নদী বাঁচাও – কৃষক বাঁচাও – দেশ বাঁচাও
আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের নামে বাংলাদেশকে মরুভূমি করার চক্রান্ত রুখে দাঁড়ান
ভারত কর্তৃক নদীর পানি প্রত্যাহার ও সরকারের নতজানু নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন
— বাসদ (মার্কসবাদী)
নদীমাতৃক বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী আজ মৃতপ্রায়। ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণে তিস্তা পারের হাজার হাজার মানুষ হাহাকার করছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা অববাহিকায় নেমে এসেছে চরম বির্পযয়। মেঘনার উজানে ভারতের বরাক নদে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা হয়েছিল। এখন আরেক বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, যার নাম ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এদেশের প্রধান নদী ব্রহ্মপুত্র কালক্রমে শুকিয়ে মরবে; বাংলাদেশ এক মহাবির্পযয়ের দিকে অগ্রসর হবে।
আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনা কি?
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ মহাপরিকল্পনা অনুসারে ছোট-বড় ৩৮টি নদীকে ৩০টি সংযোগকারী খালের মাধ্যমে যুক্ত করা হবে। এর আওতায় আন্তর্জাতিক নদী ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা থেকে পানি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে খরাপ্রবণ এলাকা গুজরাট, হরিয়ানা, রাজস্থান, তামিলনাড়ুতে। অনেকদিন ধরে প্রস্তাবনার আকারে থাকলেও সম্প্রতি ভারত এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তৎপর হয়ে উঠেছে। বিজেপি সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতী গত ১৬ মে ২০১৬ বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রধান নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে খরাপ্রবণ এলাকায় পানি পৌঁছানোই এখন কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কাজ। ২০১৫ সালের ১৩ জুলাই ভারতের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে — কেন্দ্রীয় সরকার আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নদী সংযোগ প্রকল্প ‘মানস-সংকোশ-তিস্তা-গঙ্গা’র কাজ শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে। মানস ও সংকোশ হল ব্রহ্মপুত্রের দুটি উপনদী যার পানি সরিয়ে নেয়ার অর্থ হল ব্রহ্মপুত্রে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া।
এ প্রকল্পের ফলে অনিবার্য মরুকরণের দিকে ধাবিত হবে বাংলাদেশ
বাংলাদেশের মোট পানির ৬৫-৬৭ ভাগ প্রবাহিত হয় ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ কমে গেলে কৃষি বিপর্যস্ত হবে। নদীসমূহের নাব্যতা হ্রাস পাবে, বন্যার প্রকোপ বাড়বে। সমুদ্রের পানি ভেতরে প্রবেশ করে লবণাক্ততা বাড়াবে। এর ফলে হ্রাস পাবে জমির উর্বরতা। শুষ্ক মৌসুমে সেচের অভাবে চাষাবাদ হবে না। মৎস্যসম্পদের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। ভূ-গর্ভে প্রয়োজন মত পানি সরবরাহ না হবার ফলে পানির স্তর নীচে নেমে গিয়ে আর্সেনিক দূষণের ঝুঁকি আরও বাড়াবে। সার্বিকভাবে ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য; পরিবেশ হয়ে পড়বে ক্রমশ ভারসাম্যহীন।
আন্তর্জাতিক নদীর পানি কোন দেশই একতরফা ব্যবহার করতে পারে না
যেসব নদী দুই বা ততোধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাদের বলা হয় আন্তর্জাতিক নদী। বাংলাদেশের ৫৪টি নদী ভারত থেকে এবং ৩টি এসেছে মায়ানমার থেকে। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের হেলসিংকি নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনায় নেবে। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের জলপ্রবাহ নীতিমালা কনভেনশন অনুযায়ী প্রণীত আইনে বলা হয়েছে, নদীকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না যাতে অন্য দেশ মারাত্মক ক্ষতি বা বিপদের মুখে পড়ে। এসব আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও আইনের তোয়াক্কা না করে ভারত একতরফাভাবে নদীসংযোগ পরিকল্পনা অগ্রসর করছে। অথচ, চীন কর্তৃক ব্রহ্মপুত্রের উৎস সাংপো নদীর উপর বাঁধ দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ঘোষণায় ভারত সরকার জোরালো আপত্তি জানিয়েছে।
সব শাসকদলই দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছে
বন্ধুত্বের কথা বলে ভারত অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে। দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্য, ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট, রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সমস্ত ক্ষেত্রগুলোতে ভারত আধিপত্য বিস্তার করে আছে। অথচ পানিসম্পদের ন্যায্য অধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করতে সরকার যথার্থ দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে পারেনি। তা না হলে এতদিনেও আন্তঃনদী সংযোগ পরিকল্পনার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট, জোরালো কোন প্রতিবাদ দৃশ্যমান হলো না কেন? খোদ ভারতেই বড় বড় পানি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা প্রকল্পটির বিরোধিতা করছেন। আর আমরা যেন ‘দেখা যাক’ এই ভেবে বসে অপেক্ষা করছি! পৃথিবীতে বহু দেশেরই আন্তর্জাতিক নদীর পানি আলোচনা করে যুক্তিসঙ্গত বন্টন নীতিমালার ভিত্তিতে নিজস্ব হিস্যা বুঝে নেয়ার দৃষ্টান্ত আছে। আমরা সরকারের কাছে অবিলম্বে ভারতের আন্তঃনদী সংযোগের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানানো এবং প্রয়োজনে আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে উত্থাপন করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
আসুন, নদী ও জীবন রক্ষায় ঐক্যদ্ধ হই
নদীবাহিত পলি দিয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ। শরীরে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হলে যেমন মানুষের মৃত্যু ঘটে, তেমনি নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে বা বাধাগ্রস্ত হলে ভূ-খন্ডের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। ধীরে ধীরে সেটাই হচ্ছে। সে কারণে এক সময়ের ১২০০ নদীর দেশে এখন মাত্র ২৩০টি নদী। এক ফারাক্কা বাঁধই দেশের মানচিত্র থেকে মুছে দিয়েছে ২০টি নদী। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানী লক্ষ মানুষ নিয়ে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন। মাওলানা ভাসানী যে আশংকা করেছিলেন, আজ তা নির্মম বাস্তব। শত হাহাকার করেও সেই প্রমত্ত পদ্মাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। আমরা কি নীরবে তাকিয়ে নদীর মৃত্যু দেখবো?
আসুন, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিণত করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার কন্ঠে রুখে দাঁড়াই। আমাদের দল বাসদ (মার্কসবাদী) গত কয়েক বছর ধরে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যাসহ নদী ও কৃষি বাঁচানোর দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করে আসছে। এর অংশ হিসেবে ভারতের আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে আগামী ২ — ৫ অক্টোবর ঢাকা-কুড়িগ্রাম অভিমুখে অনুষ্ঠিত হবে রোডমার্চ। এ কর্মসূিচ সফল করতে আপনাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।
২ অক্টোবর বুধবার : জাতীয় প্রেসক্লাবে সকাল ১১টায় উদ্বোধনী সমাবেশ, শেরপুরে পথসভা, সন্ধ্যায় বগুড়ার সাতমাথায় সমাবেশ।
৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার : মহাস্থানগড়, মোকামতলা, গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়িতে পথসভা। গাইবান্ধা পৌর শহীদমিনার চত্বরে বিকেল ৫টায় জনসভা।
৪ অক্টোবর শুক্রবার : দাড়িয়াপুর, ধর্মপুর, শোভাগঞ্জ ও সুন্দরগঞ্জে পথসভা। রংপুর পায়রা চত্বরে বিকেল ৫টায় জনসভা।
৫ অক্টোবর শনিবার : সাতমাথা, কাউনিয়া, তিস্তা, সিংগের ও রাজারহাটে পথসভা। কুড়িগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে বিকেল ৪টায় সমাপনী জনসভা।