প্রথম অঙ্কের পর্দা ওঠার আগেই নাটকের শেষ অঙ্কটা যে লেখা হয়ে যায়, এ তো অজানা কোনো তথ্য নয়। ১ অক্টোবর আমেরিকার প্রতিনিধি সভা বা কংগ্রেসে রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট দলের মধ্যে মতানৈক্যের ফলে বাজেট পাশ না হওয়ায় যখন মার্কিন সরকারের বেশিরভাগ দপ্তরে তালা পড়েছিল, মার্কিন সাংবাদিকরাই বলেছেন, এ হল ডামাডোলের আড়ালে জনগণের খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষা খরচে রাশ টানার কৌশল মাত্র। এমনভাবে হইচই তোলা হচ্ছিল যেন রিপাবলিকানরা সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচ চায় না, আর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটরা সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে একেবারে ঘোর জনদরদী। সারাবিশ্বের সংবাদমাধ্যম একেবারে হামলে পড়ে রব তুলেছিল ১৭ অক্টোবরের মধ্যে মার্কিন সরকারের ঋণ নেওয়ার ঊর্ধ্বসীমা না বাড়াতে পাড়লে বিশ্বজুড়ে নাকি সমূহ সর্বনাশ ঘনিয়ে আসছে। অবশেষে যথারীতি কমেডি নাট্যরীতি মেনে মধুরেণ সমাপয়েত হয়েছে। ১৬ তারিখে মার্কিন প্রতিনিধি সভা কংগ্রেসে দুই দলের সমঝোতা হয়ে সরকারের তালা খুলেছে, ঋণের সীমাও ১৬.৭ লক্ষ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ১৭.৯৪ লক্ষ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও এই সমঝোতা নাকি সাময়িক। কিন্তু দেখা গেল অচলাবস্থার পুরো সময়টা ধরে ওয়াল স্ট্রিটের বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এবং ব্যাঙ্কারদের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের আলোচনা চলেছে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অচলাবস্থার দ্বিতীয় দিনে বাণিজ্যজগতের অন্যতম মাইক্রোফোন সিএনবিসি টেলিভিশন চ্যানেলে বলেছিলেন, সামাজিক সুরক্ষা এবং প্রস্তাবিত সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা বা ‘অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট’ নিয়ে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে মতপার্থক্য। এই আইনকে অনেকেই ২০১৬-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী পারাবার পার হওয়ার জন্য ওবামা ভেলা মনে করে নাম দিয়েছেন ‘ওবামা কেয়ার’। অচলাবস্থা যত এগিয়েছে ততই স্পষ্ট হয়েছে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাটরা বাগাড়ম্বর যাই করুক দুই দলই একটা ব্যাপারে একমত যে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত বাজেট ঘাটতি কমিয়ে মিলিটারি এবং বৃহৎ পুঁজিপতিদের আর্থিক সাহায্য (স্টিমুলাস প্যাকেজ) চালিয়ে যাওয়া এবং রাষ্ট্রীয় ঋণের সুদ ঠিকমত গুণে যাওয়া। এই খাতগুলি বাদে সরকারের ব্যয় সংকোচের প্রশ্নেও তারা সম্পূর্ণ একমত।
কিন্তু ভোটের বাজারে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের লড়াইতে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাজেট পাশ না হওয়ায় ১ অক্টোবর সরকারের দপ্তরে তালা পড়ে যায়। ফলে ৮ লক্ষ সরকারি কর্মচারীকে ১৬ দিন ধরে বিনাবেতনে বাড়িতে বসে থাকতে বাধ্য করা হল, ৪ লক্ষ কর্মচারি বিনা বেতনে কাজ করতে বাধ্য হলেন, প্রায় ৮৯ লক্ষ দরিদ্র মা ও শিশু এই ১৬ দিন ধরে সস্তায় খাদ্য থেকে বঞ্চিত হলেন। বয়স্কদের ভাতা, বেকার ভাতা, ছাঁটাই শ্রমিকদের ভাতা সবই ১৬ দিনের জন্য বাদ চলে গেলো। যদিও মিলিটারি, যুদ্ধ, প্রেসিডেন্টের বেতন, সেনেটর এবং কংগ্রেস সদস্যদের বেতন যথারীতি চালু ছিল। সংবাদ মাধ্যমই বলছে, রিপাবলিকান নেতা টেড ক্রুজ ২০১৬-তে প্রেসিডেন্ট পদের অন্যতম দাবিদার। ওবামার বিরুদ্ধে সুযোগ পেলে পেশী আস্ফালন তিনি করবেনই। আবার অর্থনীতির সংকটে জেরবার প্রেসিডেন্ট ওবামার দরকার জনগণের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার । তাই তিনি যেমন চেয়েছেন ‘ওবামা কেয়ার’ নিয়ে হইচই উঠুক, তেমনই আবার চেয়েছেন শিল্প মহলকে বার্তা দিতে – আমি তোমাদেরই লোক। শিল্পমহল সামাজিক সুরক্ষাখাতে ব্যয় নিয়ে ভ্রু কুঁচকাতেই ওবামা বার বার বলছেন অনাবশ্যক সামাজিক সুরক্ষা খাতে খরচ কমাতে সরকার বদ্ধপরিকর। ওবামা শিল্পপতিদের কথা দিয়েছেন সর্বজনীন স্বাস্থ্যবিমা থেকে নিয়োগকারীদের দায়িত্বের প্রশ্নটি তিনি লঘু করে দেবেন। তাহলে কি দাঁড়াচ্ছে? অচলাবস্থার শুরুতেই ৩ অক্টোবর আমেরিকান সাংবাদিক ব্যারি গ্রে বলেছিলেন, এই অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে পর্দার আড়ালে সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সমস্ত জনকল্যাণমূলক খাতে সরকারি দায়িত্ব সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেওয়ার জমিন তৈরী করার জন্য। কথাটা সত্য বলেই প্রমাণ হল।
আইএমএফ-এর ডিরেক্টর ক্রিস্টিন লাগার্ডে আবার সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে আমেরিকার খরচ নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পরামর্শ দিয়েছেন এই সব খাতে খরচ দ্রুত কমিয়ে অবিলম্বে শিল্পপতিদের জন্য স্টিমুলাস প্যাকেজ দেওয়া উচিত। ওয়াশিংটন পোস্টের সম্পাদকীয় কলাম থেকে শুরু করে আমেরিকার তাবড় সব ব্যাংক কর্তা ধুয়ো ধরেছেন যে, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে খরচ না কমালে আমেরিকার সংকট নাকি কাটবে না। তাঁরা সংকোচনের নিদান হেঁকে বলছেন, সংকট ত্রাণের এটিই একমাত্র রাস্তা।
গত ছয় মাসে মার্কিন সরকারের কোষাগার ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার ৫৩ কোটি ডলার। মার্কিন সরকারের ঋণ সে দেশের আর্থিক লেনদেনের সমান (বিবিসি নিউজ, ১৬-১০-১৩)। এই বিপুল ধার ও ঘাটতি কি দেশের সাধারণ মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা খাতে সাহায্য দেওয়ার জন্য হয়েছে? প্রখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক পল ক্রেগ রবার্টস-এর মতে, মার্কিন সরকার গত ২৫ বছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে তহবিল তৈরির নামে কর এবং বন্ড থেকে যা আয় করেছে, ব্যয় করেছে তার থেকে অনেক কম (পলক্রেগ রবার্টস, ইন্টারনেট কলাম-২০১৩)। বৃহৎ পুঁজিপতিরা সীমাহীন লাভের জন্য সমস্ত কাজের আউটসোর্সিং করছে। এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সস্তা শ্রমকে শোষণ করে বাড়তি লাভের আশায় দেশের প্রায় সমস্ত কাজ সাগর পাড়ে চালান করছে। যার ফলে আমেরিকার অভ্যন্তরে উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ একেবারে তলানিতে। উন্নত প্রযুক্তি কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত না হয়ে, হচ্ছে কম কর্মচারী নিয়োগ করে বেশি লাভের লক্ষ্যে। কাজ হচ্ছে মূলত পরিষেবা খাতে। স্থায়ী কাজ প্রায় নেই। দেশের কর্মক্ষম মানুষের ৭.৩ শতাংশ বেকার। মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে এক বছরে ২.৭ শতাংশ অথচ মজুরি বেড়েছে গড়ে ০.৭ শতাংশ (দ্য গার্ডিয়ান, ১৬-১০১৩)। ফলে দেশে যেমন সম্পদ সৃষ্টি হচ্ছে না, অন্যদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। কমছে কর বাবদ সরকারের আয়। এর সাথে করপোরেট ট্যাক্স প্রতি বছর একাধিক বার কমানো হয়েছে। যার হাত ধরে সরকারি আয় কমেছে আরও বেশি। অপর দিকে বাড়ছে পুঁজিপতিদের দেওয়া স্টিমুলাস প্যাকেজ এবং সারা পৃথিবী জুড়ে মার্কিন যুদ্ধযন্ত্রকে সচল রাখার বিপুল খরচ। এর জন্যই বেড়েছে মার্কিন সরকারের কোষাগার ঘটতি। অথচ তার দায় চাপছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। মার্কিন একচেটিয়া পুঁজি শুধু এশিয়া ইউরোপকে ছিবড়ে করছে না, নিজের দেশের মানুষকেও রক্তশূন্য করে দিচ্ছে।
শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপসহ বিশ্বের সকল পুঁজিপতি দেশেই আজ সরকারের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প, যাকে অন্য নামে কল্যাণমূলক প্রকল্প বা কৃষিতে ‘ওয়েলফেয়ার স্কিম’ বলা হয়, তার উপর প্রবল আক্রমণ শুরু হয়েছে। ইউরোপে ব্যয় সংকোচের নামে যে অভিযান সকল দেশের সরকারগুলি শুরু করেছে তা আসলে একদা রাষ্ট্রেরই চালু করা কল্যাণমূলক ব্যবস্থাদির উপর খোলাখুলি আক্রমণ।
এই কল্যাণমূলক প্রকল্পের একটা ইতিহাস আছে। বিশেষ করে ইউরোপে এটা চালু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের পটভূমিতে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি নিজ নিজ দেশের জনসাধারণের জন্য বহুরকম যে সব কল্যাণমূলক সুযোগ-সুবিধা চালু করেছিল, তার প্রতি আকর্ষণ থেকে পুঁজিপতি দেশগুলিতে শ্রমিক আন্দোলন ঐ সব দাবিতে ঢেউ তুলবে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শক্তিশালী হবে, এই আশঙ্কায় পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলিও নানা কল্যাণমূলক ব্যবস্থা চালু করতে বাধ্য হয়েছিল। আবার পুঁজিবাদের অনিবার্য বাজার সংকট থেকে এর দ্বারা কিছুটা রেহাইও মিলেছিল, যেহেতু এই সব সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প জনগণের হাতে কিছুটা ক্রয়ক্ষমতা জুগিয়েছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থা কালক্রমে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলিতে সরকারি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়িয়ে চলে। ঐ সময় পুঁজিপতি রাষ্ট্রকে বিপ্লবের হাত থেকে রক্ষার উপায় হিসেবে ঐ ব্যবস্থা মেনে নিলেও আজ ষখন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা নেই তখন তারা তা মানতে নারাজ। বিশেষ করে তীব্র বাজার সংকটে পড়ে পুঁজিপতি শ্রেণি আরও বেশি সরকারি সহায়তা দাবি করছে। আর যেহেতু সমাজতন্ত্র নেই, দেশে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন দুর্বল, অতএব পুঁজিপতিশ্রেণিও শ্রমিক-কর্মচারীদের উপর আক্রমণে বেপরোয়া।
এটাই হচ্ছে সংকটের কেন্দ্রবিন্দু। মার্কিন পুঁজির প্রতিনিধি হিসেবে আর্থিক নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে ওবামা ও রিপাবলিকানদের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্যই নেই, যেমন ভারতে কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে নেই। কিন্তু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। আমেরিকাতেও ঠিক এরকম। সকল সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অবস্থাটা প্রায় একই। [সূত্র : গণদাবী, ২৫ অক্টোবর ২০১৩]