Friday, March 29, 2024
Homeফিচারদল গড়ে তোলার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করুন

দল গড়ে তোলার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করুন

বাসদ-এর কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শিক্ষাশিবির সম্পন্ন

শিক্ষাশিবিরের প্রথম দিন

বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত হল গত ২৮ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর। ৫ দিনের এই শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটি বিপ্লবী দলের প্রাণসত্ত্বা হল তার আদর্শিক চর্চা, সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। সে লক্ষ্যেই সম্পন্ন হল কেন্দ্রীয় শিক্ষাশিবির। দু মাস ব্যাপী দেশের জেলা ও আঞ্চলিক শাখাগুলোতে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর পাঠচক্র, আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক চালিয়ে নেয়া হয়েছিল শিক্ষাশিবিরের প্রস্তুতি। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা সঠিকভাবে অধ্যয়ন ও তার মধ্য দিয়ে সমাজ বিশেস্নষণ, দল গড়ে তোলার সংগ্রাম, দলের অভ্যন্তরে নিরন্তর আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম পরিচালনা, নিজেদের যোগ্য বিপ্লবী কর্মী হিসাবে গড়ে তোলার অনুশীলন – এই ছিল শিক্ষাশিবিরের মূল ভরকেন্দ্র।

শিক্ষাশিবিরের দ্বিতীয় দিনে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী
কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী

শিক্ষাশিবির পরিচালনা করেন বাসদ কেন্দ্রীয় কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী। তিনি তাঁর আলোচনায় পার্টি সংক্রান্ত ধারণার ক্রমবিকাশ, মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্ট্যালিন-মাও সে তুং-শিবদাস ঘোষসহ বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের অথরিটি ও নেতৃবৃন্দের অবদান, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা, আদর্শগত ও সাংগঠনিক কেন্দ্রিকতা, যৌথতা গড়ে তোলার সংগ্রাম, কমিউনিস্ট নৈতিকতা ও কমিউনিস্ট চরিত্র গড়ে তোলার সংগ্রামের দিক ও আচরণবিধি, বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনে আধুনিক সংশোধনবাদের জন্ম, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির মুক্তি সম্পর্কিত কমিউনিস্ট ধারণা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বিশ্ব পরিস্থিতির উপরও আলোকপাত করেন।

২৮ আগস্ট দুপুর থেকে শুরু হওয়া শিক্ষাশিবির বিভিন্ন বিষয়ের উপর সেশন অনুযায়ী আলোচনা হয়। দিনের আলোচনাগুলিকে কেন্দ্র করে রাতে অনুষ্ঠিত হয় গ্রুপ বৈঠক। অর্থাৎ সকল অংশগ্রহণকারী ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে দিনের আলোচনা ধরে গ্রুপ ভিত্তিক আলোচনা করেন। সেখানে উঠে আসা প্রশ্নগুলোকে সমন্বিত করে আবার দিনের মূল সেশনে আলোচনা করা হয়। এইভাবে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে মুক্ত আলোচনার পরিবেশে গোটা শিক্ষাশিবির পরিচালিত হয়।শিক্ষাশিবিরে সারাদেশের ৩৩টি জেলার ৫ শতাধিক নেতা-কর্মী অংশগ্রহণ করেন। এখানে আরো আলোচনা করেন কমরেডস শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী, আলমগীর হোসেন দুলাল, মানস নন্দী, হাসিনুর রহমান, উজ্জল রায়, জহিরুল ইসলাম, ওবায়দুলস্নাহ মুসা, আহসান হাবীব সাঈদ-সহ অন্যান্য নেতৃবন্দ।

২৮ আগস্ট শিক্ষাশিবিরের উদ্বোধনী বক্তব্যে কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী বলেন, এদেশের মাটিতে একটি সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী দল গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ এবং তারই বিকশিত উন্নততর উপলব্ধি কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারাকে হাতিয়ার করে আমরা সংগ্রাম করছি। ইতিহাস বিকাশের নিয়ম বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করে মার্কস-এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, সম্পত্তি এবং মালিকানাই সমাজে শোষণের কারণ। এই শোষণমূলক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে মানবসমাজ শ্রেণীহীন, সম্পত্তিহীন সাম্যবাদী সমাজে মানুষ যাবে। এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবে সর্বহারাশ্রেণী, সর্বহারাশ্রেণীর বিপ্লবী পার্টি। সমাজতন্ত্র হল শোষণমূলক সমাজব্যবস্থা থেকে শোষণহীন সমাজে যাওয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সমাজ। মার্কস-এঙ্গেলস পরবর্তীকালে কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি রাশিয়ায় বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মানব সমাজ প্রত্যক্ষ করেছিল এমন এক সভ্যতা যেখানে মানুষের অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটেছিল। লেনিন পরবর্তীকালে কমরেড স্ট্যালিন, কমরেড মাও সেতুঙ ও কমরেড শিবদাস ঘোষ মার্কসবাদের সম্প্রসারণ ও বিকাশ ঘটিয়েছেন। বিশেষ করে আজকের দিনে বুর্জোয়া মানবতাবাদ যখন অবক্ষয়ের চূড়ান্তে পৌঁছেছে, সে-সময় বিপ্লবী দল গঠন, পরিচালনা, কমিউনিস্ট নৈতিকতা, যৌথ নেতৃত্ব ও তার বিশেষীকৃত রূপ, যৌথ জীবনসহ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রকে ব্যাপ্ত করে মার্কসবাদ চর্চার দিকনির্দেশনা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তা থেকে আমরা পাই।

কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবত্তর্ী
কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবত্তর্ী

তিনি বলেন, মার্কসবাদী আন্দোলনে অথরিটির প্রশ্নটি কতটা গুরম্নত্বপূর্ণ সেটা সহজেই বোঝা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীনের ইতিহাসের দিকে তাকালে। কমরেড লেনিনকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ইউরোপের বড় বড় পার্টিগুলো শোধনবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী পার্টিতে পরিণত হয়েছিল। কমরেড স্ট্যালিনের অথরিটিকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে বলশেভিক পার্টির মতো একটি লড়াকু পার্টি শুধু নিজেরাই বিপথগামী হয়ে গেলো, তাই নয়, গোটা দুনিয়ার সাম্যবাদী আন্দোলনকে সংশোধনবাদের আবর্তে টেনে নিয়ে গেলো। চীনের অবস্থাও তদ্রূপ। কমরেড মাও সেতুঙকে খারিজ করার মধ্য দিয়ে এত বড় একটা পার্টি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল। আজকের দিনেও, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বোন্নত উপলব্ধি ও আধুনিকতম ধারণা কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারার ভিত্তিতেই সাম্যবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে।

কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বুর্জোয়াশ্রেণীর গণবিরোধী শাসনব্যবস্থার অনিবার্য সংকটের নগ্ন প্রকাশ হিসাবে উল্লেখ করে শ্রমজীবী শোষিত মানুষসহ সর্বস্তরের গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী জনগণের প্রতি বামপন্থীদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ গণাআন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, গোটা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়াই এখন চরম সংকটের মুখোমুখি। দেশে দেশে সাধারণ মানুষ চাকুরি হারিয়ে, শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার হারিয়ে, বেঁচে থাকার অধিকার হারিয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। বিপরীত দিকে জনগণের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে শাসকরা ফ্যাসিবাদী শাসন চাপিয়ে দিচ্ছে। আমাদের দেশেও ধনীকশ্রেণীর শাসন-শোষণকে স্থায়ী ও স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র দুর্নীতিগ্রস্ত্ম বুর্জোয়া রাজনীতির সাথে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অশুভ আঁতাতের মাধ্যমে সংকট সমাধানের নামে নানা ধরনের গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, মিশরের দিকে তাকিয়ে দেখুন, কী বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম সে-দেশের জনগণ করেছে। কিন্তু প্রকৃত বিপ্লবী দল এবং নেতৃত্বের অভাবে তাদের এতবড় সংগ্রাম মৌলবাদী শক্তির কুক্ষিগত হয়েছিল। এখন সামরিক শক্তি ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে উদ্যত হয়েছে। জনগণের উপর কি নির্মম দমন-পীড়ন নামিয়ে এনেছে। গণআন্দোলনে সঠিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ছাড়া সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত মোকাবেলা কিংবা জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাক্ষা পূরণ হতে পারে না। মুনিবুল হায়দার বলেন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের যুদ্ধ-নির্ভর অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সবসময় যুদ্ধ লাগানোর উপায় খুঁজতে থাকে। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে এখন সে সুযোগ তারা তৈরি করেছে। ইরাক-আফগানিস্তানের পর এখন সিরিয়াকে ঘিরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে এক চক্রান্ত চলছে। যে-কোনো সময় সিরিয়ার উপর তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে।

আমাদের দেশে বিগত ৫ বছরের আওয়ামী লীগের দুঃশাসন-লুটপাটে অতিষ্ঠ মানুষ পথ না পেয়ে বিএনপি-সহ মৌলবাদী শক্তিগুলোর পেছনে জড়ো হচ্ছে। একই কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে ভারতেও। কংগ্রেসের অপশাসনের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু মৌলবাদী দল বিজেপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। একদিন বুর্জোয়াদের প্রশ্রয়েই এসব শক্তি বেড়ে ওঠে। আবার তাদের দুঃশাসনের ফলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর সামনে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যতদিন পুঁজিবাদী এ ব্যবস্থা টিকে থাকবে, দু’দল পাল্টাপাল্টি করে ক্ষমতায় আসবে, কিন্তু মানুষের সমস্যার সমাধান হবে না। একদলের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে মানুষ অন্য দলকে ক্ষমতায় আনবে। আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বুর্জোয়াদের দু অংশই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সাথে হাত মেলাতে পেছপা হবে না। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সংকটগ্রস্থ। এ সংকট শুধু আমাদের দেশের নয়, শুধু আওয়ামী লীগ-বিএনপির নয়। এ সংকট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সবচেয়ে উন্নত দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও আজ প্রবল। সেখানে লক্ষ লক্ষ লোক বেকার, প্রতিদিন শ্রমিক-কর্মচারীরা ছাঁটাই হচ্ছে। বড় বড় শিল্প-কারখানা বন্ধ হচ্ছে। মানুষের শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদি স্বীকৃত অধিকার একে একে খর্ব করা হচ্ছে।

কমরেড মুবিনুল হায়দার বলেন, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের ভাগের জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তৎপর। এদেশের গ্যাসসম্পদ লুটের পর এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চক্রান্ত চলছে। বাস্তবে এটা হল ভারতের পুঁজি, ভারতের কয়লায় এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে আর আমাদের সুন্দরবন ধ্বংস হবে। আমরা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে এই সর্বনাশা চক্রান্তের বিরদ্ধে আন্দোলনে শামিল হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। ১ সেপ্টেম্বর দুপুরের অধিবেশন ছিল সমাপনী অধিবেশন। কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরীর সমাপনী বক্তব্যের পর সমবেত কণ্ঠে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গাওয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষাশিবিরের কাজ সমাপ্ত হয়।

RELATED ARTICLES

আরও

Recent Comments