বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (এসএসএফ)-এর চতুর্থ কেন্দ্রীয় সম্মেলন এমন একটা সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন বিশ্বের দেশে দেশে একদিকে শিক্ষা ও ছাত্র সমাজের উপর শাসকশ্রেণীর লাগাতার আক্রমণ নেমে আসছে, অন্য দিকে তার বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান ছাত্র তথা গণবিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। এই তাৎপর্য্যপূর্ণ মুহূর্তে আয়োজিত এস এস এফ-এর সম্মেলন উপলক্ষে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতা, কর্মী, সংগঠকদের উদ্দেশ্যে ভারতের ছাত্রসমাজ এবং আমাদের সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট্স অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে আপনাদের বৈপ্লবিক অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি।
আপনাদের সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট দৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট আদর্শিক অবস্থানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের শিক্ষা ও ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে ঐতিহাসিক ও দৃষ্টান্তমূলক সংগ্রাম পরিচালনা করছে তার প্রতি ভারতের প্রায় সমস্ত প্রদেশে ছড়িয়ে থাকা অল ইন্ডিয়া ডিএসও’র হাজার হাজার কর্মী এবং কয়েক লক্ষ সদস্য প্রত্যেকেই গভীর আবেগ ও একাত্মতা বোধ করে।
আমাদের সংগঠন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে শাসকশ্রেণীর আক্রমণ থেকে শিক্ষাকে রক্ষা করার আন্দোলন শুধু দরিদ্র ছাত্রদের বিনা বেতনে শিক্ষা অর্জন কিংবা ভবিষ্যৎ জীবিকার দাবীতে অর্থনৈতিক আন্দোলন নয়, বরঞ্চ শেষ বিচারে তা সমাজ- সভ্যতা-সংস্কৃতি তথা মনুষ্যত্ব রক্ষার সংগ্রামের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। ইতিহাস নির্ধারিত এই সংগ্রামে অঙ্গীকারবদ্ধ দুই প্রতিবেশী দেশের দুই সংগঠনের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান আমাদের সমৃদ্ধ হতে সাহায্য করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্মেলনে প্রতিনিধি দল পাঠানোর জন্য আপনাদের আমন্ত্রণ আমরা সানন্দে গ্রহণ করছি এবং আপনাদের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ভারতের শিক্ষা ও ছাত্র আন্দোলন বর্তমানে এক জটিল ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। বাজারের অঙ্গ হয়ে ওঠায় শিক্ষাক্ষেত্র আজ পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি, প্রতারণা আর লুটপাটের লীলাভূমি হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ধর্মীয় অন্ধতা, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা, ক্রমবর্ধমান হিংসা শিক্ষাঙ্গণকে কলুষিত করছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত শাসকশ্রেণীর পক্ষ থেকে সার্বজনীন শিক্ষা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তর বাক্য ব্যয়, আইন প্রণয়ন, একের পর এক কমিশন গঠন ইত্যাদির অভাব হয়নি। কিন্তু মুখে যাই বলা হোক, ঝান্ডার রঙ বা শ্লোগানে যাই পার্থক্য থাকুক না কেন প্রত্যেকটি সরকারের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপই শেষ পযন্ত শিক্ষাকে সরাসরি কিংবা কৌশলে সংকুচিত করার উদ্দেশ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে। পদদলিত করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ বিজ্ঞানভিত্তিক গণতান্ত্রিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে সভ্যতার অগ্রগতির পরিপূরক ‘ম্যান মেকিং ক্যারেক্টার বিল্ডিংয়ের’ আদর্শকে। শিক্ষাখাতে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ ক্রমাগত কমিয়ে আনা, আসন সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ স্কীম চালু করে সকল উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীকে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা, বিপুল পরিমাণ শূণ্য পদে শিক্ষক নিয়োগ না করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলার বিষয়ে চরম উদাসীনতা প্রদর্শনই সরকারী নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮৬ সালে জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার শিক্ষায় সরকারী দায়িত্ব সরাসরি অস্বীকার করে এবং শিক্ষাকে বিনিয়োগের লোভনীয় ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত করে। পরবর্তীকালে বিজেপি পরিচালিত প্রথম এনডিএ জোট সরকার দেশের দুই জন একচেটিয়া পুঁজির মালিককে নিয়ে আম্বানী-বিড়লা শিক্ষা কমিশন গঠন করে। সেই কমিশন সর্বোচ্চ মুনাফা লুণ্ঠনের অপরিহার্য নিয়মে চরম মন্দা এবং উদ্বৃত্ত পুঁজির সমস্যায় জর্জরিত এবং নুতন বাজারের সন্ধানে উন্মত্ত সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন তথা বাজার অর্থনীতির পরিপূরক হিসাবে বিনিয়োগ ও মুনাফা লুণ্ঠনের ক্ষেত্র রূপে শিক্ষাক্ষেত্রকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করে।
এই পরিকল্পনার প্রধানত দুটি উদ্দেশ্য। প্রথমতঃ, জনসাধারণের রাজস্বের অর্থে সরকার পরিচালিত সকলের জন্য অবৈতনিক শিক্ষাকে যেকোনও মূল্যে বন্ধ করা। সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফি-বৃদ্ধি ঘটিয়ে মুনাফার ভিত্তিতে পরিচালিত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সমান করে দেওয়া যাতে জরাজীর্ণ সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে শিক্ষাবাজারের ক্রেতারা আপাত ঝাঁ চকচকে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকেই বেছে নেয়। একে তারা বলছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী করা। কিন্তু সরকারী প্রতিষ্ঠানে ফি-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ এবং অল ইন্ডিয়া ডিএসও’র সংগঠিত লাগাতার আন্দোলনের ফলে যথেচ্ছ ফি-বৃদ্ধি করা সম্ভব না হওয়ায় তারা নানা কৌশল গ্রহণ করছে। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত তথাকথিত শিক্ষার অধিকার আইন। এই আইনের নামে তারা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাশফেল ব্যবস্থা তুলে দিয়েছে। তাদের যুক্তি, এতে নাকি স্কুল ছুট কমবে। এক্ষেত্রেও সারা দেশে একমাত্র অল ইন্ডিয়া ডিএসও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছে যে, পাশফেলের সাথে স্কুল ছুটের কোনও সম্পর্ক নেই, দারিদ্র্যই ঐ সমস্যার একমাত্র কারণ। এআইডিএসও বলেছে, পাশফেল তুলে দেওয়ার ফলে সরকারী শিক্ষাব্যবস্থা অর্থহীন এবং অকার্যকরী হয়ে পড়বে। সরকারী স্কুলে পড়তে বাধ্য হওয়া দরিদ্র এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা কিছুই শিখবে না। কিছু না শিখেই তাদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে যাবে। শিক্ষার অধিকারের নামে সারা দেশের মানুষের বেদনাদায়ক তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের আশঙ্কাকেই অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণ করেছে। ভয়াবহভাবে বাড়ছে স্কুলছুট। উঠে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ সরকারী স্কুল। শিক্ষাক্ষেত্র আজ লুঠের বাজারে পরিণত।
শিক্ষার উপর দ্বিতীয় আক্রমণটি আরও ভয়ঙ্কর। তা হল অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে শিক্ষার মর্মবস্তুকে বিকৃত করে দেওয়া। অর্থের বিনিময়ে যারা শিক্ষার সুযোগটি ক্রয় করতে পারছে তাদের মধ্যে যাতে যুক্তিবাদী বৈজ্ঞানিক মনন, মানবিক মূল্যবোধ, সমাজ সচেতনতা, আত্মমর্যাদাবোধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মন না গড়ে ওঠে সেই কারণে স্কুল-স্তরে যৌনশিক্ষা প্রবর্তন করা, সাহিত্যকে পাঠ্যসূচীতে গুরুত্বহীন করে দেওয়া, কুসংস্কার ধর্মীয় অন্ধতা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করার মত মানবতা-বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে দেশপ্রেমের নামে মাথা তুলছে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ। সারা দেশে আক্রান্ত এমনকি নিহত হচ্ছেন একের পর এক মুক্ত চিন্তার মানুষ।
শিক্ষার পুনর্গঠনের নামে এইসব পদক্ষেপের অন্তরালে যে পরিকল্পিত হিংস্র আক্রমণ লুকিয়ে আছে তা প্রকৃতপক্ষে সমাজের মধ্যে তীব্র শ্রেণী সংঘর্ষকেই সূচিত করে। আমরা জানি বহু বিষয়ে আপনারাও একই রকম অভিজ্ঞতার সাক্ষী। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি সঠিক বিজ্ঞানভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গী ছাড়া এই আক্রমণের গভীরতাকে উপলব্ধি করা কিংবা এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলা কার্যত অসম্ভব। বৈপ্লবিক মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সংগঠনই সেই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। একথা মুক্ত কণ্ঠে ঘোষণা করতে আমরা গৌরব বোধ করি যে, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং মতাদর্শগত সেই অমোঘ হাতিয়ারটি আমাদের আছে। আছে সমস্ত ষড়যন্ত্র, বিভ্রান্তি ও আক্রমণকে পরাস্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়।
বৈপ্লবিক অভিনন্দন সহ
কমল সাঁই, সভাপতি
অশোক মিশ্র, সাধারণ সম্পাদক
অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস্ অর্গানাইজেশন