Tuesday, November 26, 2024
Homeসাম্যবাদভিয়েতনাম যুদ্ধের মহান বীর জেনারেল গিয়াপের জীবনাবসান

ভিয়েতনাম যুদ্ধের মহান বীর জেনারেল গিয়াপের জীবনাবসান

general-vo-nguyen-giap-photo-congluan-vn-353818-huong2175935562‘দিয়েন বিয়েন ফু’! এক সময় এই শব্দটি দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদীদের বুকে কাঁপন ধরাত, বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের বুকে জাগিয়ে তুলত প্রবল আশাবাদ। এই দিয়েন বিয়েন ফু’র যুদ্ধের রূপকার, ভিয়েতনাম যুদ্ধের মহান বীর এবং কমরেড হো চি মিনের সহযোদ্ধা জেনারেল ভো গুয়েন গিয়াপ গত ৪ অক্টোবর ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন।

জেনারেল গিয়াপের দুর্দান্ত পরিকল্পনাতেই ঔপনিবেশিক ফ্র্র্র্রান্স ও পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধে কমিউনিস্ট ভিয়েতনাম জয়লাভ করেছিল। ১৯৫৪ সালে সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের সামরিক ঘাঁটি ছিল দিয়েন বিয়েন ফু’তে। দিয়েন বিয়েন ফু’তে তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর কাছে ফরাসি বাহিনীর পরাজয় ভিয়েতনামে ঔপনিবেশিক শাসনের চির অবসান ঘটিয়েছিল। এরপর ভিয়েতনামীদের লড়তে হয় বিশ্বের এক নম্বর সামরিক শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। মার্কিনীদের বর্বরতা আর ভিয়েতনামীদের অকুতোভয় প্রতিরোধ ষাটের দশকে ভিয়েতনামকে সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষের সামনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যুদ্ধের প্রতীকে পরিণত করেছিল।

১৯১১ সালের ২৫ আগস্ট পরাধীন ভিয়েতনামের মধ্যাঞ্চলীয় কুয়াং বিন প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন গিয়াপ। পরাধীনতার গস্নানি থেকে ১৪ বছর বয়সের কিশোর গিয়াপ যোগ দিয়েছিলেন স্থানীয় একটি গেরিলা বাহিনীতে। স্বাধীনতা ও মুক্তির দুর্নিবার স্পৃহা তাঁকে টেনে নিয়ে গিয়েছে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে। ১৯৩৮ সালে তিনি ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা হো চি মিন-এর ইন্দো-চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। জাপানি দখলদারের বিরম্নদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে এ সময় তিনি হো’র সঙ্গে চীনে পালিয়ে যান। চীনে গিয়াপ শরণার্থী ভিয়েতনামীদের নিয়ে ‘ভিয়েতমিন’ নামে একটি সেনাদল গঠন করেন এবং দেশে ফিরে এসে দখলদার জাপানিদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানিরা পরাজিত হওয়ার পর ফরাসি ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে ভিয়েতনামীদের লড়াই শুরু হয়। যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় দিয়েন বিয়েন ফুতে।

ঔপনিবেশিক ফ্রান্সের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনাম স্বাধীন হলেও এর দক্ষিণ অংশে কায়েম হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ। ভিয়েতনামের উত্তর অংশে প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। দক্ষিণ ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের দমনের উদ্দেশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৫ সালে সামরিক অভিযান শুরম্ন করে। এর ফলে শুরু হয় ইতিহাসখ্যাত ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এই যুদ্ধেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন জেনারেল গিয়াপ।

পৃথিবীর সর্বাধুনিক অস্ত্র ও প্রশিক্ষণে সমৃদ্ধ মার্কিন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কমিউনিজম এবং দেশপ্রেমের চেতনায় বলীয়ান ভিয়েতনামের জনগণ গেরিলা যুদ্ধে যে অবিস্মরণীয় বীরত্ব প্রদর্শন করেছে, তা ইতিহাসে বিরল। ২০০৫ সালে সায়গন পতনের ৩০তম বার্ষিকীতে এসোসিয়েটেড প্রেসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে গিয়াপ বলেছিলেন, “সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে এত ভয়ঙ্কর ও ক্ষয়ক্ষতিসম্পন্ন আর কোনো যুদ্ধ ইতিহাসে নেই।” মাই লাই গণহত্যা, ভয়ানক নাপাম বোমার ব্যবহার ইত্যাদি বহু ঘটনা বিশ্ববাসী জানেন যেখান থেকে মার্কিন বাহিনীর বর্বরতা প্রমাণিত।

১৯৬৮ সালে জেনারেল গিয়াপের পরিকল্পনায় পরিচালিত হয় টেট আক্রমণ। মার্কিন বাহিনীর পরাজয়ের পথে ভিয়েতনাম বাহিনীর এ আক্রমণকেই মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী কমিউনিস্ট বাহিনী মার্কিন অধিকৃত দক্ষিণ ভিয়েতনামের ৪০টি প্রাদেশিক রাজধানীতে এক সাথে আক্রমণ করে এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাজধানী সায়াগনে প্রবেশ করে। সায়াগনে প্রবেশ করে কমিউনিস্ট বাহিনী অল্প সময়ের জন্য মার্কিন দূতাবাস দখল করে রাখে। যদিও এর অল্প পরেই মার্কিন পাল্টা আক্রমণের মুখে ভিয়েতনাম বাহিনী পিছু হটে যায় কিন্তু এই যুদ্ধের পরই ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনীর লজ্জাজনক পরাজয় আসন্ন হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে মার্কিন বাহিনী দক্ষিণ ভিয়েতনাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এর দুই বছরের মধ্যেই দক্ষিণ ভিয়েতনাম কমিউনিস্টদের অধিকারে চলে যায়। দুই ভিয়েতনাম এক ভিয়েতনামে পরিণত হয়। সার্বভৌম ভিয়েতনাম সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন গিয়াপ। ১৯৭৬ সালে দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব গ্রহণের ৬ বছর পর তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেন।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments