শোষণ-বৈষম্য ও নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলুন
৮ মার্চ ১০৫তম আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র ৬ মার্চ ২০১৫ বিকাল সাড়ে তিনটায় প্রেসক্লাবের সামনে র্যালি, সমাবেশ ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি সীমা দত্ত, বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সুলতানা আক্তার রুবি, সাধারণ সম্পাদক মর্জিনা খাতুন। সমাবেশ শেষে আলোচনা সভা ২২/১ তোপখানা রোডস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। সমাবেশ ও আলোচনা সভায় বক্তারা নারী দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য তুলে ধরেন।
আলোচকবৃন্দ বলেন, ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা উপযুক্ত বেতন, কাজের উন্নত পরিবেশ, ১০ ঘণ্টা কর্মদিবস, অভিবাসি ও কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। হাজার হাজার নারী শ্রমিকদের এ মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে আহত ও গ্রেফতার হয় অসংখ্য নারী শ্রমিক। নারী আন্দোলনকে সংগঠিত করার লক্ষে ১৯০৭ সালে জার্মানির স্টুটগার্ডে অনুষ্ঠিত প্রথম আর্ন্তজাতিক নারী সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯০৮ সালে ভোটাধিকারের দাবিতে নিউইয়র্কের নারী দর্জি শ্রমিকরা বিভিন্ন কারখানায় কর্মবিরতি এবং ধর্মঘট পালন করে। ঐতিহাসিক এই আন্দোলনের চেতনাকে ধরে রাখার জন্য ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন ঐতিহাসিক ৮ মার্চকে নারী দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করেন। মহামতি লেনিন-এর উদ্যোগে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের অপরাপর সদস্যবৃন্দ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। ফলে সর্বসম্মতভাবে ৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস হিসেবে গৃহিত হয়। তখন থেকে এই দিবসটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালিত হয়ে আসছে।
আলোচকবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্রও প্রতিবছর এই দিবসটি পালন করে। কিন্তু যে সময় এই নারী দিবস পালিত হচ্ছে সে সময় নারী দিবসের ইতিহাসকে ম্লান করে দেয়ার জন্য বাহারি পণ্যের ব্যবসা চলছে। বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র নারীদিবসের চেতনার বিরুদ্ধে এই সকল যড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রত্যয়ী। একই ভাবে নারী দিবস যে শোষণ মুক্তির চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে চায় সেই চেতনাকেও ভয় পায় পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শাসকশ্রেণী। এখন গোটা বিশ্বজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। মানুষ বেকার হচ্ছে, খাদ্যের অভাবে মানুষ মরছে, শ্রমিক ছাঁটাই চলছে, কৃষক আত্মহত্যা করছে, বেশিরভাগ মানুষ সম্পদহারা হচ্ছে। অন্যদিকে বেশিরভাগ সম্পদের মালিক হচ্ছে এক ভাগ মানুষ, যারা গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যুদ্ধ বাধিয়ে নারী শিশু হত্যা চলছে, চলছে অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা। মুনাফার পাহাড় গড়ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।
আলোচকবৃন্দ বলেন, আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠীর চরিত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। বর্তমান সরকার একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করে নারীসহ সকল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে শুধু ক্ষুন্নই করেনি বিপন্ন করেছে। এই শাসকদের চরিত্র আরো বেশি উম্মুক্ত হয়ে যায় যখন মানুষ দেখে তাজরীন ফ্যাশনের ১১৭ জন শ্রমিকসহ অসংখ্য শ্রমিক আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়, রানা প্লাজা ধসে ১১৩৭ শ্রমিক মরে অথচ একজন মালিকেরও বিচার হয় না, ফাঁসি নিশ্চিত করে না। রাষ্ট্রীয় এই শোষণ নিপীড়নের মধ্যে নারীদের জীবনের দৈন্যদশা আরো বেড়ে যায়। ৮০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী গার্মেন্ট শ্রমিকদের সিংহভাগ নারী। তাদের নেই নূ্যনতম মজুরি, নেই নিরাপদ কর্মপরিবেশ, নেই মাতৃত্বকালীন ছুটি। প্রায় ২০ লাখেরও বেশি শ্রমিক গৃহকর্মে ১২-১৬ ঘণ্টা শ্রম দেয় যাদের বেশিরভাগ কিশোরী। শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, শ্রম ঘণ্টা বা নিরাপত্তা ও সাপ্তাহিক ছুটি কোনটিই নেই। চা শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে যে নারীরা কাজ করে তাদের রয়েছে মজুরি বৈষম্য। সম্পত্তিতে নারীদের সমঅধিকার নিশ্চিত হয়নি। গার্হস্থ্য শ্রম এখনো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত নয়। নারী নির্যাতন-পাচার, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌতুকের কারণে হত্যা, অশ্লীল ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে ব্ল্যাকমেইলের অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে প্রতিদিন। প্রতিবছর এদেশ থেকে ৪০/৫০ হাজার নারী ও শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে। নারী জীবনের এই শোষণ বঞ্চনা অপমানের হাত থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হল শোষণ-বৈষম্য থেকে মুক্তি। বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র নারীদিবসের চেতনাকে ধারণ করে সকল ধরনের শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম পরিচালনা করছে।
আগামী ৮ মার্চ নারীদিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ নারীমুক্তি কেন্দ্র- এর উদ্যোগে ইডেন কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজে র্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।