নবীন উদ্যম, অপরিসীম দৃঢ়তা, অপ্রতিরোধ্য সংকল্প নিয়ে সংগ্রাম চলবে যতদিন না সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় — ভগৎ সিং
“আমরা মনে করি, সাম্রাজ্যবাদ হল লুটের উদ্দেশ্যে সংগঠিত এক বিরাট ষড়যন্ত্র। মানুষ কর্তৃক মানুষের, এক জাতির দ্বারা অপর জাতির সুচতুর শোষণের যে প্রক্রিয়া, সাম্রাজ্যবাদ হল তার সর্বোচ্চ এবং শেষ পর্যায়। এই সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের লুণ্ঠনের ষড়যন্ত্রকে আরও ব্যাপক করতে সাম্রাজ্যবাদী আদালতের সাহায্যে আইনসম্মত হত্যাকান্ড চালায়। শুধু তাই নয়, অবাধ গণহত্যা, ব্যাপক ধ্বংস, এমনকি যুদ্ধের মত হীন অপরাধ তারা ঘটিয়ে চলে। মানুষ যদি তাদের ধ্বংসাত্মক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নীরবে নতমস্তকে মেনে না নেয়, যদি তাদের অবাধ লুণ্ঠনের অধিকার মেনে নিতে অসম্মত হয়, তবে নিরস্ত্র নিরপরাধ জনগণকে গুলি করে হত্যা করতে এদের হাত কাঁপে না। ‘আইন শৃঙ্খলা’র রক্ষাকর্তা সেজে এরাই শান্তি হরণ করে, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, মানুষ খুন করে, যতরকম অপরাধ সম্ভব তার সবই এরা ঘটায়।
আমরা মনে করি, স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার, যা কোনভাবেই হরণ করা চলে না। আমরা মনে করি, কোন মানুষকেই তার পরিশ্রমের ফলভোগ করা থেকে বঞ্চিত করা চলে না। আমরা মনে করি, প্রতিটি জাতিই নিজ নিজ দেশের সমস্ত সম্পদের অধিকারী। যদি কোন সরকার জনগণের এই মৌলিক অধিকার হরণ করে তবে জনগণের অধিকার হল, বলা উচিত জনগণের কর্তব্য হল, সেই সরকারকে ধ্বংস করা।
আমরা পরিবর্তন চাই। সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রে বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে তাকে আমূল বদলে ফেলে এমন এক নবীন সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই যেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের সম্ভাবনা থাকবে না এবং সর্বক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে। আমরা মনে করি, গোটা সমাজব্যবস্থাকে বদলে ফেলে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যদি না যায়, তবে মানবসভ্যতার পরিণতি বড় ভয়ানক।
বিপ্লবের মধ্যে হানাহানি অনিবার্য নয়, এর মধ্যে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ লিপ্সার কোন অবকাশ নেই। বিপ্লব বোমা-পিস্তলের সংস্কৃতি নয়। অন্যায়ের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তিত করার জন্য বিপ্লব আমাদের চাই। উৎপাদন যারা করেন অর্থাৎ শ্রমিক মানবসমাজের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অথচ শোষকশ্রেণী তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্য এবং মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। একদিকে, সকলের মুখের অন্ন উৎপাদন করছে যে কৃষক সে স্বপরিবারে উপবাসে মরছে, যে তন্তুবায় কাপড় বুনে সারা পৃথিবীর বাজার পূর্ণ করে দিচ্ছে, তার নিজের ঘরে নিজের এবং শিশুর শরীরটুকু ঢাকা দেবার উপযুক্ত বস্ত্রখ- জোটে না। রাজমিস্ত্রি, কর্মকার এবং সূত্রধর অপরূপ প্রাসাদ নির্মাণ করছে, কিন্তু তাদের নিজেদের জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে নোংরা বীভৎস বস্তির অন্ধকারে। অন্যদিকে পুঁজিপতি, শোষক সমাজে যারা ঘুণপোকার অস্তিত্ব নিয়ে বেঁচে আছে, তারা নিজেদের লিপ্সা চরিতার্থ করতে কোটি কোটি টাকা জলের মত খরচ করছে। এই ভয়ঙ্কর বৈষম্য এবং আত্মবিকাশের অধিকারের ক্ষেত্রে মিথ্যা সমানাধিকারের বাণী সমাজকে এক মাৎস্যন্যায়ের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি কখনই চিরস্থায়ী হতে পারে না। বরং এটা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান যে, আজকের সমাজব্যবস্থা আত্মবিস্মৃত আনন্দে এক অগ্নিগর্ভ পর্বতের জ্বালামুখের উপর বসে আছে, এবং কোটি কোটি শোষিত মানুষের শিশু সন্তানদের সঙ্গে শোষকবর্গের ঘরের অবোধ শিশুরাও এক বিপদজনক গভীর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে। যদি সময় থাকতে মানবসভ্যতার কাঠামোকে রক্ষা করা না যায়, তবে তা ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এই জন্যই বিপ্লব অত্যাবশ্যক। যারা এই প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করেন তাদের কর্তব্য হল মানবসমাজকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তির উপর পুনর্গঠিত করা। যতদিন তা না করা যাবে, যতদিন মানুষের দ্বারা মানুষের উপর শোষণ, এক রাষ্ট্রের দ্বারা অপর রাষ্ট্রের শোষণ — যাকে আমরা সাম্রাজ্যবাদ বলি, তা বজায় থাকবে ততদিন এর উদ্ভূত যন্ত্রণা এবং অপমান থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করা যাবে না; যুদ্ধের চূড়ান্ত অবসান এবং বিশ্বের সার্বভৌম শান্তির যুগের সূচনা করার সমস্ত প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। বিপ্লব আমরা চাই অন্ততঃ এমন একটা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার জন্য, যেখানে এরকম প্রাণঘাতী বিপদের সম্মুখীন হতে হবে না, এবং যেখানে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। এর ফলে বিশ্বমানবসমাজকে পুঁজিবাদের শৃঙ্খল এবং যুদ্ধের সর্বনাশা সংকট থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
আমরা চাই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এরই অবিচ্ছেদ্য প্রাথমিক কাজ হল রাজনৈতিক বিপ্লব সফল করা, তাই-ই আমরা চাই। রাজনৈতিক বিপ্লব মানে শুধুমাত্র বৃটিশের হাত থেকে ভারতীয়দের হাতে রাষ্ট্র (অর্থাৎ ক্ষমতা) হস্তান্তর করা বোঝায় না। আমাদের মতো সুনির্দিষ্ট বিপ্লবী লক্ষ্য আছে এমন ভারতীয়দের হাতে অর্থাৎ জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে বিপ্লবী দলের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চাই। তারপর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে গোটা সমাজকে পুনর্গঠিত করার পথে সংগঠিতভাবে আমাদের এগুতে হবে। বিপ্লবের এই সঠিক ধারণা যদি আপনার না থাকে তবে দয়া করে থামুন, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি তুলবেন না। অন্তত আমাদের কাছে ‘বিপ্লব’ শব্দটির তাৎপর্য সুমহান। এই শব্দটিকে যেমন তেমন করে ব্যবহার করতে বা অপব্যবহার করতে দিতে আমরা পারিনা। আপনি যদি বলেন আপনার লক্ষ্য হল জাতীয় বিপ্লব সংগঠিত করা অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধাঁচে ভারতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, তাহলে আপনার কাছে আমি প্রশ্ন করব, কোন কোন শক্তির উপর নির্ভর করে আপনি বিপ্লবের পথে এগুতে চান। জাতীয় বিপ্লবই হোক আর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবই হোক, যেকোন বিপ্লবের জন্যই একমাত্র নির্ভরযোগ্য শক্তি হল কৃষক এবং শ্রমিক।
যদি কেউ বলেন তারা শ্রমিক কৃষকের কাছে যাবেন এবং তাদের সক্রিয় সমর্থন সংগ্রহ করবেন, তাহলে আমি বলব এধরনের ভালো ভালো কথায় দেশের শ্রমিক কৃষক বোকা বনে যেতে চাইবে না। তারা প্রশ্ন তুলবে, যে ধরনের বিপ্লবের জন্য ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান তাদের সামনে রাখা হচ্ছে, সেই বিপ্লব তাদের জন্য কি এনে দেবে। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ গদিতে লর্ড রেডিং-ই থাকুন আর পুরুষোত্তমদাস ঠাকুরদাসই থাকুন, লর্ড আরউইনের পরিবর্তে স্যার তেজবাহাদুর সপ্রুই আসুন, তাতে দেশের শ্রমিক কৃষকের জীবনে কি পরিবর্তন আসবে! তাই শ্রমিক কৃষকের জাতীয় চেতনার কাছে আবেদন করা নিরর্থক। আপনার স্বার্থে তাকে কাজে লাগানো বৃথা। আপনাকে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে তাদের বোঝাতে হবে বিপ্লবটা তারই বিপ্লব, তারই কল্যাণের জন্য বিপ্লব। এই বিপ্লব সর্বহারাদের স্বার্থে সর্বহারাদের নিজস্ব বিপ্লব।
বিপ্লবের আঘাতে পুঁজিবাদ, শ্রেণীবিভেদ তথা মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে বিশেষ অধিকার তুলে দেয় এমন সমাজব্যবস্থার অবসান ঘটে যাবে। বিপ্লব দেশকে আত্মনির্ভর হবার পথ করে দেবে। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এক নবীন রাষ্ট্র, এক নতুন সমাজ জন্ম নেবে, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তগত করে বসে থাকা অবাঞ্ছিত সামাজিক শক্তিগুলির দখলদারীদের খতম করে দেবে।
ভাবপ্রবণতা ছেড়ে বাস্তবতাকে মোকাবেলা করতে প্রস্তুত হোন। বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ।
…. সান্ধ্য অবকাশে কিছু ভাষণ দেবার মত নেতা আমাদের অনেক আছে, এসব নেতাদের কোন মূল্যই নেই। লেনিন যাকে বলেছেন ‘জাত বিপ্লবী’, তেমন ধরনের নেতা আমাদের চাই। আমাদের চাই এমন সব সর্বক্ষণের বিপ্লবী কর্মী, বিপ্লব ছাড়া আর কোন আকাক্সক্ষা, বিপ্লবের জন্য কাজ ছাড়া আর কোন কাজ যাদের নেই। দলে এমন ধরনের কর্মী যত বেশি সংখ্যায় পাওয়া যাবে, সাফল্যের সম্ভবনা ততই বাড়তে থাকবে।
দাসসুলভ মানসিকতা এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের নাগপাশে শৃঙ্খলিত আজকের তরুণ সমাজের মধ্যে এই বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার জন্য যে অস্থির আকুলতা, তার মধ্যে আমি বিপ্লবী প্রগতিশীলতার অঙ্কুর দেখতে পাই। আজকের যুবকরা যতই বিপ্লবী মানসিকতা অর্জন করতে থাকবে, দেশের দাসত্বের চিত্র ততই তাদের সামনে স্পষ্ট হতে থাকবে এবং তাদের মধ্যে দেশ স্বাধীন করবার আকাক্সক্ষা উদ্বেল হয়ে উঠবে।
বিপ্লবীরা পরার্থপর, তাই তারা শান্তির পূজারী। কাপুরুষের তথাকথিত শান্তিবাদ বা বেয়নেট উঁচিয়ে যে মিথ্যা শান্তি বজায় রাখা হয় তেমন শান্তি নয়, ন্যায় এবং শান্তির ভিত্তিতে স্থায়ী এবং প্রকৃত যে শান্তি, তেমন শান্তি বিপ্লবীদের কাম্য।
নবীন উদ্যম, অপরিসীম দৃঢ়তা, অপ্রতিরোধ্য সংকল্প নিয়ে সংগ্রাম চলবে যতদিন না সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যতদিন না বর্তমান সমাজব্যবস্থাকে উৎখাত করে সমাজের অবাধ সমৃদ্ধির ভিত্তিতে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং এই পথে সমস্ত ধরনের শোষণের অবসান ঘটানো যায়। এই পথেই মানবসভ্যতা এগিয়ে যাবে স্থায়ী শান্তির এক নতুন যুগে।
পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শোষণের দিন ফুরিয়ে আসছে। এ সংগ্রাম আমরা শুরু করিনি, আমাদের জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে এ সংগ্রাম শেষ হয়ে যাবে না। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে, বর্তমান বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই সংগ্রাম অনিবার্যভাবে গড়ে উঠেছে। আমাদের মৃত্যুতে, আত্মদানের পুষ্পমাল্যে আরেকটি নূতন ফুল গাঁথা হবে।”
(গত ২৩ মার্চ ছিল ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের আপোষহীন ধারার বীর বিপ্লবী ভগৎ সিং-এর ৮৪ তম ফাঁসি দিবস। তাঁর সংগ্রামী স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি পত্রস্থ হলো।)