক নারীদিবস উপলক্ষে কর্মসূচি
আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী
৬ মার্চ ২০১৪, শুক্রবার, বিকাল ৩টা
স্থান : টিএসসি সড়ক দ্বীপ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও নারী হোস্টেলে দেয়ালিকা প্রদর্শনী