Tuesday, April 30, 2024
Homeফিচারএকতরফা নির্বাচন ও সংঘাত-সহিংস রাজনীতির চক্রে বিজয়ের মাসে পরাজিত মানুষ || স্বাধীনতার...

একতরফা নির্বাচন ও সংঘাত-সহিংস রাজনীতির চক্রে বিজয়ের মাসে পরাজিত মানুষ || স্বাধীনতার ভুলুণ্ঠিত স্বপ্ন বাস্তবায়নে বামপন্থীদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের শক্তি গড়ে তুলুন

সাম্যবাদ। ১ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা। ডিসেম্বর ২০১৩

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর চলছে – কিন্তু মানুষের মনে বিজয়ের অনুভূতি নেই। দেশের মানুষ ভাবছে, এত অসহায়, এত পরাজিত তারা কখনো ছিল না। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনাও মানুষকে আশাবাদী করে তুলতে পারছে না। গত কয়েক মাস ধরে চলমান রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার সাথে নতুন বিপদ শুরু হয়েছে। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর জামাত-শিবির চক্র প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে চোরাগুপ্তা হত্যা-খুনের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা, লুটপাটের তাবণ্ড চালাচ্ছে। গণতন্ত্রকামী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, দেশপ্রেমিক সমাজসচেতন প্রতিটি মানুষ এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইছে। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ বলছে, পরিত্রাণের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট একটি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে – এটা এখন অত্যন্ত স্পষ্ট। নিজেদের সুবিধামতো সংবিধান সংশোধনসহ বিভিন্নভাবে এ আয়োজন চলছে অনেকদিন ধরেই। অন্যদিকে বিরোধী দল বিএনপি জামাতসহ অন্যান্য মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোকে সাথে নিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বেছে নিয়েছে ককটেল-বোমা-পেট্রোল বোমা হামলার পথ। জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী মহাজোট আর গণধিকৃত বিএনপি-জামাত — দুই বিবদমান শক্তিই জিম্মি করেছে জনগণকে। আওয়ামী জোটের হাতে আছে রাষ্ট্রশক্তি, র্যা ব-পুলিশ-বিজিবি, বিএনপি-জামাতের হাতে আছে হরতাল-অবরোধ-বোমা-সন্ত্রাস। তাদের গদি দখলের লড়াইয়ের আগুনে পুড়ছে সারা দেশ।

নজিরবিহীন একতরফা নির্বাচনের পথে দেশ

একতরফাভাবে প্রহসনের নির্বাচন আয়োজনের দিকে এগিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। এদেশের মানুষ এর আগে ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে ভোটারবিহীন নির্বাচন দেখেছে, ভোটডাকাতি-মিডিয়া ক্যুসহ নির্বাচনে কারচুপির নানা কলাকৌশল দেখেছে, আর এবার দেখতে যাচ্ছে প্রার্থীবিহীন নির্বাচন। এবারের ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইতিমধ্যে ১৫৪ জন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন! মহাজোটের মনোনীতদের নির্বাচিত দেখাতে অনুগত রিটার্নিং অফিসারদের কাজে লাগিয়ে নির্ধারিত সময়ের পরও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানো হয়েছে। আবার অনেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন জানালেও তা গৃহীত হয়নি, বরং তাদের কাউকে কাউকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছে। পতিত স্বৈরাচার এরশাদের জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনতে ও ধরে রাখতে প্রলোভন, চাপ প্রয়োগ, অসুস্থ ঘোষণা করে দল ভাঙ্গা, চিকিৎসার নামে অন্তরীণসহ নানা কূটকৌশল-জোরজবরদস্তি-নাটক চলছে। পরিহাস হল – গণতন্ত্রের জন্য কলংকজনক ও অনৈতিক এইসব কর্মকাণ্ড করা হচ্ছে ‘সংবিধান ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষা’র নামে। পুলিশ-বিজিবি-প্রশাসনিক শক্তিতে দমন-পীড়ন-গ্রেপ্তার চালিয়ে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো এই হাস্যকর নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় থাকতে চায় মহাজোট।

মহাজোট-জোটের বিরোধ গণতন্ত্র বা সংবিধান রক্ষার জন্য নয়

সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কাজে লাগিয়ে জনমত উপেক্ষা করে এককভাবে সংবিধান থেকে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাদ দিয়ে বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের ক্ষেত্র তৈরি করেছে মহাজোট সরকার। সকলের অংশগ্রহণে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির পরিবর্তে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন অনুষ্ঠান, সম্ভব না হলে অনুগত দলগুলোকে নিয়ে পাতানো নির্বাচনের পরিকল্পনাতেই তারা এগিয়েছে। মাঝে লোকদেখানো সংলাপের কিছু নাটক হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি-জামাত এখন নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি করলেও তারা ২০০৬ সালে কীভাবে নীলনকশার নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় আসার ছক কষেছিল তা সবাই জানে। ফলে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করতে তাদের আন্দোলনে মানুষকে সম্পৃক্ত করতে না পেরে তারা বেছে নিয়েছে বোমাবাজি-অগ্নিসংযোগ করে অচলাবস্থা তৈরির পথ। এই সুযোগে জামাত-শিবির ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে তাদের নেতাদের বিচার ও শাস্তি ঠেকাতে সহিংস তাবণ্ড-নৈরাজ্য চালিয়ে আতংক সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে গত ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার পর সারাদেশে বেশ কিছু স্থানে জামাত হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে, লক্ষ্মীপুর-লালমনিরহাট-সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলায় একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। বিএনপি যে-কোনো কৌশলে ক্ষমতায় যেতে জামাত-হেফাজতের মতো মৌলবাদী শক্তিগুলোকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, যার ফলে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ বাড়ছে।

নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গ – কিন্তু নির্বাচন মানেই গণতন্ত্র নয়

বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া হলো নির্বাচন, যার মাধ্যমে মানুষ ভোট দিয়ে তার পড়্গের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। এদেশে বুর্জেয়া গণতন্ত্র আজ এমন অধঃপতিত অবস্থায় গিয়েছে যে স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াও বজায় রাখতে পারছে না। ক্ষমতা থাকাকালে গণবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড, সন্ত্রাস-দুর্নীতি-দলীয়করণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি কারণে যে জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়, তার ফলে ভোট দেওয়ার অধিকার জনগণের উপর ছেড়ে দিতে এরা অপারগ। এ হলে ভরাডুবিকেই তাদের মেনে নিতে হবে। ফলে ক্ষমতাসীনরা সংবিধান সংশোধন, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও প্রশাসনের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দলীয়করণ করে পুনরায় ক্ষমতায় আসবার মরিয়া চেষ্টা করে। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনের ব্যবস্থা যদি থাকেও, তাতে নিরপেক্ষ ও প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের গ্যারান্টি কতটুকু? নির্বাচনে পেশিশক্তি, আঞ্চলিকতা, ধর্মের ব্যবহার, টাকার ছড়াছড়ি ইত্যাদি থাকে বলে মানুষের পক্ষে বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে তা প্রতিনিধি নির্বাচন সম্ভব হয় না। এভাবে বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বারবার লুটেরা-স্বৈরাচারী শাসকদের দুঃশাসনে নিপতিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সব অধিকার ভূলুণ্ঠিত করে, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ধ্বংস করে এরা শাসন পরিচালনা করে এবং পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন অনুষ্ঠানকেই এরা গণতন্ত্র বলে চালিয়ে দেয়। ফলে একই নীতির অনুসারী এক দলের পরিবর্তে অন্য দলের ক্ষমতায় আসা এ দৃশ্য দেখে মানুষ ভাবে ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’। বাস্তবিক পক্ষে রাবণদেরই আমরা নির্বাচন করি।

বিরোধী জোটের ৫ বছরের আন্দোলনে জনস্বার্থের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না

বিএনপি’র নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোট ৫ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড চালালেও সেখানে জনস্বার্থ ছিল অনুপস্থিত। জনগণকে পক্ষে টানার জন্য কিছু কথা কখনও কখনও তুললেও সেগুলো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী লড়াইয়ের পথ পরিহার করে সরকারকে অভিযুক্ত করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে কর্মীনির্ভর আনুষ্ঠানিকতার বাইরে তা যায়নি। জনগণের কাছে গিয়ে তাদের ভাবিয়ে তোলা, যুক্তি করা – এসব তাদের চিন্তারও বাইরে। এসব না করলেও তাদের স্বার্থপুষ্ট মিডিয়ার বদৌলতে প্রচারে এতটুকু বিঘ্ন ঘটবে না – এটা তারা জানে। ফলে তাদের ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে ককটেল, পেট্রোল বোমা, ভাংচুর, সহিংসতা। যথারীতি সরকারও পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দমন-পীড়নের পথেই চলেছে। কথা ও পেশিতে পরস্পরকে ঘায়েল করার রীতির মধ্যে গণতন্ত্রের এতটুকু অবশেষ আর থাকেনি। এদের গণবিচ্ছিন্ন পাল্টাপাল্টিতে জনগণের পক্ষে ‘নিরাপদ দর্শক’ হয়ে থাকারও উপায় নেই – কারণ প্রধান আঘাতটা আসে তাদেরই উপরে। কিন্তু তারপরও জীবনের সাথে সম্বন্ধহীন মল্লযুদ্ধ জনগণের চেতনার জগতকে আচ্ছন্ন করে রাখে। এই চলেছে বিগত ৫ বছর এবং তার পূর্বের সময় জুড়ে।

নীতিহীন দোষারোপের রাজনীতি : অধিকার হারিয়ে পুড়ছে জনগণ

সন্ত্রাসের মাধ্যমে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি করে বিএনপি চাইছে আওয়ামী লীগকে চাপে ফেলতে। আওয়ামী লীগ চাইছে এসব ঘটনা জনসমক্ষে তুলে ধরে বিএনপিকে জনবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করতে। এভাবে উভয়েই যার যার রাজনৈতিক ফায়দা তুলছে। পেট্রোলবোমা-সহিংসতার দায় আওয়ামী লীগ চাপাচ্ছে বিএনপির উপর, আর বিএনপি বলছে, এজেন্সির মাধ্যমে এসব সরকারের কাজ। পারস্পরিক দোষারোপে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের জীবনে। ২০০৪ সালেও যখন শেরাটন হোটেলের সামনে বাসে আগুন দিয়ে ১১ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তখন বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ বলেছিল, এটা সরকারের কাজ। এরা একদল অন্যদলের অপকর্ম দেখিয়ে নিজেদের অপকর্ম জায়েজ করে। কিন্তু মাঝখান থেকে এদের নীতিহীন সংঘাতে পুড়ছে সাধারণ মানুষ, ভুগছে সাধারণ মানুষ। খর্ব হচ্ছে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার।
চলমান বুর্জোয়া রাজনীতিতে কোথাও এতোটুকু নীতির অবশেষ নেই। দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, অনেক রক্তের বিনিময়ে এদেশের মানুষ একবার ১৯৭১ সালে পরাজিত করেছে পাকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতক রাজাকার-আলবদরদের। ১৯৯০ সালেও মানুষ রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারী এরশাদকে হটিয়েছিল। কিন্তু ইতিহাসের কি নির্মম পরিহাস! ক্ষমতায় যাওয়ার স্বার্থে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দল কখনো পরাজিত যুদ্ধাপরাধী জামাত-শিবিরের সাথে, কখনো পতিত স্বৈরাচার এরশাদের সাথে হাত মিলিয়েছে। নীতিহীন ক্ষমতাযুদ্ধে সহযোগী হিসেবে যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদী শক্তিকে পাশে পেতে চেয়েছে বিএনপি-আওয়ামী লীগ। যে কারণে ’৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সংগঠিত গণআদালতের রায় গত ২১ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। বিএনপি প্রত্যক্ষভাবে সেদিন রক্ষা করেছিল জামায়াতকে, আর আওয়ামী লীগ ওই আন্দোলনকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে পরবর্তীকালে এই ঘাতকদের সাথেই ঐক্য করে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছিল। অন্যদিকে বিএনপি তো জোট গঠন করে রাজাকার-আলবদরদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়াতে সহযোগিতা করেছিল।
এখন একদলের গলায় মালা হয়েছে পতিত স্বৈরাচার, অন্যদলের বগলের তলায় পরাজিত যুদ্ধাপরাধী রাজাকার। শাসকগোষ্ঠীর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে পতিত স্বৈরাচার আমাদের উপহার দিয়েছে রাজনৈতিক তামাশা ও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে বুর্জোয়া রাজনীতির দেউলিয়াত্ব। আর পরাজিত যুদ্ধাপরাধী জামাত-শিবির চক্র উপহার দিয়েছে সন্ত্রাসী তাবণ্ড, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা।

এরাই মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটায়, আবার তার বিপদ দেখিয়ে ক্ষমতার পথ প্রশস্ত করতে চায়

সীমাহীন আত্মত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে এদেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সেদিন সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তি ধর্মের নামে শোষণমূলক পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠনের কাজে লিপ্ত হয়েছিল। এতবড় মানবতাবিরোধী, গণহত্যাকারীদের বিচার না হলে মুক্তিযুদ্ধের নৈতিক অবস্থানটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাও ভূলুণ্ঠিত হয়। যে কাজটি স্বাধীনতার পর পরই সম্পন্ন হতে পারতো, শাসক দলগুলো গত ৪২ বছরে তা করেনি। অথচ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রথম মাসেই শুরু হয়েছিল, যা এখনো বন্ধ হয়নি। ৪২ বছরে শাসক দলগুলোর প্রশ্রয়ে নিশ্চিহ্নপ্রায় ও পরাজিত মৌলবাদী শক্তি এখন সন্ত্রাসী চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।
আজকে মৌলবাদী শক্তির ভয়াবহ সহিংস চেহারা দেখে আমরা অনেকেই উদ্বিগ্ন, আতঙ্কিত। এটা কিন্তু নতুন কোনো চিত্র নয়। মৌলবাদী শক্তির এই বিপদ আমরা দেখেছি জেএমবি-বাংলা ভাইদের রূপে, দেখেছি দেশের ৬৩টি জেলার ৫ শতাধিক স্থানে একযোগে বোমা হামলার মধ্য দিয়ে। এই বিপদ আমরা দেখেছি হেফাজতের চেহারায়। কিন্তু কেন বার বার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়? কেমন করে এ বিপদের হাত থেকে যথার্যই আমরা মুক্তি পেতে পারি – এ বিষয়গুলো না ভেবে তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান কি সুফল বয়ে আনবে?
আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে জনগণের বিরাট সুমহান আত্মত্যাগ সত্ত্বেও একটি বড় দুর্বলতা থেকে গিয়েছিল। মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের ধারায় গড়ে ওঠা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত করে আধুনিক গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে রাজনৈতিক আন্দোলনকে পরিচালিত করা যায়নি। এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে বুর্জোয়াদের পক্ষে সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীনভাবে লড়াই পরিচালনা করা আজকের দিনে আর সম্ভব নয়। এটা তাদের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকেই এ দুর্বলতা স্পষ্ট ছিল। কিন্তু এদেশের বামপন্থী দলগুলোও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক এই সংগ্রাম এগিয়ে নিতে পারেনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে শাসকগোষ্ঠীর সকল অংশ ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করেছে, মানুষের ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়েছে, বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তির সাথে নানা মাত্রায় আপস-সমঝোতা করেছে। পাশাপাশি শিক্ষাসহ যে সাংস্কৃতিক ভিত্তির উপর সাম্প্রদায়িক চিন্তার জন্ম হয় তাকেই প্রত্যেক শাসক উৎসাহিত করেছে। সাংবিধানিক অঙ্গীকারকে পাশ কাটিয়ে একধারার শিক্ষার বদলে মাদ্রাসা শিক্ষাসহ চার ধারার শিক্ষা বহাল রেখেছে যা সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির আবাদভূমি হিসাবে কাজ করেছে।
এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করেছে। সেটি হল, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে গণআন্দোলনের অনুপস্থিতি। বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠী যে গণবিরোধী দুঃশাসন আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে – মানুষ তার থেকে রেহাই পাবার কোনো যথার্থ ও কার্যকর পথ দেখতে পায়নি। বামপন্থী দলগুলোও গণআন্দোলনের পথে শক্তি সঞ্চয় করে মানুষকে পথ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। বারে বারে ব্যর্থতার পরিণতিতে মানুষের যুক্তিবাদী মন ও গণতান্ত্রিক চেতনা বিনষ্ট হয়েছে। এর থেকে সৃষ্ট মানুষের ক্ষোভ-হতাশা মৌলবাদী চিন্তা ও সংস্কৃতির প্রতি ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণ।
যুদ্ধাপরাধী-মৌলবাদীদের ঠেকাতে ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে হলেও আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচনকে সমর্থন জানাতে হবে – আজকে আওয়ামী লীগ জনগণকে এ সমীকরণের সামনে দাঁড় করাতে চায়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, জনগণের চাওয়া আর সরকারের চাওয়ার মাঝে বিস্তর ফারাক আছে – গত ৪২ বছরের ইতিহাস তার সাক্ষী। এ দুটোর মৌলিক তফাৎটি ধরতে না পারলে আমরা বর্তমান শাসকদের অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী তৎপরতার সহযাত্রী হয়ে যাবো।

বিরোধ এদের গদি দখলের প্রশ্নে : দেশ পরিচালনার নীতিতে এরা একই

বর্তমান অচলবস্থার সুযোগে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। স্বল্প আয়ের, সীমিত আয়ের মানুষের কি হবে – তা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান কুশীলব গার্মেন্টস শ্রমিকরা বাঁচবে কি করে – তার জবাব সরকারের কাছে নেই। বিরোধী দলও নিশ্চুপ। কারণ এরা উভয়েই মালিক পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে চলে। চরম দুর্ভোগে নিপতিত শ্রমিকরা বিক্ষোভ করলে শিল্প ধ্বংসের আখ্যা দিয়ে পুলিশি হামলা-মামলা, ভয়-ভীতি দেখিয়ে দমন করে। মালিকদের মজুরি নিয়ে নানা তালবাহানা, হা-পিত্তেশের নাটক শেষে শ্রমিকদের বাধ্য করা হয়েছে ৫৩০০ টাকা মজুরিতে। ‘বেশি মজুরি দিলে গার্মেন্টস টিকবে না’ – এ বকুনির আড়ালে নির্ধারণ করা বেতনে একজন শ্রমিক, ন্যূনতম পুষ্টি চাহিদা মেটানোর নিরিখে কিভাবে অর্থনৈতিক জীবন নির্বাহ করবে – এ মূল প্রশ্নটিকেই চাপা দিয়েছে। ন্যায়নিষ্ঠ শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতাও এক্ষেত্রে মালিক ও সরকারকে সুযোগ করে দিয়েছে। ৩৫-৪০ লক্ষ শ্রমিকের স্বার্থে বিএনপির কোনো কথা নেই। নিজেদের প্রতিযোগিতা ও বিরোধের জেরে একটি গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লাগানো হলে মালিকের দুঃখে খোদ প্রধানমন্ত্রী কেঁদে আকুল হয়েছেন। আর হরতাল-অবরোধের দোহাই তুলে গার্মেন্ট মালিকরা সরকারের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছেন নানা সুবিধা।
দেশের অপর প্রধান জনগোষ্ঠী গ্রামের গরিব-মাঝারি কৃষক, ভূমিহীন দিনমজুর-ক্ষেতমজুরদের জীবনে যে দুর্বিসহ অবস্থা নেমে এসেছে সেটা নিয়েও সরকারি-বিরোধী কোনো পক্ষই উদ্বিগ্ন নয়। চাষী সবজি বিক্রি করতে পারছে না, সার-ডিজেল-কীটনাশকের দাম আকাশ ছোঁয়া। চাষীদের মাথার ওপর এনজিও-মহানজী ঋণের বোঝা। গ্রামে কাজ নেই। বর্তমান বা অতীতের কোনো শাসকই এ দুরবস্থা থেকে কৃষকদের রক্ষা, কৃষি রক্ষার কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি? শাসকদের একই নীতি নারীদের বিষয়েও। নারীর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিরাপদ সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ এর কেউ নেয়নি। এদের শাসনের বদৌলতেই দিন দিন বাড়ছে নারী নির্যাতন। ছাত্রদের শিক্ষার অধিকার, জনগণের স্বাস্থ্যের অধিকার – সকল প্রশ্নেই আমাদের শাসকরা এক ও অভিন্ন নীতি নিয়ে চলে। তারপরও তারা নাকি জনগণের অধিকারের জন্য লড়াই করছে!
মার্কিনীদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের স্বার্থে ১১ বছর ধরে কখনও TIFA, সর্বশেষ TICFA নামে চুক্তি করার প্রচেষ্টা নির্বাচনকালীন সময়ে এসে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকারের এখতিয়ার বহির্ভূত এ চুক্তি সম্পাদন বিশ্বমোড়ল মার্কিনীদের সন্তুষ্ট করার স্বার্থে – এটা সহজেই বোধগম্য। জনগণের স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশপ্রেমিক বাম-গণতান্ত্রিক শক্তি যখন এ নিয়ে বিরোধিতা করছে তখন বিএনপি এটাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রসারিত হবে এবং এটা আরো আগেই করা উচিত ছিল।
সরকারে থাকলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়েই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকারী ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা করে। জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, সার, গাড়িভাড়া, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সেবাখাতে বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণ করে মূল্য বৃদ্ধি ঘটায়। অপরদিকে, এমপিদের বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিতে ট্যাক্স ছাড় দেয়, সামরিক বাহিনীসহ অনুৎপাদনশীল খাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপব্যয় করে। এরা উভয়ই গরিবকে শোষণ করে ধনীদের স্বার্থ রক্ষা করে। মুক্তবাজার-বিশ্বায়ন-উদারীকরণের পথে অর্থনীতি চালায়। দেশের সম্পদ কয়লা-গ্যাস উত্তোলনের জন্যে এরা সবাই বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করেছে। দুর্নীতি-সন্ত্রাস-দলীকরণে এরা কেউ কারও চেয়ে পিছিয়ে নেই। সম্প্রতি নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারি কর্মকর্তাদের খুশি করতে ৫০ পদের গ্রেড উন্নীত করা হয়েছে। নির্বাচনের সাথে সংযুক্ত ব্যক্তিরা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার সাথে যুক্ত হচ্ছেন। আবার বিগত সরকারের অনুগত কর্মকর্তাদের প্রায় ১০০০ জন ওএসডি হয়ে বসে আছেন। সরকার পরিবর্তন হলে দেখা যাবে একদলের পদোন্নতি ঘটবে আর একদল এভাবে ওএসডি হয়ে বেতন গুনবেন। এভাবে গত ৪২ বছর ধরে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছে। সামগ্রিক ফলাফলে দেশে একদল কোটিপতি ফুলেফেঁপে উঠেছে, অন্যদিকে গরিব-নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তদের জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যার যার স্বার্থ হাসিল করেছে -দলগুলো বিকিয়ে দিচ্ছে দেশের স্বার্থ

সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অধীনে আজ সারাদুনিয়ার পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো এক সূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে। মূলত পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ আজ একে অপরের পরিপূরক কিন্তু স্বার্থ নিয়ে পরস্পরের বিরোধও আছে। প্রবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে চীনের উত্থান, ভারতের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি অপরাপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আর এই বিশ্বপরিস্থিতিতে বাংলাদেশ নানা কারণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ভারত চাইছে বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ তাদের নিয়ন্ত্রণে ও কর্তৃত্বে আটকে রাখতে। চীন ও ভারতকে মোকাবেলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং বঙ্গোপসাগরকে ব্যবহার করতে চায়। এর বাইরে অন্যান্য ছোট-বড় শক্তিরও অর্থনৈতিক স্বার্থ বাংলাদেশকে ঘিরে আছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্য ফয়সালা করতে এসব সাম্রাজ্যবাদী দেশ এবং বিশ্বব্যাংক-জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা বাংলাদেশ তোলপাড় করে বেড়াচ্ছেন। আমাদের শাসক দলগুলোও তাদের ওপর নানা মাত্রায় নির্ভর করে আছে। এদের কাছে জাতীয় স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ এসবের কোনো অর্থ নেই।
শাসকগোষ্ঠী কেন সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর? এর একটি কারণ আগেই বলা হয়েছে যে আজকের বিশ্ব ব্যবস্থা নানা দিক থেকে আন্ত-সংযোগে সম্পর্কিত। অন্য একটি কারণ হল, এখানকার বুর্জোয়া শক্তিগুলো এককভাবে দেশের বাজার বিকশিত করার ক্ষমতা রাখে না, কিন্তু এরাই আবার বাইরের বাজারেও ভাগ বসাতে চায়। যেমন গার্মেন্ট-সহ রপ্তানীমুখী বিভিন্ন শিল্পের মালিকরা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর বাজারে নিজেদের পণ্য রপ্তানির সুযোগ চায়। ফলে সাম্রাজ্যবাদের সাথে তাদের সম্পর্ক দর-কষাকষির। আর সর্বোপরি আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয় দলই জানে তাদের জনবিরোধী শাসনে জনগণের ওপর শেষ পর্যন্ত ভরসা করা যায় না। জনগণকে এরা কোনোভাবেই বিশ্বাস করে না। যে কারণে এরা জনগণের কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকার ও দাবি-দাওয়া নিয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলার পথে পা দেয় না। আজকের বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী শক্তি সবচেয়ে বেশি ভয় পায় জনগণের উত্থানে, গণআন্দোলনে।

চাই গণআন্দোলন – চাই জনগণের শক্তির উত্থান

অনিশ্চিত জীবনের নিশ্চয়তা খুঁজতে নাসিমা বরিশাল থেকে এসেছিল ঢাকায় – এসে পুড়ে মরল। মনিরের ঢাকা দেখার সাধ অঙ্গার হয়েই মিটল। মতিঝিলে একটি কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকল রাজপথে – সাংবাদিকদের ছবি তোলার হুড়াহুড়ির মাঝেই সে মারা গেল। মরছে কে? মন্ত্রী-এমপি, বড় নেতাদের আত্মীয়-পরিজন নয়। সাধারণ মানুষ – যারা রাজনীতিকে তাদের বিষয় নয় বলে মনে করে। নষ্ট রাজনীতি থেকে দূরে থেকে, ঘৃণা করেও তার প্রভাব থেকে বাঁচা যায়না। আপনিও হতে পারেন সেই বাসের যাত্রী, একটু পরেই আপনার শরীর ঝলসে যেতে পারে। আপনিও হতে পারেন সেই নিরীহ পথচারী, ককটেলের আঘাতে একটি মুহূর্তই আপনার জীবনের শেষ মুহূর্ত হতে পারে। কিংবা বার্ন ইউনিটে প্লাস্টার করা শরীরে যন্ত্রণায় প্রতি মুহূর্তে কাতরাতে থাকবেন। চোখে জল নিয়ে উদ্বিগ্নতা নিয়ে হাজার বছরের মতো একটি একটি করে রাত পার করবেন আপনার স্বজনেরা। অথবা আপনি মরে গেলেন তো বাঁচলেন। আর আপনার স্বজনেরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মৃত্যুর ভার বইবেন সারা জীবন।
উদ্বিগ্নতা, হাসফাঁস, অস্থিরতা, ব্যাকুলতা – এসব মৃত্যুর চেয়ে কম কিসে? মৌলানা ভাসানি বলেছিলেন, রাজনীতি হলো মহৎ কর্মপ্রয়াস। এখন রাজনীতির কেন্দ্র থেকে মানুষ নির্বাসিত। মানুষ কিভাবে বাঁচবে, মর্যাদার জীবন পাবে – এ এখনকার রাজনীতির বিষয়ই নয়। লুটপাট-দুর্নীতির অর্থনীতির চালকের আসনে কে বসবে, দেশেরে সম্পদ কে লুটপাট করবে তাই নিয়েই তো বিরোধ!
এক বিশেষ পরিস্থিতিতে কবি নবারুণ ভট্টাচার্য লিখেছিলেন : “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না,/ এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না,/ এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না।” সত্যিই তো এমন দেশ মুক্তিযোদ্ধারা চায়নি, আমরা চাইনি – কিন্তু শাসক বুর্জোয়া দলগুলো আমাদের জিম্মি করে, আমাদের অজ্ঞতা, অসচেতনতা ও বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে এ অবস্থা তৈরি করেছে। দায় আমাদেরও কম নয়। স্বাধীনতার পর গত ৪২ বছরের বুর্জোয়া দল ও শক্তির নীতিহীন লুটপাট ও দুঃশাসন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমস্ত অর্জনকে ভুলুণ্ঠিত করেছে, পদদলিত করেছে। আজও তাই করে চলছে। আর আমরা কেউ ঘৃণা প্রকাশ করছি, কেউ ক্ষুব্ধ হচ্ছি, কেউবা নির্লিপ্ত হয়ে থাকছি। কিন্তু এ সবে কি কোনো ফলাফল দাঁড়াবে – আমাদের স্বার্থের রাজনীতি যদি গড়ে না তুলি?
দেশের পরিস্থিতি যে দিকে চলেছে তাতে আমাদের সামনে দুই ভয়াবহ বিপদ – একদিকে একতরফা নির্বাচনের পথে সমস্ত গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির কবর দিয়ে প্রবল পরাক্রান্ত রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ; অন্যদিকে একাত্তরের পরাজিত ঘাতকদের সাথে নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। বুর্জোয়া রাজনীতি জনগণকে উপায়হীনভাবে ঠেলে দিচ্ছে এই দুই বিকল্পের যে কোনো একটিকে বেছে নিতে। এর কোনোটিই তো আমাদের চাওয়া নয়, আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু এ পরিস্থিতির কোনো চটজলদি সমাধানও নেই। এটা আমাদের মনে করা না করার বিষয় নয়। এটা ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষা। বহু দিন ধরে বিন্দু বিন্দু যে সংকটের পাহাড় গড়ে ওঠেছে, তাকে এক মুহূর্তের এক ধাক্কায় সরিয়ে দেয়া যায় না। বহু বছরের প্রাচীন মহীরুহকে এক টানে উপড়ে ফেলা যায় না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধও একদিনের ফসল নয়। আমরা মনে করি, এ পরিস্থিতির একটাই বিকল্প – পুঁজিবাদী শোষণ-বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা উচ্ছেদের লড়াই। এই লক্ষ্যে আজ প্রয়োজন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, দ্রব্যমূল্য, সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অধিকার, নারী নির্যাতন, শ্রমিক-কৃষকের ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে তিল তিল করে গণআন্দোলন গড়ে তোলা, তাকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নেয়া। একমাত্র গণআন্দোলনের পথেই জনগণের শক্তির উত্থান ঘটিয়েই এ দুঃসহ পরিস্থিতির অবসান ঘটানো সম্ভব, সম্ভব স্বাধীনতার অপূরিত স্বপ্ন – গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে যাওয়া।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments