Thursday, April 18, 2024
Homeসাম্যবাদযুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর শাসকদের আপোস-পৃষ্ঠপোষকতার বিপরীতে গণআন্দোলনের জয়

যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর শাসকদের আপোস-পৃষ্ঠপোষকতার বিপরীতে গণআন্দোলনের জয়

সাম্যবাদ। ১ম বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা। ডিসেম্বর ২০১৩
অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে, নাটকীয় মুহূর্ত পেরিয়ে অবশেষে কার্যকর হল একাত্তরের ঘাতক, আলবদর বাহিনীর নেতা যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর হল। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে বিজয়ী হল জনগণের আন্দোলন, পরাজিত হল শাসকগোষ্ঠীর আপস-পৃষ্ঠপোষকতা। কসাই কাদের নামে কুখ্যাত এই জামাত নেতাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে রায় ঘোষণা করেছিল। এবছরের শুরুতে, ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে এ রায় ঘোষণার পর থেকে দেশপ্রেমিক মানুষ বিশেষত তরুণ প্রজন্ম বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। গড়ে ওঠে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ যেখানে সমবেত কণ্ঠে স্লোগান উঠেছিল : “আপসের এই রায় – জনগণ মানবে না”, “একটাই দাবি – রাজাকারের ফাঁসি”।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জামাতের ভূমিকা সকলেরই জানা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগি হিসাবে জামাতে ইসলামী এবং তার অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। পাকবাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে এরা সারাদেশে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যাসহ মুক্তিকামী দেশবাসীর ওপর বর্বর নিপীড়ন চালিয়েছিল।
স্বাধীনতার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সাথে শাসকদের আপস-আঁতাতের আড়ালে চাপা পড়ে যায়, যদিও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো তখন নিষিদ্ধ ছিল। জেনারেল জিয়া তার সামরিক শাসনের পক্ষে শক্তিবলয় গড়ে তোলার লক্ষ্যে ধর্মভিত্তিক দল ও শক্তিগুলোকে পাশে টেনে নেয়। এর মাধ্যমেই জামাত স্বাধীন দেশের মাটিতে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে। সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের আমলেও এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে। সামরিক শাসনকে বৈধ করার উদ্দেশ্যে প্রণীত রাষ্ট্রধর্ম বিলের মধ্য দিয়ে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী দলগুলোকে রাজনীতি করার অধিকার দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে জামাতকে পুনর্বার বৈধতা দেয়া হয়। ১৯৮৬ সালে এরশাদ স্বৈরাচারের পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং জামাত অংশগ্রহণ করে। ওই সময় থেকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ জামাতের সাথে সমঝোতা করে চলেছে। এরশাদ পতনের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট এবং বামপন্থীদের ৫ দলীয় জোটের পাশাপাশি জামাতকে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। ’৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি সরকার গঠনের জন্য জামাতের সমর্থন নেয়। ওই সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত রাষ্ট্রপতি প্রার্থীও জামাতের সমর্থনের আশায় গোলাম আযমের সঙ্গে দেখা করেছিল।
১৯৯২ সালে রাজাকার শিরোমণি গোলাম আযমকে জামাতের আমীর করার খবরে ছাত্র সংগঠনগুলোই প্রথম বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং এ বিক্ষোভ সারাদেশে ছড়িয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় গণআদালত। বিএনপি সরকারের সমস্ত নিপীড়ন নির্যাতন অগ্রাহ্য করে ৯২ সালের ২৬ মার্চ কয়েক লড়্গ মানুষ সমবেত হয়েছিল সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। সেখানে অনুষ্ঠিত গণআদালত গোলাম আযমের অপরাধকে মৃত্যুদণ্ডযাগ্য অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করে এবং তা কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়। কিন্তু বিএনপি সরকার গোলাম আযমকে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে যায় এবং গণআদালতের ২৪ জন সদস্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে। ’৯৪ পরবর্তীকালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি চাপা পড়ে যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুর আড়ালে। সে সময় আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে জামাতের সাথে ‘কৌশলগত’ ঐক্য করেছিল। পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে সম্পূর্ণ নিরবতা অবলম্বন করে। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি-জামাতের জোট ক্ষমতায় আসীন হয় এবং জামাতের দুইজন নেতাকে মন্ত্রী করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা ওড়ার ঘটনা দেশপ্রেমিক প্রতিটি মানুষকে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নটি তরুণ প্রজন্মের দ্বারা ব্যাপক সমর্থন লাভ করে এবং আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি অন্ত র্ভুক্ত করে। এরই অংশ হিসেবে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের অধীনে এখন ১২ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি এদেশের জনগণের বহু আকাঙ্ক্ষিত বিষয়। কিন্তু বার বার সে আকাঙ্ক্ষা মার খেয়েছে যুদ্ধাপরাধী শক্তির সাথে শাসকদের আপস-সমঝোতায়। শাসকগোষ্ঠীর আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে-পৃষ্ঠপোষকতায় একাত্তরের পরাজিত শক্তি ক্রমাগত বিকশিত হয়েছে। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা নিয়ে দেশী-বিদেশী বহু ধরনের তৎপরতা চলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছে জনগণের আন্দোলন। একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শাসকদের উপর ভরসা করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি আদায় হবে না, চূড়ান্তভাবে জনগণের আন্দোলনের শক্তিতেই এ গণআকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করতে হবে।
RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments