দেশে চলছে ভয়াবহ লোডশেডিং। শিল্প, কৃষি, জনজীবন লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত। সরকারের পক্ষ হতে বলা হয়েছিল, একঘণ্টা পরিকল্পিত লোডশেডিং করা হবে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পনার বদলে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। একঘণ্টার লোডশেডিং দেশের অনেক স্থানে নয়-দশ ঘণ্টাতেও দাঁড়াচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের কর্তারা বলেই যাচ্ছেন, আমরাই দেশকে শতভাগ বিদ্যুৎ দিয়েছি। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেই লোডশেডিং করতে হচ্ছে। কারণ যুদ্ধের কারণে আমদানি করা জ্বালানি তেল-এলএনজির দাম বেড়ে যাওয়ায় ভতুর্কি কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে হয়েছে। অচিরেই সংকট কেটে যাবে। তথ্যমন্ত্রীতো বলেই ফেললেন, অস্ট্রেলিয়াতেও নাকি দিনে ১৭-১৮ ঘন্টা লোডশেডিং হচ্ছে! আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও তখন কোমড় বেঁধে তা প্রচারে নেমে পড়লেন। যদিও জানা গেল, অস্ট্রেলিয়াতে লোডশেডিং সংক্রান্ত খবরটা বানোয়াট। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই বিশ্ববাজারে তেল-এনএনজির দাম ক্রমাগত বাড়ছিলো এবং আরো বাড়ার পূর্বাভাস ছিল। যুদ্ধের ফলে তেল-এলএনজির দাম একলাফে বেড়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল-এলএনজির দাম সবসময়ই অস্থিতিশীল। ফলে আমাদের মতো দেশে আমদানি করা জ্বালানি তেল-এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিরোধিতা করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। যেসব দেশে জ্বালানির নিজস্ব কোনো উৎস নেই, তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনে উচ্চমূল্যে তেল—এলএনজি আমদানি ছাড়া বিকল্প নেই। কিন্তু বাংলাদেশের কি বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেল-এলএনজি আমদানি ছাড়া বিকল্প ছিল না? শুধুমাত্র ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এলএনজি আমদানি বাবদ ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। (১/৮/২০২২ বণিক বার্তা) অথচ সে টাকার একটা অংশ দিয়েই স্থল ও সাগরের গ্যাস পরিকল্পনামাফিক উত্তোলন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। সরকারের যুক্তি হচ্ছে, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমছে। প্রতিদিন ৩৭০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২২০-২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যায়। বাকি জ্বালানির জন্য উচ্চমূল্যে তেল ও এলএনজি আমদানি ছাড়া উপায় ছিল না। এবং গ্যাসের মজুতও বেশিদিনের নেই। ফলে জনগণকে বিদ্যুৎ দিতেই সরকার এলএনজির উপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। আসুন, সরকারের এ যুক্তিগুলো যাচাই করে দেখি।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় যখন এলো, তখন বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল এক হাজার মেগাওয়াটের মতো। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের কথা বলে করা হলো ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি(বিশেষ বিধান), ২০১০’ আইন। কোনো দরপত্র ও প্রয়োজনীয় সরকারী প্রক্রিয়া ছাড়া একের পর এক বেসরকারি উচ্চমূল্যের ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি করা হয়। সরকারঘনিষ্ট সামিট, ওরিয়নের মতো ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর সাথে চুক্তি করা হয়। চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার বিধান রয়েছে। যে বিধানের বিশেষ দিক হলো, কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হোক বা না হোক, বাধ্যতামূলকভাবে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। আর এই চার্জ চুক্তির মেয়াদকাল পর্যন্ত দিয়ে যেতে হবে। অথচ সেসময় তেল গ্যাস জাতীয় সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি বলেছিল, জনগণের মতামত উপেক্ষা করে মাত্র ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পেতে বছরে কুইক রেন্টাল খাতে ২৪ হাজার কোটি টাকা ভতুর্কি দেওয়া হচ্ছে। অথচ মাত্র কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে রাষ্ট্রায়ত্ত পুরনো বিদ্যুৎ প্লান্ট নবায়ন-মেরামত ও সম্প্রসারণ করলে, এসব প্লান্ট থেকে ১ হাজার ৫শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত। এজন্য উচ্চমূল্যের রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র দরকার নেই। কারণ তা ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে বিরাট বিপদের কারণ হবে। বিদেশ থেকে বেশি দামে তেল এনে কম দামে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দেওয়া, উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনা, ক্যাপাসিটি চার্জের ফলে হাজার হাজার কোটি টাকা ভতুর্কি বাবদ ব্যবসায়ীদের পকেটে যাবে, বিদ্যুতের দাম বাড়বে এবং ভবিষ্যতে জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। আর আজ তার ভয়াবহ ফলাফল আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সেসময় জাতীয় কমিটি দেখিয়েছিল, ১৮টি কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের স্থাপিত ক্ষমতার তুলনায় উৎপাদন শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ। ভতুর্কি মূল্যে ফার্নেস অয়েল-ডিজেল নিয়েও অল্প উৎপাদন করে শত শত কোটি টাকা লুটপাট করেছে, উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের কারণে সৃষ্ট লোকসানের ফলে, সরকার দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্য বাড়িয়েছে। গ্যাস উত্তোলনের কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই হঠাৎ ২০১৫ সালে সরকারের পক্ষ থেকে বলা শুরু হয় যে গ্যাসের মজুত দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। যে গ্যাস আছে, তা দিয়ে আর ১৫ বছর চলবে। তার উদ্দেশ্য ছিল বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এরপরই দেশী বিদেশী কোম্পানির সাথে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তি, এলএনজি আমদানির তৎপরতা শুরু ও এলএনজি ভিত্তিক বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি হতে থাকে। ২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি শুরু হয়।
বর্তমানে গ্যাসের চাহিদার ২০ শতাংশ আমদানি করা এলএনজি দিয়ে পূরণ করা হচ্ছে। সরকারের জ্বালানি মহাপরিকল্পনা ২০১৬-তেও, এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে ২০২৩ সাল নাগাদ গ্যাসের চাহিদার ৪০ শতাংশ, ২০২৮ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ এবং ২০৪১ সাল নাগাদ গ্যাসের চাহিদার ৭০% বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি দিয়ে পূরণ করা হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, এলএনজির দাম বিশ্ববাজারে অস্থিতিশীল হবে, এটা জানার পরও কেন, এলএনজি আমদানিতেই জোর দেওয়া হলো? আর মহাপরিকল্পনাতে এলএনজি আমদানিকেই প্রধান করে, এখন কেন দাম বেশি বলে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখা হচ্ছে?
গ্রীষ্মকালে এখন বিদ্যুতের চাহিদা সর্বোচ্চ ১৪-১৫ হাজার মেগাওয়াট আর শীতকালে চাহিদা নেমে আসে ৯-১০ হাজার মেগাওয়াটে। অথচ অপরিকল্পিতভাবে চাহিদার চেয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার ৩৪৮ মেগাওয়াট, যার প্রায় অর্ধেক বেসরকারি মালিকানার রেন্টাল-কুইকরেন্টাল ও আইপিপি মডেলের। অথচ এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। ফলে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন ক্ষমতা বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান করা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে, অন্যদিকে দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গত তিন বছর বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে গেছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। গত এক দশকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ জনগণের ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। বর্তমানে এলএনজি ও তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে আরও বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হচ্ছে, ফলে এদিকে ১২ বা ১৩ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন না হওয়ার কারণে লোডশেডিং এ জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে, কিন্তু ঠিকই ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে যেতে হচ্ছে। সংসদীয় কমিটির কাছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুসারে, গত বছরের জুলাই থেকে গত মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে সরকার ক্যাপাসিটি চার্জ বা কেন্দ্র ভাড়া দিয়েছে প্রায় ১৬ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের কাছে গেছে প্রায় ১২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বিদ্যুতের চাহিদা না থাকলেও, ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা করা হয় ২০১৭ সালে। শুধুমাত্র আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ বছরে ৩ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা এবং প্লান্টের ২৫ বছর মেয়াদকালে ১ লাখ ৮ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা দিতে হবে। শুধু তাই নয়, আগস্টে বিদ্যুৎ আসার কথা থাকলেও, সঞ্চালন লাইন নির্মাণ না হওয়ায়, ডিসেম্বরের আগে সে বিদ্যুৎ আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারপরও ডিসেম্বর পর্যন্ত শুধু চারমাসে বিদ্যুৎ ছাড়াই ভাড়া বাবদ আদানিকে দিতে হবে ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। আদানি থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য পিডিবি তার স্বাভাবিক ‘মেরিট অর্ডার ডিসপ্যাচ’ পদ্ধতি (কম খরচে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কেন্দ্রগুলোকে আগে সুযোগ দেওয়া) অনুসরণ না করে ‘প্রায়োরিটি—বেসড ডিসপ্যাচ’ পদ্ধতি অনুসরণ করবে। এ পদ্ধতিতে আমদানিকৃত বিদ্যুতের ক্ষেত্রে প্রধমে দেশীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে নিষ্ক্রিয় রাখা হবে। এমনকি যদি তারা কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তবু প্রাধান্য পাবে আমদানি।(৮/৬/২০২২, ডেইলি স্টার)। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের লুটপাট, দুর্নীতি, ঋণ কেলেঙ্কারির বিচার দূরে থাকুক, তাদের একের পর এক সুবিধা প্রদান অব্যাহত আছে। ৩ বছরের কথা বলে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি নবায়ন করে বাড়িয়ে ১৬ বছরে চলছে। সর্বশেষ ২০২১ সালে ভোটারবিহীন সংসদে এগুলোর মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানোর বিল পাশ হয়েছে। আরো ভয়ংকর খবর হলো, এখন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ব্যাংক থেকে ইচ্ছেমতো ঋণ নিতে পারবে, কোনো সীমা থাকবে না বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি আইন সংস্কার করেছে। একেই বলে, তেলা মাথায় তেল দেওয়া!
এভাবেই দেশী-বিদেশী পুঁজিপতিগোষ্ঠীর স্বার্থ ও মুনাফা নিশ্চিত রাখতে গিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার দেশের বিদ্যুৎখাতকে তাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে,দেশের অর্থনীতিকে সর্বনাশা খাদে ফেলেছে।
আমাদের দলসহ তেল গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি, দেশপ্রেমিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন থেকেই এই কথাগুলো বলে আসছিলাম। স্থলভাগে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো, পুরনো ও পরিত্যক্ত গ্যাসকূপগুলো মেরামত, সংস্কার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিলে বর্তমান গ্যাসের ঘাটতির অনেকটাই মেটানো যেত। স্থল ও সাগরে যে বিশাল অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র আছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্সকে দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি (সৌর,বায়ু,পানি ইত্যাদি) উৎপাদন বাড়ালে, বিদেশ থেকে লক্ষ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি বা পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনো প্রয়োজন হতো না। কিন্তু সরকার কোনো পরামর্শেই কান দেয়নি। কারণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও দেশীয় কোম্পানি বাপেক্সকে দিয়ে দেশের গ্যাস উত্তোলন করলে, মুনাফা ও কমিশন নাই। পকেট তো ভরবে আমদানি করলে, বেসরকারিকরণ করলে। এতে ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশী বিদেশী পুঁজিপতিগোষ্ঠীকে খুশি রাখা যায়।
সরকারের নিয়োগ করা আন্তর্জাতিক পরামর্শক কোম্পানি স্লামবার্জার দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উপর ২০১১ সালে সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা করে তাদের প্রণীত ‘গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিতে পরামর্শ’-তে দেওয়া সুপারিশও সরকার অনুসরণ করেনি। এতে বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলো ওভারহোলিং-সংস্কার করে উৎপাদন বৃদ্ধি ও সম্ভাবনাময় নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের পরামর্শ ছিল। সে রিপোর্টে বলা হয়েছিল, প্রায় ১২৫ মিলিয়ন ডলার (প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ করে বিদ্যমান গ্যাসক্ষেত্রগুলোর কমপক্ষে ৪০টি কূপের ধারণক্ষমতা বাড়ানো যায় এবং সেগুলো থেকে প্রতিদিন ৪০০-৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। কিন্তু ১১ বছরে সরকার তাতে কান দেয়নি। (২৬/৪/২০২২, ডেইলি স্টার।)
ইতোমধ্যে আবিষ্কৃত অথচ এখনও উত্তোলন করা হয়নি বা উত্তোলন স্থগিত আছে, সেগুলো জরুরি ভিত্তিতে উৎপাদনের আওতায় নিয়ে আসার পরামর্শ কয়েক বছর আগেই বিশেষজ্ঞরা রেখেছিলেন। যেমনÑ২০১৮ সালে আবিষ্কৃত ভোলা নর্থ গ্যাসক্ষেত্রটি অটুট পড়ে আছে। সেখানে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আছে, যা দিয়ে একবছরের চাহিদা মেটানো যায়। ভোলার অপর গ্যাসক্ষেত্র শাহবাজপুরে প্রায় ১.৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস থাকলেও, সেখান থেকে সক্ষমতার অর্ধেক উৎপাদন হচ্ছে। ভোলা দ্বীপ থেকে মূল ভূখণ্ডে সংযোগ পাইপ তৈরি না করায়, এ গ্যাস পুরো কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ আমরা দেখি, দেশেরই বিভিন্ন জায়গায় গ্যাস পাইপলাইন তৈরি করা হয়েছে, সেখানে আদৌ কোনোদিন গ্যাস সরবরাহ করা যাবে কি না, তা মাথায় না রেখেই। পাইপলাইন না করার পেছনে সরকারের জ্বালানি মন্ত্রী ও পেট্রোবাংলার যুক্তি হচ্ছে, যে পরিমাণ গ্যাস আছে, তাতে পাইপলাইন অর্থনৈতিকভবে লাভজনক হবে না। অথচ একবছরে এলএনজি আমদানিতে লক্ষ কোটি টাকা খরচ করা তাদের কাছে অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হয় না! কথায় আছে, দুষ্ট লোকের ছলের অভাব হয় না! অথচ ২০০৩ সালে মার্কিন কোম্পানি ইউনিকল ভোলায় জরিপ চালিয়ে বলেছিলো, ভোলায় নতুন করে ৩-৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়ার ভালো সম্ভাবনা আছে। ফলে পাইপলাইন বসালে, ভবিষ্যতে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে কি না এ যুক্তি তুলে গ্যাস উত্তোলন বন্ধ রাখা, নিছক ছলমাত্র! সর্বশেষ ২০২১ সালে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্স অনুসন্ধান চালিয়ে ভোলায় আরো তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। বাপেক্সের কূপ খনন ও গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা থাকলেও, বাপেক্সের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি খরচে কাজটি দেওয়া হয়েছে রাশিয়ান গ্যাজপ্রমকে। একইভাবে হবিগঞ্জে রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের ৯ নম্বর কূপটি ২০১৬ সাল থেকে উত্তোলনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু এখনও সেটি চালু হয়নি, জরুরি পদক্ষেপ না নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বছরের পর বছর সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে।
২০২০ সালে আবিষ্কৃত সিলেটের জকিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস সরবরাহের কোনো জরুরি পরিকল্পনার কথা জানা যায়নি। ছাতক গ্যাসক্ষেত্রের বড় আকারের প্রমাণিত মজুত থেকে মাত্র সামান্য গ্যাস তোলা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের পটিয়ায় ১৯৫৩ সালে গ্যাস পাওয়ার পরেও, সেসময় তুলনামূলক দুর্বল কারিগরি ব্যবস্থাপনায় গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হয়নি। বর্তমানে উন্নত কারিগরি ব্যবস্থাপনায় সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলন সম্ভব। এসব গ্যাসক্ষেত্র থেকে দ্রুত ও জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস উত্তোলনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে যে পরিমাণ গ্যাস এখনই সরবরাহের আওতায় আনা সম্ভব, তা দিয়ে এলএনজি আমদানির একটি বড় অংশ কমিয়ে দেওয়া সম্ভব।
আশু স্বল্পমেয়াদী সমাধানের পাশাপাশি তেল গ্যাস রক্ষা কমিটি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জরুরি ভিত্তিতে স্থল ও সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও বিনিয়োগের দাবি জানিয়েছিল। জ্বালানি বিভাগের অধীন হাইড্রোকার্বন ইউনিট (এইচসিইউ) ও নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডিরেক্টরেট (এনপিডি) যৌথভাবে মার্কিন প্রতিষ্ঠান গুস্তাভসন অ্যাসোসিয়েটসের মাধ্যমে ২০১০ সালে দেশের স্থলভাগ ও অগভীর সমুদ্রের গ্যাসের মজুদ নিয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষার ফলাফল অনুসারে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ, দেশে এমন অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রগুলোয় গ্যাস সম্পদের সম্ভাব্য মজুদের পরিমাণ ৩৮ টিসিএফের কিছু বেশি। প্রতিবছর গ্যাসের ব্যবহার ১ টিসিএফ হিসেবে, ৩৮ বছরের সম্ভাব্য মজুদ ধরে নেওয়া যায়। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পর বহু বছর পার হয়ে গেলেও সমুদ্রসীমায় গ্যাসের মজুদ অনুসন্ধান ও জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা উত্তোলনের জন্য কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অথচ মায়ানমার ও ভারত তাদের সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করছে বহুদিন ধরে। মালয়েশিয়ার তেল—গ্যাস কোম্পানি পেট্রোনাস এবং ভারতের ওএনজিসি কয়েক দশকে ব্যাপক সক্ষমতা অর্জন করেছে। বাপেক্সকে ভারতের ওএনজিসির মতো সক্ষম করবার কথা জাইকার তৈরি করা সরকারের পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যানেও বলা হয়েছিল। মাস্টার প্ল্যানের পরিকল্পনা মতো এলএনজি আর কয়লা আমদানিনির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে, এলএনজি আর কয়লা আমদানির টার্মিনাল তৈরি করা হয়েছে কিন্তু মাস্টার প্ল্যানেরই আরেকটি অংশে যেখানে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছিল সেটা কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি! জাতীয় কমিটিসহ দেশের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন, জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি, আর তার জন্য চাই দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের স্থলভাগ ও সাগরের গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকাশ। বিদেশ থেকে আমদানি করা কয়লা আর এলএনজির ওপর নির্ভর করে সস্তায় নির্ভরযোগ্য জ্বালানি পাওয়া যায় না, ফলে জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন করা যায় না। তেল, কয়লা বা এলএনজির দামের কোনো স্থিতিশীলতা থাকে না, এগুলোর সরবরাহের কোনো নিশ্চয়তা থাকে না, পারমাণবিক বিদ্যুতের জ্বালানি ইউরেনিয়ামের জন্যও বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়। কাজেই আমদানি করা তেল-কয়লা-এলএনজি-ইউরেনিয়ামভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে হাজার হাজার মেগাওয়াট ক্যাপাসিটি হয়তো বাড়ানো যায়, কিন্তু তার মাধ্যমে সস্তায় নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। তাছাড়া রামপাল, রূপপুরসহ কয়লাভিত্তিক ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ দেশের জন্য ভয়াবহ, আর্থিক ও পরিবেশগত দিক থেকে হুমকিস্বরূপ বিধায় সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য।
দেশীয় কর্তৃত্বে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা আমরা সবাই জানি। দেশের স্থলভাগ ও সাগরের গ্যাস উত্তোলনের জন্যও কিন্তু একই মডেলের কথা বলা হচ্ছে বহু বছর ধরে। পদ্মা সেতুর মতো জটিল ও ব্যয়বহুল সেতু নির্মাণের অভিজ্ঞতাও আগে বাংলাদেশের ছিল না কিন্তু দেশি-বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। তেল-গ্যাস উত্তোলনের ক্ষেত্রেও এই পদ্ধতিটির কথা আমরা বলছি বহু বছর ধরে। সাগরের তেল-গ্যাস উত্তোলনে বাংলাদেশের নিজস্ব দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা নেই, স্থলভাগে আছে। কিন্তু যাদের সাগরে গ্যাস উত্তোলনে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা আছে তাদেরকে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ করে সাগরের গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ নিলে পদ্মা সেতুর চেয়ে বহুগুণ কম খরচে মূল্যবান গ্যাস উত্তোলন করা যেত।
উপরের আলোচনাতেই স্পষ্ট, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের মুনাফা ও লুটপাটের স্বার্থে কীভাবে বিদ্যুৎখাতের বর্তমান সংকট সৃষ্টি করেছে এবং তার বোঝা চাপাচ্ছে দেশের অর্থনীতি ও জনগণের কাঁধে। এর ফলাফল হিসেবে, বিদ্যুতের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি সময়ের ব্যাপার মাত্র। ফলে বিদ্যুৎখাতে লুটপাটের সাথে জড়িতদের বিচার ও শাস্তি, অবিলম্বে রেন্টাল-কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল, ব্যয়বহুল-আমদানি নির্ভর-পরিবেশ বিধ্বংসী জ্বালানি নীতি বাতিল করে স্বনির্ভর, পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দাবিতে আজ জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। একইসাথে আজকের এ সংকটের জন্য দায়ী আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে সকল বাম গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম জোরদার করতে হবে।