মায়ানমারে গত ১লা ফেব্রুয়ারী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বন্দী করে দেশটির সেনাবাহিনী আবারও ক্ষমতা দখল করেছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে গণতন্ত্রকামী মানুষ সেনাশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে থাকে। বিক্ষোভ দমনে প্রতিদিন সেনাবাহিনী-পুলিশ নির্বিচারে সাধারণ বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালাচ্ছে। গত ২৭ মার্চ একদিনেই দেশটিতে নিহত হয়েছে ১১৪ জন বিক্ষোভকারী। এ পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে। হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেফতার করেছে। এত নিপীড়ন নির্যাতনেও থেমে নেই আন্দোলন। বিক্ষোভকারীরা প্রতিদিন নতুন শক্তি ও কৌশলে আন্দোলন জোরদার করছে।
গণতন্ত্রের জন্য মায়ানমারের জনগণের সংগ্রাম নতুন নয়। দেশটি ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় পুরো সময় দেশটিতে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে ছিল। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছে। দেশটির শীর্ষ পুঁজিপতিদের অধিকাংশই সাবেক বর্তমান সেনা কর্মকর্তা। এছাড়াও দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকাংশেই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। অপরদিকে জনগণের রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক অধিকারকে বরাবর সংকুচিত নিয়ন্ত্রিত করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে বিভিন্ন সময় জনগণ রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে সামিল হয়েছে। ১৯৮৮ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনে কয়েক হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একইভাবে ২০০৭ সালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনেও হত্যা নির্যাতন চালায় সেনাবাহিনী। গণ-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ পরিচালনা করার স্বার্থে সেনা শাসকরা জনগণকে বিভক্ত করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জাতিগোষ্ঠীর সাথে কারেন, শান, রোহিঙ্গা ইত্যাদি জাতির জাতিগত দ্বন্দ্ব তীব্র করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মানুসারী মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের উপর বর্বর নিপীড়ন চালিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর ভয়াবহ আক্রমণ করে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আজ তাদের বাসস্থান হারিয়ে আমাদের দেশে উদ্বাস্তু হয়ে অবস্থান করছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে সেনা শাসকরা বারবার সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর কাছে নতজানু হয়েছে। বিশেষত মায়ানমারের প্রতিবেশী সাম্রাজ্যবাদী চীন তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে সেনাশাসনকে সবসময় সমর্থন সহযোগিতা করেছে। চীন তার ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর জন্য মায়ানমারের ভিতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযোগ স্থাপনের কাজ অনেকদূর অগ্রসর করেছে। আরাকান রাজ্যে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীন ছিল মুখ্য বিনিয়োগকারী। এই বন্দরে চীনকে ৭০ ভাগ মালিকানা দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। এছাড়াও আরাকান থেকে চীনের ইউনান পর্যন্ত ২৩৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণ করছে চীন। গ্যাসের জন্য চীন অনেকাংশে মায়ানমারের উপর নির্ভরশীল। দেশটির বিদেশি বিনিয়োগের সিংহভাগই চীনের। একইভাবে ভারত তার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহে যোগাযোগ ও বাণিজ্যের স্বার্থে মায়ানমারের সেনাশাসনকে সমর্থন করে। এছাড়াও অস্ত্র ক্রয়সহ নানা বাণিজ্যিক সুবিধা দিয়ে সেনাশাসকরা রাশিয়াসহ পৃথিবীর অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সমর্থন আদায় করে। চীন এক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং সেনাশাসকদের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থক। ফলে চলমান সেনাশাসন বিরোধী আন্দোলনে চীন বিরোধিতা চোখে পড়ার মত।
জনগণের দীর্ঘ সেনাশাসন বিরোধী আন্দোলন এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর চাপে ২০১৫ সালে দেশটিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অং সাং সুচীর নেতৃত্বাধীন এনএলডি জোট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। যদিও দেশটির সংবিধানে সংসদের ২৫ ভাগ আসন এবং দেশটির স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। সংবিধান পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় ৭৫ শতাংশের অধিক আসন বেসামরিক সরকারের হাতে না থাকায় সেনাবাহিনীর মূল ক্ষমতা কাঠামোয় কোন পরিবর্তন আসেনি। গত বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৪১২ আসনের মধ্যে ৩৪৬টিতে বিজয়ী হয় অং সাং সুচীর নেতৃত্বাধীন এনএলডি এবং সেনা-সমর্থিত ইউএসডিপি জিতেছিল ৩৩ আসনে। এ নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি কে হবে এ নিয়ে সেনাপ্রধান মিন হ্লাইয়াং এবং অং সাং সুচীর মধ্যে দ্বন্দ্বের জেরে সেনাবাহিনী আবারও গত ১লা ফেব্রুয়ারী ক্ষমতা দখল করে। অং সাং সুচী সহ নির্বাচিত প্রায় সকল জনপ্রতিনিধিদের গ্রেফতার করে।
রোহিঙ্গা সংকটের পর বর্তমান সেনা অভ্যুত্থান এবং আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মায়ানমার আবারও আমাদের দেশে আলোচিত হচ্ছে। ২০১৭ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর নিপীড়নে প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আমাদের দেশের সরকার আশ্রয় দিলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনের জন্য মায়ানমারের উপর কার্যকর কোন চাপ তৈরি করতে পারেনি। সেনা অভ্যুত্থানের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবসন প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। আমাদের দেশেও গত প্রায় এক দশক ধরে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকার স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করেছে। আমাদের দেশের জনগণও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে লড়াই করছে। ফলে মায়ানমারে চলমান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে এদেশের জনগণের সমর্থন আছে। কিন্তু গত ২৭ মার্চ মায়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকার মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে সেনাশাসকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সেখানে চীন, রাশিয়া, ভারতের মত সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধি অংশ নেয়। এ ঘটনার মাধ্যমে বোঝা যায় এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের শাসকশ্রেণী, হোক সে মায়ানমারের সেনাশাসক, বাংলাদেশের ভোট ডাকাতির সরকার বা তথাকথিত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের ফ্যাসিস্ট মোদি সরকার এদের মধ্যে একটা ঐক্য আছে। কি সে ঐক্য? তাদের ঐক্য হচ্ছে শোষণ-লুটপাট নির্বিঘ্ন করার, জনগণকে নিপীড়ন-নির্যাতন-বিভক্ত করার ঐক্য। শাসকদের ঐক্য থাকলেও নিপীড়িত মানুষের কার্যকর কোন ঐক্য নেই। দেশে দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ের জন্য নিপীড়িত মানুষের ঐক্য আজ অপরিহার্য। মায়ানমারের গণতন্ত্রকামী মানুষ প্রতিদিন বুকের রক্ত দিয়ে ফ্যাসিস্ট সেনাশাসনের বিরুদ্ধে লড়ছে। আমাদের দেশের প্রতিটি গণতন্ত্রমনা মানুষের উচিত তাদের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ানো। মায়ানমারের জনগণের মরণপণ সংগ্রাম এ অঞ্চলে নিপীড়িত মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রেরণা যোগাবে।
(উৎস: সাম্যবাদ, এপ্রিল-মে ২০২১)