মোদী এসেছিলেন রক্তাক্ত পথ ধরে, তাই তার যাওয়ার পথের দিকে কেউ তেমন দৃষ্টি দেয়নি। তাকে কেউ চায়নি, কিন্তু তিনি এসেছেন। প্রশ্ন জাগে, এই নাছোড়বান্দা আগমনে বাংলাদেশের উপকার কিছু হল কী?
সরকারি ও দলদাস বুদ্ধিজীবীরা মতামত তৈরির উদ্দেশ্যে এই প্রোপাগান্ডা করছেন যে, এটা একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে প্রতিবেশী দেশের প্রধান নির্বাহীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রেওয়াজ অনুসারে। তিনি সেই দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। তিনি মোদী না হয়ে যে কেউ হতে পারতেন। আমরা ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানাইনি, জানিয়েছি রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে মোদী এসেছেন। এটাতে সরকারের কোন হাত নেই। এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভও তাই অবান্তর।
তর্কের খাতিরে কথাটাকে সত্য ধরে নেই। তাহলে এই প্রশ্ন জাগে, ভারতের প্রধান নির্বাহীর আগমন তো নিছক বেড়ানো নয়। যে কোন দেশের প্রধান নির্বাহীর আগমন মানেই দ্বিপাক্ষিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা ও কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ভারতের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অন্য যে কোন দেশের তুলনায় ভারতের সাথেই বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সবচেয়ে বেশি জড়িত।
এই প্রেক্ষিতে মোদির সফরকে আমরা একটু পর্যালোচনা করি। এ সফরে পাঁচটি দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এগুলো হলো – দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, সহনশীলতা ও প্রশমন, দুই দেশের জাতীয় ক্যাডেট কোর বিষয়ক, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিকারে সহযোগিতার ফ্রেমওয়ার্ক স্থাপন, বাংলাদেশ-ভারত ডিজিটাল পরিষেবা, আইসিটি সরঞ্জাম সরবরাহ, রাজশাহী কলেজে ক্রীড়া সুবিধা প্রদান ইত্যাদি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রতিকারে ফ্রেমওয়ার্ক ছাড়া বাকিগুলোর গুরুত্ব নিয়ে আমাদের বলার কিছুই নেই। দুর্যোগ, ক্যাডেট কোর, আইসিটি ও খেলার সরঞ্জাম নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সময়ক্ষেপণ করে বৈঠকের কোন উপযোগিতা আছে বলে আমরা মনে করি না।
আবার বাণিজ্য নিয়ে যে আলোচনা হলো সেখানে কাদের স্বার্থ জড়িত? দুই দেশের মধ্যে যে বাণিজ্য ঘাটতি সেটা কিভাবে কমানো যায় সে নিয়ে আলোচনা হল। আলোচনা হল ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিদেশীয় হাইওয়ে বিষয়ে। আলোচনা হল ভারতের করিডোর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগ কিভাবে হতে পারে তা নিয়ে। বিশেষ করে চিলাহাটি-হলদিবাড়ি হয়ে ভুটানে পৌঁছার জন্য ভারতীয় ভূমি ব্যবহারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে নরেন্দ্র মোদীকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন।
পরররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ২৭ মার্চ রাতে সাংবাদিকদের বললেন,“এই যোগাযোগটা দাঁড়ালে আমাদের রপ্তানী ক্ষমতা বাড়বে। সময় ও অর্থ বাঁচবে।”
এই আমাদের মানে কাদের তা সাধারণ মানুষকে বুঝতে দেয়া হয় না। রপ্তানী করেন দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক শিল্পপতিরা। এই পুঁজির মালিকদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পণ্য নেপালে ও ভুটানে রপ্তানী করার জন্য অর্থাৎ নেপাল ও ভুটানের বাজার ধরার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সওয়াল করছেন। তাদের ‘সময় ও অর্থ’ বাঁচবে বলে তৃপ্তিতে বাক্য উদগিরন করছেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
অথচ দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য এক অভিশাপ হয়ে আছে তিস্তা নদী। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা এখনও পাইনি। গ্রীষ্মের মরু আর বর্ষার বন্যায় সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে প্রতিবছর সর্বহারা হয় লাখো মানুষ, শ্রম ছাড়া যাদের আর কোন সম্বল নেই। শুধু তিস্তা নয়, ফারাক্কা ও টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু কোন ফল আসেনি। অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিই ঠিকমতো ভারতের কাছে করা হল না। এই কৃষকদের ‘সময় ও অর্থ’ সরকারের কাছে মূল্যহীন, মূল্যবান পুঁজিপতিদেরটা। তাই চিলাহাটি দিয়ে রাস্তা কী করে হবে তাই নিয়ে সওয়াল হয়, চিলাহাটির পাশে হাজার হাজার কৃষক যে চোখের জলে জমিন ভিজিয়ে দিচ্ছে সে নিয়ে সওয়াল হয় না। করিডোর-ট্রানজিট, শুল্ক, কর ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হয়, দেশের জল-জমি নিয়ে আলোচনা হয় না।
আলোচনা হল না সীমান্ত হত্যা নিয়ে, যা আজ এক অসহনীয় অবস্থায় গিয়ে পৌঁছেছে। সীমান্তবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকার প্রয়োজনেই সীমান্তের কাছাকাছি যেতে হয়। মাছ ধরার জন্য জেলে, চাষবাস করার জন্য কৃষক, কেনাবেচার জন্য সীমান্ত এলাকার ছোটখাট ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন কারণে সীমান্ত যেতে হয়। অথচ ‘গরু চোরাচালানকারী’ আখ্যা দিয়ে এসকল সাধারণ মানুষকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়, নির্যাতন করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সাথে এসেছে। গত দশ বছরে ভারতীয় বাহিনীর হাতে ৯৩৩ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। মাছ ধরতে গিয়ে, চাষ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে ভারতের জেলে বছরের পর বছর ধরে আছেন কতজন তার সংখ্যাও আমাদের দেশের সরকার জানেন না। এইসকল হত্যার কোন বিচার ভারতের আদালতে হয় না। বহূল আলোচিত ফেলানী হত্যার বিচার ৯ বছর ধরে আজও চলমান।
সীমান্তে ফ্ল্যাগ বৈঠক করে এর সমাধান সম্ভব নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশের এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দাবি করা দরকার ছিল, দরকার ছিল সীমান্তে চলাচল সম্পর্কিত নিয়মনীতি প্রতিষ্ঠিত করার। কিন্তু এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হল না। কারণ সীমান্তবর্তী মানুষের জীবনের মূল্য সরকারের কাছে খুব বেশি নয়। পুঁজিপতিদের ‘সময় ও অর্থের’ নিশ্চয়তা বিধান করার দায় নিয়েই তারা চিন্তিত।
অথচ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করে দ্বিপাক্ষিক বিষয় ছাড়াও তার দেশের নির্বাচনে নিজ দলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের কাজটি এ সফরের মাধ্যমে খুব সূচারুরূপে করেছেন। গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে মতুয়া সম্প্রদায়ের মন্দিরে যাওয়া বাস্তবে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে দলকে জেতানোর প্রচেষ্টামাত্র। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের মোট ২৯৪টি বিধানসভার ১৪টি বিধানসভার ফল পুরোপুরি নির্ভর করে মতুয়া ভোটের ওপর। আর মোট ৬০ থেকে ৭০টি বিধানসভায় ৫ থেকে ১০ হাজার করে মতুয়া ভোটার রয়েছে। এ কথাগুলো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসেছে। ভারতের সরকারের পক্ষ থেকে কোন প্রতিবাদ জানানো হয়নি।
ফলে অবধারিতভাবে দেশের জনগণের স্বার্থ সম্পর্কিত আলোচনা না করা, যতটুকু আলোচনা সেটা মূলত দেশীয় পুঁজিপতিশ্রেণির বাজার বিস্তৃতির জন্য তাদের হয়ে দরকষাকষি এবং লোকদেখানো আইসিটি, খেলার সরঞ্জাম কেনা ইত্যাদি চুক্তি – এই হলো দিনশেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার সারাংশ। এই সফরের অন্যান্য দিক বাদ দিয়ে মোটাদাগে দুটি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর সাক্ষাৎ বিবেচনা করলেও, এ থেকে বাংলাদেশের জনগণের বিন্দুমাত্র উপকার ঘটেনি। অথচ এই প্রবল অতিথির আতিথেয়তার খরচ মেটানোর রাষ্ট্রীয় অর্থ এই জনগণের পকেট থেকেই গেছে।
(উৎস: সাম্যবাদ, এপ্রিল-মে ২০২১)