একতরফা নির্বাচন ও সহিংসতা-হানাহানির অপরাজনীতি প্রত্যাখ্যান করুন
ক্ষমতা দখলের নীতিহীন লড়াই-এর বিপরীতে
জনগণের পক্ষের রাজনীতি গড়ে তুলুন
আওয়ামী লীগ-বিএনপির গদি দখলের লড়াই-এর আগুনে পুড়ছে সারা দেশ। পুলিশের গুলিতে, বোমার আঘাতে মরছে মানুষ। বাসে পেট্রোল বোমা মেরে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে নীরিহ মানুষের শরীর। চারিদিকে সংঘাত-সহিংসতা, সবাই আতঙ্কিত। ঘর থেকে কেউ বের হলে পরিবারের সবাই দুশ্চিন্তায় থাকেন। আর এ ধরনের জঙ্গিত্বের প্রবণতা একবার শুরু হলে সরকারি-বেসরকারি নানা মহল যার যার সুযোগমতো একে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে। হরতাল-অবরোধে পণ্য পরিবহন ব্যাহত হচ্ছে, বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। রবিশস্য ফলিয়ে বাঁচে যে কৃষক তার অবস্থা আরও করুণ। আজকে তোলা সব্জি কাল নষ্ট হয়ে যাবে, তাই পানির দামে কৃষক তার ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। দিনমজুর-রিকশা চালক-পরিবহন শ্রমিক-ছোট ব্যবসায়ীদের আয়-রোজগার বন্ধ। গুরুতর অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে পর্যন্ত নেয়া যাচ্ছে না। সব মিলে মানুষের জীবন আজ বিপন্ন।
মহাজোট-জোটের বিরোধ গণতন্ত্র বা সংবিধান রক্ষার জন্য নয়
লুটপাট-দুর্নীতি-সন্ত্রাস-দলীয়
একতরফা নির্বাচন দেশকে স্বৈরতন্ত্রের পথে ঠেলে দেবে
সকলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। অথচ মহাজোট সরকার ‘গণতন্ত্র ও সংবিধানের ধারাবাহিকতা’র অজুহাত দেখিয়ে একতরফা নির্বাচনের পথে হাঁটছে। আমাদের দলসহ বামপন্থীরা এবং গণতন্ত্রমনা মানুষ সরকারের এই অপকৌশলের বিরোধিতা করেছে। কারণ গায়ের জোরে এ ধরনের সাজানো নির্বাচন দেশে বিদ্যমান ন্যূনতম গণতন্ত্রকেও বিপন্ন করবে। দমন-পীড়ন ও গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ হবে, আরো বেশি ফ্যাসিবাদী শাসনের সূচনা ঘটবে। জবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা দেশে যে সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে তাতে জনসাধারণের নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকা বিপন্ন হবে। যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদীদের ঠেকাতে ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে হলেও আওয়ামী লীগের একতরফা নির্বাচনকে সমর্থন জানাতে হবে – এমন প্রচারণার ঢাক জোরেসোরেই বাজানো হচ্ছে। অথচ গত ৪২ বছর ধরে ক্ষমতাসীনদের দুঃশাসন, ভোটের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করা ও তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী শক্তি এ পর্যায়ে আসতে পেরেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জনগণের দাবি, কিন্তু সবক্ষেত্রে গণবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়ে শুধু বিচারের কথা বললেই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠিত হবে? মৌলবাদী অপশক্তিকে রুখতে চাই জনগণের জাগ্রত চেতনা আর ভয়ে কুঁকড়ে না গিয়ে লড়াকু মানসিকতা।
গদির দখল নিয়ে বিরোধ থাকলেও দেশ পরিচালনার নীতিতে শাসকরা একমত
অন্যদিকে গদি নিয়ে যত বিরোধই থাকুক, আওয়ামী লীগ-বিএনপি উভয়ই একই নীতিতে দেশ চালায়। আমেরিকার স্বার্থে টিক্ফা চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে এরা একমত। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবির প্রশ্নে উভয়ের অবস্থান মালিকদের পক্ষে।
সরকারে থাকলে এরা প্রত্যেকেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকারী ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের স্বার্থ রক্ষা করে, সাধারণ মানুষের পকেট কেটে বৃহৎব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের যথেচ্ছ মুনাফা লোটার সুযোগ করে দেয়। জ্বালানি তেল-বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানি-সার, গাড়িভাড়া, শিক্ষা-চিকিৎসাসহ সেবাখাতে ভর্তুকি হ্রাস ও বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণ করে মূল্যবৃদ্ধি ঘটায়। অথচ এমপিদের বিলাসবহুল গাড়ি আমদানিতে ট্যাক্স ছাড় দেয়, সামরিক বাহিনীসহ অনুৎপাদনশীল খাতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ অপব্যয় করে। এরা উভয়েই গরিবকে শোষণ করে ধনীদের স্বার্থরক্ষাকারী মুক্তবাজার অর্থনীতি-বিশ্বায়ন-উদারীকরণের পথে অর্থনীতি চালায়। দেশের সম্পদ গ্যাস-কয়লা উত্তোলনের জন্য এরা সবাই বিদেশি কোম্পানিগুলোর সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি করেছে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দলীয়করণ, স্বেচ্ছাচারী শাসনের ক্ষেত্রে এরা কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই। গত ৪২ বছরের শাসনে দেশে একদল কোটিপতি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে, অন্যদিকে গরিব-নিমড়ববিত্ত-মধ্যবিত্তরা জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে।
গণতন্ত্রের কথা মুখে বললেও এরা কেউ গণতন্ত্রী নয়
দেশের স্বাধীনতা অনেক রক্তের বিনিময়ে এসেছে। সেদিন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এদেশে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আজ পর্যন্ত কখনও সামরিক, কখনও বেসামরিক স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় দেশ চলেছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ বৈষম্য থাকার কথা নয়, অথচ সাম্প্রদায়িকতা আজ ভয়াবহ সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভোটের আগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার-নিপীড়ন বর্তমানের ভোট রাজনীতিরই একটা অংশ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে, লুটপাট করে সাম্প্রদায়িক জিগির তুলে একদলের লাভ, আর এর ফলে সংখ্যালঘুদের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয় এতে আরেক দলের লাভ। তাই এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হলে স্থানীয় ভিত্তিতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
লুটেরাদের শুভবুদ্ধি উদয়ের প্রার্থনা নয়, চাই জনগণের শক্তির উত্থান
অনেকে বলেন, বর্তমান সংকট নিরসনের জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে সমঝোতা বা তাদের শুভবুদ্ধি উদয়ের জন্য আবেদন জানাতে হবে। যারা দেশে সংকট তৈরি করেছে আমরা কি তাদের কাছেই সমাধানের জন্য নিস্ফল আবেদন-নিবেদন করতে থাকবো, না কি এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো এবং বিকল্প পথ অনুসন্ধান করবো? এই দুই দলের মধ্যে আপাতত সমঝোতা যদি হয়ও তাতে কি নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংকটের স্থায়ী সমাধান হবে? অথবা স্বৈরতন্ত্রী দুই দল মিলে-মিশে দেশ চালালেই কি গণতান্ত্রিক শাসন হবে? নির্বাচনে শুধু ক্ষমতার বদল হলেই জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। জনগণের পক্ষের রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে না পারলে অপরাজনীতির শিকার হতে হবে। ক্ষোভ-ঘৃণা প্রকাশ বা নির্লিপ্ত থেকে সমস্যার সমাধান হবে না। গণআন্দোলনের পথে জনগণের শক্তি নির্মাণই মুক্তির পথ।
সচেতন মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এ পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য
গোটা দুনিয়ায় আজ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সংকটগ্রস্থ। পুঁজিবাদ কোনো দেশেই মানুষের সংকট সমাধান করতে পারছে না। পারছে না সমাজকে বিকশিত করতে, গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। আমাদের দেশের সংকটও এর থেকে ভিন্ন কিছু নয়। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের আর কোনো পথ নেই এ ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া। বামপন্থীরা সমাজের আমূল পরিবর্তন ও শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লড়াই করছে। কিন্তু সেই পরিবর্তনের মতো যথেষ্ট শক্তি এখনও এদেশের বামপন্থী শক্তিসমূহ অর্জন করতে পারেনি। আমাদের পার্টি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, গণতান্ত্রিক বামমোর্চাসহ আরও কিছু গণতান্ত্রিক শক্তি কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আমরা সীমিত সামর্থ্যে জনগণের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু আমরা শক্তিশালী বিকল্প হয়ে না ওঠা পর্যন্ত কি আপনারা যারা সচেতন মানুষ আছেন তারা প্রতিবাদ করবেন না? আমাদের তো আন্দোলন-সংগ্রামের বিরাট ইতিহাস আছে। তাহলে সব কিছুই আমরা মুখ বুঁজে মেনে নিচ্ছি কেন? আমাদের দলের পক্ষ থেকে জনসাধারণকে গণআন্দোলনের পথে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি নির্মাণের সংগ্রামে এগিয়ে আসার আহবান জানাচ্ছি। এলাকায় এলাকায় নিজেদের উদ্যোগে বিক্ষোভ সংগঠিত করুন। মূল্যবৃদ্ধি, সাম্প্রদায়িকতা, নারী নির্যাতনসহ জনজীবনের বিভিন্ন সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। এই অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠুন। আমরা আমাদের নীতি-আদর্শ ও শক্তি নিয়ে আপনাদের পাশে দাঁড়াব।
—————————————————————————
বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন কমিটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত লিফলেট
তারিখ : ০৯.১২.২০১৩