গত ৩১ জুলাই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনার শেষের দিকে আমাদের দল বাসদ (মার্কসবাদী)-সহ মোট চারটি দল সভা বয়কট করে বেরিয়ে আসে। যে আলোচনাকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা, তা হলো বিদ্যমান সংবিধানের চার মূলনীতি। এই প্রশ্নে চারটি দল একসাথে সভা বর্জন করলেও সবার বক্তব্য একইরকম নয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দলের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান আছে এবং এটি আমরা ‘জুলাই ঘোষণা’ সম্পর্কিত আলোচনার সময় থেকেই লিখিতভাবে ও নানা আলোচনার মধ্য দিয়ে সরকার, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও জনগণের কাছে তুলে ধরেছি।
এ প্রসঙ্গে প্রথমে একটা কথা বলে নেয়া দরকার। আমরা মনে করি না যে, সংবিধান বা তার মূলনীতি শাশ্বত কোন বিষয়, এগুলোর পরিবর্তন হতে পারে না। তেমনি বাহাত্তরের সংবিধান সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক একটি সংবিধান, আমরা সেটাও মনে করি না। বাহাত্তরের সংবিধানের যে অংশে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামো বর্ণনা করা হয়েছে, সেটি পরিবর্তনের আলোচনা রাজনৈতিক মহলে দীর্ঘদিন ধরে চলমান এবং আমরা সেটা সমর্থন করি। এ কারণে এর বিভিন্ন বিধান সংস্কারের প্রস্তাব আমরা রেখেছি। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর ছাত্রনেতৃত্ব ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকের বক্তব্য, সরকারের বিভিন্ন মহলের বক্তব্য, জুলাই ঘোষণার খসড়া, সংবিধান সংস্কার কমিশনের লেখা ও সর্বশেষ ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবনা- এসব দেখে আমাদের স্পষ্ট মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এ সম্পর্কিত বিভিন্ন আলোচনার মধ্যে সংবিধান পুনর্লিখনের দাবিও এসেছে। একটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দল হিসেবে আমরা মনে করি, রাষ্ট্রক্ষমতায় বৃহৎ ব্যবসায়ী-পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক দল ও তার সহযোগী সামরিক বাহিনী ও আমলাতন্ত্র বসিয়ে রেখে সবচেয়ে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সংবিধান প্রণয়ন করলেও দেশের অবস্থার তেমন কোন পরিবর্তন হবে না। জনগণ কতটুকু অধিকার পাবে সেটা সংবিধানে কী আছে, তার উপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে সংবিধানের প্রয়োগ কারা ঘটাচ্ছে, তাদের উপর। যে শক্তি রাষ্ট্র চালায়, যে শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতায়- তার রাজনৈতিক চরিত্রই রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারণ করে, সংবিধান নির্ধারণ করে না। আজকের দুনিয়ায় সকল পুঁজিবাদী রাষ্ট্রই কমবেশি ফ্যাসিবাদী। এই ফ্যাসিস্ট নিপীড়ন থেকে জনগণের অধিকারকে রক্ষা করতে পারে একমাত্র গণআন্দোলন ও জনগণের ঐক্য। তারপরও আমরা সংবিধানের সংস্কার চাই এ কারণে যে, এই ফ্যাসিবাদী জুলুমের বিরুদ্ধে জনগণের লড়াইকে যাতে খানিকটা সুরক্ষিত করা যায়, সংবিধান দিয়ে যাতে নিপীড়ক তার নিপীড়নকে জায়েজ করতে না পারে।
মূলনীতি পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আমাদের এ অবস্থান বাস্তবে ইতিহাস বিকৃতির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান। চার মূলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গটি আমরা কীভাবে দেখি সেটাও আমরা ঐকমত্য কমিশনের প্রথম সভায় ও পরবর্তীতে স্প্রেডশিটে দেয়া প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সাথে আলোচনায় তুলে ধরেছি। আমাদের মুখপত্র ‘সাম্যবাদ’-এর মার্চ ও মে, ২০২৫- দুইটি সংখ্যায় সেটা প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখায়ও তা আমরা তুলে ধরব।
ইতিহাসবিকৃতি প্রসঙ্গে
এদেশের ২৩ বছরের প্রায়উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জাতি গঠনের বিরাট সংগ্রাম একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরিণতি পায়। ইতিহাসের এই সমগ্র অধ্যায়টিকে পেছনে ঠেলে দেয়ার একটা চেষ্টা গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিজয় একাত্তরে নয়, বরং সূচিত হয়েছিল সাতচল্লিশে, একাত্তর এর চূড়ান্ত পর্যায়- এই ভাষ্যটা বিভিন্ন রূপে ও ভাষায় সামনে আসছে। এই ভাষ্য অনুসারে স্বাধীন জাতিগঠনের ঐতিহাসিক ভরকেন্দ্র করা হয়েছে সাতচল্লিশকে এবং সাথে সাথে পাকিস্তান আন্দোলনকে। ফলে এই ভাষ্যটা খুব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিপরীতে যে ধর্মনিরপেক্ষ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থান সেদিন ঘটেছিল- একে অস্বীকার করে।
এই চিন্তার প্রতিফলন অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় দলিলপত্রেও দেখতে পাওয়া যায়। এ বছরের ডিসেম্বর মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি প্রস্তাবিত এবং জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রস্তাবিত- এই দুইটি খসড়া জুলাই ঘোষণা খুঁটিয়ে দেখলে সেটা বোঝা যায়। এই ঘোষণাগুলো, বিশেষ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জানুয়ারিতে দেয়া খসড়া জুলাই ঘোষণায় স্বাধীন জাতি গঠনের ঐতিহাসিক ভরকেন্দ্র করা হয়েছে অবিভক্ত ভারতবর্ষের পাকিস্তান আন্দোলনকে। এই বিষয়টিকে আরও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, “…বৃটিশ আমলের …সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে লাহোর প্রস্তাব। …বাংলাদেশের জনগণের রাষ্ট্র গঠনের সুস্পষ্ট অভিপ্রায় লাহোর প্রস্তাবে প্রতিফলিত হয়।” (সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ১৪)
ইতিহাস বর্ণনার ক্ষেত্রেও এ তিনটি প্রতিবেদনের মধ্যে একটা অদ্ভূত সাদৃশ্য আছে। তিনটিতেই ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তি হয়েছে উল্লেখ করে তারা চলে গেছেন সরাসরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের পরই তাদের ইতিহাসটা চলে এসেছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে। একইভাবে তিনটি প্রতিবেদনেই ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য লড়াইগুলো এবং একাত্তরের পর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থান- এই পর্বটি সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসকে যথার্থভাবে উপস্থাপনের ব্যত্যয় ঘটেছে।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, সায়ত্ত্বশাসনের দাবির ভিত্তিতে ছেষট্টির ছয়দফা আন্দোলন, সায়ত্ত্বশাসন ও কৃষক-শ্রমিকদের মুক্তির ১১ দফা দাবিতে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের গণপরিষদ নির্বাচন- এগুলো ছিল পাকিস্তানের প্রায়উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ও নতুন জাতি হিসেবে নিজেদের আত্মপ্রকাশের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল এই গণআন্দোলনগুলোরই স্বাভাবিক পরিণতি। ইতিহাস থেকে এই অধ্যায়গুলো বাদ দেয়ার অর্থ হলো ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো এবং বাংলাদেশের জাতি গঠনের ইতিহাসকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা। আবার এই সংগ্রামের মধ্যেই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, শোষণমুক্তি, সমাজতন্ত্র- এই কথাগুলো মওলানা ভাসানীসহ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, লেখক, শিল্পী, নির্মাতা, বুদ্ধিজীবীরা জনগণের মধ্যে নিয়ে আসেন এবং এর পক্ষে একটি গণআকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়। এই দীর্ঘ আন্দোলনের সকল পর্যায়ে বামপন্থীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বিশেষত মওলানা ভাসানী এ সময়ের আপোষহীন, অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে ১৯৭০ সালের নভেম্বরে সর্বপ্রথম স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কথা উচ্চারণ করেছিলেন। এই ইতিহাস আওয়ামী লীগ সরিয়ে দিয়ে মুজিবকেন্দ্রিক ইতিহাস লিখতে চেয়েছে, এখন সাতচল্লিশকেন্দ্রিক ইতিহাস লেখার প্রচেষ্টা চলছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তৈরি সর্বশেষ একটি খসড়া জুলাই ঘোষণাপত্র বিভিন্ন মাধ্যমে আমাদের হাতে এসেছে। এটি খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, জনমতের চাপে পূর্বের দলিলগুলোতে উল্লেখিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে তারা খানিকটা মেরামত করতে চেয়েছেন। যদিও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস তথা জাতি গঠনের ইতিহাস এখানেও যথার্থভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এখানে আবার ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরকে সিপাহী-জনতার বিপ্লব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, বাস্তবে এটি ছিল একটি সামরিক ক্যু। এই ক্যু-এর পরই মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করা হয় ও পরবর্তীতে তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেয়া হয়।
মুজিববাদ বলে আসলেই কি কিছু আছে
পূর্ব পাকিস্তানের উঠতি ব্যবসায়ী-পুঁজিপতি গোষ্ঠী ও ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ সমর্থনে মুক্তিযুদ্ধের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত গণপরিষদের পরিবর্তে ১৯৭০ সালে নির্বাচিত গণপরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে সংবিধান রচনার উদ্যোগ নেয়, যা ছিল অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ। মওলানা ভাসানীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এর প্রতিবাদ করেন। গণআকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষিতে এই ধারণাগুলোকে তারা মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে রাখতে বাধ্য হয়। আমরা এই কথাটা বলছি এ কারণে যে, সংবিধান রচনার তিন বছরের মধ্যেই সকল গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করে, হাজার হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে খুন করে, সংবিধানের চারটি কলঙ্কজনক সংশোধনী এনে শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করেন ও একদলীয় শাসনের দিকে পা বাড়ান। এরপর থেকে যারাই ক্ষমতায় এসেছে, প্রতিটি সরকারই ক্রমাগত গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে, একের পর এক জনবিরোধী নীতি কার্যকর করেছে এবং গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ এই শোষণ-জুলুম-অত্যাচার-বাক স্বাধীনতা হরণকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে।
বাহাত্তরের সংবিধান প্রনয়নের আগে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে দলীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে সংবিধানে এটাকেই মূলনীতি করা হয়। এটাকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্ন এখন এসেছে যে, এই সংবিধানের ভাবাদর্শগত ভিত্তি হলো মুজিববাদ। এক্ষেত্রে জেনে রাখা উচিত যে, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা একটা আধুনিক, গণতান্ত্রিক সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ১৭৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়ারা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীস্বাধীনতা, এক মানুষ-এক ভোট এসকল প্রগতিশীল ধারণাগুলো নিয়ে এসেছিল। এরপর থেকে সকল বুর্জোয়া রাষ্ট্রই তাদের সংবিধানকে এই ধারণাগুলোর উপর দাঁড় করায়। যদিও আজকের এই সাম্রাজ্যবাদের যুগে আন্তর্জাতিকভাবে বুর্জোয়ারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাওয়ার কারণে সকল দেশেই এই ধারণাগুলো সংবিধানে লেখা আছে, বাস্তবে রাষ্ট্রের কোথাও এর কার্যকরিতা নেই।
১৯১৭ সালে রুশদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠিত হয়। আইনস্টাইন, রমারঁল্যা, বার্ট্রান্ড রাসেল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন মনীষীরা এই নতুন সভ্যতাকে দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন, সমর্থন করেছিলেন। এরপর থেকে স্বাভাবিকভাবেই উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা আন্দোলনে রুশ দেশের এই শোষণবিহীন সমাজব্যবস্থা ‘সমাজতন্ত্র’ জনগণের একটা গুরুত্বপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা হিসাবে বারবার ধ্বনিত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামেও বহু বুদ্ধিজীবীর মুখ থেকে সমাজতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে। সংবিধান প্রণয়নের সময়ও এই দাবি উঠেছে। ১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল পল্টনে ভাসানী বলেন, “একটি ন্যাশনাল কনভেনশন ডেকে সকলের মতামত নিয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা উচিত ছিল। কিন্তু সরকার তা করেনি।” …“পরিষদের যে একদলীয় শাসনতন্ত্র প্রণীত হচ্ছে তাতে কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারা মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং খাঁটি সমাজতন্ত্রের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।” ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল সন্তোষে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটি সভায় এক প্রস্তাব গৃহীত হয়- “সংবিধান হবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক। সকল ধর্মমতের অনুসারী বাঙালি অবাঙালি নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার পায়, সেজন্য শাসনতন্ত্রে নিশ্চয়তা থাকতে হবে।” ফলে মুজিববাদ বলে যা দাবি করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়।
চার মূলনীতি কি ফ্যাসিবাদের উৎস
আরেকটি যুক্তি এই সময়ে এসেছে যে, মুজিববাদ অর্থাৎ এই চার মূলনীতি হলো ফ্যাসিবাদের উৎস। আমরা ফ্যাসিবাদ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য পুস্তিকাকারে ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশ করেছি। সেখানে আমরা দেখিয়েছি যে, ফ্যাসিবাদ কোন দল কিংবা সংবিধানের মূলনীতি আনে না। দেশের অর্থনীতি গুটিকয়েক বৃহৎ ব্যবসায়ী শ্রেণির হাতে কেন্দ্রীভূত হলে, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সেটাই একটা কেন্দ্রীভূত শাসনকাঠামো সৃষ্টি করে। অর্থনৈতিক ভিত্তির সাথে রাজনৈতিক উপরিকাঠামোর সম্পর্ক না বুঝতে পারলে, কখনও মুজিববাদ, কখনও আওয়ামী লীগ, কখনও সংবিধান, কখনও আমলাতন্ত্রকে ফ্যাসিবাদের উৎস মনে হবে। এ দিয়ে ফ্যাসিবাদ মোকাবেলা করা যাবে না। এতে এই শাসকশ্রেণিরই সুবিধা হবে। একদিকে বৃহৎ ব্যবসায়ীরা গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রকে পুনরায় কুক্ষিগত করবে, অন্যদিকে মুজিববাদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক লড়াই চলবে। আমরা তা-ই এখন ঘটতে দেখছি।
ঐকমত্য কমিশন বরাবর লিখিত চিঠিতে আমরা এ প্রসঙ্গে বলেছিলাম যে, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তরপর্বে কী ছোট, কী বড়, কী উন্নত, কী অনুন্নত- সকল পুঁজিবাদী দেশেই ফ্যাসিবাদ শিকড় গেড়েছে। ফ্যাসিবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি অর্থাৎ পুঁজির ক্রমাগত কেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনে ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীকতা ও কঠোরতা এবং বিজ্ঞানের কারিগরি দিকের সাথে আধ্যাত্ম্যবাদের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সাংস্কৃতিক যন্ত্রীকরণের চেষ্টা- এগুলিকে হাতিয়ার করে সকল পুঁজিবাদী দেশের শাসকশ্রেণি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো, প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ ধ্বংস করতে চেয়েছে। ফ্যাসিবাদকে হাতিয়ার না করে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দ্বারা জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান করা তার পক্ষে অসম্ভব। ফলে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ ঐক্যবদ্ধ জনগণের সচেতন, সংগ্রামী, দীর্ঘস্থায়ী লড়াই ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গণআন্দোলনের যে হাতিয়ারগুলি তৈরি হয়েছিল, পুঁজিবাদী শাসন যদি সেইগুলোকে বিকল করে দেয় এবং জনগণের ঐক্য বিনষ্ট করতে সক্ষম হয়, তবে বাংলাদেশে অন্য কোন শক্তির মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ কায়েম হবে। ইতিহাস এর স্বাক্ষী।”
চার মূলনীতি নিয়ে আমাদের বক্তব্য
চার মূলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা সবচেয়ে বেশি। পাকিস্তানি প্রায়উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদ এদেশের সকল শোষিত জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। একটা ভৌগলিক ভূখণ্ডে বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব থাকতে পারে। একটা নতুন জাতি ও নতুন রাষ্ট্র গড়ে উঠার পথে যে স্বাধীনতা আন্দোলন, সেখানে একটি অখণ্ড জাতিসত্ত্বা তখনই তৈরি হবে, যখন ওই সময়ে বিদ্যমান সমস্ত জাতিসত্ত্বাগুলোর সমঅধিকার নিশ্চিত হবে এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষিত থাকবে। প্রথম যুগে বুর্জোয়ারা যখন সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে আপোষহীনভাবে লড়েছে, তখন তারা খানিকটা হলেও এ প্রচেষ্টা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিকভাবে পুঁজিবাদ চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদের স্তরে প্রবেশ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই এদেশে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগের মতো বুর্জোয়া শক্তি অখণ্ড জাতিসত্ত্বা নির্মাণের কোন উদ্যোগই নেয়নি।
ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের প্রগতিশীল চরিত্রকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে একেই অন্য জাতিগোষ্ঠীর উপর নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। যে জাতীয়তাবাদ মুক্তির লড়াই করলো, বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নিজেই আগ্রাসী হয়ে উঠলো। আজকের দিনে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয়তাবাদ একটা অখণ্ড জাতি তৈরি করতে পারে না। একমাত্র আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ রাষ্ট্রই সকল জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি, সমান অধিকার ও বিকশিত হওয়ার সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে।
আমরা ঐকমত্য কমিশনের কাছে এ ব্যাপারে বলেছিলাম, “বাহাত্তরের সংবিধানে যেভাবে জাতীয়তাবাদের ধারণা দেয়া হয়েছে, তা অবশ্যই প্রশ্নসাপেক্ষ ও আলোচনার দাবি রাখে। আবার এটাও ঠিক, পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে ধারাবাহিক লড়াই, আত্মনিয়ন্ত্রণের সশস্ত্র স্বাধীনতার লড়াই গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আবার আওয়ামী লীগ এই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে অন্য জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি দেয়নি। উল্লেখ্য যে, ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটির ধারণা ইউরোপীয় নবজাগরণ থেকে আসা। শব্দটি দেশপ্রেম, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। বাহাত্তরের সংবিধানে দেশের অন্যান্য জাতিসত্ত্বাকে স্বীকৃতি না দিয়ে জাতীয়তাবাদ বলতে শুধুমাত্র ‘বাঙালি জাতি’-এর স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল ভুল। আমরা মনে করি, সংবিধানে বাংলাদেশের সব জাতিসত্ত্বার স্বীকৃতি ও সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।” প্রতিক্রিয়াশীল পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার এই সময়ে, সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয়তাবাদ দিয়ে দেশপ্রেম, সার্বভৌমত্ব আসবে না- এটাই বাস্তব। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের সুনির্দিষ্ট ধারণা না অর্জন করলে আজকের দিনে জাতিসত্ত্বাগুলোর সমঅধিকার সুরক্ষিত করা অসম্ভব। এ সত্ত্বেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সুবিশাল সংগ্রামের ঐতিহাসিক উপাদান হিসেবে আমরা একে রাখতে চাইছি এবং এর উপর আবশ্যিক কিছু শর্ত যুক্ত করছি।
সমাজতন্ত্র বাদ দেয়ার যৌক্তিকতা দেখাতে গিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে, “সমাজতন্ত্র গণতান্ত্রিক শাসনবিরোধী।” (সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ৬৯) আমরা এই প্রসঙ্গে কমিশনকে বলেছিলাম, “…এই বক্তব্য ইতিহাসসম্মত নয়, বিজ্ঞানসম্মতও নয়। ১৯১৭ সালে রুশ দেশে মহান লেনিনের নেতৃত্বে মার্কসবাদের মূলনীতিগুলোকে কার্যকরী করে সর্বহারা শ্রেণি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই রাষ্ট্রের প্রতি সারা দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের প্রবল আকর্ষণ তৈরি হয়। এই রাষ্ট্রব্যবস্থা বেকারত্ব দূর করে, নারীকে ব্যাপক স্বাধীনতা দেয়, বিনামূল্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ সবগুলো মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। আইনস্টাইন, রমাঁ রল্যাঁ, বার্ট্রান্ড রাসেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মওলানা ভাসানীসহ বহু মনীষী এই সভ্যতাকে কুর্নিশ করেছিলেন। একটি বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত রাষ্ট্র একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যেই সম্ভব হতে পারে।”
সমাজতন্ত্রকে বাদ দেয়ার সুপারিশের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন আরও লিখেছেন, “সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা …মুক্তবাজার অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে।” (তৃতীয় অধ্যায়, সুপারিশের যৌক্তিকতা, সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ৬৯)
অর্থাৎ মুক্তবাজার অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াও সমাজতন্ত্রকে বাদ দেয়ার একটা কারণ। অথচ আমাদের দেশের পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গত ১৫ বছর ধরে দেশের বৃহৎ ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা করার জন্য এই মুক্তবাজার অর্থনীতিকেই কার্যকর করেছিলেন। এই ব্যবসায়ীরা দেশকে প্রায় লুট করে নিয়েছেন। মুক্তবাজার অর্থনীতির ঠিকাদারদের নিজেদের দেশেই মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু নেই। তারা নিজেদের বাজারে শুল্ক বসিয়ে অন্য দেশের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে প্রতিষ্ঠা করে, সেটা এই কয়দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট। কিন্তু সমাজতন্ত্র খারাপ, কারণ এই দেশ বিক্রি করে দেয়া মুক্তবাজার অর্থনীতির উপর সে সীমাবদ্ধতা আরোপ করবে!
ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে কমিশনের বক্তব্য আরও অদ্ভূত। বলা হয়েছে, “মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব রাজনৈতিক আলোচনায় ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল একপ্রকার অপরিচিত ধারণা। …ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজ ও রাষ্ট্রে বিভক্তি ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, এবং অতীতে ফ্যাসিবাদী শাসনের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। এটি বাংলাদেশের বিদ্যমান বহুত্ববাদী সমাজের ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এবং মূলত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিরোধী।” (সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন, পৃষ্ঠা ৬৯)
এ হেন আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা সেদিন লিখেছিলাম যে, “বলা হচ্ছে, ধর্মনিপেক্ষতা নাকি বিভক্তি সৃষ্টি করে। অথচ ধর্মীয় বিভক্তি ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছে একটা রক্ষাকবচ। ধর্মনিরপেক্ষতা সকল ধর্মবিশ্বাসীকে স্বাধীনভাবে নিজ নিজ বিশ্বাস বা ধর্ম পালনের নিশ্চয়তা প্রদান করে। ধর্মনিরপেক্ষতার আসল অর্থ হলো- ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং ধর্ম পালনের অধিকার একটি মৌলিক অধিকার; কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে ধর্ম সংযুক্ত থাকতে পারে না।” ধর্মনিরপেক্ষতা কীভাবে ফ্যাসিবাদের আদর্শিক ভিত্তি হয়, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিরোধী হয়, আবার ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া ছাড়া একটা রাষ্ট্র কীভাবেই বা গণতান্ত্রিক হয়- তা আমাদের জানা নেই।
বাস্তবে সরকার ও তার পিছনে যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো দাঁড়িয়ে আছে, তারা বিদ্যমান মূলনীতিগুলোকে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের একচেটিয়া সম্পত্তি বলে দেখাতে চাইছেন এবং এরই কারণে তাদের ইতিহাসকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যার পথ নিতে হচ্ছে। সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাসহ এ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের কিছু মৌল আকাঙ্ক্ষাকে বাদ দিতে চাওয়ার অর্থ হলো গোটা জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম ও প্রাণ দেয়া লাখো শহিদের আকাঙ্ক্ষাকে অমর্যাদা করা।
ঐকমত্য কমিশনে আমাদের সর্বশেষ প্রস্তাবনা
আমরা সর্বশেষ ঐকমত্য কমিশনকে বলেছিলাম, আপনাদের প্রস্তাবনাগুলোকে (সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি) বিদ্যমান মূলনীতিগুলোর সাথে যুক্ত করুন। কিন্তু সেটা তারা মানেননি। তারা বলেন যে, তাদের প্রস্তাবিত মূলনীতিগুলো পরবর্তীতে সংস্কার বা সংশোধন করা সংবিধানের মূলনীতি অংশে অবশ্যই উল্লেখ থাকবে- এই মর্মে একমত হওয়ার জন্য। বিদ্যমান সংবিধানের চার মূলনীতি রাখা কিংবা না রাখার ব্যাপারে কোন আলোচনা ঐকমত্য কমিশন করবে না, পরবর্তী নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসা জনপ্রতিনিধিরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা বলেছি যে, এই ধরনের বিষয় নিয়ে কোন মাঝামাঝি সমঝোতা হয় না। বিদ্যমান মূলনীতির ব্যাপারে কোন শব্দ খরচ না করে, কেবল নতুন নীতিগুলো রাখার ব্যাপারে সম্মতি দেয়া মানে এটা স্বীকার করা যে, বিদ্যমান মূলনীতিগুলো পরবর্তী সংস্কার বা সংশোধনীতে নাও থাকতে পারে। এই সম্মতি আমাদের পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। মূলনীতিগুলো যেহেতু জাতি গঠনের ইতিহাসের সাথে যুক্ত- ফলে জনগণই এই প্রশ্ন ফয়সালা করুক।
আমরা বলেছিলাম, আমরা কমিশনে আলোচনায় মিলিত হয়েছি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রকাঠামোর গণতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয়ে ঐক্যমত হওয়ার জন্য। মূলনীতি রাষ্ট্রের কাঠামোগত বিষয় নয়। বিভিন্ন আদর্শ ও মতের রাজনৈতিক দলের মধ্যে এ নিয়ে ঐক্যমতে আসা সম্ভবও নয়, আবার এসব ব্যাপারে মাঝামাঝি কোন সমঝোতাও হয় না। আপনারা এটা নিয়ে আলোচনা বাদ দিন। কিন্তু তারা শোনেননি।
পরিশেষে,
জুলাই অভ্যুত্থানে আমরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলাম। বিভিন্ন সময় সরকারের সাথে বিভিন্ন বৈঠকে প্রায়শই আমরা লিখিত মতামত দিয়েছি। সংস্কার কমিশনগুলোতে লিখিতভাবে আমাদের প্রস্তাবনা পাঠিয়েছি, ঐকমত্য কমিশনেও পাঠিয়েছি। ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় আমরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি, বিভিন্ন বিষয়ে আমাদের মতামত রেখেছি, তর্ক-বিতর্ক করেছি। অনেক ক্ষেত্রে আমরা সামগ্রিক স্বার্থে কমিশনের প্রস্তাব মেনে নিয়েছি। মূলনীতি প্রশ্নে আমাদের অবস্থানের যুক্তিসঙ্গত কিছু কারণ আছে। সে কারণে আমাদের এই অবস্থান নিতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ইতিহাসের কী ধরনের বিকৃতি ঘটিয়েছিল, তা আমরা ভুলে যাইনি। জাতি গঠনের ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার প্রচেষ্টা ও ইতিহাস বিকৃতির এই পরিপ্রেক্ষিতের উপর দাঁড়িয়ে যখন মূলনীতি পরিবর্তনের আলোচনা আসে, তখন এটাকে সাধারণভাবে সংবিধানের কয়েকটি শব্দ পরিবর্তন, কিংবা নতুন কথাগুলোর মধ্যে পুরনো মূলনীতির নির্যাসগুলোতো পাওয়া গেলে বদলাতে সমস্যা কী- এত সাধারণভাবে আমরা নিতে পারছি না। প্রতিটি পরিবর্তনকেই তার প্রেক্ষাপট থেকে বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে সরলীকৃত চিন্তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে ইতিহাসের এমন এক পরিবর্তনের অংশীদার আমরা হব, যার জন্য ভবিষ্যত আমাদের ক্ষমা করবে না।
লেখক: মাসুদ রানা, সমন্বয়ক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরাম, বাসদ (মার্কসবাদী)
