গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ বিক্ষুব্ধ। এর মধ্যেই মহাজোট সরকার সুন্দরবনের পাশে বাগেরহাটের রামপালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বিনিয়োগে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিশাল আকৃতির কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, অদূরেই ওরিয়ন কোম্পানিকে ৬০০ মেগাওয়াটের আরেকটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের জন্য জমি দেয়া হয়েছে। কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন উচ্চ মাত্রায় পরিবেশ দূষণ ঘটায়। যে কারণে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল, কৃষিজমি বা বনাঞ্চলের আশেপাশে সাধারণত কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয় না। সুন্দরবন থেকে সরকারি হিসাবে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা পোড়ানো হবে তা থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া, ছাই, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি আশেপাশের বায়ু, পানি, মাটিকে দূষিত করবে। এই দূষণ পানি ও বাতাসের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনকে বিপন্ন করবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল পরিমাণ কয়লা বহনকারী জাহাজ আসা-যাওয়া করবে বনের ভেতর দিয়ে। গতবছর শ্যালা নদীতে একটি তেলবাহী জাহাজডুবিতে সুন্দরবনের বিপন্ন দশা আমরা দেখেছি। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন ও ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ সুন্দরবনের দশা তাহলে কি দাঁড়াবে? কয়লার বিষক্রিয়ায় ধীরে ধীরে সুন্দরবনের মৃত্যু হলে সারা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় দক্ষিণাঞ্চল তো বটেই, বাংলাদেশের বিরাট অংশ অরক্ষিত হয়ে পড়বে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভারতীয় কোম্পানির সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্তগুলোও অসম এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী, উৎপাদিত বিদ্যুতের দামও পড়বে বেশি।
বহুল সমালোচিত এই প্রকল্প নিয়ে ইতিমধ্যে শুধু দেশে নয়, ইউনেস্কো-রামসারসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাও প্রশ্ন তুলেছে। অথচ, প্রধানমন্ত্রী একহাতে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরষ্কার নিচ্ছেন, অন্য হাতে সুন্দরবনের জন্য বিপজ্জনক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। সকল মহলের প্রতিবাদ সত্ত্বেও গায়ের জোরে ক্ষমতা দখল করে থাকা আওয়ামী মহাজোট সরকার স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আমাদের দলসহ গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা, তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি ও অন্যান্য বামপন্থী দল, দেশপ্রেমিক ব্যক্তিবর্গ-সংগঠন রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এ আন্দোলনকে শক্তিশালী করতে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চা আগামী ১৬-১৮ অক্টোবর ঢাকা থেকে সুন্দরবন রোডমার্চের ডাক দিয়েছে। রোডমার্চের মূল বক্তব্য – বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে, কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই।
রামপাল প্রকল্পের সর্বশেষ পরিস্থিতি
‘জলবায়ু পরিবর্তন’, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন’ ও ‘পরিবেশ দূষণ’ নিয়ে সারা দুনিয়ায় ব্যাপক শোরগোল। জোর আওয়াজ উঠেছে, বনাঞ্চল এবং পরিবেশ রক্ষার। এর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ করা হচ্ছে। ‘কার্বন’ বেচা-কেনা শুরু হয়েছে। আমাদের দেশের সরকারও আন্তর্জাতিক ওইসব বরাদ্দের ভাগ চাইতে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত হয়েছে। এমনই একটি সময়ে, সরকারের একটি পরিকল্পনার কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে আমরা কথা বলছি।
২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকেই রামপালে ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ এবং মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে ২০১৩ সালের ৫ আগস্ট রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিবেশগত ছাড়পত্র দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দাখিল করা পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা বা ‘এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট’ (ইআইএ) রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে এই ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। অথচ, এই রিপোর্টের ওপর ঢাকায় অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে উপস্থিত বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো রিপোর্টটিকে ত্রুটিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করে। অবশ্য, পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়ার বহু পূর্বেই সরকার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চূড়ান্ত করে এনেছে। গত ৫ অক্টোবর ’১৩ প্রকল্প থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় বসে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কেন্দ্রটি উদ্বোধন করা হয়েছে। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহবান করা হয়েছে।
মূল কেন্দ্র নির্মাণের আগে মাটি ভরাট, ড্রেজিং ইত্যাদি প্রস্তুতিমূলক কাজে খুব বেশি পরিবেশ দূষণ হওয়ার কথা না। কিন্তু এই প্রস্তুতিমূলক কাজের ফলে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণটুকুও নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি বলে খোদ সরকারি মনিটরিং রিপোর্টেই স্বীকার করা হয়েছে! বালি ভরাটের সময় ধুলো নিয়ন্ত্রণ, ড্রেজিং এর সময় শব্দ দূষণ ও কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মৎস্য সম্পদ রক্ষা ইত্যাদির জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়ার কথা ছিল, তার কোনোটাই পালন করা হয়নি বলে স্বীকার করা হয়েছে সরকারেরই নিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান সিইজিআইএস-এর নভেম্বর ’১৪ সালের মনিটরিং রিপোর্টে। এই দূষণগুলোর জন্য হয়তো সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যাবে না। কিন্তু এগুলো স্পষ্টতই দেখায় যে, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে সুন্দরবনের কী ঘটবে! প্রস্তুতি পর্যায়েই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে, যখন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হবে, যখন তা পুরোদমে চালু হবে, যখন প্রতিদিন হাজার হাজার টন সালফার-নাইট্রোজেন গ্যাস, ছাই, কয়লা ধোয়া পানি নির্গত হবে তখন কী ঘটবে তা অনুমান করতে অসুবিধা হয় না।
কয়লা কতটা কালো
পরিবেশ দূষণে কয়লার ভূমিকা শীর্ষস্থানে। বায়ুমণ্ডলের সবচেয়ে বড় ঘাতক কার্বন, যার বড় অংশই নির্গত হয় কয়লা থেকে। তারপরও বিভিন্ন দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। তবে পৃথিবী এখন দূষণমুক্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। সম্প্রতি আমেরিকাতে প্রায় তিনশত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জার্মানিতে ৩.১ গিগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন পাওয়ার প্ল্যান্ট আর কিছুদিনের মধ্যেই বন্ধ করা হবে। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে। এর কারণ হল, যত উন্নত প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হোক না কেন, নিরাপদ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ (clean coal energy) বলে কিছু নেই। পরিবেশের ক্ষতির মানদণ্ড বিচারে এগুলো এখনো লাল তালিকাভুক্ত (red catagory)।
কয়লার ক্ষতি কতটা তার কিছু তথ্য-উপাত্ত সম্প্রতি তুলে ধরেছে ভারতীয় প্রভাবশালী দৈনিক ‘দ্য হিন্দু’ ২০১৩ সালের ১১ মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে। ভারতের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপরে গবেষণা চালিয়ে মূল প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে আরবান ইমিশনস ডট ইনফো এবং গ্রিনপিস ইন্ডিয়া নামে দুটি সংস্থা। গবেষণাটি করেছেন বিশ্বব্যাংকের দূষণ বিষয়ক বিভাগের সাবেক প্রধান সরথ কে. গুটিকুন্ডা ও পূজা জাওহার। এতে দেখা গেছে, ভারতের ১১১টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে প্রতি বছর গড়ে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষের অকাল মৃত্যু এবং গড়ে ২ কোটি মানুষ অ্যাজমা আক্রান্ত হচ্ছে। টাকার অঙ্কে এ ক্ষতির পরিমাণ সাড়ে তিন থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার। অকাল মৃত্যুর পাশাপাশি হৃদরোগ, ব্রংকাইটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুসহ অন্যরা। ‘গ্রিন রেটিং প্রজেক্ট অফ ইন্ডিয়া’র মতে, ভারতে এনটিপিসির অধীনে রয়েছে ২৫টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এরমধ্যে ছয়টি পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এসব নানা কারণে ভারত নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর প্রদেশ গুজরাটেই সৌরবিদ্যুতের বিরাট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আর গত কয়েক বছরে ভারতের কর্নাটক, মধ্য প্রদেশ ও তামিলনাড়–তে তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল হয়েছে (দ্য হিন্দু, ২৫ মে ২০১২)।
যে ভারতীয় এনটিপিসি বাংলাদেশে সুন্দরবনের পাশে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করতে যাচ্ছে সেই ভারতেরই ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশান অ্যাক্ট ১৯৭২’ অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে এবং ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত পরিবেশ সমীক্ষা বা আইএ গাইড লাইন ম্যানুয়াল ২০১০ অনুযায়ী, কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ২৫ কিমি’র মধ্যে কোনো বাঘ/হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জৈববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। ভারতীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের ‘তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন সংক্রান্ত গাইডলাইন, ১৯৮৭’ অনুসারেও কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিমি’র মধ্যে কোনো কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা যায় না। অর্থাৎ এনটিপিসিকে বাংলাদেশে সুন্দরবনের যত কাছে পরিবেশ ধ্বংসকারী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে দেয়া হচ্ছে, তার নিজ দেশ ভারতের আইন অনুযায়ী তা তারা করতে পারতো না!
বর্তমানে চীন বিশ্বের সবচেয়ে কয়লা ব্যবহারকারী এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ৩০ বছরে চীনে অতিমাত্রায় কয়লা পোড়ানোয় দেশটির উত্তরাঞ্চলে মানুষের গড় আয়ু কমেছে ৫ দশমিক ৫ বছর। বেঁচে থাকার সুযোগ কমে আসায় বছরে চীনের ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন বছর নষ্ট হচ্ছে। এর আর্থিক মূল্য কতটা তা সহজেই অনুমেয়। ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স অব ইউএসএ’ পরিচালিত গবেষণাটি ২০১৩ সালের জুলাইয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অনলাইনে প্রকাশ হয়েছে। চীনের বিখ্যাত শহর সাংহাইয়ে কয়লা পোড়ানো বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ২৮ অক্টোবর ’১৩ সাংহাই পরিবেশ রক্ষা ব্যুরো ভয়াবহ দূষণ ঠেকাতে চার বছরের জন্য কয়লা পোড়ানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সেখানে বলা হয়েছে, সাংহাইয়ে অবস্থিত শিল্প খাতের ৩০০টি সহ ২ হাজার ৮০০ কয়লা চুল্লিকে বিকল্প জ্বালানিতে রূপান্তর করতে হবে ২০১৫ সালের মধ্যে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি রাজ্যের রোন কাউন্টিতে অবস্থিত ১৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ‘কিংস্টন ফসিল পাওয়ার প্ল্যান্ট’টি এমোরী এবং ক্লিঞ্চ নদীর মোহনায় অবস্থিত। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে দুটো নদীতে এবং আশেপাশের এলাকায় দূষণ ছড়িয়েছে। সে দেশেরই টেক্সাসের ফায়েত্তি কাউন্টিতে ১৯৭৯ সালে নির্মিত ১২৩০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৯৮০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নিঃসৃত বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস বিশেষত সালফার ডাই অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় বিভিন্ন জাতের গাছ আক্রান্ত হয়েছে, বহু পেকান বাগান ধ্বংস হয়েছে, অন্তত ১৫ হাজার বিশালাকৃতির পেকান গাছ মরে গিয়েছে। এবং এই ক্ষতিকর প্রভাব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এমনকি ৪৮ কিমি দূরেও পৌঁছেছে।
সরকারি মহলের যুক্তি
শুরু থেকে সরকার ও তাদের পক্ষের কিছু বিশেষজ্ঞ প্রচার চালাচ্ছে যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না। এমনকি পরিবেশ দূষণও করবে না। কয়লার কারণে পরিবেশ দূষণ না হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ভারত-চীনের পরিবেশ রক্ষা দফতরগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণের কথা বলছে কোন যুক্তিতে? নাকি ওইসব দেশে কয়লার দূষণ হলেও বাংলাদেশে হবে না?
বলা হচ্ছে, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা হবে। ঘরের ভেতর বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা-বালু-তুরাগ নদী দূষণ আর দখলে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃতপ্রায়। সরকারের নাকের ডগায় এসব নদীর মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। সেখানে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরের সুন্দরবনের জল-স্থলসহ পরিবেশ রক্ষা যথাযথভাবে হবে? যথেষ্ট নজরদারি থাকবে? অন্তত অভিজ্ঞতা থেকে দেশের মানুষ জানে – এটা হবে না। আধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবেশগত বিধি-নিষেধ মেনে চলার যেসব কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো বাংলাদেশের মতো দেশে কতটুকু কার্যকর হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও পরিবেশগত মান নিয়ন্ত্রণ কঠোরভাবে অনুসরণ করতে গেলে উৎপাদন খরচ বাড়বে, অর্থাৎ বিদ্যুতের দামও বাড়বে। এসব যথাযথভাবে মনিটরিং করার মতো সক্ষম ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, সর্বোপরি জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার উপযুক্ত চরিত্রসম্পন্ন সরকারের অনুপস্থিতিতে পরিবেশ রক্ষা করে কাজ করার প্রতিশ্রুতি কথার কথা হয়ে থাকবার সম্ভাবনাই বেশি।
ইআইএ রিপোর্ট অনুসারে প্রস্তাবিত ১৩২০ মেগাওয়াট রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৪ কিমি দূরে, যা সরকার নির্ধারিত সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিমি এনভায়রনমেন্টালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) থেকে ৪ কিমি বাইরে বলে নিরাপদ হিসেবে দাবি করা হয়েছে। অথচ, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটায় বলে সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংরক্ষিত বনভূমি ও বসতির ১৫ থেকে ২৫ কিমি-এর মধ্যে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয় না।
প্রধানমন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ দু-একজন বলেছেন, “আট বছর ধরে বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চলছে। কিন্তু ওই এলাকায় তো গাছপালা মরেনি, পরিবেশের কোনো ক্ষতি হয়নি।” বড়পুকুরিয়া আর রামপাল একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। রামপালের গুরুত্ব সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ঘিরে। সবাই জানেন, জোয়ার-ভাটার লোনা ও মিঠা পানির ওপর নির্ভরশীল এ ম্যানগ্রোভ বন অত্যন্ত সংবেদনশীল। অন্যদিকে, কাগজপত্রে ২৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার হলেও বড়পুকুরিয়ায় প্রকৃত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় অর্ধেকেরও কম। অথচ রামপালের ক্ষমতা ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট, মানে বড়পুকুরিয়ার চেয়ে ১০ গুণের বেশি। দৈনিক কয়লাও পুড়বে ১০ গুণ বেশি, গড়ে প্রতিদিন ১৩ হাজার টন কয়লা। আর বড়পুকুরিয়া খনির কয়লা তুলে সেখানেই ব্যবহার হচ্ছে, এতে পরিবহনজনিত দূষণ এবং ক্ষতির পরিমাণ সঙ্গত কারণে কম। কিন্তু রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আসবে সুন্দরবনের ভেতরের চ্যানেল দিয়ে। লাখ লাখ টন কয়লার মজুদ ও লোড-আনলোডের জন্য ডিপো তৈরি হবে সুন্দরবনের আকরাম পয়েন্টে। বড় জাহাজ থেকে কয়লা নামানোর পর ১৩-১৪ টনের ছোট জাহাজে তা নিয়ে যাওয়া হবে বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এতে দিন-রাতে কয়লা লোড-আনলোড আর পরিবহনে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুন্দরবনের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য খাল-নালার পানি।
আর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বড়পুকুরিয়ার পরিবেশের ক্ষতি হয়নি, খালি চোখে দেখে যারা সিদ্ধান্ত টানতে চান, তারা জেনে-বুঝেই মিথ্যাচার করছেন। খালি চোখে বোঝার উপায় আছে কি ঢাকার বাতাস মারাত্মক মাত্রায় দূষিত? মহানগরীর দূষিত বাতাসে প্রতিবার শ্বাস নিয়ে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে, বিকারগ্রস্ত হয়ে বড় হয়ে উঠছে শিশুরা। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে জানতে হলে বড়পুকুরিয়ার পরিবেশ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। কিন্তু সেই কাজ না করেই ঢালাও সার্টিফিকেট দেয়া কতটা যৌক্তিক বা সমীচীন!
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, আন্দোলনকারীরা মানুষের স্বার্থ বাদ দিয়ে এখন পশু-পাখি রক্ষায় আন্দোলনে নেমেছে। এখানে বলা দরকার, এই প্রধানমন্ত্রীই এ বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসের অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছিলেন, “বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে। আর সুন্দরবন বাঁচাবে বাংলাদেশকে। আসুন আমরা সবাই মিলে বাঘ বাঁচাই, প্রকৃতি বাঁচাই।” যে কোনো বিবেচক মানুষই জানেন, সুন্দরবন শুধু যে অমূল্য অনবায়নযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ তাই নয়, এটি রক্ষার সাথে কোটি কোটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা জড়িত। প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুন্দরবন লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন রক্ষা করে। সুন্দরবন না থাকলে বাংলাদেশই অরক্ষিত হয়ে পড়বে।
আসলে শাসকদের চোখে ‘মানুষের স্বার্থ’ কথাটার অর্থ কি সেটাও আমরা খুব ভালো করেই টের পাচ্ছি। বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের কথা বলে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর ফলে বিদ্যুতের উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে বা ভবিষ্যতে আরও কিছু বাড়বে – একথা ঠিক। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বেড়েছে তারও বেশী। প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি হিসেবে দিতে হচ্ছে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোকে। এর ফলে জনগণের পকেট থেকে দুইভাবে লুটপাট চলছে – একবার ভর্তুকি দেয়ার নামে, আরেকবার অধিক দামের বিদ্যুৎ কেনার মাধ্যমে। শুধু এক বিদ্যুৎ খাতেই কি ভয়াবহ লুটের শিকার হচ্ছে দেশবাসী! আসলে বিদ্যুৎ শুধু নয়, জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান-নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সমস্ত ক্ষেত্রেই দেশের সাধারণ মানুষ নির্মম শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে চলেছে। এমনই একটি তথ্য এসেছে ৬ অক্টোবর বিভিন্ন দৈনিকে। এক গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে. মহাসড়ক নির্মাণ সবচেয়ে ব্যয়বহুল হচ্ছে বাংলাদেশ। ইউরোপে চার লেনের নতুন মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় পড়ছে ২৮ কোটি টাকা। ভারতে এ ব্যয় গড়ে ১০ কোটি টাকা, চীনে গড়ে ১৩ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশের তিনটি মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করতে ব্যয় ধরা হচ্ছে কিলোমিটার প্রতি গড়ে ৫৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা মহাসড়ক চারলেন নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা। ‘স্বার্থ’টা কার রক্ষিত হচ্ছে তা বোঝ যাচ্ছে কি?
বলা হচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে উন্নতমানের বিটুমিনাস কয়লা আমদানি করে ব্যবহার করা হবে, যাতে সালফার-এর পরিমাণ কম। বর্তমানে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় সাব-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। রামপালে এর চেয়ে উন্নতমানের সুপার-ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে, যাতে উচ্চ দক্ষতা ও কম কয়লা ব্যবহার হবে। বাস্তবে, সাব ক্রিটিক্যাল টেকনোলজির তুলনায় সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোজি ব্যবহার করলে দুষণের পরিমাণ সর্বমোট মাত্র ৮ থেকে ১০ শতাংশ হ্রাস পায় যা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভয়াবহ দূষণ সামান্যই কমাতে পারে। কৃষিজমি, জনবসতি ও শহর নিকটে থাকা, নদীর পানি স্বল্পতা, পরিবেশগত প্রভাব ইত্যাদি নানান বিবেচনায় এনটিপিসি’র এসব প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র ভারতের পরিবেশ মন্ত্রণালয় বাতিল করে দিয়েছে। যাঁরা বলছেন, রামপাল প্রকল্পে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না, এখানে সুপারক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহৃত হবে, তাঁরা যদি তাঁদের এসব যুক্তি ভারত সরকারকে বোঝাতে পারতেন, তাহলে ভারতে আরও তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এখনই শুরু করা যেত!
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে সুন্দরবন থেকে ‘নিরাপদ দূরত্বে’। বলা হয়েছে, সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্য থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটার দূরে। এই বক্তব্যের চালাকি হচ্ছে এই যে, বিশ্ব ঐতিহ্য বলে ইউনেসকো সুন্দরবনের উপকূলসংলগ্ন একটি অংশকে নির্দিষ্ট করেছে, যার থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র ঠিকই ৭০ কিলোমিটার দূরে। সরকার এটা বলে ইউনেসকোকে বুঝ দিচ্ছে, কিন্তু সরকার কি তবে সুন্দরবন বলতে তার ক্ষুদ্র একটি অংশকেই বোঝাতে চায়? সরকার কি তবে সুন্দরবনের বড় অংশ খরচের খাতায় ফেলছে? কয়লা পরিবহন হবে সমুদ্র থেকে পুরো সুন্দরবনের মাঝ দিয়ে, বিশ্ব ঐতিহ্য বলে চিহ্নিত অংশের পাশ দিয়ে। এই পরিবহনই ওই টুকরোসহ পুরো সুন্দরবনকে বিপর্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট।
রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপদ
রামপালে কয়লা পুড়বে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন, প্রতিদিন ১৩ হাজার মেট্রিক টন। এতে ছাই হবে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার ৬০০ মেট্রিক টন।
ক) বায়ু দূষণ : ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে উৎপাদিত বায়ু দূষণকারী উপাদানগুলো হলো –
১) ৭৯ লক্ষ টন কার্বন ডাই অক্সাইড যা প্রায় ৩৪ কোটি গাছ কেটে ফেলার সমান।
২) ৫২ হাজার টন সালফার ডাই অক্সাইড। এই সালফার ডাই অক্সাইড এসিড রেইনের কারণ এবং অন্যান্য উপাদানের সাথে বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার পরিমাণ বাড়িয়ে তোলে যার ফলে ফুসফুস ও হার্টের রোগসহ বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ হয়।
৩) ৩১ হাজার টন নাইট্রোজেন অক্সাইড। এই নাইট্রোজেন অক্সাইড ফুসফুসের টিস্যু’র ক্ষতি করে যার ফলে শ্বাসতন্ত্রের নানান রোগ হতে পারে।
৪) ১৩০০ টন ক্ষুদ্র কণিকা যার ফলে ব্রংকাইটিস সহ ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ বেড়ে যায়।
৫) ১৯০০ টন বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড।
৬) ৪৪০ পাউন্ড মারকারি বা পারদ। ২৫ একর আয়তনের একটা পুকুরে এক চা চামচের ৭০ ভাগের একভাগ পারদ পড়লে সেই পুকুরের মাছ বিষাক্ত হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। পারদের কারণে ব্রেন ড্যামেজসহ স্নায়ুতন্ত্রের নানান রোগ হয়।
৭) ৫৯০ পাউন্ড বিষাক্ত আর্সেনিক যার ফলে আর্সেনিকোসিস এবং ক্যানসারের বিস্তার ঘটায়।
৮) ৩০০ পাউন্ড সীসা, ১০ পাউন্ড ক্যাডমিয়াম এবং পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য ভারী ধাতু।
খ) কঠিন ও তরল বর্জ্য: কয়লা পুড়িয়ে ছাই তৈরী হয় এবং কয়লা ধোয়ার পর পানির সাথে মিশে তৈরী হয় আরেকটি বর্জ্য তরল কয়লা বর্জ্য। ছাই এবং এই তরল উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত কারণ এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। ছাই বা ফ্লাই এ্যাশকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিকটে অ্যাশ পন্ড বা ছাইয়ের পুকুরে গাদা করা হয় এবং স্লারি বা তরল বর্জ্যকে উপযুক্ত ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে দূষণ মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ছাই বাতাসে উড়ে গেলে, ছাই ধোয়া পানি চুইয়ে কিংবা তরল বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে মাটিতে বা নদীতে মিশলে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ ঘটে। একটি ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বছরে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ঋষু অংয এবং ২ লক্ষ টন ইড়ঃঃড়স অংয উৎপাদিত হবে যার উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা করা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি বড় সমস্যা।
গ) পানি দূষণ : কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কঠিন ও তরল বর্জ্য বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে, সংরক্ষণ আধার থেকে চুইয়ে নানানভাবে গ্রাউন্ড ও সারফেস ওয়াটারের সাথে মিশে পানি দূষণ ঘটায় যার ফলে পানির মাছ, জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি হুমকির মুখে পড়ে।
ঘ) শব্দ দূষণ : কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টারবাইন, কমপ্রেসার, পামপ, কুলিং টাওয়ার, কনস্ট্রাকশনের যন্ত্রপাতি, পরিবহনের যানবাহনের মাধ্যমে ব্যাপক শব্দ দূষণ ঘটে থাকে।
এ সকল কারণেই আবাসিক এলাকা, কৃষিজমি এবং বনাঞ্চলের আশপাশে কয়লা ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার অনুমতি প্রদান করা হয় না।
সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে কয়লা পরিবহনের ক্ষতি : আমদানিকৃত কয়লা পরিবহন করা হবে সুন্দরবনের ভেতরে প্রবাহিত পশুর নদী দিয়ে। কয়লা থেকে অত্যধিক পরিমাণে কার্বন কণা নির্গত হয়, যা পরিবহনের সময় আশেপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। আবার এই বিপুল পরিমাণ কয়লা জাহাজে পরিবহনের সময় যে শব্দ ও বর্জ্য উৎপন্ন করবে তা এই সুন্দরবনের নদী-নালা, খাল-বিলসহ গোটা পরিবেশকে দূষিত করবে। এর ফলে এখান জলজ প্রাণীগুলো নিশ্চিতভাবে হুমকির মধ্যে পড়বে। এক হিসাবে দেখা যায়, সুন্দরবনের ভেতরে হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত ৩০ কিমি নদী পথে বড় জাহাজ বছরে ৫৯ দিন এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত প্রায় ৬৭ কিমি পথ ছোট লাইটারেজ জাহাজে করে বছরে ২৩৬ দিন রামপাল প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় হাজার হাজার টন কয়লা পরিবহন করতে হবে। যেখানে বৃক্ষরোপণের মতো কমসূচিতে সুন্দরবনের ক্ষতির আশঙ্কা করা হয় সেখানে তার ভেতর দিয়ে কয়লা পরিবহন কিভাবে সমর্থনযোগ্য হতে পারে?
নদীর পানি প্রত্যাহার : কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিপুল পরিমাণ মিঠা পানির প্রয়োজন হয়। সরকারি ইআইএ রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রে শীতলীকরণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য পশুর নদী থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৯ হাজার ১৫০ ঘনমিটার করে পানি উত্তোলন করা হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের পর অবশিষ্ট পানি পরিশোধন করে ঘণ্টায় ৫ হাজার ১৫০ ঘনমিটার হারে আবার নদীতে ফেরত দেয়া হবে। এর ফলে নদী থেকে প্রতি ঘণ্টায় পানি উত্তোলনের পরিমাণ হবে ৪ হাজার ঘনমিটার। নদী থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৪ হাজার ঘনমিটার পানি প্রত্যাহারের ফলে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীর পলি প্রবাহ, প্লাবন, জোয়ার-ভাটা, মাছসহ জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ ইত্যাদির উপর প্রভাব পড়বে।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর : এই প্রকল্পে প্রতিদিন কয়লা ধোয়ার জন্য ২৫ হাজার কিউবিক মিটার স্বচ্ছ পানি ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে উত্তোলন করতে হবে। ২৫ বছর এই প্রকল্পের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে, সুতরাং ২৫ বছর প্রতিদিন এই পরিমাণ পানি উত্তোলনের কাজটি চালিয়ে যেতে হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর পরিণতিতে সুন্দরবন অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে যাবে।
বিশেষজ্ঞদের গবেষণা
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুণ চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে সুন্দরবন ও এর আশেপাশের এলাকায় প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব বিষয়ক একটি গবেষণা করা হয়েছে। এই গবেষণায় পরিবেশগত প্রভাবের দিকগুলো ৩৪টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে পৃথকভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণায় ২৭টি ক্ষেত্রেই পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে এসেছে।
৫ মে ২০১১ ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. আব্দুস সাত্তার ম-লের নেতৃত্বে পরিবেশবিদদের একটি দল প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির স্থান পরিদর্শন করেন। তাঁরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের ২৩ ধরনের ক্ষতির হিসেব তুলে ধরেন যার সার কথা, এ প্রকল্পের ফলে সুন্দরবনের স্বাভাবিক চরিত্র বিনষ্ট হবে। এই পরিবেশ বিজ্ঞানীর মতে, কয়লা পোড়া সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড, কার্বন ডাই অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ইত্যাদি সুন্দরবনের জৈবিক পরিবেশ ও বায়ুম-লকে বিঘিœত করবে। বায়ুম-লের সালফার ডাই অক্সাইড ও কার্বন যৌগগুলো থেকে সৃষ্ট গ্রীন হাউজ গ্যাস বনের জন্য অতি মারাত্মক ক্ষতিকর এসিড বৃষ্টি ঘটাবে এবং তা শুধু সময়ের ব্যাপার। ওই অঞ্চলের এবং আশপাশের কৃষি জমিতে উৎপাদিত কৃষিপণ্য খেলে মানবদেহে ছড়িয়ে পড়বে অ্যাজমা, ফুসফুসবাহিত নানা রোগ, এমনকি ক্যান্সারের সম্ভাবনাও রয়েছে।
আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
ইতোমধ্যে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক জলাভূমির রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে গঠিত আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘রামসার’ সুন্দরবন এলাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দিয়েছে এবং এ ঘটনায় সুন্দরবনকে নিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো সরকারকে চিঠি (১১ জুলাই ’১৪) দিয়ে বলেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় এই বনের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় সরকার ব্যর্থ হলে বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাবে সুন্দরবন। বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে সুন্দরবন নাম লেখাবে ‘বিপন্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের’ তালিকায়। বিদ্যুৎকেন্দ্র, নৌপথ, শিল্পকারখানা স্থাপন এবং নদী খননের ফলে সুন্দরবনের অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে উল্লেখ করে তা বন্ধে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে বলেছে এই সংস্থাটি।
এমনকি বাংলাদেশের বন মন্ত্রণালয়ের স্বাক্ষর করা এক চিঠিতেও এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে বলা হয়েছে, “কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে রয়েল বেঙ্গল টাইগার তথা সমগ্র জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে।” চিঠিতে প্রকল্পটিকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়ার জন্যও অনুরোধ জানানো হয়েছে। আর ওদিকে ইন্ডিয়ান টাইমসে (২ আগস্ট ’১৩) প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যাচ্ছে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের বাংলাদেশি অংশ তো বটেই এমনকি ভারতীয় অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সেখানকার পরিবেশবাদী সংগঠন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে।
প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ না করার পরামর্শ দিয়েছে বহুজাতিক ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগের পরামর্শ দানকারী প্রতিষ্ঠান ব্যাংকট্র্যাক। ফ্রান্সের বৃহৎ তিন ব্যাংক বিএনপি পারিবাস, সোসিয়েতে জেনারেলি ও ক্রেডিট এগ্রিকোল এরই মধ্যে প্রকল্পটিতে অর্থায়নে আপত্তি জানিয়েছে। নরওয়ের দুটি পেনশন ফান্ডও ভারতের এনটিপিসি থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। প্রকল্পটি সম্পর্কে কাউন্সিল অন এথিকস অব নরওয়ের মন্তব্য, সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিলেও এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি করবে।
এই চুক্তি অসম
এতবড় ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনকে বিপন্ন করে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলে জনগণের জন্যে তা কি কোনো সুফল বয়ে আনবে? হিসাব বলছে, আনবে না। এ প্রকল্পে বিদ্যুতের দাম প্রস্তাব করা হয়েছে ইউনিট প্রতি ৮-৮.৫০ টাকা, যেখানে বর্তমানে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের মূল্য ৪-৫ টাকা। এই প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭০% অর্থ আসবে বিদেশি ঋণ থেকে, বাকি ৩০%-এর মধ্যে ভারত বহন করবে ১৫% আর বাংলাদেশ ১৫%। আর ওই ৭০ ভাগ ঋণের সুদ পরিশোধ এবং ঋণ পরিশোধ করার দায়-দায়িত্ব বাংলাদেশের। অর্থাৎ ভারতের বিনিয়োগ মাত্র ১৫ ভাগ, কিন্তু তারা মালিকানা পাবে ৫০ ভাগ। বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এনটিপিসি-র প্রাধান্য থাকবে। অথচ বাংলাদেশের বিনিয়োগ এখানে বেশি। কারণ বাংলাদেশ জমি দিচ্ছে, জনবসতি সরাতে হচ্ছে। কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন হ্রাস ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতি যা কিছু হবে তার সবটাই হবে বাংলাদেশের। চুক্তি অনুযায়ী কয়লা আমদানির দায়িত্বও বাংলাদেশের কাঁধে। সময়মতো কয়লা না পাওয়া কিংবা অন্য কোনো কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র কিছুদিন বন্ধ থাকলে সেজন্য ক্ষতির দায়ও বহন করতে হবে বাংলাদেশকেই।
আসলে ভারতের সাথে ট্রানজিট সংক্রান্ত আলোচনার মতো রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও মহাজোট সরকার ভারতের আনুকূল্য লাভের চেষ্টায় জাতীয় স্বার্থে ছাড় দিচ্ছে। আমাদের নদীগুলো ভারতের পানি আগ্রাসনের শিকার। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ-এর হাতে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা চলছেই। এখন বাংলাদেশ ভারতকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয় যোগাযোগের জন্য ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র এবং বাংলাদেশের শাসকদের জনবিরোধী সাম্রাজ্যবাদের প্রতি নতজানু নীতিই রামপাল বিদ্যুৎপ্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করছে।
বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসনের নামে দেশি-বিদেশি লুটেরাগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে, সরকার বারবার দেশের জন্য সর্বনাশা পথ গ্রহণ করছে। দেশের স্থলভাগের গ্যাসক্ষেত্রগুলো একে একে অসম চুক্তিতে (গড়ে ৭৯ ভাগ গ্যাস ওদের আর মাত্র ২১ ভাগ আমাদের) মার্কিন-ব্রিটিশ-কানাডিয় প্রভৃতি বহুজাতিক কোম্পানিকে ইজারা দেয়া হয়েছে। এখন আমাদের নিজেদের গ্যাস ওদের কাছ থেকে আন্তর্জাতিক বাজার দরে বেশি দামে কিনতে হয়। এতে প্রতি বছর আমাদের লক্ষ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। আমাদের সম্পদ লুট করতে গিয়ে কত ধরনের দুর্নীতি যে হয়েছে, নাইকোর দুর্নীতি মামলা তারই প্রমাণ। ফুলবাড়ি-বড়পুকুরিয়ার উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত অব্যাহত রাখা, বঙ্গোপসাগরের গ্যাসব্লক অসম শর্তে বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দান, রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে ১৪ থেকে ১৭ টাকা কিংবা তারও বেশি দরে বিদ্যুৎ ক্রয় কিংবা হালের এই ভারতীয় বিনোয়োগে সুন্দরবন-কৃষিজমি ধ্বংসকারী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ইত্যাদি সবকিছুই জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে মুনাফা ও লুটপাটের আয়োজনের অংশ।
বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানের লক্ষ্যে বেশ কিছু বিকল্প প্রস্তাব দেশের বামপন্থী দল ও দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী, জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা দিয়ে আসছেন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে, পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে আধুনিকায়ন করে কম্বাইন্ড সাইকেলে পরিণত করলে বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ রয়েছে তা দিয়েই সস্তায় গোটা দেশের বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান সম্ভব। বর্তমানে ২০-২৫% সক্ষমতায় ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করে যে ৪০০০-৪৫০০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে, আধুনিকায়ন করা হলে একই পরিমাণ গ্যাস থেকে ৮০০০-৯০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সস্তায় ইউনিট প্রতি দেড় থেকে দুই টাকা খরচে উৎপাদন করা যেত। সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই এই লক্ষ্যে উদ্যোগ নিলে ২০১১ সালের মধ্যেই বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হতে পারতো। জরুরি উদ্যোগে ৬ মাসে পুরাতন বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামত ও আধুনিকায়ন এবং দেড়-দুই বছরে নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হলে কুইক রেন্টালের চেয়ে অনেক কুইক এবং অনেক সস্তায় বিদ্যুৎ সংকটের স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হতো। কিন্তু তা না করে সরকার রেন্টাল-কুইক রেন্টালের নামে দেশি-বিদেশি লুটেরাদের লুটপাটের ব্যবস্থা করেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে সামিট, ওরিয়েন্টাল, দেশ, অটবি, এগ্রিকো সহ দেশি-বিদেশি কোম্পানির জন্য বিদ্যুৎ খাতকে লাভজনক করেছে আর দেশবাসীর ওপর বোঝা বাড়িয়েছে।
জ্বালানি সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে জাতীয় সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাপেক্স, পেট্রোবাংলা, জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, ব্যুরো অব মিনারেল ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু করার চক্রান্ত বন্ধ করতে হবে। এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে যা তেল-গ্যাস-কয়লা সম্পদ অনুসন্ধান, উত্তোলন এবং তার কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করবে। হাতের কাছে থাকা এসব সমাধানের পাশাপাশি আশু এবং দীর্ঘমেয়াদী কিছু বিকল্প নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। সারা বিশ্ব এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। কারণ তেল, গ্যাস, কয়লা এসব প্রাকৃতিক সম্পদ সবই একদিন ফুরিয়ে যাবে। তাই এখন থেকেই এমন জ্বালানির সন্ধান করা দরকার, যার উৎস প্রাকৃতিকভাবে অফুরন্ত। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস যেমন উইন্ডমিল, জিওথার্মাল, সোলার এনার্জি ইত্যাদি ব্যবহারে প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়ন, সমর্থনদান ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এখন অত্যন্ত জরুরি।
চাই গণআন্দোলন, চাই প্রতিরোধ
রামপালে প্রক্রিয়াধীন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে ইতিমধ্যে শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাও প্রশ্ন তুলেছে। রামপাল প্রশ্নে সরকার বারবার বিদ্যুৎসংকটের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছে, বলছে রামপালে তাদের গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা। উপরের আলোচনায় আমরা সরকারের এসব যুক্তি যাচাই করে দেখেছি। ফলে দেশবাসীর উদ্বিগ্ন প্রশ্ন : সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি না করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাস্তবায়ন কি আসলেই সম্ভব? দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু সেটা যদি হয় সুন্দরবনের বিনিময়ে তবে কি তা আত্মঘাতী ছাড়া কিছু হবে?
তাহলে, এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? বাংলাদেশের ইতিহাস আমাদের এ শিক্ষাই দেয় যে, গণআন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া, প্রতিরোধের শক্তি নির্মাণ করা ছাড়া শাসকদের এসব গণবিরোধী লুটতরাজের প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। এরই অংশ হিসেবে গণতান্ত্রিক বাম মোর্চার ডাকে আগামী ১৬-১৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা-সুন্দরবন রোডমার্চ। জাতীয় সম্পদ গ্যাস-কয়লা-বিদ্যুৎ-বন্দর, সুন্দরবন, আমাদের কৃষি জমি ও পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে পরিচালিত আন্দোলনে যুক্ত হয়ে প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তুলুন। বামপন্থীদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের ধারায় জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি, সমাজ পরিবর্তনের শক্তি গড়ে তোলার সংগ্রামে এগিয়ে আসুন।