বাণিজ্য ও মুনাফার চক্রে আবর্তিত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমেই ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। ডিগ্রিধারীর সংখ্যাবৃদ্ধি সত্ত্বেও সমাজে মানবিকতা-মূল্যবোধের অবশেষ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ‘উন্নয়ন’-এর মুখরোচক বুলির আড়ালে চাপা পড়ছে অধিকারহারা মানুষের আর্তনাদ। শাসকদের নানা পরিকল্পনা-নীতি যখন মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়, তার বিপক্ষে দাঁড়িয়েই শুভবোধের উদ্বোধন হয়, সমাজ-সভ্যতা এগিয়ে যায়। ইতিহাস আমাদের শেখায় অন্যায়-অসঙ্গত কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। দুঃশাসন-দুর্নীতির পঙ্কে সমাজ যতই নিমজ্জিত হোক, দেশের ছাত্র-যুবসমাজ যদি ঘুরে দাঁড়ায়, কোনো দুঃসহ ভারই টিকে থাকতে পারে না। সময়ের এ প্রয়োজনকে ধারণ করে এগিয়ে আসার জন্য আমরা সমগ্র ছাত্রসমাজের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাই।
সারা দেশের স্কুলগুলোতে ভর্তি ফি ও মাসিক বেতন বৃদ্ধির ফলে তীব্র অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীতে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা চালু শিক্ষার মানের অবনমনই কেবল ঘটায়নি, শিক্ষার্থী অভিভাবকদের মানসিক চাপ ও হয়রানি বাড়িয়েছে। পাশাপাশি কোচিং ও গাইড বইয়ের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার ফলে খরচ বেড়েছে বহুগুণ। প্রশ্নপত্র ফাঁস ও পাসের হার বাড়িয়ে দেখানোর ফলে দুর্নীতি পাকাপোক্ত আসন গেড়েছে। শিশুদের খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনের কোনো অবকাশই নেই। মাধ্যমিক স্তরেও একদিকে পরিকাঠামো নেই, অন্যদিকে রয়েছে পর্যাপ্ত ও মানসম্মত শিক্ষকের অভাব। এসব ঘাটতি দূর না করে চালু হওয়া সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি সৃজনশীলতা বাড়ায়নি, বহুগুণে বাড়িয়েছে কোচিং ও গাইডের ব্যবসা।
জ্ঞান বিতরণ নয়, কেবল পরীক্ষা নেবার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজসমূহ। শিক্ষক স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, হল-সেমিনারসহ সামগ্রিক আয়োজন তৈরিতে অবহেলা এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। চাহিদা অনুসারে অর্থ বরাদ্দ না দেবার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে ধুঁকে ধুঁকে। ‘ইউজিসি’র ২০ বছর মেয়াদী কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চালানোর জন্য বেতন-ফি বৃদ্ধি, পরিবহন ও হলসমূহে ভর্তুকি কমানো, বাণিজ্যিক নাইটকোর্স চালু ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আর দেশি-বিদেশি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর অর্থায়নে চালাতে হবে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম। গত দুই দশকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে হাতে গোনা, বিপরীতে প্রাইভেট স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে বহুগুণ। সন্ত্রাস দখলদারিত্ব কায়েম ও পরিকল্পিতভাবে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ করে রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।
এতসব সংকট থাকার পরও দেশে কার্যকরী কোনো ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠছেনা অনেকদিন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চরম ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে দেশে। বুর্জোয়া শাসনের ভিত্তি পার্লামেন্ট, বিচার বিভাগ- এগুলো আজ জাদুঘরে। পুরোপুরি পুলিশি নিয়ন্ত্রণে চলছে রাষ্ট্র। প্রতিদিন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খুন, ধর্ষণ, শিশু হত্যা ইত্যাদি অমানবিক, বর্বর কর্মকা-। দাম দিয়ে কেনা বাংলা এখন যেন এক লাশের দেশ। চরম ফ্যাসিবাদী স্বেচ্ছাচারী দাপটে ’৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৭১ এর সেই লড়াকু ছাত্রযুবকদের দেশ আজ দিশাহীন।
দেশের পাঁচ শতাংশ মানুষ আজ পঁচাশি শতাংশ সম্পদের মালিক। তারাই এ সরকারকে অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছে। বড় বড় কর্পোরেট গ্রুপগুলো মিলে ঠিকক করছে দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে। পুঁজিবাদী এ ব্যবস্থা সমস্ত সংকটের জন্ম দিচ্ছে, শিক্ষার সংকট এর বাইরের কিছু নয়।
আজ এই বন্ধ্যা ও বন্দীদশা থেকে দেশকে মুক্ত করার দায়িত্ব ছাত্রদেরই। চতুর্থ সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমাদের সংগঠন লড়াই-সংগ্রামের সেই উন্নত চরিত্র সৃষ্টির সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করছে।
শুভেচ্ছাসহ
প্রকাশনা উপপরিষদ, চতুর্থ সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি
৪র্থ কেন্দ্রীয় সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি – ২০১৬